করোনা পরিস্থিতি : ঘরে বাইরে লড়াই করছে তুরস্ক

তুরস্কের পতাকা- সংগৃহীত

  • সাইমা আকন্দ
  • ২১ এপ্রিল ২০২০, ১১:৫০

বেসামাল পরিস্থিতিতে বিশ্ব। গত দুই সপ্তাহে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে গত চার মাসের দ্বিগুণ। চীনের উহান থেকে শুরু করে চার মাসে ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হয়েছিলো ১০ লাখ মানুষ। অথচ পরের দুই সপ্তাহে সেই সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে ২০ লাখ। এই যখন অবস্থা, তখন কেমন আছে তুরস্ক? আক্রমণের শুরুর দিকে দেশটির প্রস্তুতি ছিলো ভালো। প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগান বড় গলায় আশ্বাসও দিয়েছিলেন- পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে মাত্র কয়েক সপ্তাহ সময় লাগবে! না। করোনার প্রলয় থামানো যাচ্ছে না। সামলে রাখতে পারছে না কোনো দেশ। এই প্রতিবেদনটি যখন তৈরি করা হয়, তখনকার হিসাবে তুরস্কে ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ৬৯ হাজার ৩৯২ জন। মৃত্যু হয়েছে এক হাজার ১৫১৮ জনের। আর সুস্থ্য হয়েছেন ৫ হাজার ৬৭৪ জন। আক্রান্ত এবং মৃত্যুর সংখ্যাটা আমেরিকা ও ইউরোপের উন্নত দেশগুলোর মতো এতোটা নাজুক না হলেও খুব একটা কমও নয়।
অথচ শুরুর দিক থেকেই তুরস্কের সতর্কতা প্রশংসিত হয়ে আসছিলো আন্তর্জাতিক মহলে। আক্রমণের প্রথম দিকেই দেশব্যাপী বিধিনিষেধ জারি করেছিলেন এরদোগান। খুব প্রয়োজন হলে মানুষকে ঘর ছেড়ে বাইরে যেতে নিষেধ করেছিলেন। বিশেষভাবে জোর দিয়েছিলেন ২০ এর নিচে এবং ৬৫ বছরের বেশি বয়সি লোকদের ওপর। অর্থাৎ শিশু, কিশোর এবং বৃদ্ধদের ব্যাপারে ঝুঁকি নিতে চাচ্ছিলেন না তিনি।
এরদোগানের ঘোষণার পরপরই সারা দেশে তা বাস্তবায়ন করতে নামে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। মানুষের সাড়াও পাওয়া যায়। এতে দেখা যায় করোনায় আক্রান্ত অন্যান্য দেশের তুলনায় তুরস্কে বিস্তারের হার অনেকটা কমে আসে। কিন্তু যতটা আশা করা হয়েছিলো, ততটা কমানো সম্ভব হয়নি।
পরিস্থিতি বিবেচনায় আরো কঠোর হন দেশটির প্রেসিডেন্ট। হঠাৎ করেই দুইদিনের কারফিউ জারি করেন তিনি। আচমকা এই কারফিউতে নেতিবাচক সমালোচকরা মুখর হয়ে উঠেন। কিন্তু সমালোচনায় কান দেননি এরদোগান। তিনি জানান, এই লড়াই কেবল তুরস্কের নয়, সারা বিশ্বের। করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বিশ্ব এখন এক পতাকার নিচে। চেষ্টা থাকলে সফল হওয়া যাবেই। তিনি বলেন, ‘আমি আমার জনগণকে বিশ্বাস করি। এটা কেবল ফাঁকা বুলি নয়। জনগণও সেই বিশ্বাস রাখে।’
করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সামনের সারিতে থাকা চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশংসা করেন এরদোগান। আর অন্যদেরকে আহ্বান করেন, যার যার অবস্থানে থেকে ত্যাগ স্বীকার করতে। আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম ত্যাগের ঘোষণাটি দেন তিনি নিজেই। নি¤œ আয়ের লোকদের জন্য নিজের সাত মাসের বেতন দান করে দেন এরদোগান। এছাড়া সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য ও আইনপ্রণেতারা ৫২ লাখ তুর্কি লিরা দান করেছেন বলেও জানান এই প্রেসিডেন্ট।
পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে কিছু বৈপ্লবিক ভ’মিকাও নেওয়া হয় দেশটিতে। কারাগার থেকে বিপুল সংখ্যক কয়েদিকে ছেড়ে দেওয়ার ঘোষণা আসে। আর যারা সাধারণ ক্ষমার আওতায় পড়ছেন না, কিন্তু সশ্রম দন্ডপ্রাপ্ত তাদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয় মাস্ক তৈরির কাজ। প্রধান ছয়টি কারাগারে এখন কয়েদিরা তৈরি করছে মাস্ক । আর সেগুলো পৌঁছে যাচ্ছে হাসপাতালে।
শুধু তুরস্কের হাসপাতাল নয়। মাস্ক, পিপিই, জীবাণুমুক্ত গ্লোভসের মতো সুরক্ষা সামগ্রী পাঠানো হচ্ছে অন্য দেশেও। বিশেষ করে গাজায় নির্যাতিত মুসলমানদেরকে স্বাস্থ্য সহায়তা দিয়ে আসছে তুরস্ক। তুরস্কের সহায়তা পৌঁছানো হচ্ছে ইসরাইল, আমেরিকার মতো উল্টোমতের দেশেও।
ইসরাইলের সঙ্গে মুসলিম বিশ্বের দেশ তুরস্কের ক’টনৈতিক সম্পর্ক থাকলেও এরদোগানের আমলে সে সর্ম্পক খারাপ পর্যায়ে যায় । কিন্তু সঙ্কটকালে তুরস্কের এই মানবিক সহায়তা গ্রহণে ইসরাইলের পক্ষ থেকে অনীহা দেখা যায়নি। তবে তুরস্কের শর্ত ছিলো ফিলিস্তিনিদের জন্য সহায়তায় কোনো বাধা দেবে না ইসরাইল।
এদিকে করোনা ভাইরাসের আক্রমণে দিশেহারা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। যাদের কাছ থেকে সাহায্য আসছে না, তাদেরকে হুমকি দিতেও দ্বীধা করছেন না তিনি। ট্রাম্পের হুমকি থেকে রেহাই পায়নি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও। করোনার প্রকোপ শুরু হওয়ার পর আমেরিকা প্রথম সাহায্য পায় তুরস্ক থেকে। ট্রাম্প প্রশাসনের অনুরোধের পর প্রায় পাঁচ লাখ টেস্ট কিট পাঠান এরদোগান। তুর্কি সামরিক বাহিনীর একটি বিমানে করে চিকিৎসাসামগ্রী পাঠানো হয়েছে যুক্তরাজ্যেও। সাহায্য পাঠানো হয়েছে লিবিয়ায়। পাকিস্তানে লকডাউনের সময় দেশটির পাশে ছিলো তুরস্ক। তুরস্কের টেস্ট কিট পৌঁছে গেছে রাশিয়া-ঘেঁষা দেশ সার্বিয়া, হার্জেগোভিনা, মন্টিনিগ্রো, উত্তর মেসিডোনিয়া ও কসভোতে।
করোনার আক্রমণে বিপর্যস্ত স্পেনে পৌঁছেছে ১৫০টি তুর্কী ভেন্টিলেটর। তুরস্ক থেকে ৩৩ লাখ ডলার মূল্যের মেডিক্যাল সামগ্রী কিনেছে স্প্যানিশ একটি প্রতিষ্ঠান। ইতালিতে পৌঁছেছে মাস্ক, নিরাপত্তা সরঞ্জামসহ বিপুল স্যানিটাইজার।

অন্যদিকে ইরানে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই দেশটিকে নানাভাবে সহযোগিতা করে আসছে তুরস্ক।
ঘরে ও বাইরে করোনার বিরুদ্ধে লড়াই করছেন প্রেসিডেন্ট এরদোগান। তবে পরিস্থিতি বলছে, এখন ঘরের লড়াইটাই প্রকট হয়ে উঠছে তার জন্য। জিততে হলে নিতে হবে ঘরের ভেতরে থাকার কৌশল। এই কৌশলে হঠাৎ করেই থেমে গেছে পৃথিবী। থেমে গেছে তুরুস্কও।

প্রাচীন আনাতোলিয়ার এখন ভ’তুড়ে চেহারা। পর্বতময় প্রাচীন এই সভ্যতাই তুরস্কের বড় অংশ। এই অংশটাতেই সংযোগ ঘটেছে এশিয়া ও ইউরোপের। তুরস্কের শহর ইস্তানবুলকে কেটে বয়ে গেছে বসফরাস প্রণালী। এর একদিকে এশিয়া। অন্যদিকে ইউরোপ। দুই মহাদেশের সংযোগের কারণেই বরাবর রাজনৈতিকভাবে সরগরম ছিলো আনাতোলিয়া। এই অঞ্চলের প্রকৃতিও পর্যটক আকর্ষণ করার মতো। ইস্তানবুলকে বলা হয় সংস্কৃতি, ইতিহাস ও অর্থনীতির হৃদয়। কিন্তু এই হৃদয় এখন মানুষশুন্য। ইস্তানবুলজুড়ে এখন খোলা প্রকৃতি। সড়কে গাড়ির জট নেই। মানুষের কোলাহল নেই। একদিকে কৃষ্ণ সাগর। অন্যদিকে মর্মর সাগর। মাঝে বসফরাসের প্রবাহ। এর তীরেই নিঃসঙ্গ দাঁড়িয়ে তোপকাপি প্রাসাদ, ওসমানীয় শাসক সুলতান সুলেমানের বাড়ি।
জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এখন কেউ তোপকাপি প্রাসাদ দেখতে আসে না। তাকসিম স্কোয়ার, গালতা টাওয়ারের আশপাশেও লোক দেখা যায় না। ভ’তুড়ে চেহারা নিয়েছে অলি-গলি।

কেবল ইস্তানবুল নয়, করোনার আতঙ্কে ফাঁকা হয়ে গেছে, দেশটির অন্য শহর, নগর, বন্দর এবং পর্যটন এলাকা।
ইস্তানবুলের ইউরোপিয় অংশ থেকে এজিয়ান সাগরের দিকে নাক বাড়িয়ে দিয়েছে চানাক্কালে। সরু এই উপকুলটি কিছুদিন আগেও গিজগিজ করতো পর্যটকে। ১৯১৫ সালে এই চানাক্কালেতেই পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে উসমানীয়রা। বহু ক্ষয়-ক্ষতির পর জয় হয় উসমানীয়দের। সেই যুদ্ধের পর থেকে চানাক্কালের চেহারা পাল্টে দিয়েছিলো পর্যটকরা। কিন্তু এখন? দেখে চেনা কঠিন।

সারা বিশ্বের মতো চেহারা পাল্টে ফেলেছে তুরস্কের ঘনবসতির শহরগুলোও। দেশটির রাজধানী আনকারার কথাই ধরা যাক। ওখানে কড়াকড়ি সবচেয়ে বেশি। বিনা কারণে কেউ ঘর ছাড়লেই মুখোমুখি হতে হচ্ছে জেরার। কারফিউ ঘোষণার পর গুনতে হয়েছে জরিমানাও। রাজধানীর সড়কগুলোতে সময়ে সময়ে ছিটানো হচ্ছে জীবাণুনাশক। আর মানুষদের উদ্বোধ্ব করা হচ্ছে জীবাণুমুক্ত থাকতে। তুরস্কের পঞ্চম ঘনবসতির শহর আনতালিয়া, দক্ষিণ উপক’লের শহর। পর্যটকদের কাছে স্বর্গের মতো। ভ’মধ্যসাগর আর তারুরস পর্বতমালার সুন্দর এক হয়েছে এই শহরে। এই সুন্দরকে ঘিরে ওখানে তৈরি হয়েছে বড় বড় হোটেল। কিন্তু করোনার আক্রমণে হোটেলগুলো ফাঁকা। সৈকত আর শহরের অলি-গলিতে টহল দিচ্ছে পুলিশ।

আরো একটি শহর বুরসা। ইস্তানবুলের উপক’ল ধরে এগিয়ে গেলেই শহরটি। তবে ঘুরপথে যেতে না চাইলে ইস্তানবুল থেকে মরমর সাগর পাড়ি দিলেই প্রাচীন পর্যটন এলাকা বুরসা। কেবল পর্যটন নয়, তুরস্কের ৪র্থ ঘনবসতির এই শহরটি ব্যাপক শিল্পোন্নত। ওসমানীয় শাসনামলেও এর কদর ছিলো। বিশ্ব অর্থনীতিতে বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে এসেছে। কিন্তু এখন বিশ্বের সঙ্গে তাল রেখে থেমে গেছে বুরসার চাকাও।

