অভাবনীয় গতিতে এগোচ্ছে তালেবান

- সংগৃহীত

  • ফারজানা তানিয়া
  • ০৩ অক্টোবর ২০২৩, ১২:৩৭

বর্তমান শাসকরা ক্ষমতায় আসার আগে আফগানিস্তান একটি দুর্নীতির খনিতে পরিণত হয়েছিল। ক্ষমতায় থাকাকালীন তো মহাসমারোহে লুটপাট হয়েছে, পালানোর সময়ও বিপুল সম্পদ নিয়ে গেছেন সাবেক শাসকরা। প্রতিবেশী দেশগুলো মাটির নিচের সম্পদ তুলে বিশে^র মোড়লে পরিণত হয়েছে, আর তা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেছেন আফগানরা। এখন সময় বদলেছে। নতুন শাসকদের সুশাসনের ফল পাচ্ছেন তারা। একসময়ের ভঙ্গুর অর্থনীতি এখন সচল। খনিজ সম্পদের সদ্ব্যবহার করে দ্রুত এগোচ্ছে আফগান অর্থনীতি।

খনিজ সম্পদ লুটের অভিপ্রায়ে নিজেদের মাটিতে গেঁড়ে বসা বিদেশিদের ২০২১ সালে ঝেটিয়ে বিদায় করেছিলেন আফগানিস্তানের বর্তমান শাসকরা। চারদিক থেকে সহযোগিতার হাত সংকুচিত হলেও, মোড়লদের চোখরাঙানিতে উদারহস্তে কেউ সহযোগিতা না করলেও নিজেদের সুশাসনের বদৌলতে আফগানিস্তান এখন পাশের দেশগুলোর অর্থনীতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বড় হচ্ছে।

এক হাজার ২০০-রও বেশি খনিজ ক্ষেত্র নিয়ে আফগানিস্তান এখন বিশে^র অন্যতম প্রধান খনিজ-সমৃদ্ধ দেশ। অনুমান করা হয়, দেশটির খনিজ সম্পদের মূল্য প্রায় তিন ট্রিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে রয়েছে- স্বর্ণ, ক্রোমাইট, তামা, লোহা, সীসা, দস্তা, কয়লা, প্রাকৃতিক গ্যাস, পেট্রোলিয়াম, মূল্যবান পাথর, লিথিয়াম, ট্যাল্ক্ এবং আরও বিরল কিছু পদার্থ।

খনিজ সম্পদ অর্থনীতিকে নিশ্চিতভাবে সমৃদ্ধ করবে, এই সম্ভাবনাকে সামনে রেখে দেশটির সরকার খনিজ উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন উপায় অনুসন্ধান করে যাচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে গত ৩১ আগস্ট স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক করপোরেশনের সঙ্গে সাতটি খনিচুক্তি স্বাক্ষর করেছেন তারা।

‘ঐতিহাসিক’ হিসেবে আখ্যায়িত চুক্তিগুলো পাঁচ থেকে ত্রিশ বছর মেয়াদি। এর মধ্যে রয়েছে- হেরাতে চারটি লোহার ব্লক, ঘোরে একটি সীসা এবং জিঙ্ক ব্লক, তাখারে সোনার মজুদ এবং আয়নাক টু-এর তামা-সম্পদ। চুক্তিতে অংশ নেওয়া কোম্পানিগুলো আগামী তিন দশকে ছয় বিলিয়ন ডলারেরও বেশি বিনিয়োগ করতে প্রস্তুত।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এই প্রকল্পগুলো থেকে আসা রাজস্ব এবং এর সঙ্গে সম্পর্কিত উন্নয়ন এবং কাজের সুযোগ অর্থনীতিতে বিশাল রসদ জোগাবে। আফগান জনগণের জীবনমান উন্নয়নের জন্য এখন এই রাজস্ব, উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানের বিকল্প নেই।

প্রকল্পগুলো থেকে সরকার ঠিক কতটা মুনাফা পাবে, তা আপাতত অঙ্কের হিসেবে অনুমান করা সম্ভব নয়। কারণ, খনির স্থানগুলোতে অনুসন্ধানকাজ চলছে। তবে চুক্তি অনুযায়ী, স্বর্ণের খনিতে ৫৬ শতাংশ, একটি তামার খনিতে ১২ শতাংশ, একটি সীসার খনিতে ২০ শতাংশ এবং প্রতিটি লোহার খনিতে ১৩ শতাংশ শেয়ার থাকবে রাষ্ট্রের। তাছাড়া, অর্থ মন্ত্রণালয় এই প্রকল্পগুলোর ওপর প্রাসঙ্গিক বিভিন্ন কর আরোপ করবে, যা দেশটির জন্য আয়ের অনেক পথ খুলে দেবে।

এসব চুক্তি থেকে আসা অর্থনৈতিক সুবিধাগুলো রাজস্ব খাতে অবদান রাখার পাশাপাশি এই খাত থেকে আসা অর্থ সারাদেশের শিল্প-কারখানার উন্নয়নে অনুঘটক হিসেবে কাজ করবে বলে আশা করা হচ্ছে।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সীসা এবং দস্তা প্রকল্প দেওয়া হয়েছে কাবুল-ভিত্তিক আফগান ইনভেস্ট কোম্পানিকে। তারা একটি ৫০০ কিলোভোল্ট বিদ্যুৎ আন্তঃসংযোগ প্রকল্পের অবশিষ্ট ১৩ শতাংশ সম্পন্ন করার অতিরিক্ত দায়িত্ব নিয়েছে। এর মাধ্যমে প্রতিবেশী তুর্কমেনিস্তান থেকে বিদ্যুৎ আমদানি নিশ্চিত হবে। এটি দেশের ক্রমবর্ধমান বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাতে এবং দেশের প্রায় সব শিল্প পার্কগুলোতে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে সাহায্য করবে। এতে কারখানাগুলোর কর্মসময় ১২ ঘণ্টা থেকে বাড়িয়ে ২৪ ঘণ্টা করা সম্ভব হবে।

বিদ্যুৎ সরবরাহ বৃদ্ধি আফগান কৃষির উন্নয়নেও সহায়তা করবে। বর্তমানে, দেশের অধিকাংশ কৃষিকাজ কায়িক শ্রমের ওপর নির্ভরশীল। বিদ্যুৎ সরবরাহ বাড়লে তা এই খাতের যান্ত্রিকীকরণে সহায়ক হবে। আফগানিস্তান চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রি অ্যান্ড মাইনস বা এসিআইএম-এর প্রধান শিরবাজ কামিনজাদার মতে, তুর্কমেনিস্তান থেকে অতিরিক্ত বিদ্যুতের সরবরাহের ফলে কৃষি ও শিল্প উৎপাদন দুই বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত বাড়তে পারে।

তাছাড়া, তুর্কমেনিস্তানের বিদ্যুতের দাম কম হওয়ায় বিদ্যুতের এই আন্তঃসংযোগ প্রকল্প দেশের বিদ্যুৎ বিলও কমিয়ে দেবে। এতে অন্য দুই বিদ্যুৎ সরবরাহকারী দেশ উজবেকিস্তান এবং তাজিকিস্তানের সঙ্গে আরও ভালো দাম পাওয়া নিয়ে আফগান সরকারকে দরকষাকষির সুযোগ এনে দেবে।

লোহার খনির উন্নয়ন আফগানিস্তানের শিল্প উন্নয়নে নিঃসন্দেহে বিশাল অবদান রাখবে। এতে দেশের অসংখ্য ইস্পাত কারখানায় আকরিক সরবরাহ করা যাবে। একইসঙ্গে সীসা খনি দেশের আটটি ব্যাটারি উৎপাদনকারী কোম্পানির জন্য কাঁচামাল সরবরাহের ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করবে। এতে আফগানিস্তান ব্যাটারি রফতানিকারক দেশে পরিণত হয়ে উঠতে পারে।

২০২১ সালে বিদেশি সেনা প্রত্যাহারের পর বিদেশি ঠিকাদার এবং সাব-কন্ট্রাক্টররা কর্মরত আফগানদের চাকরি থেকে বাদ দিয়েছিল। এরপর বেকারত্বের হার ভয়াবহ উচ্চতায় পৌঁছেছে। এই খনি প্রকল্পগুলো সেই বেকারত্ব মোকাবিলায় দেশটিকে উল্লেখযোগ্যভাবে সহায়তা করবে।

প্রকল্পগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত কর্মকাণ্ড বিভিন্ন ক্ষেত্রে ৫০ হাজারেরও বেশি লোকের কর্মসংস্থান তৈরি করবে বলে আশা করা হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে- ভূতত্ত্ববিদ, প্রকৌশলী, খনি শ্রমিক, মেশিন অপারেটর, পরিবহন কর্মী, সরঞ্জাম প্রস্তুতকারক, লজিস্টিক বিশেষজ্ঞ ও নিরাপত্তাকর্মী।

এছাড়াও, কোম্পানিগুলো তাদের চুক্তির অংশ হিসেবে কম্যুনিটি ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভে বিনিয়োগ করতে বাধ্য। এটি স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা এবং অন্যান্য খাতে অতিরিক্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করবে, যার লক্ষ্য হবে স্থানীয় কম্যুনিটিগুলোর জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন। এই উদ্যোগ দারিদ্র্য দূরিকরণে বিশাল ভূমিকা রাখবে। বিশেষ করে, ঘোরের মতো অনুন্নত প্রদেশগুলোতে এই উদ্যোগ প্রভাব হবে আকাশচুম্বী।

প্রকল্পগুলো আফগান সরকারকে আরেকটি বড় সমস্যা নিরসনে সহায়কের ভূমিকা পালন করবে। সেটা হলো- আফগান মুদ্রার স্থিতিশীলতা। বিদেশি সেনা প্রত্যাহার এবং অনেক ঠিকাদার আফগানিস্তান ছাড়ার পর আফগান ব্যাঙ্কগুলোর আমানতকারীরা দ্রুত শত শত মিলিয়ন ডলার বিদেশি অ্যাকাউন্টগুলোতে স্থানান্তর করেন। ফলে দেশটিতে বৈদেশিক মুদ্রার তীব্র ঘাটতি দেখা দেয়।

এর ফলে আফগানিস্তানের মুদ্রা আফগানির মানের ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ে এবং ব্যাঙ্কগুলো দেওলিয়া হওয়ার হুমকির মুখোমুখি হয়। দা আফগানিস্তান ব্যাঙ্ককে আফগান মুদ্রা বাঁচাতে জরুরি আর্থিক স্থিতিশীলতার নীতি অবলম্বন করতে হয়েছিল। সৌভাগ্যবশত, এই নীতি সফল হয়েছিল। পট পরিবর্তনের দুই বছর পেরোলেও দেশটিতে এখনও বৈদেশিক মুদ্রার ব্যাপক প্রয়োজন রয়েছে।

এই খনি প্রকল্পগুলো দেশে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহকে শক্তিশালী করতে বড় ভূমিকা রাখবে। এই সাতটি খনির প্রত্যেকটির সঙ্গে ইউরোপীয় এবং এশীয় অংশীদারদের সম্পৃক্ততা থাকবে, যারা আন্তর্জাতিক বাজারে প্রক্রিয়াজাত সামগ্রী রফতানি করার ক্ষেত্রে সাফল্য দেখিয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার এই প্রবাহ আফগানিস্তানের স্থিতিশীলতায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে।

মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটের সেনারা চলে যাওয়ার পর ক্ষমতায় আসা তালেবান সরকারকে কোনো রাষ্ট্র স্বীকৃতি দেয়নি। কিন্তু তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে চীন, রাশিয়া, তুরস্ক, আরব আমিরাত, সৌদি আরব, কাতার ও পাকিস্তান। এসব দেশের সঙ্গে সরকার সমঝোতার ভিত্তিতে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এখন আর সেখানে প্রতিদিন বোমা কিংবা গোলার আঘাত মানুষ মারা যায় না। অনেকটাই শান্ত আফগানিস্তান। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার সুযোগে অর্থনেতিকভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতে পারছে দেশটি।

এরই অংশ হিসেবে সম্প্রতি দেশটির উত্তরাঞ্চলের সার-ই-পুলের কাশকারি বেসিনের ১০টি কূপের নয়টি থেকে চীনের সহযোগিতায় জ্বালানি তেল উত্তোলন শুরু হয়েছে। ৯টি কূপ থেকে প্রতিদিন ২০০ টন তেল উত্তোলন করা হচ্ছে। আফগান কর্মকর্তারা আশা করছেন, উত্তোলনের ক্ষমতা বাড়িয়ে এক হাজার টনেরও বেশি করা হবে।

দেশটির খনিজ সম্পদ ও পেট্রোলিয়াম বিষয়ক ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী শেখ শাহাবুদ্দিন দেলাওয়ার বলেছেন, এই খাতে কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন দেশীয় কর্মীদের নিয়োগ দেওয়া হবে। এছাড়া সাধারণ অনেক কর্মীও নিয়োগ পাবেন। সরকার জানিয়েছে, এই খনি থেকে পাওয়া রাজস্ব ব্যবহার করে খনিজ সম্পদের অন্য খাতগুলোকে পুনর্গঠন করা হবে।

এর ধারাবাহিকতায় গত মাসে স্বাক্ষরিত খনি চুক্তিগুলো আফগানিস্তানে অর্থনৈতিক রূপান্তর ঘটাবে বলে মনে করা হচ্ছে। চুক্তিগুলো শুধু সরকারকে অতিপ্রয়োজনীয় রাজস্ব প্রদান করবে তা নয়, সাধারণ আফগানদের জীবনযাত্রাও এর মাধ্যমে উন্নত হবে। নতুন নতুন চাকরি হবে, ঘরে ঘরে সচ্ছলতা আসবে। পৃথিবীর কাছে আবির্ভূত হবে অন্য চেহারার এক আফগানিস্তান।