বিশ্বে হঠাৎ কোণঠাসা চীন

ছবি - সংগৃহীত

  • ইলিয়াস হোসেন
  • ২৬ এপ্রিল ২০২০, ১৩:৩৮

এটা এখন আর অস্বীকার করার উপায় নেই যে চীনের হটকারিতায় বিশ্বে করোনাভাইরাসের সংকট ভয়াল রূপ নিয়েছে। তারা শুরুতেই সংক্রমণের তথ্য লুকিয়েছে। মৃত্যু নিয়ে চীনের লুকোচুরিও ধরা পড়ে গেছে। মোট আক্রান্ত ও মৃত্যু নিয়ে চীনের তথ্যে এখন কেউই বিশ্বাস করছে না। এসব ব্যর্থতা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য চীনের কমিউনিস্ট সরকার আগ্রাসী কূটনীতিকে বেছে নিয়েছে। চীনকে তুলে ধরতে চাইছে করোনা মোকাবিলায় সফল দেশ হিসেবে। বিপরীতে পশ্চিমের গণতান্ত্রিক সরকারগুলোকে ব্যর্থ হিসেবে প্রতিষ্ঠায় প্রপাগান্ডা চালাচ্ছে বেইজিং। তাতে অবশ্য হিতে বিপরীত হচ্ছে। ইউরোপ থেকে আমেরিকা, এশিয়া থেকে আফ্রিকার দেশগুলোতে চীন ক্রমেই কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন।

চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং করোনাভাইরাস মহামারিকে পুঁজি করে দেশের ভেতরে রাজনৈতিক ক্ষমতা আরও পাকাপোক্ত করেছেন। তবে এটা করতে গিয়ে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি যে হাতিয়ার ব্যবহার করেছে তাতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশটির অবস্থান আরও হুমকিতে পড়েছে।
বিভিন্ন দেশে করোনার চিকিৎসা সামগ্রী ও বিশেষজ্ঞ পাঠিয়ে সহায়তা করেছে চীন। বিনিময়ে করোনা মোকাবিলায় জিনপিংয়ের নেতৃত্বের প্রশংসা দাবি করেছে বেইজিং। জনগণকে রক্ষায় পশ্চিমা সরকারগুলো ব্যর্থ, এমন একটি ধারণা প্রতিষ্ঠায় মরিয়া চীন। কমিউনিস্ট সরকার নিজ দেশে যেমনটা করে থাকে, বিশ্বমঞ্চেও ঠিক তাই করতে চেয়েছে। এতে চীনের ওপর ক্ষোভ বেড়েছে।

সম্প্রতি বিবৃতি দিয়ে ফ্রান্স, ব্রিটেন এবং আফ্রিকার দুই ডজন দেশ চীন সরকারের নিন্দা জানিয়েছে। করোনাভাইরাসের উৎপত্তি নিয়ে চীন সরকার ভ-ামি ও ঔদ্ধত্যের আশ্রয় নিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। করোনা মোকাবিলায় চীনের পদক্ষেপের বিপরীতে পশ্চিমা সরকারগুলোকে অকার্যকর হিসেবে চিত্রিত করছে বেইজিং। এসব করে চীন সরকার নিজ দেশে প্রশংসিত হচ্ছে। তবে করোনার হানায় বিধ্বস্ত দেশগুলোতে চিকিৎসা সামগ্রী ও বিশেষজ্ঞ পাঠিয়ে বেইজিং যে প্রশংসা কুড়িয়েছিল তা ভেস্তে যেতে বসেছে।
যেমন চীনের সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠেছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স। যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডমিনিক রাব বলেছেন, এই সংকটের পর চীনের সঙ্গে আর স্বাভাবিক সম্পর্ক রাখার সুযোগ নেই। করোনার উৎপত্তি কিভাবে হলো এবং কিভাবে এটাকে আগেই থামানো যেত তা নিয়ে চীনকে কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে।

শি জিনপিংয়ের বৈশ্বিক উচ্চাভিলাসের জন্য এসবের ফল হতে পারে সুদূরপ্রসারী। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের সম্পর্কের ইতোমধ্যেই অবনতি ঘটেছে। অন্য দেশগুলোও সম্পর্ক পুনর্বিবেচনা করতে যাচ্ছে বলে আভাষ পাওয়া যাচ্ছে। জাপানি কোম্পানিগুলোকে চীন থেকে সরিয়ে নেওয়ার জন্য টোকিও ২০০ কোটি ডলার সহায়তার দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। কারণ জাপান মনে করছে যে চীনের ওপর নির্ভর করা যায় না।

ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রো প্রশ্ন তুলেছেন যে চীন যেভাবে করোনা সংকট সামলেছে তা গণতান্ত্রিক দেশগুলোর জন আদৌ কোনো মডেল হতে পারে কিনা। চীন সরকার করোনা সংকট খুব ভালোভাবে সামলেছে বলে ভাবা ঠিক হবে না বলে মত দিয়েছেন ম্যাক্রো। ফ্রান্সে চীনা দূতাবাস এক বিবৃতি দিয়ে বলেছে, পশ্চিমা সরকারগুলো নিজ নিজ দেশের সবচেয়ে বিপন্ন জনগোষ্ঠীকে রক্ষায় ব্যর্থ হচ্ছে। সেখানে নার্সিং হোমে প্রবীণরা বিনা চিকিৎসায় নিসঙ্গ অবস্থায় মারা যাচ্ছে।
দৃশ্যত এর মাধ্যমে ফ্রান্সের সমালোচনা হয়েছে। করোনায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর অন্যতম ফ্রান্সে বহু প্রবীণ নাগরিক এভাবে মৃত্যু বরণ করেছেন। এই বিবৃতির পর প্যারিসে চীনা রাষ্ট্রদূতকে তলব করে ফ্রান্সের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং এর প্রতিবাদ জানায়।

ফিনানসিয়াল টাইমস পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে ম্যাক্রো বলেছেন চীন এই সঙ্কট অন্যদের থেকে ভালভাবে মোকাবেলা করেছে এটা বলা অজ্ঞতা । চীনে কী ঘটেছে আমরা আসলে তা জানি না। ম্যাক্রোঁ বলেছেন মহামারি ঠেকাতে গিয়ে মানুষের স্বাধীনতা কেড়ে নিলে পশ্চিমা গণতন্ত্র ঝুঁকিতে পড়বে।
অবশ্য চীনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে জিনপিংকে দৃঢ়, শক্তিধর, এবং কল্যাণকামী নেতা হিসেবে চিত্রিত করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে তিনি করোনা মহামারির বিরুদ্ধে জনযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন। চীনের কূটনীতিকরাও ক্রমেই যুদ্ধংদেহী ও জাতীয়তাবাদী মনোভাবের পরিচয় দিচ্ছেন। তাতে বৈরিতা বরং আরও জোরালো হয়েছে। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের চীনা গবেষক সুসান এল শার্ক বলেন, চীন সরকার যেভাবে নিজ দেশ চালায় সেই ধারা আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও বজায় রাখতে চায়।
চীন সরকারের নীতি কী? ভিন্নমত দমন, মুক্তমত বা তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ, কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বকে সবকিছুর নিয়ন্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বারোপ এবং ব্যতিক্রম ছাড়া কোনো ভুল স্বীকার না করা। বিশ্ব নেতাদের সঙ্গে আলাপকালে জিনপিংও এমন কথা বলছেন। তিনি বলছেন, করোনাভাইরাস কোনো সীমান্ত মানছে না। এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। চীন সরকার করোনা নিয়ন্ত্রণ করেছে। এ নিয়ে বিশেষজ্ঞ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করতে চায়। করোনা মোকাবিলায় চীনকে বিশ্বের জন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করছেন।

চীন সরকার দাবি করছে, কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ এই সংকট তারা সামাল দিতে পেরেছেন সাফল্যের সঙ্গে। বিশ্ব তাদের এই অর্জনের প্রশংসা করুক। অথচ চীনের নাগরিকরাই কমিউনিস্ট সরকারের ভূমিকায় তীব্র অসন্তোষ জনিয়েছেন। চীনে নজিরবিহীন সমালোচনা হয়েছে কমিউস্টি সরকারের। এমনকি শি জিনপিংয়েরও। চীনে সরকারের সমালোচনা করলে কঠিন বিপদ হতে পারে জেনেও নাগরিকরা নানা মাধ্যমে সরকারের সমালোচনা করেছেন।
অপরদিকে চীনের কূটনীতিকরা এই সময়ে লেনদেনের ওপর জোর দিয়েছেন। বেইজিংয়ের নিরপেক্ষ রাজনৈতিক বিশ্লেষক উ কিয়াং বলেন, চীন সরকার করোনা মোকাবিলায় শুধু সেইসব দেশকে সহায়তা দিচ্ছে যারা এ মহামারি রোধে চীনকে সাফল্যের মডেল হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। সাহায্য তারাই পাচ্ছে যারা করোনার জন্য চীনের নিন্দা করছে না বা চীনকে দায়ী করছে না।

