নেপালে অস্থিতিশীলতা : চীন না ভারত দায়ী

ওলিকে ক্ষমতাচ্যুত করতে নেপালের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সামাজিক ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তারের সব উপায় উপকরণ সক্রিয় করে তোলে ভারত - ইন্টারনেট

  • ইলিয়াস হোসেন
  • ০২ জানুয়ারি ২০২১, ০৮:৪০

হিমালয়ের দেশ নেপালে আবারও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা দেখা দিয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও ক্ষমতার লড়াইকে এর কারণ বলে মনে করা হচ্ছে। তবে এর পেছনে চীন ও ভারতের ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্বও বহুলাংশে দায়ী। নেপালের এই রাজনৈতিক অচলাবস্থার ফলে শেষ পর্যন্ত চীন না ভারত বেশি লাভবান হবে, সেই প্রশ্ন উঠছে। আজ থাকবে এ নিয়ে বিশ্লেষণ।

নেপালের রাজনীতিতে নাটকীয়তা সৃষ্টি হয়েছে। ক্ষমতাসীন দল নেপাল কমিউনিস্ট পার্টি বা এনসিপির মধ্যে দ্বন্দ্বে পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি। কিন্তু দলের মধ্যে তার বিরোধীরা এ সিদ্ধান্তকে ‘সাংবিধানিক অভ্যুত্থান’ আখ্যায়িত করে সুপ্রিম কোর্টের আশ্রয় নিয়েছেন। তবে প্রধানমন্ত্রী তার অবস্থানে অটল আছেন। তিনি বলছেন, নির্বাচনের মাধ্যমে তিনি নতুন ম্যান্ডেট নিতে চান। কারণ, এনসিপিতে দ্বন্দ্বের কারণে তার সরকার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছিল।

গত ২০ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী ওলি প্রেসিডেন্টকে দিয়ে পার্লামেন্ট বিলুপ্ত করান। তবে নেপালের আইনজীবী দিনেশ ত্রিপাঠি বলেছেন, সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী আগেভাগে পার্লামেন্ট ভেঙে দিতে পারেন না। প্রধানমন্ত্রী ওলি এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী পুষ্প কমল দাহাল প্রচÐের মধ্যে দীর্ঘদিনের বিরোধের ফলে এই অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এর ধারাবাহিকতায় সংসদ ভেঙে দেওয়ার পর জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন ওলি। তিনি বলেন, তার বিরুদ্ধে অনাস্থা ভোটের পরিকল্পনার কথা জানতে পেরে তিনি পার্লামেন্ট ভেঙে দিতে বাধ্য হয়েছেন।
ওলি বলেছেন, ক্ষমতাসীন দলের ভিতরে বিরোধের কারণে সরকার চালানো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তারা নির্বাচিত সরকারকে কোণঠাসা করে ফেলেছে। সরকারের বিরুদ্ধে কাজ করছে। তারা কাজ করতে দিচ্ছে না । তাই তিনি পার্লামেন্ট ভেঙে দিতে বাধ্য হয়েছেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুপ্রিম কোর্টে যে আবেদন করা হয়েছে তার ফল বা সিদ্ধান্ত পেতে প্রায় দুই সপ্তাহ লেগে যেতে পারে। প্রধানমন্ত্রী ওলি বলেছেন, দেশের অখÐতা এবং সার্বভৌমত্বকে নিরাপদ রাখতে ভালভাবে কাজ করে যাচ্ছে তার সরকার। তার ভাষায়, ভারতের বাধা উপক্ষো করেই কালাপানি এবং লিপুলেখকে নেপালের মানচিত্রের সঙ্গে অঙ্গীভূত করে তা প্রকাশ করার মাধ্যমে জাতীয় মর্যাদা বৃদ্ধি করেছেন। এ জন্য তিনি রোষের শিকারে পরিণত হয়েছেন। এর আগে গত জুনে প্রধানমন্ত্রী ওলি দাবি করেন, তাকে ক্ষমতা থেকে উৎখাতের চেষ্টা করা হয়েছে। তিনি দেশের মানচিত্রকে নতুন করে প্রকাশ করার কারণে তার বিরুদ্ধে এমনটা করা হচ্ছে বলে তার অভিমত। নেপালের নতুন মানচিত্র প্রকাশ করাকে অগ্রহণযোগ্য বলে মন্তব্য করেছে ভারত।

ওলির পার্লামেন্ট ভেঙে দেয়ার আগে দিল্লি থেকে ভারতীয় সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাদের ঘন ঘন কাঠমান্ডু সফরে মনে হচ্ছিল সেখানে রাজনৈতিক অভ্যুত্থান আসন্ন। ভারতের সেনাপ্রধান, বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থা র’য়ের প্রধান এবং ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের পরং চীনের প্রভাবশালী প্রতিরক্ষামন্ত্রীর সফরের পর অস্থিরতা আরো বেড়ে যায়। আর এখন রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ঘিরে ধরেছে দেশটিকে।

