হুমকির মুখে ভারতের গণতন্ত্র

কার্টুনটি করেছেন নিতুপর্না - কার্টুনিস্ট নিতুপর্না ডট অর্গ

  • আহমাদ আব্দুল্লাহ
  • ১৩ ডিসেম্বর ২০২০, ০৯:২৮

জোসেফ স্ট্যালিন বহু আগে একবার বলেছিলেন, যারা ভোট দিয়ে নিছক একটি ভোটের সংখ্যা বৃদ্ধি করে তারা জনগণ নয়, বরং যারা ভোটের ফায়সালা করে তারাই হলো জনগণ। স্ট্যালিনের রাশিয়ার দৃশ্যপট অবশ্য এমন ছিল। আর এ কারণেই রাজনীতিবিদ হিসেবেও স্ট্যালিন বেশ সফলতাও পেয়েছিলেন। সে সময়গুলোতে ধরে নেয়া হতো যে, শুধুমাত্র পশ্চিমা গণতান্ত্রিক দেশগুলোতেই নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়। কিন্তু তা ভুল প্রমানিত হয়েছে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে গনতন্ত্র প্রতিষ্টা হয়েছে। এর বড় উদহারন ভারত। কিন্তু সেই ভারতে এখন গনতন্ত্র হুমকির মুখে পড়েছে।

ঔপনিবেসিক শাসন থেকে বের হয়ে আসার সময়গুলোতে দরিদ্র দেশগুলোর কাছে মৌলিক অধিকার, আইনের শাসন কিংবা ক্ষমতার শান্তিপূর্ন হস্তান্তর ছিল নিছকই এক অলীক কল্পনা। বরং এ দেশগুলোতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রক্তপাতের মধ্য দিয়েই ক্ষমতার পালাবদল হতো।

ভারত যখন ৫০ এর দশকে একটু একটু করে গনতন্ত্রের পথে চলতে শুরু করে তখন ভারতের অবস্থাও এমন হতাশাব্যাঞ্জকই ছিল। ভারতের মতো একটি দেশ, যেখানে অসংখ্য ভাষা, ধর্ম ও নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী বসসাস করে সেখানে গনতন্ত্রের সফল বাস্তবায়ন কেউ আশাও করেনি। কিন্তু পরবর্তী কয়েক যুগে ভারত এ আশংকাকে মিথ্যা প্রমাণ করে বিশ্বের বৃহত্তম গনতান্ত্রিক দেশ হিসেবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়। ভারতে একটি সময়ে প্রাতিষ্ঠানিক বিশ্বাসযোগ্যতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং নাগরিক অধিকারও নিশ্চিত করা হয়। যদিও ভারতের গনতান্ত্রিক ইতিহাসে কিছু কালিমাও ছিল। যেমন: আভ্যন্তরীন ও বাহ্যিক হুমকির অজুহাতে ইন্দিরা গান্ধী সংবিধানের প্রতি দ্বায়বদ্ধ না থেকে ৭০ এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে দেশে জরুরি অবস্থা জারি করেছিলেন।

তবে, সে কালিমাযুক্ত ইতিহাস থেকেও ভারত অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে। একবিংশ শতকের সূচনালগ্নে ভারতে গনতন্ত্রের শক্তিশালী অবস্থানই ছিল, যেখানে অনেকগুলো রাজনৈতিক দল সক্রিয় ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছিল। দেশটিতে তরুণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যাও অনেক বেড়েছিল। অর্থনৈতিকভাবেও ভারত বিশ্বে অনেকের নজর কেড়েছিল। তবে, নবীন এ গনতন্ত্রের দেশটিতে যেমন কিছু ইতিবাচক দিক ছিল তেমনি অনেক বড়ো আকারের দুর্বলতাও ছিল। যদিও ভারতে যুব ভোটারদের সংখ্যা এখন অনেক, কিন্তু অধিকাংশই তাদের গনতান্ত্রিক ইতিহাসের কালো অধ্যায় সমন্ধে তেমন সচেতন নয়। তারা এটাও জানে না যে, ভোট প্রদানের মাধ্যমে জনগনের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না, বরং এখান থেকেই তাদের দায়িত্ব শুরু হয় মাত্র।

নানামুখী টানাপোড়েনের মধ্যে যখন ভারতে ইন্টারনেট পরিসেবা ও অন্যন্য তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়লো তখন অনেকেই আশা করেছিল যে, এর মাধ্যমে ভারতের গণতন্ত্র আরো সংহত হবে। স্বাধীনতা নতুন মাত্রা পাবে। কিন্তু কার্যত তা হয়নি। বরং নতুন নতুন সব জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। ভারতের ডিজিটাল সমৃদ্ধি ভারতকে মুক্ত করতে পারেনি, বরং নতুন নতুন জালিয়াতি ও কারসাজির পথ উম্মুক্ত করেছে।

