ইউরোপের ছোট মুসলিম দেশ কসোভো কেমন?

পাখির চোখে কসোভো - সংগৃহীত

  • হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী
  • ২৭ অক্টোবর ২০১৯, ১০:৫৬


বিগত শতকের ৯০-এর দশকের একেবারে শেষ প্রান্তে সাবেক যুগোশ্লাভিয়ার বিভিন্ন অংশের মধ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। ভেঙে যাওয়া দেশটির কোনো অংশ স্বাধীন হতে চায়, অপর অংশ আবার তাদের পিছু টেনে ধরে এই ছিল অবস্থা। সেই সময়ে আমাদের দেশে বসনিয়া-হেরজেগোভিনা, সার্বিয়া, কসোভো এসব নামের সাথে পরিচিত হয় আমাদের দেশের সংবাদপত্র পাঠক এবং এবং রেডিও-টিভির শ্রোতারা।


সময়ের ব্যবধানে সেই স্মৃতিও মুছে গেছে মানুষের মন থেকে। এখন কসোভো নামটিই তাদের অচেনা। তাই কেউ কসোভো নিয়ে আলোচনায় অনেকে হয়তো বিস্ময়মাখা চোখ তুলে জানতে চাইবে , ‘কসোভো! সে আবার কোথায়?’  কসোভো কিন্তু ইউরোপের দেশ। গৃহযুদ্ধ পেরিয়ে স্বাধীনতা পাওয়া দেশটি এখন আর বিশ্বগণমাধ্যমের সংবাদ শিরোনাম হয় না। কিন্তু এটা ঠিক যে, কসোভোর শরীর থেকে গৃহযুদ্ধের আগুনে পোড়ার ছাইও মুছে গেছে। এখন কেউ দেশটি ভ্রমণে গেলে দেখতে পাবে মনকাড়া অনেক কিছু। যদিও সার্বিয়ার সাথে যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু সার্বিয়ার ফোঁসফোসানি কমেনি। তারা এখনও ভাবে ও বলে যে কসোভো কোনো দেশ নয়, এটি সার্বিয়ার অংশ। অন্যায়ভাবে একে সার্বিয়ার কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হয়েছে। সার্বিয়ার এ ভাবনার সমর্থক হলো রাশিয়া এবং বলকান অঞ্চলের আরো অনেক দেশ। যে দেশটিকে নিয়ে এরকম ভাবনা, সে দেশ ভ্রমণ করতে যাওয়া কতটা নিরাপদ? না, কসোভো কোনো বিপজ্জনক দেশ নয়, বরং সম্পূর্ণ নিরাপদ। চাইলে আপনি আজই দেশটিতে যেতে পারেন, কোনো সমস্যা নেই।


কসোভোর বেশিরভাগ মানুষ যেহেতু আলবেনিয়ান গোত্রের, তাই দেশটির প্রধান ভাষাও আলবেনিয়ান। এছাড়া সেদেশে আছে সংখ্যালঘু সার্ব জনগোষ্ঠী, তাদের ভাষা আবার সার্বিয়ান। মজার ব্যাপার হলো, সেদেশের তরুণরা আবার ইংরেজি বলতেই ভালোবাসে দেশটির জনসংখ্যার অর্ধেকই হলো ২৫ বছরের কম বয়সী।


যে অল্প কিছু পর্যটক কসোভো যান, তাদের বেশিরভাগেরই প্রবণতা হলো, কসোভোর রাজধানী প্রিসটিনা দেখে ফিরে যাওয়া। অথচ দেশটিতে দেখার মতো অনেক কিছু আছে। যেমন, প্রিজরেন-এ আছে ওসমানীয় স্থাপত্যকলার চমৎকার সব নিদর্শন, পেজায় আছে অনেক অপরূপ পাহাড়পর্বত। মোট কথা, কসোভোতে দেখার মতো অনেক জিনিস এবং করার মতো অনেক কাজ রয়ে গেছে।


কসোভো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ একটি দেশ, যদিও দেশটির সমাজ অনেকটাই ধর্মনিরপেক্ষ। তাই রাস্তায় বেরুলে আপনি হিজাব ও শালীন পোশাক পরিহিতা কিছু নারী যেমন দেখবেন, তেমনি দেখবেন অসংখ্য নারীকে, যাদের পরণে ইউরোপের পোশাক। যেহেতু মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, তাই কসোভোতে আছে অনেক চমৎকার মসজিদ, যা পর্যটকদের হাতছানি দিয়ে ডাকে।