চীন সরকার চাচ্ছে তারা বিভিন্ন দেশে যে চিকিৎসা সামগ্রী পাঠিয়েছে সেজন্য তাদের প্রশংসা করা হোক। যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোতে চীনের একজন কূটনীতিক উইসকনসিনের একজন আইন প্রনেতাকে করোনা মোকাবিলায় বেইজিংয়ের ভূমিকার প্রশংসা করে একটি প্রস্তাব উত্থাপনের জন্য চাপাচাপি করেছেন।
করোনাভাইরাস মোকাবিলায় চীন সফল হয়েছে বলে জার্মানির কাছ থেকেও স্বীকৃতি আদায়ের চেষ্টা করেছে বেইজিং। তবে চীনের এ আহ্বান জার্মান সরকার নাকচ করে দিয়েছে। চীন সরকার অবশ্য এ ধরনের তৎপরতার কথা অস্বীকার করেছ। এ ধরনের প্রশংসা যোগাড় করে চীনে প্রতিদিনই জিনপিংয়ের পক্ষে প্রপাগান্ডা চালানো হয়। তাকে তুলে ধরা হয় একজন দক্ষ কমান্ডার ইন চিফ হিসেবে। বিপরীতে করোনা মোকাবিলায যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশের ভূমিকাকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়।

চীনের এসব প্রচেষ্টার মধ্যে স্ববিরোধিতাও প্রকট। কারোনার জন্য বিশ্বে চীনবিরোধী মনোভাব চাঙ্গা হয়ে উঠলে বেইজিং তার কড়া সমালোচনা করেছে। চীন এটাকে বলেছে বর্ণবাদ। এখন চীন সরকার নিজেই এ ধরনের বর্ণবাদ উসকে দিচ্ছে। যেমন চীনের হোটেল ও জনসমাগমস্থলে বিদেশীদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। আফ্রিকানদের তাদের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। চীনের এই পদক্ষেপের সমালোচনা হয়েছে প্রকাশ্যেই। ঘানা, কেনিয়া ও নাইজেরিয়া সরকার চীনের সমালোচনা করেছে। চীনে আফ্রিকার রাষ্ট্রদূতরা চিঠি লিখে এর এসব পদক্ষেপের নিন্দা জানিয়েছে।

চীন সরকার বিদেশ থেকে ফেরার ওপর কড়াকড়ি আরোপ করেছে। অথচ যারা ফিরছেন তাদের বেশিরভাগই চীনা নাগরিক। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বলছে, তারা আফ্রিকানদের টার্গেট করেনি। সব বিদেশিদেও ওপরই কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে।
চীনা কূটনীতিকরা এখন চীনের ইমেজ বাড়াতে আগ্রাসী নীতি অনুসরণ করছেন। এ নীতির অন্যতম হচ্ছে অন্য দেশকে আক্রমণ।
ব্রাজিলের প্রেসিডেন্টের ছেলে এডুয়ার্ডো করোনাভাইরাসকে চীনের চেরনোবিল বলে মন্তব্য করেছিলেন। ১৯৮৬ সালে রাশিয়ার চেরনোবিলে পরমাণু দুর্ঘটনার সঙ্গে করোনাকে তুলনা করেছিলেন তিনি। চীনা দূতাবাস এ মন্তব্যে ক্ষোভে ফেটে পড়ে।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক প্রধান কর্মকর্তা জোসেফ বোরেল সম্প্রতি বলেছেন, চীন সরকার ইইউর সুনাম নষ্টের চেষ্টায় মরিয়া। চীন যেসব বক্তব্য দিচ্ছে তাতে এটা প্রমাণ করার চেষ্টা করা হচ্ছে যে ইউরোপের সবাই মনে হয় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত।
চীন থেকে নি¤œমানের চিকিৎসা সামগ্রী দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে নেদারল্যান্ডস, স্পেন ও চেক প্রজাতন্ত্র। এদিকে তাওইয়ান ইউরোপের অনেক দেশকে মাস্ক সরবরাহ করায় ইইউ তাদের ধন্যবাদ জানিয়েছে। অথচ আগে চীন ক্ষুদ্ধ হতে পারে এ কারনে তাইওয়ান নিয়ে খুবই সতর্ক থাকত ইইউ।
ডোনাল্ড ট্রাম্পও চীনের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। আমেরিকায় কেন এত মানুষ মারা যাচ্ছে জানতে চাইলে তিনি চীনের দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, "অন্য দেশের পরিসংখ্যান কি মানুষ আসলেই বিশ্বাস করে?"

যুক্তরাষ্ট্র চীনে মৃত্যু সংখ্যা নিয়ে তদন্ত করার ঘোষণা দেওয়ার পর সম্প্রতি চীন মোট মৃতের সংখ্যা সংশোধন করেছে। উহানে করোনাভাইরাসে মৃতের সংখ্যা আরও ১৩০০ জন বাড়িয়েছে। ওয়াশিংটন পোস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, উহানের হানকাউ ক্রিমেশন সেন্টারে প্রতিদিন ১৯ ঘণ্টা ধরে মৃতদেহ পোড়ানো হয়েছে। তাতে ৩ এপ্রিল পর্যন্ত ১২ দিনে কেবল উহানেই ৪০ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়ে থাকতে পারে ধারণা করা হচ্ছে।