থেমে আছে আনাতোলিয়ার পশ্চিমের উপক’ল ইজমির। বুরসার পাশে অ্যাজিয়ান সাগরের উপকুলের শহর এটি। ইজমির থেকে এজিয়ান সাগর পাড়ি দিলে গ্রিসের অ্যাথেন্স। ইস্তানবুল আর আঙ্কারার পর ইজমির দেশটির তৃতীয় জনবহুল শহর। আর গ্রিসের অ্যাথেন্সের পর এজিয়ান সাগর এলাকার দ্বিতীয় বৃহত্তম মহানগর। কিন্তু এই নগরের সড়কেও নেই নাগরিকের শোরগোল।

সেই রোমান সা¤্রাজ্য থেকে আলাদা কদর নিয়ে আছে এডিরনি। এটি তুরস্কের সীমান্তের শহর। সীমানা পেরিয়ে একদিকে গ্রিস, অন্যদিকে বুলগেরিয়া। আন্তর্জাতিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে শহরটি বরাবরই জৌলুশে ভরা। কিন্তু এখন? এখন যেখানে মানুষের চাঞ্চল্য নেই, সেখানে জৌলুশও নেই।
আরেকটি শিল্পোন্নত শহর কায়সারি। আনাতোলিয়ার মধ্যাঞ্চলের এই প্রাচীন শহরটি প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। বাইরের শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিলো। এখন এই শহর মোকাবেলা করছে অদৃশ্য এক শত্রুকে।

আনাতোলিয়ার কেন্দ্রের শহর কোনিয়া। প্রথম দেখাতেই চোখ জুড়িয়ে যাওয়ার মতো। দরবেশ, সুফি, সাধকদের এই শহরকে ডাকা হয় শান্তির শহর। এখানে আছে নান্দনিক নির্মাণশৈলি। বেশ কিছু নিদর্শন। কোনিয়ায় জন্মেছিলেন আধ্যাত্মিক কবি জালাল উদ্দিন রুমি। কবির এই শহর ইতিহাসে যেমন সমৃদ্ধ। অর্থনীতি ও শিল্পেও তেমন সমৃদ্ধ। এই সমৃদ্ধি এখন হুমকিতে। থমকে যাওয়া পৃথিবীর অর্থনীতিই এখন ধ্বংসের মুখে।

চ্যালেঞ্জের মুখে মানুষ। তুরস্কের মালাতায়ার মতো বড় বড় শহর। হাজার বছরের বসতি। সভ্যতা। পেশা। ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি। সানলিউরফা নামের শহরে ২ মিলিয়ন লোকের বাস। অথচ এই বিরান ছবিটি দেখলে সেটা আন্দাজ করাও কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।

দেশটির চোখ জোড়ানো শহর মারদিন। উঁচু এই পাথুরে ভ’মিতে মানুষের বসতি পুরনো। পুরনো শহরের পাহাড়ের ঢালে যে বাড়িগুলো বানানো হয়েছে, সেগুলোর নির্মাণশৈলির খ্যাতি রয়েছে। শহরের চ’ড়ায় দাঁড়ালে চোখে পড়ে টাইগ্রিস নদী। নদীর ওপারে অন্য বসতি।

আবার পর্যটকে মুখরিত হয়ে উঠবে মুগলা? এজিয়ান সাগরের উপক’ল এই মুগলা। সরু হয়ে ঢুকে গেছে সাগরে। কোনোটা আবার বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। ওগুলো মানচিত্রে দেখা যায় ছড়ানো-ছিটানো। বাস্তবে দারুণ মনোরম। প্রকৃতির ভেতর সাজানো রিসোর্ট। ওগুলো তৈরি করা হয়েছে মানুষের অবকাশ যাপনের জন্য। কিন্তু এখন মানুষ আসছে না। অবকাশে আছে ওই রিসোর্টগুলোই। মানুষকে ঘরে বন্দি রেখে অবকাশ নিচ্ছে প্রকৃতিও।