পৌনে তিন কোটি জনসংখ্যার নেপাল এখনো এশিয়ার অন্যতম অন্যতম দরিদ্র দেশ। এখন করোনা মহামারী নিয়ে লড়াই করছে দেশটি। করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে থাকলেও সারা বিশ্ব থেকে আসা পর্বতারোহীরা এখনো মুখ ফিরিয়ে রয়েছে। নেপালের অভিবাসী কর্মীরা বিশ্বের অনেক জায়গায় বেকার হয়ে পড়েছেন। এই চাপ মোকাবেলায় চীন নেপালিদের জন্য ইউনান প্রদেশে কাজ করার বিশেষ অনুমতি দিয়েছে।

ভারতের সাথে সম্পর্কের টানাপড়েনের ক্ষতি পুষিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছে বেইজিং। অবশ্য নেপালের গণমাধ্যমগুলোতে ভারতপন্থীদের প্রভাব বেশি থাকায় নেপালি নাগরিকদের অর্থনৈতিক দুরবস্থা যতটা প্রচারণা হয় তার চেয়ে বেশি।
নেপালের সঙ্গে সাম্প্রতি বছরগুলোতে চীনের সম্পর্ক বেশ উন্নত হয়েছে। ২০১৫ সালে নেপালে নতুন সংবিধান রচনা নিয়ে ভারত ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে। কারণ ওই সংবিধান ভারতের মনপুত ছিল না। এরপর দিল্লি নেপালের ওপর নজিরবিহীন অবরোধ আরোপ করলে নেপালে জনমত ভারতবিরোধী হয়ে ওঠে। সেই সুযোগে নেপালিদের পাশে দাড়ায় চীন। এরপর থেকেই নেপালের সঙ্গে চীনের ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে আর ভারত ক্রমশই দূরে সরে গেছে।

চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং গত বছর নেপাল সফর করেন। প্রধানমন্ত্রী ওলি তার দেশে শি জিনপিংয়ের চিন্তাধারার ওপর প্রশিক্ষণের আয়োজন করেন এবং মাউন্ট এভারেস্টের উচ্চতা পরিমাপের জন্য চীনের সঙ্গে যৌথ কমিটির ঘোষণা করেন।

চীনের সাথে মহাসড়ক যোগাযোগ প্রকল্পের কাজ ৯০ শতাংশ শেষ। এটি শেষ হলে বৈদেশিক বাণিজ্যের জন্য এককভাবে ভারতের ওপর নির্ভরতা নেপালের কমবে। এ ছাড়া এভারেস্টের নিচ দিয়ে একটি টানেল নির্মাণ করে চীন-নেপাল সংক্ষিপ্ত রুটে বহুপক্ষীয় যোগাযোগের একটি প্রকল্পের কাজও হচ্ছে।

২০১৭ সালের নির্বাচনে ওলি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই জানতেন, তিনি নেপালের প্রধানমন্ত্রী থাকুন তা দিল্লি চায় না। এ কারণে তিনি ভারসাম্য বজায় রাখার পরিবর্তে চীনের সাথে সম্পর্ক সুদৃঢ় করতে সব ধরনের পদক্ষেপ নেন। এতে আরো বেশি ক্ষুব্ধ হয় বড় প্রতিবেশী ভারত। লিপুলেখ কালাপানিকে নেপালের অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে নতুন মানচিত্র প্রকাশ করায় ভারত আরও ক্ষিপ্ত হয়। সর্বশেষ ভারতের অযোধ্যায় বিজেপি সরকার ঘটা করে রাম মন্দির স্থাপনের আয়োজনের সময় রাম জন্মভূমি নেপালে বলে দাবি করে মোদি সরকারের ক্ষোভের আগুনে ঘি ঢেলেছেন ওলি।

ওলিকে ক্ষমতাচ্যুত করতে নেপালের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সামাজিক ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তারের সব উপায় উপকরণ সক্রিয় করে তোলে ভারত। এই কার্যক্রমে সরকারের পাশাপাশি ভারতের সেনাবাহিনীর একটি অংশ যুক্ত হয়ে পড়ে বলে ধারনা করা হয়। দেশটির সেনাবাহিনীতে নেপালি গোর্খা রেজিমেন্ট নিয়ে বিতর্ক উঠার পর এ পরিস্থিতি তৈরি হয়।

নেপাল সরকার প্রকাশ্যে নেপালিদের অন্য দেশের পক্ষে যুদ্ধ করে জীবন দেয়ার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করে। দিল্লির কর্মকর্তারা মনে করছেন, চীনের ইন্ধনে এতদিন পরে নেপাল সরকার এ নিয়ে প্রশ্ন করার ঔদ্ধত্য দেখিয়েছে।
এর পরপরই চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী কাঠমান্ডু সফর করেন। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, ভারতীয় গোর্খা রেজিমেন্টের পুরোটাকে নেপালি সেনাবাহিনীতে আত্তীকরণের জন্য প্রয়োজনীয় তহবিল বেইজিং দিতে চেয়েছে। কিন্তু ভারতীয় পক্ষ দ্রæত রাজনৈতিক দাবার চাল খেলে বিষয়টি এগোতে দেয়নি। তার আগেই ক্ষমতার বিন্যাস এলোমেলো হয়ে যায়।

কাঠমান্ডু বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ বিপিন অধিকারী নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেছেন, ওলি ভারতের প্রিয়ভাজন ছিলেন না। তিনি বলেন, নেপালের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হয়তো ভারত ঘেষা হবেন। সাম্প্রতিক এই পরিবর্তনে চীন যে কিছুটা চাপে পড়েছে তাতে সন্দেহ নেই। তবে ভারতও স্বস্তিতে নেই। নেপাল পরিস্থিতির দিকে সতর্ক নজর রাখলেও এখনও প্রকাশ্যে কোনও বিবৃতি দেয়নি নয়াদিল্লি। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, হাওয়া কোন দিকে বইবে তা না বুঝে আগে থেকে কোনও মন্তব্য করে নেপাল বিতর্কে নিজেদের জড়াতে চায় না দেশটি।

অনেক বিশ্লেষক মনে করেন , এই ঘটনায় নেপালে বেশ কিছু বছর ধরে তৈরি হওয়া ভারত-বিরোধী আবেগ কিছুটা থমকে যাবে। হয়তো কিছু দিনের জন্য রাজনৈতিক ডামাডোলের বাজারে নেপালকে ব্যবহার করে ভারতের উপরে চাপ তৈরির চীনের কৌশলও বদলে যাবে। মানচিত্র পরিবর্তন করে ভারতের তিনটি সীমান্তবর্তী এলাকাকে নেপালের অন্তর্ভুক্ত বলে দেখানোর যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ওলি সরকার, নতুন সরকার এলে হয়তো তাকেও বদলানো হবে।

রাজনৈতিক টালমাটাল পরিস্থিতিতে নেপালে গণতন্ত্র বির্পযস্ত হবে বলেই মনে করা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদে বেইজিংয়ের প্রভাব বাড়া ছাড়া কমবে না। সীমান্ত রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য যা উদ্বেগজনক। নয়াদিল্লির মতে, নেপাল বেশ কয়েক মাস ধরেই বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত।
কোভিড মোকাবিলার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ভূমিকা নিতে না পারা, অর্থনীতিতে টালমাটাল পরিস্থিতি, শাসক দলের মধ্যে বিরোধ, রাস্তায় রাজতন্ত্র এবং হিন্দু রাষ্ট্রের পক্ষে আন্দোলনসহ সব মিলিয়ে অস্থির করে রেখেছিল ওলি সরকারকে। এ পরিস্থিতিতে নেপাল কমিউনিস্ট পার্টিকে একজোট রেখে নিজেদের বাণিজ্যিক এবং কৌশলগত লক্ষ্য পূরণেই চীন বেশি ব্যস্ত।

তবে চীনের বড় সফলতা হলো এক সময় নেপাল ছিল ভারত প্রভাবিত দেশ। দুটি হিন্দুপ্রধান দেশ হলেও ভারতের দাদাগিরিতে অসন্তুষ্ট ছিল নেপালিরা। কিন্তু সেটা চেপে রাখা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। কিন্তু গত কয়েক বছরে অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। এখন নেপালে ভারতবিরোধী জনমত প্রবলভাবে দৃশ্যমান।
ভারতের একতরফা প্রভাববলয়ের দেশটিতে সম্প্রতিক সময়ে চীন শক্তপোক্ত জায়গাদখল করেছে। এটাকে ভারতীয় নীতির ব্যর্থতা হিসাবে দেখা হয়। বর্তমান রাজনৈতিক অস্থতিশীলতার ফলে শেষ পর্যন্ত ভারত নাকি চীনের লাভ হবে তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে চীন দেশটির অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে যেভাবে শক্ত ভিত্তি গড়ে তুলেছে তাকে দেশটির কোনো রাজনৈতিক দল কিংবা ভারতও অস্বীকার করতে পারবে না। এর মানে হচ্ছে নেপালে চীনের দৃঢ় অবস্থান এখন এক অনিবার্য বাস্তবতা। এটাই হয়তো দিল্লির বড় মাথা ব্যথার কারণ।

বিশ্লেষকরা বলছেন, দক্ষিণ এশিয়ায় চীন ও ভারতের প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতার বলি হচ্ছে নেপাল। ভারত ও চীনের এই প্রতিযোগিতা থেকে নেপাল লাভবান হতে পারে। তবে সেজন্য দুটি দেশের সঙ্গেই কাঠমাÐুকে ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। এটা সম্ভব হলে দুটি থেকেই নেপাল বিনিয়োগসহ আর্থিক সুবিধা নিতে পারে।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে