দক্ষিণ এশিয়ায় রাজনৈতিক পরিবর্তনের ঝড়

-

  • আলতাফ পারভেজ
  • ১১ মে ২০২২, ২৩:১৬

 

দক্ষিণ এশিয়ার দেশে দেশে তাপমাত্রার হিসাবে এখন গ্রীষ্মের তীব্রতা চলছে। কিন্তু রাজনীতিতে বয়ে যাচ্ছে বসন্তের অচেনা এক ঝড়। পাকিস্তানে নাটকীয়ভাবে ইমরান খান বিদায় নেয়ার পর শ্রী লঙ্কায় রাজাপক্ষে পরিবারের সবচেয়ে পুরানো উইকেটটিও পড়ে গেল। মৃদু উত্তেজনা চলছে মালদ্বীপে। অস্থিরতার উপাদান আছে নেপালেও। প্রশ্ন উঠেছে, এর সবই কি মহামারির প্রতিক্রিয়া? নাকি আরও গভীর কোন বার্তা আছে চলতি ঘটনাবলীতে।

ঝড়ের শুরু ছিল পাকিস্তানে। দুর্নীতির মামলায় নাস্তানাবুদ বিরোধীদলগুলো হঠাৎ একজোট হয়ে যায় সেখানে। পিটিআইকে কেবল কেন্দ্র থেকে সরানো হয়নিÑ প্রভাবশালী প্রদেশ লাহোর থেকেও উৎখাত হয়ে গেছে ইমরানের দলের সরকার। প্রায় দু মাস বয়সী সরকার-বিরোধী এই আন্দোলনের সবচেয়ে নজরকাড়া দিক ছিল এর অহিংস চরিত্র। ব্যাপক উস্কানি সত্ত্বেও দেশটির প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠান সশস্ত্র বাহিনীও এবারের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে পক্ষে-বিপক্ষে জোরালো ভূমিকা নেয়নি। গণতন্ত্রের জন্য লক্ষণ হিসেবে এটা স্বস্তির ছিল।

ইসলামাবাদে টিম-ইমরানের ইনিংস তছনছের পর দক্ষিণ এশিয়ার চলতি বসন্ত নি¤œচাপ তৈরি করে কলম্বোতে। রাজাপক্ষেদের পারিবারিক শাসনে দেশটির অর্থনীতি জীর্ণশীর্ণ হয়ে পড়েছিল। জিনিসপত্রের লাগামহীন দামে দিশেহারে মানুষ আস্তে-আস্তে রাস্তায় নামতে থাকে বিরোধীদল ছাড়াই। প্রায় এক মাসের এই জন-আন্দোলন ইতোমধ্যে সিংহলী বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদের অপরাজেয় প্রতীক রাজাপক্ষে বংশের ডালপালা অনেকখানি মাটিতে নামিয়ে এনেছে। প্রথমে মন্ত্রিত্ব ছাড়তে হয় অর্থমন্ত্রী বাছিলকে। এরপর গেছেন প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা। এরা উভয়ে ভাই। একই বংশের তৃতীয় সন্তান গোতাবায়া এখনও প্রেসিডেন্ট হিসেবে টিকে থাকলেও এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে, রাজাপক্ষেদের প্রতি সিংহলিদের পুরানো বিশ্বাস ও ভরসার অল্পই আর অবশিষ্ট আছে।

ইমরান ও রাজাপক্ষেরা ভূ-রাজনীতিতে গণচীনের কাছাকাছি ছিলেন। কিন্তু তাই বলে দক্ষিণ এশিয়ার চলতি ঝড়কে একতরফা ভূ-রাজনৈতিক রঙে লেপটে দেয়া কঠিন। অন্তত মালদ্বীপ ও নেপালের ঘটনাবলীকে সেভাবে শনাক্ত করা যায় না।

ইসলামাবাদ ও কলম্বোর মতো না হলেও মালদ্বীপেও রাজনৈতিক উত্তেজনা ধূমায়িত হচ্ছে ক্রমে। পার্শ্ববর্তী দুই বড় দেশের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা আছে সেখানকার উত্তেজনায়। দেশটিতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হবে আগামী বছর। পরের বছর হবে সংসদ নির্বাচন। কিন্তু ইতোমধ্যে সরকার-বিরোধী জনসংযোগে নেমে পড়েছেন প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট আবদুল্লা ইয়ামীন। গত বছর ভারতের সঙ্গে সামরিক এক চুক্তির পর থেকে মালদ্বীপের বর্তমান সরকারকে ভারতপন্থী হিসেবে তুলে ধরে দেশজুড়ে একধরনের জাতীয়তাবাদী মেরুকরণ ঘটাতে চাইছেন ইয়ামীন। ফেব্রুয়ারিতে হয়ে যাওয়া এক উপ-নির্বাচনে তাঁর প্রগ্রেসিভ পার্টির প্রতি জনসমর্থন বাড়ারও ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। তবে সেই নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম সোলিহ ও স্পিকার মুহামেদ নাশিদের জোট জিতেছে। সোলিহ ইতোমধ্যে ফরমান জারি করে দেশে ভারতবিরোধী প্রচারণা বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন। অন্যদিকে নাশিদ বলছেন, চীনের সিল্করুট প্রকল্পে যুক্ত হওয়া মালদ্বীপের জন্য ভুল হয়েছে। ইয়ামীনের বিপরীতে সোলিহ ও নাশিদের এরকম অবস্থান খোলামেলাভাবে দেশটির রাজনৈতিক মেরুকরণে ভূ-রাজনৈতিক উপাদান যুক্ত করছে।

পাকিস্তান ও শ্রী লঙ্কার মতো মালদ্বীপের রাজনৈতিক বিবাদে অর্থনীতির ছাপ কম। তবে শ্রী লঙ্কার মতো মালদ্বীপের অর্থনীতিও বড় আকারে পর্যটন-নির্ভর। মহামারির সময় তাদেরও আয়-রোজগার কমে গিয়েছিল প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ। শ্রী লঙ্কা ও পাকিস্তানের মতো বড় অংকে না হলেও মালদ্বীপেরও দেনার দায় আছে ৫ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার। শ্রী লঙ্কার মতো তারাও নানান জায়গায় ঋণের জন্য হাত পেতেছে গত এক বছর। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম বাড়ায় দেশটি শ্রী লঙ্কার চেয়ে ভালো অর্থনীতির মাঝেও উদ্বেগে আছে।

ইমরান খান ও মাহিন্দা রাজাপাকসার পতনের পর মালদ্বীপের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলোকে উদ্বিগ্ন দেখা যাচ্ছে নেপালের কংগ্রেস সরকারকে নিয়েও। মালদ্বীপের চেয়ে নেপালে রাজনৈতিক পরিস্থিতি শান্ত হলেও অর্থনীতি সেখানে বেশ বেসামাল। একদিকে আমদানি-রফতানি ভারসাম্য হারাচ্ছেÑ অন্যদিকে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে চলেছে। সবচেয়ে উদ্বেগে আছে দেশটি বৈদেশিক মুদ্রার কোষাগার কমতে দেখে। সরকার প্রবাসী নেপালীদের দেশে বেশি করে তহবিল পাঠাতে বলছে।
অনেকেই বলছেন, শ্রী লঙ্কার অর্থনৈতিক সংকটের শুরুর দিককার লক্ষণ নেপালে দেখা দিয়েছে ইতোমধ্যে। দেশটির প্রাক্তন তিন অর্থমন্ত্রী এরিমধ্যে উদ্বেগ প্রকাশ করে যৌথ বিবৃতি দিয়েছেন।


নেপালে প্রধানমন্ত্রী কংগ্রেসের হলেও অর্থমন্ত্রী মাওবাদী কমিউনিস্ট পার্টির। ফলে সংকটের পুরো দায় কংগ্রেস নিতে চাইছে না। বহু দিক থেকে অর্থমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবি উঠেছে। কিন্তু অর্থমন্ত্রী সংকটের জন্য দায় চাপিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্ণর প্রসাদ অধিকারীর উপর। অধিকারীকে বরখাস্ত করা হয়েছিল গত এপ্রিলে। কিন্তু তিনি উচ্চ আদালতে মামলা করে বরখাস্তের আদেশ ঠেকিয়ে রেখেছেন। এতে তৈরি হয়েছে অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারণে বাড়তি জটিলতা। শেষপর্যন্ত যদি অর্থমন্ত্রী জনার্দন শর্মাকেই পদ ছেড়ে যেতে হয় তাহলে সরাসরি তার প্রতিক্রিয়া হবে ক্ষমতাসীন জোটে। জোটের ছোট শরিক হিসেবে কংগ্রেস দল তখন সরকার টিকিয়ে রাখতে পারবে বলে মনে হয় না। এর মধ্যেই বিদ্যুত খাতে ৫০ কোটি ডলারের প্রকল্প নিয়ে নেপালে যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতি বিস্ময়ভরা চোখে দেখতে হচ্ছে ভারত ও চীনকে।

নেপাল ও মালদ্বীপের এই টানাপোড়েনের সঙ্গে পাকিস্তান ও শ্রী লঙ্কা পরিস্থিতির হুবহু মিল না থাকলেও ইউক্রেন যুদ্ধ এরকম সকল দেশে জনগণের জীবনযাত্রায় খরচপাতি বাড়িয়ে চলেছে। বাংলাদেশেও তেলসহ প্রায় সকল জিনিসের দাম বাড়ছে ক্রমাগত। এ অবস্থা অবসানের কোন বিকল্প মডেল দেখছে না মানুষ।
শ্রী লঙ্কায় জ্বালানি, ওষুধ ও খাবার সংকটের মুখে বিক্ষুব্ধ জনতা কেবল সরকারের বিরুদ্ধে নয়Ñ বিরোধী দলের নেতাদের বাড়ির সামনেও প্রতিবাদী অবস্থান নিয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে এটা এক অভিনব সংযোজন। ঋণের অর্থে উন্নয়নের চমক দেখে এই মানুষরা আর সন্তুষ্ট থাকতে পারছে না। আকর্ষণ হারাচ্ছে তারা একই ধাঁচের বিরোধী দলের উপরও।


পাকিস্তানের অভিজ্ঞতায়ও দেখা গেল ইমরান খানকে পদত্যাগ করতে হলেও জনতা বিরোধী দলের উপরও পূর্ণ ভরসা করতে পারছে না। নতুন জোট-সরকার সেখানে তীব্র টানাপোড়েনের মধ্যে কোনভাবে দিন পার করছে। নতুন নির্বাচনই দেশটির নিয়তি হয়ে উঠছে ক্রমে। কারণ জরুরি হয়ে পড়া অর্থনৈতিক সংস্কারের জন্য সরকারের পক্ষে শক্ত জনসমর্থন লাগবে সেখানে।


নেপালেও বিদ্যমান মূলধারার দলগুলো রাজনৈতিক সংকটের সমাধান দিতে না পেরে জাতীয় নির্বাচনে যেতে চাইছে। তাতে অবশ্য এসব দেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা কাটবে বলে নিশ্চিত করে বলতে পারছে না কেউ। নেপালে মানুষ অভিজাতদের পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতি থেকে বের হয়ে বামপন্থীদের বিপুলভাবে ভোট দিয়েও স্বস্তিকর রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পায়নি আজও।


এদিকে, ভারতেও ডলারের বিপরীতে রূপির দর ক্রমে পড়ছে। পাইকারী এবং খুচরা উভয় পর্যায়ে মুদ্রাস্ফীতি এমন স্তরে চলে গেছেÑ যা দেশটিকে ১৯৯১ এর অর্থনৈতিক সংকট স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। রাজ্য পর্যায়ে পাঞ্জাব, অন্ধ্র প্রদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলতার কথা জানাচ্ছেন নীতিনির্ধারকরা। আবার অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির বাইরেও ভারতকে সতর্ক হতে হচ্ছে চারপাশের প্রতিবেশী দেশগুলোতে তার নানান ধরনের প্রকল্পগুলো নিয়েও। তবে হিন্দুত্ববাদের প্রবৃদ্ধি সেখানকার সরকারকে জনরোষ থেকে ভালো সুরক্ষা দিচ্ছে।

রাজনৈতিক ভাষ্যকাররা বলছেন, তীব্র অর্থনৈতিক সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে উপমহাদেশের দেশগুলোতে নতুন করে বিদ্যমান রাজনৈতিক কাঠামোর অকার্যকারিতা উম্মোচিত হচ্ছে। পুরানো পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতি লোকরঞ্জনবাদী নানান পদক্ষেপে কিছুটা সময় পার করলেও ইমরান ও রাজাপক্ষেদের ব্যর্থতা ও বিদায় দেখাচ্ছে উপমহাদেশে মানুষ নতুন রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, স্বচ্ছতা ও সুশাসন চাইছে। রাষ্ট্রীয় সম্পদ বন্টনের পুরানো পদ্ধতির বদল চায় তারা। অবসান দরকার গুটিকয়েক মানুষের শাসন, স্বজন তোষণ এবং সম্পদ পাচারের। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, উচ্চ ধনীদের উপর বাড়তি করারোপ এবং সেই অর্থে মানব সম্পদের উন্নয়ন ছাড়া সহনীয় আর কোন বিকল্প নেই এমুহূর্তে। কিন্তু এরকম কর্মসূচি এগিয়ে নেয়ার মতো আমূল পরিবর্তনবাদী রাজনৈতিক দলগুলো কোনঠাসা অবস্থা কাটিয়ে উঠতে পারছে না।


শ্রী লঙ্কায় দেখা গেছে, মানুষ ৩০ দিন রাস্তায় রাস্তায় মিছিল করেও পরিস্থিতিকে গণ-অভ্যুত্থানের দিকে এগিয়ে নিতে পারেনি। ফলে পার্লামেন্টারি পথেই সেখানে এখন বিকল্প খোঁজা হচ্ছে। তবে এর মাঝেই দক্ষিণ এশিয়ার দেশে-দেশে নতুন করে বাড়ছে চীন, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের অদৃশ্য সক্রিয়তা। হঠাৎ আসা চলতি ঝড়ের পরই হয়তো বোঝা যাবে কার কী অর্জন; কারা লুটিয়ে পড়েছে আর, কারা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো।
শেষ