যেভাবে শুরু হতে পারে পাক-ভারত পারমাণবিক যুদ্ধ

- সংগৃহীত

  • হায়দার সাইফ
  • ০৯ জুন ২০২৩, ১৭:৪৪

পাকিস্তান ও ভারত প্রথম পারমাণবিক পরীক্ষা করেছিল ১৯৯৮ সালে। এরপর দুই দেশই সিদ্ধান্ত নেয়, আর পরীক্ষা তারা করবে না। তখন থেকেই পারমাণবিক শক্তি কার্যত দুই দেশের জন্য প্রতিরোধ সক্ষমতা হিসেবে কাজ করেছে। কিন্তু সাম্প্রতিককালে বৈশ্বিক ঘটনাপ্রবাহ নানা চড়াই-উৎরাইয়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। বহু বিশ্লেষক বলেছেন, বিশ্ব তৃতীয় পারমাণবিক যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। এতদিন পারমাণবিক অস্ত্র যেভাবে প্রতিরোধের সক্ষমতা হিসেবে ভূমিকা রেখেছে, তা হয়তো আগামীতে আর সম্ভব হবে না। ভারত ও পাকিস্তানের ক্ষেত্রেও এটা সত্য। শুধু তাই নয়, নানা কারণে এই দুই দেশের মধ্যে পারমাণবিক সঙ্ঘাতের আশঙ্কা বরং আরও বাড়ছে।

২০২১ সালে ইউরোপিয়ান জার্নাল অব ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটিতে তৃতীয় পারমাণবিক যুগ নিয়ে একটি নিবন্ধ ছাপা হয়। সেখানে বলা হয় তৃতীয় পারমাণবিক যুগ হলো দ্বিতীয় ও প্রথম পারমাণবিক যুগের সমন্বয়। দ্বিতীয় যুগের কৌশল হলো কৌশলগত স্ট্র্যাটেজিক নন-নিউক্লিয়ার উইপন্স বা এসএনএনডাবিলউ মোতায়েন রাখা। তৃতীয় পারমাণবিক যুগেও সেটা বহাল আছে। তবে, সমস্যা হলো, প্রথম যুগে বড় শক্তিগুলোর মধ্যে যে প্রতিযোগিতা ছিল, সেটাও এখানে যুক্ত হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই দুইটা মিলে যাওয়ার কারণেই বিপদটা অনেক বেড়ে গেছে।

কিন্তু এসএনএনডাব্লিউ অস্ত্র কোনগুলো? বিভিন্ন দেশের জাতীয় শক্তি ও সম্পদের কেন্দ্রগুলোকে টার্গেট করে যে সব অস্ত্র মোতায়েন রাখা হয়, সেগুলোকেই এক কথায় এসএনএনডাব্লিউ বলা যায়। এগুলোও আবার দুই ধরণের হতে পারে। একটি হলো আঘাত হানার উপযোগী দৃশ্যমান অস্ত্র। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ক্রুজ ও ব্যালিস্টিক মিসাইল, হাইপারসনিক গ্লাইড ভেহিকল ও ড্রোনের মতো অস্ত্র। স্যাটেলাইট-বিধ্বংসী অস্ত্র বা মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেমও এই ক্যাটেগরিতে পড়বে।

দ্বিতীয়টা হলো সাইবার ও ইলেকট্রনিক ওয়্যারফেয়ার। এই যুদ্ধের মাধ্যমে বড় ধরণের কৌশলগত সুবিধা অর্জন করা যায়। তথ্য যুদ্ধ বা মিডিয়া প্রচারণাও এই যুদ্ধের মধ্যে পড়বে। জনমতের উপর প্রভাব বিস্তার থেকে শুরু করে, এই যুদ্ধ সর্বোচ্চ পর্যায়ে প্রভাব বিস্তারেও ভূমিকা রাখে।