আইন দিয়ে গণতন্ত্রকে অকার্যকর করার ধারণাটি এ শতকে এসে খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি। বরং এখন গনতন্ত্রকে অনেক বেশি দুর্বল ও নাজুক অবস্থায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে গনতন্ত্রের মূল স্তম্ভগুলোকে সুকৌশলে ধ্বংস করে দেয়ার মাধ্যমে। আগে সামরিক অভ্যুত্থান বা অন্যন্য বেআইনী পন্থায় গণতন্ত্রকে নির্বাসনে পাঠানো হতো। আর এখন গনতন্ত্রের সিস্টেম লস দিয়েই গনতন্ত্রকে বিপর্যস্ত করে দেয়া হয়েছে।

গণতন্ত্রের কাঠামোকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। একটি হলো; সাংবিধানিক কাঠামোগুলোর ওপর নির্বাহী বিভাগের প্রভাব বিস্তার করা, রাজনীতির মূল খেলোয়াড়গুলোকে অকার্যকর বানিয়ে সাইড লাইনে বসিয়ে রাখা এবং রাজনীতির নিয়ম কানুনকে দুর্বল করে দেয়া। এভাবে কাজ করে সাম্প্রতিক সময়ে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, পেরুর প্রেসিডেন্ট আলবার্তো ফুজিমুরি এবং হাঙ্গেরীর প্রেসিডেন্ট ভিকটর ওরবান সফলতাও পেয়েছেন।

নিজ দেশে গণতন্ত্রকে দুর্বল করে তারা নিজেদের অবস্থানকে ভালোভাবেই সংহত করতে পেরেছেন। এ তালিকায় নতুন করে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। মোদির একনায়কোচিত মনোভাবের কারণে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বায়ত্তশাসন অনেকক্ষেত্রেই খর্ব হতে শুরু করেছে। বেশ কিছু ঘটনাও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঘটেছে যা ভারতের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যাপকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

গণতন্ত্রের অন্যতম একটি স্তম্ভ হলো বিচার বিভাগ। বিচার বিভাগই নির্বাহী বিভাগের একচ্ছত্র ক্ষমতায় ভারসাম্য বজায় রাখে। ভারতের বিচার বিভাগ এবং এর রায়গুলো এক সময় জগৎ জুড়ে বিখ্যাত ছিল। কিন্তু এ প্রতিষ্ঠানগুলো জনগনের চেয়ে বরং সরকারের স্বার্থ রক্ষাতেই বেশি তৎপর হয়ে উঠেছে। বিগত ৬ বছরে ভারতের সুপ্রীম কোর্ট ইলেক্টরাল বন্ড কেস, নাগরিকত্ব সংশোধন আইন, মুদ্রা রহিত করণ, অভিবাসী সংকটসহ বিতর্কিত নানা ইস্যুতে সরকারের পক্ষেই অবস্থান নিয়েছে।

কিছুদিনের মধ্যে ভারতের এটর্নী জেনারেল একজন কমেডিয়ানের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা নিয়ে কাজ শুরু করবেন। এই কমেডিয়ান দেশটির প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে মন্তব্য করায় তার বিরুদ্ধে এ মামলা হয়। ২০১৮ সালে ভারতের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সুপ্রীম কোর্টের চারজন বিচারপতি একসাথে একটি সংবাদ সম্মেলন করেন এবং প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে তাদের ক্ষোভের কথা জানান।

এসব ঘটনা থেকে বোঝা যাচ্ছে , ভারতের গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো ঠিকমতো চলছে না। ভারতের মিডিয়াও গত কয়েক বছরে অনেকটা নগ্নভাবেই সরকারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। তারা সরকারের চাপে রীতিমতো কোনঠাসা অবস্থায় রয়েছে। বিশ্বে সংবাদ স্বাধীনতার পরিসংখ্যানে ১৮০টি দেশের মধ্যে ভারত এখন ১৪২ নম্বরে অবস্থান করছে। সাংবাদিক নিপীড়ন এবং একের পর এক সাংবাদিককে কারাগারে নিক্ষেপ করায় ভারত এ তালিকায় ক্রমশই পিছিয়ে পড়ছে।

ভারতের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সর্বশেষ কলংকিত হয়েছে দেশটির নির্বাচন কমিশন। গত অক্টোবর মাসের শেষ দিকে বিহার রাজ্যে যে নির্বাচন হয়েছিল তাতে চরম জালিয়াতি ও ভোট কারচুপির তথ্য পাওয়া গেছে। সাংবিধানিকভাবে ভারতের নির্বাচন কমিশন একটি স্বায়ত্ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান এবং তারা ভারতের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক যে কোনো নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে করার স্বার্থে যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে। অথচ বিহার রাজ্যের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন কমিশনকে সরকারের পক্ষে কাজ করার জন্য দায়ী করেছে।

বিরোধী দলগুলো ১১৯ জন প্রার্থীর তালিকাও প্রনয়ন করেছে। যারা ভোট গননায় জয়ী হয়েছে এবং রিটার্নিং অফিসাররা তাদেরকে জয়ের জন্য অভিবাদনও জানিয়েছেন। কিন্তু পরে যখন তারা নির্বাচনের জয়ী হওয়ার স্বপক্ষে সার্টিফিকেট সংগ্রহ করতে গিয়েছেন তখন তাদেরকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, নির্বাচনে তারা কেউই আসলে জয়ী হননি।

