চীনের নতুন চ্যালেঞ্জ

চীনের পতাকা- সংগৃহীত -

  •  হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী
  • ২২ মার্চ ২০২০, ২১:৩৭

মাসচারেক আগেও চীন ছিল বিশ্বের এক অর্থনৈতিক পরাশক্তি। কী তার রমরমা! এদেশ-ওদেশকে সহজে বিপুল অঙ্কের ঋণ দিয়ে বেড়াচ্ছে, নানা দেশে নিচ্ছে বিশাল-সব প্রকল্প। তার ওপর বিশ্বের এক বিশাল অংশকে একসূত্রে গাঁথার জন্য তারা নিল রোড অ্যান্ড বেল্ট নামের এক সুপার মেগা প্রকল্প, যা আগে কেউ কখনো দেখেনি, ভাবেওনি। চীনের এমনতর কাণ্ড দেখে বিশ্বমোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পর্যন্ত ভিরমি খাওয়ার যোগাড়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কী করবেন দিশা না-পেয়ে চীনা পণ্যের ওপর শুল্ক বাড়িয়ে দিলেন বেপরোয়া মাত্রায়। চীনও পাল্টা ব্যবস্থা নিল। শুরু হয়ে গেল চীন-মার্কিন বাণিজ্যযুদ্ধ। এ লড়াই হয়তো আরো কিছুদিন চলতো, কিন্তু তার মাঝেই নেমে এলো আরেক বিপর্যয় - করোনা ভাইরাস। চীনের হুপেই প্রদেশের উহান নগরীতে উৎপত্তি হওয়া এ ভাইরাস আমাদের চিরচেনা এ পৃথিবীটাকে ক্রমেই বদলে দিচ্ছে।

গত ২৩ জানুয়ারি বাইরের দুনিয়ার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে লকডাউন বা অচল হয়ে যায় চীন। তাকে অনুসরণ করে ৯ মার্চ থেকে ইতালিও। অচলবস্থার ফলে চীনের অর্থনীতি আরো বেশি করে ফাঁদে পড়েছে। কারণ, তাদের মুদ্রা সহজে বিনিময়যোগ্য নয়। বিপরীতে ইতালি হচ্ছে ইউরোজোনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ এবং বৈশ্বিক বাজারের সাথে পুরোপুরি সমন্বিত। যাহোক, এই অবরূদ্ধ অবস্থার বিরূপ প্রভাব তাদের ভেতরে-বাইরে বেশ বড় করেই পড়বে। সব মিলিয়ে ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি বেশ জটিল হয়ে উঠছে। কেউ বুঝতে পারছে না, কবে এ দুর্দিন কাটবে। তবে কমপক্ষে এক বছর তো লাগবেই। এ সময়ের মধ্যে এর টিকা উদ্ভাবিত হবে, তা বাজারে আসবে, তার পরই পৃথিবী ফিরে পাবে স্বাভাবিক অবস্থা। বিস্ময়কর হলো, এমন দুর্দিনেও থেমে নেই দেশগুলোর পারস্পরিক ধাক্কাধাক্কি। এর মধ্যেও চীন-ভারত বৈরিতা কিছুমাত্র কমেনি। এই গত ৫ ফেব্রূয়ারি চীনের কার্গো জাহাজ দাই চুই ইয়ুন পাকিস্তান যাওয়ার পথে সেটিকে আটক করে ভারত। তাদের দাবি, জাহাজটি বহন করছিল এমনসব সরঞ্জাম, যা পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র নির্মাণে ব্যবহৃত হতে পারে।

চীন-ভারত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে টানাপোড়েনের এটা হলো সর্বশেষ ঘটনা। চীনা পত্রপত্রিকা এ বিষয়ে লিখেছে, ''দক্ষিণ এশিয়া ও ভারত মহাসাগরের ওপর নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করতে ভারত শুধু পাকিস্তানকে হেয় করার, নিঃসঙ্গ করার এবং আক্রমণ করার সব রকম চেষ্টা চালিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, বরং দেশটি ভারত মহাসাগরের পুলিস অফিসার হওয়ারও চেষ্টা করে যাচ্ছে। গত বছর আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের কাছ থেকে চীনের একটি ছোট জাহাজকে অশোভনভাবে তাড়িয়ে দেয় ভারতের নৌবাহিনী। জাহাজটি বৈজ্ঞানিক গবেষণাকাজ করছিল। এ বছর আবার দা ছুই ইয়ুন জাহাজকে ঠুনকো অজুহাতে আটক করেছে। ভারতের এসব উস্কানিমূলক কাজের কঠিন জবাব চীনকে অবশ্যই দিতে হবে আর চীনা কম্পানিগুলোকে বৈধ পন্থায় এর ক্ষতিপূরণ আদায়ের পদক্ষেপ নিতে হবে।''
এরপর আছে তাইওয়ান। কুওমিনতাংরা একদা প্রায় ৩০ বছর চীন শাসন করেছিল আর গত প্রায় ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে তাইওয়ান শাসন করে চলেছে। চীন মনে করে, চীন-তাইওয়ান সুসম্পর্কের পথে এই কুওমিনতাংরাই প্রধান বাধা। সম্প্রতি তারা একজন নতুন চেয়ারম্যান নির্বাচন করেছে, যার লক্ষ্য হচ্ছে ১৯৯২ সালে সম্পাদিত চীন-তাইওয়ান পলিসি বাতিল করা। চীন এ পলিসিকে উভয় পক্ষের মধ্যে সংলাপের পূর্বশর্ত বলেই মনে করে থাকে।

ওদিকে করোনা মহামারী ঠেকাতে তাইওয়ান নিয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, নৈতিক বাধ্যবাধকতা ও স্বচ্ছতার এক ককটেইল বা মিলিত ব্যবস্থা। এর অংশ হিসেবে তাইওয়ানের এপিডেমিক কম্যান্ড সেন্টার দ্রূত বাস্তবায়ন করে চলেছে ১২৪টি ব্যবস্থা। এর মধ্যে আছে স্থল, নৌ ও আকাশ সীমান্ত সুরক্ষা, নতুন তথ্য ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে করোনা সংক্রমণ চিহ্নিতকরণ, সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের কোয়ারেন্টিনে নিয়ে যাওয়া, ভুল খবরের বিরুদ্ধে লড়াই করার পাশাপাশি জনগণকে সচেতন করা, এ বিষয়ে অন্যান্য দেশের সাথে আলোচনা করা এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে নীতি প্রণয়ন করা।। এভাবে, সমাজকে মুক্ত ও গণতান্ত্রিক রেখেও, করোনা মহামারী রোধে সফল হয়েছে তাইওয়ান। তারা চীন তথা গোটা বিশ্বের কাছে প্রমাণ করেছে, বিপুল সম্পদ ছাড়া, চরম কড়াকড়ি ছাড়া এবং গোটা দেশকে কোয়ারেন্টিনে নিয়ে যাওয়া ছাড়াই মহামারী প্রতিরোধ করা সম্ভব। এর পাশাপাশি আছে হংকংয়ের চলমান পরিস্থিতি, যা দেখে তাইওয়ানবাসী ভীত। তারা ভাবছে, চীন যদি দেখে যে, শান্তিপূর্ণ পুণরেকত্রীকরণের আশা আর নেই, সেক্ষেত্রে তারা শক্তি প্রয়োগের কথাই ভাববে এবং সেটাই বাস্তবতা।
এদিকে গত কয়েক দিনে বিশ্বের অনেক পুঁজিবাজারে ব্যাপক দরপতন ঘটেছে। এর মধ্য দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ্ব একটা বড় মন্দার দিকে যাচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে। এর ফলে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চলমান উৎপাদন কমানোর প্রবণতা আরো বেড়ে যাবে।

সব মিলিয়ে বলা যায়, চীনের এতদিনের চেনা পৃথিবীটা হারিয়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং বিশ্বের বাকি অংশ এতে হতভম্ব হলেও নতুন পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিতে তারা সাংস্কৃতিকভাবে প্রস্তুত। বাজারের পতন এর আগেও ঘটেছে। ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য অথবা মধ্য এশিয়ার আর্তনাদের বিষয়গুলোও ওয়াশিংটন বা ব্রাসেলসের মাথাতেই আছে। কিন্তু যে পৃথিবীকে চীন এতদিন চিনতো এবং যে পৃথিবীর ওপর ভর করে চীন গত ৪০ বছর ধরে শনৈঃ শনৈঃ উন্নতি লাভ করেছে, সেই পৃথিবীটা দৃশ্যপট থেকে দ্রূত হারিয়ে যাচ্ছে। চীনের কাছে এ বিষয়টা একেবারে নতুন। তারা এমন-কিছু চায়নি। এমন-কিছুর জন্য তারা প্রস্তুতও ছিল না। এমন অভিজ্ঞতাও তাদের ছিল না, যা থেকে তারা এর সমাধানে কিছু সহায়তা পেতে পারে। মাওবাদী চীন সবসময় বহির্বিশ্বের দরজা বন্ধই রেখেছে। বাইরের জগৎ থেকে তারা ছিল বিচ্ছিন্ন।

চীনের এখন যেটা সবচাইতে বড় প্রয়োজন তা হলো, নিজেকে নিয়ে এবং বিশ্বকে নিয়ে নতুন করে এবং নতুনভাবে ভাবা। কার্যকর সমাধান হলো, পাশ্চাত্য যেভাবে পৃথিবীকে নিয়ে ভাবে, সেটাকেই গ্রহণ করা।
প্রশ্ন হলো, চীন কি তা করবে? করলে কখন এবং কিভাবে?