এসএনএনডাব্লিউ-এর বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মের মধ্যে সমন্বয় এখন একটা বড় চ্যালেঞ্জ। এই সমন্বয়ের অভাবে ভুল ত্রুটি যেমন বাড়তে পারে, তেমনি ক্ষয়ক্ষতির ভয়াবহতাও বহু গুণ বেড়ে যাবে। অস্ত্রের সাথে এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যুক্ত হচ্ছে। মানুষের সিদ্ধান্ত গ্রহণের জায়গা নিচ্ছে তারা। এটা শুধু তত্ত্বকথা নয়। বেশ কয়েকটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাযুক্ত প্ল্যাটফর্মের প্রোটোটাইপ তৈরি করা হয়েছে। সেগুলোর পরীক্ষা নিরীক্ষাও চলছে। আরেকটি বড় সমস্যা হলো, যে সব প্ল্যাটফর্মে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যুক্ত হচ্ছে, সেগুলোর আবার পারমাণবিক অস্ত্র বহনেরও সক্ষমতা রয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ডিফেন্স অ্যাডভান্সড রিসার্চ প্রজেক্টস এজেন্সি ২০২০ সালের আগস্টে একটি পরীক্ষা চালায়। সেখানে কম্পিউটার জেনারেটেড সিস্টেমে সবচেয়ে দক্ষ মানব পাইলট আর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা পরস্পরের বিরুদ্ধে বিমান যুদ্ধের প্রতিযোগিতা করে। পাঁচবারের লড়াইয়ে প্রত্যেকবারই পাইলটকে হারিয়ে দেয় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। এইসব নতুন প্রযুক্তির কিছু ব্যয়বহুল, কিছু সস্তা। প্রসার বাড়লে সবগুলিরই দাম আস্তে আস্তে কমে আসবে। সমস্যা হলো, নতুন হওয়ায় এই মুহূর্তে অনেকগুলো প্রযুক্তি নিয়ে কোন নীতিমালা নেই।

অস্ত্রগুলোতে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম যুক্ত হওয়ায় অন্য ঝুঁকিও বেড়েছে। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে রয়্যাল ইন্সটিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স এক প্রতিবেদনে সতর্ক করে দিয়ে বলে, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, এবং অন্যান্য পারমাণবিক শক্তিধর দেশগুলোর সামরিক সিস্টেমগুলোতে সাইবার হামলার ঝুঁকি রয়েছে। এটা কোন কথার কথা নয়, বরং ঝুঁকিটা সত্যিকারের।

২০১০ সালে ওয়াইওমিংয়ের ওয়ারেন এয়ার ফোর্স ঘাঁটিতে ৫০টি মিনিটম্যান থ্রি ইন্টার-কন্টিনেন্টাল ব্যালিস্টিক মিসাইলের সাথে এক ঘন্টার জন্য যোগাযোগ হারিয়ে ফেলেছিল মার্কিন বিমান বাহিনী। তখন তীব্র আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল যে, শত্রুপক্ষ হয়তো অস্ত্র সিস্টেমে ক্ষতিকর কোন তথ্যের অনুপ্রবেশ করাতে পারে। অনেকে হয়তো বলতে পারেন, ভারত পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্রের সাথে এ ধরনের প্রযুক্তি যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা তেমন নেই। তাদের ধারণা ভুল।

ড্রোন এরই মধ্যে এখানে চলে এসেছে। মিসাইল ডিফেন্স এবং দূরপাল্লায় নিখুঁত আঘাত হানার উপযোগী কামানও এসেছে। ভারত তাদের এন্টি-ব্যালিস্টিক ও ক্রুজ মিসাইল সুরক্ষা তৈরির জন্য সক্রিয় চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা এমআইআরভি হাইপারসনিক গ্লাইড ভেহিকল তৈরি করছে। এরই মধ্যে তারা এসএসবিএন মোতায়েনও করেছে। এসএসবিএন হলো পারমাণবিক চালিত সাবমেরিন। এরা পারমাণবিক ওয়্যারহেড বহনে সক্ষম ব্যালিস্টিক ও ক্রুজ মিসাইল দুই-ই বহন করতে পারে।

এই সব সিস্টেমের সাথে সাইবার প্রযুক্তি যুক্ত থাকায় ভারত-পাকিস্তান উভয়ের জন্যেই সমস্যা বেড়ে গেছে। দুই দেশই পারমাণবিক শক্তিধর। যে কোন দুর্ঘটনা, হিসেবের ভুল বা প্রযুক্তিগত সমস্যার কারণে ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটে যেতে পারে।

ভারত আর পাকিস্তনের বারতি কিছু ঝুঁকি রয়েছে। তারা সার্বক্ষণিক উত্তেজনা পরিস্থিতির মধ্যে আছে। দুই দেশের মধ্যে একাধিক সশস্ত্র সঙ্ঘাত হয়েছে। দুই দেশই তাদের অস্ত্রসম্ভার ও সক্ষমতা বাড়াচ্ছে। তার চেয়েও বড় সমস্যা হলো, ২০১৪ সাল থেকে দুই দেশের মধ্যে সংলাপের কোন ফ্রেমওয়ার্ক নেই। এই সব সমস্যা সবারই জানা। কিন্তু এর সাথে আরও বিষয় যুক্ত হয়ে সঙ্ঘাতের আশঙ্কা বেড়ে গেছে। এই বিষয়গুলো হলো: ভারতের সীমিত সঙ্ঘাতের নীতি। পারমাণবিক অস্ত্র প্রথম ব্যবহার না করার নীতি থেকে ভারতের সরে যাওয়া। তাদের ২০০৩ সালের নীতিতে এর প্রতিফলন রয়েছে। এর অর্থ হলো, সুনির্দিষ্ট ঘোষণা না থাকলেও ভারত এখন প্রথমে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে। অস্ত্র সিস্টেম ও প্ল্যাটফর্ম পরিচালনায় ভারতের দুর্বল রেকর্ড। এতে দুর্ঘটনাজনিত সঙ্ঘাতের আশঙ্কা বেড়ে গেছে।

ভারতের যে সীমিত যুদ্ধের নীতি, বাস্তবে কখনও সীমিত থাকে না। ২০০১-০২ সালেও পূর্ণ মাত্রায় সেনা প্রস্তত করেছিল ভারত। সমস্যা রয়েছে পারমাণবিক নীতিতেও। ভারতের ২০০৩ সালের পারমাণবিক নীতিমালায় বলা হয়েছে, পারমাণবিক অস্ত্রের বিষয় ভারত নো ফার্স্ট ইউজ বা প্রথমে অস্ত্র না ব্যবহারের নীতি নিয়েছে। যদি তারা পারমাণবিক অস্ত্র দ্বারা আক্রান্ত হয়, তখনই তারা এটা ব্যবহার করবে। তবে, বিশেষজ্ঞরা বলছে, ভারতের এই ঘোষণা রাজনৈতিক। এটা আভিযানিক কোন নীতিমালা নয়।

২০১৯ সালে ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটিতে প্রকাশিত এক নিবন্ধে ক্রিস্টোফার ক্ল্যারি ও ভিপিন নারাং বলেন, ভারতের কর্মকর্তারা তাদের দীর্ঘদিনের প্রথম ব্যবহার না করার নীতি থেকে সরে আসতে শুরু করেছে। প্রয়োজনে আগাম পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের বিষয়টিও এখন তাদের বিবেচনায় রয়েছে।

এই সব নীতিগত সঙ্কটের সাথে যুক্ত হয়েছে প্রযুক্তি ব্যাবহারের দুর্বলতা। ২০২২ সালের ৯ মার্চ পাকিস্তান বিমান বাহিনীর এয়ার ডিফেন্স অপারেশান্স সেন্টার একটি উচ্চ গতির উড়ন্ত বস্তু দেখতে পেয়ে সেটির অনুসরণ করে। বস্তুটি ভারতের আকাশে কিছু সময় উড়ার পর হঠাৎ করে দিক বদলে পাকিস্তানের আকাশসীমায় ঢুকে পড়ে। পাকিস্তানের আকাশসীমা লঙ্ঘনের পর অবশেষে বস্তুটি পাকিস্তানের পাঞ্জাবের মিয়া চান্নুর কাছে পতিত হয়।

পাকিস্তানের আইএসপিআর পরদিন এক ব্রিফিংয়ে জানায়, এই উড়ন্ত বস্তুটি বহু আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ বিমান চলাচলে বিঘ্ন ঘটিয়েছে। মানুষের জীবন ও সম্পদের প্রতি ঝুঁকি সৃষ্টি করেছে। যে কারণেই এটা ঘটুক না কেন, এখানে প্রযুক্তি ব্যবহারে ভারতের চরম অদক্ষতার পরিচয় ফুটে উঠেছে। দুই দিন চুপ থাকার পর ভারত সরকার স্বীকার করে যে, রুটিন রক্ষণাবেক্ষণের সময় তাদের একটি মিসাইল দুর্ঘটনাক্রমে লঞ্চ হয়ে পাকিস্তানের ভেতরে ঢুকে পড়েছিল।

ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিংও পার্লামেন্টে বিষয়টি স্বীকার করেন। তার বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, মিসাইলটি নিয়ন্ত্রণে বাইরে গিয়ে পাকিস্তানের ভেতরে ঢোকার পরেও ভারত পাকিস্তানকে বিষয়টি জানায়নি। হয় তারা মিসাইলের গতিপথ অনুসরণ করতে পারেনি। অথবা, ইচ্ছা করেই তারা চুপ থেকেছে। বাস্তবতা যা-ই হোক না কেন, এই ঘটনায় বোঝা যায় উচ্চ পর্যায়ের প্রযুক্তি ব্যবহারে ভারতের দক্ষতার ঘাটতি রয়েছে। আরও আশঙ্কার বিষয় হলো, দুই দেশের মধ্যে যোগাযোগের যে শূণ্যতা রয়েছে, সেটা বড় ধরণের সংঘর্ষের কারণ হতে পারে।

ভারতের বিভিন্ন সামরিক প্রযুক্তিগত দুর্ঘটনা অবশ্য নতুন নয়। এনিয়ে ভারতের ভেতরে বাইরে অনেকেই অনেকবার উদ্বেগ জানিয়েছেন। উদীয়মান প্রযুক্তি পারমাণবিক সঙ্ঘাতের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে। নানা কারণে ভারত আর পাকিস্তানের মধ্যে এই ঝুঁকিটা অনেক বেশি। ভারত ও পাকিস্তনের মধ্যে সামরিক বোঝাপড়া বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন সময়ে নানা ধরণের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। কিন্তু সেগুলোর কোনটাই পুরোপুরি মানা হয়নি।

বর্তমান পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের সাথে আলোচনার বসার আগ্রহ ভারতের মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। পাকিস্তান তাদের পক্ষ থেকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার আগ্রহ জানিয়েছে। কিন্তু ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট ভারত জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিলের পর আলোচনার জন্য পূর্বশর্ত দিয়েছে পাকিস্তান। সেটা হলো, কাশ্মীরের আগের মর্যাদা আগে ফিরিয়ে দিতে হবে।

অদূর ভবিষ্যতে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বিদ্যমান পারমাণবিক ঝুঁকিগুলো যে কমে আসবে, সে ধরণের কোন লক্ষণ আপাতত চোখে পড়ছে না। বরং যে সব কারণে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হতে পারে, সে সব ঘটনা ধীরে ধীরে আরও বাড়ছে।