কসোভো আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা পায় ২০০৮ সালে। এর মধ্য দিয়ে তারা হয় ‘ইউরোপের নবীনতম রাষ্ট্র’। স্বাধীনতার মুহূর্তকে স্মরণীয় করে রাখতে রাজধানী প্রিস্টিনার উপকণ্ঠে তারা নির্মাণ করেছে একটি স্মৃতিসৌভ। প্রতি বছর স্বাধীনতা দিবসে তারা স্মৃতিসৌধটিকে নতুন করে রঙ করে। রঙ নির্বাচন করা হয় ওই বছরের প্রতিপাদ্য বা থিমকে মাথায় রেখে। যেমন, ২০১৬ সালে স্মৃতিসৌধটিকে নীল রঙে রাঙানো হয়, সাথে ছিল মেঘমালা ও কাঁটাতার। এর মধ্য দিয়ে তারা ইউরোপের থেকেও তাদের নিঃসঙ্গতাকে চিত্রিত করেছিল।


স্বাধীনতা স্মৃতিসৌধের পরই যে জিনিসটি পর্যটকদের আকর্ষণ করে সেটি হলো ক্লিনটনের ভাস্কর্য। কোন ক্লিনটন চিনতে পারছেন তো? হ্যাঁ, আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন। গৃহযুদ্ধ চলাকালে তিনি কসোভোকে সাহায্য করেছিলেন এবং কসোভোকে রক্ষায় রাজি করিয়েছিলেন ন্যাটো জোটকে। কৃতজ্ঞ কসোভো সে কথা ভোলেনি। তারা ক্লিনটনকে তাদেরই একজন মনে করে। এর কাছেই আছে নারীদের পোশাক বিক্রয়কেন্দ্র। সেটির নাম কী, বলতে পারেন? পারছেন না? সেটির নাম হিলারী।
পুরো বলকান অঞ্চলেই কফি কালচার ব্যাপক। কসোভোতে আমি দেখেছি, একটি এক্সপ্রেসো বা কাপুচিনো কফি খেতে-খেতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বন্ধুদের সাথে গল্প করছে মানুষ। তবে সবচাইতে গুরুত্পূর্ন এটি দিক হলো ইউরোপের অন্য দেশের মতো কসোভোর প্রবীণরা নিঃসঙ্গ নন। পরস্পরের সাথে তাদের যোগাযোগ ও বন্ধুত্ব খুবই জোরদার। কসোভোর যেখানেই আপনি যান না কেন দেখবেন ৬০ থেকে ৭০ বছর বয়সী প্রবীণরা ৪-৫ জনের দলে ভাগ হয়ে কফি পান করতে করতে ধূমসে আড্ডা দিচ্ছে। প্রবীণদের এমনতর সখ্য দেখে উত্তর আমেরিকা ও পশ্চিম ইউরোপে নেই।


কসোভোর রাজধানী। শহরের পরিচ্ছন্ন রাস্তা ঘাটের আপনি খুঁজে পেতে পারেন অনেক ক্যাফে ও বার। এমনকি সরু রাস্তাতেও। যেগুলো মূল রাস্তার ক্যাফে ও বারের চাইতে ভালো। আপনার শরীর-মন ভালো নেই? একটু চাঙ্গা হতে চান? পান করুন প্রিন্স কফি। এটি হলো কসোভোর স্টারবাকস। কফি ও চায়ের নানা ভ্যারাইটিতে চুমুক দিতে চান? ছোট রাস্তার ক্যাফেগুলো সবই অফার করবে আপনাকে। আপনার সামনে হাজির করবে ডেজার্ট লিস্ট। দামের কথা ভাবছেন? এক পিস ম্যাকারন পাবেন মাত্র ৬০ সেন্টে। তাদের স্নিকারস কেক, চিজ কেক, ট্রেস লেসেস কেক। অসাধারণ স্বাদ সে সবের । দাম? দুই ইউরো (এক ইউরোর প্রায় কাছাকাছি)। কসোভোতে আরো নানা রকম খানাখাদ্য আছে, তবে এগুলোই সবচাইতে মজাদার।


এতো কিছু সত্ত্বেও কসোভো দেখতে যায় না অনেক অনেক পর্যটক। এর কারণ, একজন পর্যটক কোনো দেশে যাওয়ার আগে দেশটি সম্বন্ধে কিছু তথ্য জানতে চায়। কিন্তু তারা কসোভো সম্বন্ধে সে রকম কিছু পায় না। ওদেশে হোটেলের ভাড়াও সস্তা। আছে পর্যটকদের সস্তায় থাকার মতো হোস্টেল। ওখানকার লোকজন অত্যন্ত সদয়! কসোভোর কোথায় কী পাওয়া যায়, কী দেখলে ভালো হয় জানতে চাইলে তারা এতো সুন্দর করে বুঝিয়ে দেয়! এসব হোস্টেলে আপনি চাইলে রাতে আরামসে ঘুমাতে পারেন, নতুবা অন্য পর্যটকদের সাথে ক্যঅম্পফায়ারে যোগ দিতে পারেন। এছাড়া হোস্টেলের লোকজন আপনাকে এমন কিছু জায়গা দেখিয়ে আনবে, যেখানে একা একা আপনি যেতেই পারতেন না।


কসোভোর মানুষ আর বেড়ানোর কথা তো অনেক হলো। অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন ইউরোপের এই ছোট এই দেশটি কিভাবে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট দেশে পরিনত হলো। আর এ দেশের সংস্কৃতিতে ইসলামের প্রভাব এতটা থাকছে কিভাবে? কসোভোর ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে আছে এই সর্ম্পকের ইতিহাস।

আসুন এবার কসোভো নামের দেশটির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস আমরা জেনে নেই। এর মাধ্যমেই আমরা জানতে পারবো কিভাবে এটি ইউরোপের মুসলিম দেশ পরিনত হলো।
কসোভোর আয়তন ১০ হাজার ৯০৮ বর্গকিলোমিটার। জনসংখ্যা প্রায় ১১ লাখ। জনসংখ্যার ৯৬ শতাংশ মুসলিম। কসোভোর দক্ষিণ-পশ্চিমে আলবেনিয়া, দক্ষিণ-পূর্বে মেসিডোনিয়া, পশ্চিমে ক্রোয়েশিয়া ও উত্তরে সার্বিয়া অবস্থিত। কসোভোর সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও শিক্ষাগত অবস্থা চমকপ্রদ। প্রিস্টিনা বিশ্ববিদ্যালয় কসোভোর সংস্কৃতি ও শিক্ষাবিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। দেশটির ইসলামী ঐতিহ্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তুরস্ক প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করছে। তুরস্কের সাথে দেশটির রয়েছে ঐতিহাসিক সর্ম্পক।


কসোভোর ইতিহাস পাশের পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর মতো। বাইজান্টাইন ও সার্বিয়নরা দীর্ঘদিন দেশটি শাসন করেছে। উসমানীয় সুলতান দ্বিতীয় মুরাদের সময় সার্বিয়নাদের বিরুদ্ধে বিখ্যাত কসোভো যুদ্ধ হয়। কসোভো সমভুমির এই যুদ্ধ ইতিহাসে ঐতিহাসিক যুদ্ধ হিসাবে পরিচিত। ১৪৫৫ সালে এই অঞ্চলটি উসমানীয় সা¤্রাজ্যর অংশে পরিনত হয়। এখানকার আলবেনীয় জনগোষ্টীর ওপর ক্যাথলিক খ্রিস্টানরা এতটাই করারোপ করেছিলো যে মানুষের জীবন যাপন দুর্বিষহ হয়ে পড়েছিলো। উসমানীয়দের বিজয়ের পর আলবেনীয় জনগোষ্টী এক সাথে ইসলাম গ্রহন করে। পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো ৫০০ বছর উসমানীয় শাসনের অধীনে ছিলো। এ সময় এ অঞ্চলে ইসলামের বিস্তার ঘটে। ফলে উসমানীয় ঐতিহ্যর প্রতিফলন পাওয়া যায় কসোভোতে।


কসোভোর দুই জনগোষ্ঠী আলবেনিয়ান ও সার্ব এদের মধ্যে কখনোই বনিবনা ছিল না। এদের দীর্ঘ দিনের রেষারেষির এক পর্যায়ে ২০০৮ সালে একতরফাভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করে কসোভো। স্বাধীন কসোভোকে স্বীকৃতি দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের বড় বড় দেশগুলো। এ সময় সার্বিয়ার পেছনে এসে দাঁড়ায় রাশিয়া। রাশিয়ার মদদ পেয়ে সার্বিয়া রাজি হয় না কােসভোর স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দিতে। কসোভোয় বসবাসকারী সার্বরাও কসোভোর স্বাধীনতা চায় না।
১৯৯০-এর দশকে যুগোশ্লাভিয়া ভেঙ্গে যাবার পরপরই স্বাধীনতার ইচ্ছে প্রকাশ করে কসোভো। সার্বিয়া এর ‘জবাব’ দেয় কসোভোর আলবেনিয়ান জনগোষ্ঠীর ওপর নিষ্ঠুর হত্যা-দমন-পীড়ন চালিয়ে। ১৯৯৯ সালে ন্যাটোর সামরিক হস্তক্ষেপে এই হত্যাযজ্ঞের অবসান ঘটে।

এই লেখার ভিডিও রুপ দেখুন ইউটিউবে