এর আগেও ভারতের নির্বাচন কমিশন ও ইভিএম এর বিরুদ্ধে নানা সময়ে অভিযোগ তোলা হয়েছিল। সরকার কোনো সময়ই তাতে পাত্তা দেয়নি। তবে, এবার বিহার নির্বাচনের পর নির্বাচন কমিশনের সরকার তোষণ যেন প্রকাশ্যে চলে এসেছে। ভারতে নির্বাচন কমিশন এর আগে কখনোই এত মারাত্মকভাবে আস্থার সংকটে পড়েনি।

এ জন্য নির্বাচন কমিশনের দায়ও কম নয়। তাদের আস্থা ও গ্রহণযোগ্যতা কমে যাচ্ছে। এর আগে ভারতের নির্বাচন প্রক্রিয়া ছিল স্বচ্ছ এবং কী হচ্ছে না হচ্ছে- তা জনগন বুঝতো। কিন্তু এবার নির্বাচন কমিশন গোটা নির্বাচনী প্রক্রিয়াকেই রহস্যময় করে তুলেছে।

বিশ্বেও উন্নত অনেক দেশেই এখন আর ইভিএম প্রযুক্তি নেই। যে কয়টি দেশে আছে তারাও তাদের সোর্স কোড অডিট রিপোর্টের অনেকখানি অংশই পাবলিক ডোমেইনে উম্মুক্ত করে দিয়েছে। কিন্তু ভারতে ইভিএমটি অনেকটাই পুরনো আর সেখানে জনগনের মাঝে তথ্য প্রকাশ করার কোনো প্রক্রিয়াও চালু নেই। সোর্স কোড উম্মুক্ত করে দিলেই যে ইভিএম নিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়া যাবে তাও নয়। সোর্স কোড খুলে দেয়ার পর তৃতীয় আরেকটি পক্ষ দিয়ে আবার তা অডিটও করাতে হবে। এসব কিছুই ভারতে করা হয়নি। নির্বাচন কমিশনও এ ইভিএম বিতর্ক নিরসনে কার্যকর কোনো উদ্যেগ নেয়নি যা কমিশনকে আরো বেশি প্রশ্নের মুখে ফেলেছে।

একটি দেশের গণতন্ত্র কতটা শক্তিশালী তা বোঝা যায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার মধ্য দিয়ে। কিন্তু ভারতের কোনো কিছুই এখন পরিস্কার নয়। সেখানে কোনো জবাবদিহিতাও নেই। যেহেতু সেখানে ভোট গননাতেই কোনো স্বচ্ছতা নেই, তাই কারা ভোট দিলো বা কারা দিলো না- তা এখন আর গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়।
কাশ্মীর ইস্যুতে কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকা বা নাগরিকত্ব ইস্যুতে দেশজুড়ে জনমনে অস্থিরতা এত ব্যাপকভাবে ভারতে আগে কখনো দেখা যায়নি। বিজেপি সরকার এখন প্রাদেশিক সরকারগুলোর ওপরও ছড়ি ঘোড়ানোর চেষ্টা করছে। ভিন্ন দলের মুখ্যমন্ত্রীদেরকে আদালতের মাধ্যমে সরিয়ে দেয়ার অপপ্রয়াস চালানো হচ্ছে। ভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষ বা সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে দমিয়ে রাখার জন্য সরকারের পৃষ্টপোষকতায় উগ্র হিন্দুত্ববাদকে সামনে নিয়ে আসা হয়েছে। বাবরী মসজিদকে কেন্দ্র করে সুপ্রীম কোর্ট যে রায় দিয়েছে তা আদালতের নিজের বক্তব্যের সাথেই সাংঘর্ষিক বলে প্রতীয়মান হয়েছে। একাধিক সাবেক বিচারপতি বাবরী মসজিদ সংক্রান্ত এ রায়কে প্রত্যাখান করেছেন। আবার রায় প্রকাশের সাথে সাথে করোনার মাঝেই প্রধানমন্ত্রী রাম মন্দির নির্মান কাজে হাত দিয়েছেন। তাতে মনে হচ্ছে, আদালত যেন নির্বাহী বিভাগের আদেশেই এ স্পর্শকাতর ইস্যুতে এমন বিতর্কিত রায় প্রদান করেছে।

ভারতের সরকার চলমান করোনা মহামারি মোকাবেলায়ও ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। বিহারের প্রায় ৩০ লাখ শ্রমিক যারা অন্যন্য প্রদেশে কাজ করার জন্য গিয়েছিলেন, তারা করোনা পরিস্থিতিতে লকডাউনের মধ্যে পায়ে হেটেই নিজ রাজ্যে ফিরে গেছে। ফলে করোনা দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ার একটি সুযোগ পেয়েছে। এরই মধ্যে ভারতে দেড়লাখ মানুষ করোনায় মারা গেছে। প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ মহামারিতে আক্রান্ত হচ্ছে আর মারা যাচ্ছে ৫শরও বেশি মানুষ। সর্বক্ষেত্রে একসাথে এভাবে নিম্নগামী যাত্রা ভারতের ইতিহাসে আগে কখনো দেখা যায়নি।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে