ওয়াইসি কি ভারতের ভবিষ্যত কিং মেকার

ইলাস্ট্রেশন করেছেন সৌরভ সিং - ওপেন দ্যা ম্যাগাজিন

  • ইলিয়াস হোসেন
  • ৩০ নভেম্বর ২০২০, ১০:২৭

ভারতের নিপীড়িত মুসলিমদের নতুন কণ্ঠস্বর হিসেবে দ্রুতই উপরে উঠে আসছেন আসাদউদ্দিন ওয়াইসি। সম্প্রতি বিহারের বিধানসভা নির্বাচনে চমক দেখিয়েছে তার দল। এবার তার টার্গেট পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও উত্তর প্রদেশ। ভারতের এই প্রদেশগুলোতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুসলমানের বাস। এসব রাজ্যের শত শত আসনে জয় পরাজয় নির্ধারণ হয় মুসলমানদের ভোটে। তাকে কাজে লাগিয়ে কিং মেকার হতে চান লন্ডন থেকে ব্যারিস্টারি ডিগ্রিধারী ও সুবক্তা আসাদ উদ্দিন ওয়াইসি।

বিহারের সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনে ৫টি আসন দখল করার পরে দক্ষিণ ভারতভিত্তিক অল ইন্ডিয়া মজলিশে ইত্তেহাদুল মুসলিমীন বা মিম কয়েক মাস পরে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা ভোটেও লড়ার কথা জানিয়েছে। বিহারে ২০ আসনে মিমের লড়াইয়ের কারণে হিন্দুত্ববাদী বিজেপি বিরোধী জোট বেশ কিছু আসনে হেরেছে বলে যে অভিযোগ উঠেছে, তাও খারিজ করে দিয়ে়ছেন সংগঠনটির প্রধান আসাদউদ্দিন ওয়াইসি।

ভারতের বিতর্কিত তিন তালাক রদ করার বিরোধিতা থেকে শুরু করে বাবরি মসজিদ ভাঙার ইস্যু বা নাগরিকত্ব আইন নিয়ে ওয়াইসি সোচ্চার ছিলেন। তাতে ভারতীয় মুসলিম সমাজের একটা বড় অংশ তাকে সেদেশে মুসলিমদের নতুন নেতার ভূমিকায় দেখতে শুরু করছেন।

প্রায় ৯৩ বছরের পুরনো রাজনৈতিক দল মিমের প্রভাব মাত্র কয়েক বছর আগেও হায়দরাবাদ শহরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। ওয়াইসি যেভাবে দেশের নতুন নতুন প্রান্তে জমি খুঁজে পাচ্ছেন তাতে তাকে ভারতীয় মুসলিম সমাজের উদীয়মান মুখ হিসেবে অনেকে দেখছেন তাকে। বিহারের পাশাপাশি এখন মহারাষ্ট্র থেকেও তাদের নির্বাচিত এমপি আছেন।

সমাজসেবার মাধ্যমে মুসলিমদের পাশাপাশি দলিতদেরও মন জয় করেছেন ওয়াইসি। বিশ্বের প্রভাবশালী ৫০০ মুসলিমের তালিকায় তিনি বারবার জায়গা করে নিয়েছেন। এখন পর্যন্ত চারবার সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন এই জনপ্রিয় রাজনীতিক। মুসলিম তরুণ-তরুণীরা বলছেন, ওয়াইসির রাজনীতি তাদেরকে আকৃষ্ট করেছে। কারণ, তিনি একজন বলিষ্ঠ একজন নেতা এবং ব্যক্তিগত জীবনে কলুষমুক্ত ।

পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে ওয়াইসি তথা মিমের প্রবেশ কতটা প্রভাব ফেলতে পারে - এ নিয়ে রাজনৈতিক মহলে চলছে আলোচনা। মিমের আগমনী বার্তায় সমূহ বিপদ দেখছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম সমাজের একাংশ বলছে, ওয়াইসি যেভাবে কড়া ভাষায় মুসলিম সমাজের অনুন্নয়নের কথা বলে থাকেন, তা অনেক ক্ষেত্রেই সত্য। আগামী বছরের এপ্রিল-মে মাসে ভোট নেওয়া হতে পারে পশ্চিমবঙ্গ আর আসামে। ২০২২সালে ভোট হবে উত্তরপ্রদেশে।

পশ্চিমবঙ্গে মিমের লড়াইয়ের কারণে বিজেপি বিরোধী ভোট ভাগাভাগি হয়ে যেতে পারে বলে রাজনৈতিক মহলে আলোচনা চলছে। তাতে লাভ হতে পারে বিজেপির আর ক্ষমতা হারাতে পারেন মমতা। একই অবস্থা হয়েছে বিহারে। এ কারণে মিমকে কেউ কেউ বিজেপির বি টিম বলে সমালোচনা করে থাকে। তবে বিজেপির একজন কট্টর সমালোচক ওয়াইসি।

পশ্চিমবঙ্গে মিমের নেতারা বলছেন, আমরাও কখনও চাই না যে বিজেপি জিতুক। সেজন্যই ওয়াইসি বিহারে এবারের নির্বাচনের আগে কংগ্রেস জোটের কাছে অনুরোধ করেছিলেন জোটে সামিল করার জন্য। কিন্তু কংগ্রেস তাতে রাজী হয়নি। পশ্চিমবঙ্গেও যদি কেউ সঙ্গে না নেয় এখানেও তাই হবে । মিম নেতারা জানিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গেও ইতোমধ্যে তৃণমূল কংগ্রেমকে চিঠি দিয়ে জোটে সামিল হওয়ার অনুরোধ করেছে। কিন্তু তাতে সাড়া দেয়নি তৃনমুল কংগ্রেস। তাদের বক্তব্য যদি যথেষ্ট সংখ্যক আসন ছাড়া হয় তাহলে তৃণমূলের সাথে কাজ করতে রাজী আছে মিম।

বিজেপির বিরুদ্ধে ভোটে লড়ার জন্য সব রাজনৈতিক সামাজিক সংগঠনগুলোর কাছে আহ্বান জানিয়ে মুসলিম সামাজিক সংগঠনগুলোর একাংশ ইতিমধ্যেই প্রচার শুরু করেছে। ফেসবুকে এরকম বেশ কিছু ভিডিও ইতিমধ্যেই সামনে এসেছে যেখানে সব রাজনৈতিক দলগুলোর উদ্দেশ্যে বলা হচ্ছে যে মিমকেও যেন বিজেপি-বিরোধী জোটে সঙ্গে নেওয়া হয়।

পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভায় ২৯৪টি আসন। তার মধ্যে ৯৪টি আসনে লড়তে চাইছে মিম। নির্বাচন বিশ্লেষকরা বলছেন, ২৯৪টির মধ্যে এমন ৯৮টি আসন আছে, যেখানে মুসলমান ভোটাররাই জয়-পরাজয় নির্ধারণ করেন। উত্তর দিনাজপুর ৫০ শতাংশ, মালদহে ৫৯ শতাংশ এবং মুর্শিদাবাদে ৬৬ শতাংশ মুসলিম ভোটার। এছাড়াও বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনাতেও মুসলমান জনসংখ্যা ৪০ শতাংমের মতো।

মিমের টার্গেট হবে রাজ্যের মুসলিম অধ্যুষিত আসনগুলিই। গত তিন বছর ধরে তারা সংগঠন মজবুত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে তারা অন্তত ১৫ টি জেলায় সংগঠন বিস্তার করেছেন। তাদের অভিযোগ, মমতার নেতৃত্বাধীন তৃণমূল সরকার রাজ্যের সংখ্যালঘুদের জন্য কিছুই করেনি। সংখ্যালঘুরা দেশের মধ্যে সব থেকে গরিব। তাঁদেরকে রাজনৈতিক দলগুলি কেবলমাত্র ভোটব্যাঙ্ক হিসেবেই ব্যবহার করছে বলে অভিযোগ মিমের।

পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন বিশেষজ্ঞ সব্যসাচী বসু রায় চৌধুরী বলেন, মিম যেসব এলাকায় প্রভাব বিস্তার করেছে, সেগুলো মূলত বিহার লাগোয়া উত্তর দিনাজপুর, মালদা বা মুর্শিদাবাদ এসব অঞ্চল। এখানে একদিকে যেমন মুসলিম ভোটারদের আধিক্য আছে, আবার এগুলো বিহারের সেই সব এলাকার পাশেই, যেখানে ওয়াইসির দল এবার ভোটে জিতেছে। আবার কলকাতা বা পার্শ্ববর্তী যেসব এলাকায় উর্দুভাষী মুসলমানরা থাকেন, তাদের মধ্যেও মিমের একটা সমর্থন গড়ে উঠেছে। তাই এইসব ফ্যাক্টরগুলো ভোটের ফলাফলে ভালই প্রভাব ফেলবে বলে আমার ধারণা।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সিনিয়র সাংবাদিক অরুন্ধতী মুখার্জী বলেন, ওয়াইসি যেসব প্রশ্ন তুলছেন রাজ্যের মুসলিমদের অনুন্নয়নের ক্ষেত্রে, সেগুলোকেও মুসলিম সমাজের একাংশ সমর্থন করছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর বিরুদ্ধে একটা কথা অনেক সময়ই বিজেপি বলে থাকে যে তিনি মুসলমান তোষণের রাজনীতি করছেন। ওয়াইসি যে প্রশ্নগুলো তুলছেন তা হল মমতা ব্যানার্জী মুসলমানদের সঙ্গে আছেন বলে কিছুটা লোক দেখানো রাজনীতি করছেন, আদতে মুসলমানদের অর্থনৈতিক বা শিক্ষাক্ষেত্রে উন্নতি কিছুই হচ্ছে না।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক সব্যসাচী চৌধুরী বলেন, পশ্চিমবঙ্গে সরকারি প্রকল্পগুলোর মধ্যে বিশেষ করে কন্যাশ্রী খুবই উপকারী এবং ভাল একটা প্রকল্প। কিন্তু সেটির নামের সঙ্গে যখনই 'শ্রী' যোগ করা হল, তার মধ্যে কি একটা হিন্দু টোন চলে এল না? তবে কংগ্রেসের নেতারা সরাসরি বলছেন ওয়াইসির দল মুসলিম ভোট কেটেছে বলেই বিজেপি জোট বিহারে আবার ক্ষমতায় আসতে পেরেছে। কংগ্রেস নেতা দিগি¦জয় সিং বিহার নির্বাচনের ফল বেরোনোর পর ওয়াইসিকে 'ভোট কাটুয়া' বলেছেন। আসাদউদ্দিন ওয়াইসি এই অভিযোগ জোরালোভাবে অস্বীকার করে বিবিসিকে বলছেন, ভারতীয় মুসলিমরা তাকে বিজেপির উপযুক্ত জবাব হিসেবে দেখছেন বলেই বিভিন্ন রাজ্যে বেছে নিচ্ছেন।

বিহারের সাফল্যের পর ওয়াইসি বলেন, আমার ইতিহাস মানুষ জানে না। বারো-তেরো বছর বয়স থেকে শুনছি আমাদের বাড়ির সামনে এসে আরএসএস গুন্ডারা নোংরা স্লোগান দিচ্ছে, ওয়াইসি কবরে যাও কিংবা পাকিস্তানে। ভেতর থেকে এটা আমাকে আরও শক্ত করে তুলেছে, প্রতিবাদ করে জেলে গিয়ে পুলিশের মারও খেয়েছি। কোনও শিসমহল থেকে আমি রাজনীতিতে আসিনি, কেউ আমার জন্য মখমলের কার্পেটও বিছিয়ে রাখেনি। ফলে কে কী বলল আমার কিচ্ছু যায় আসে না। আর ভোট-কাটুয়া বা বি-টিম পুরনো হয়ে গেছে - অক্সফোর্ড অভিধান ঘেঁটে বরং নতুন গালাগালি খুঁজতে বলব তাদের।

তবে শুধু মুসলিমদের সঙ্গে নিচ্ছেন না তিনি দলিত এবং ধর্মনিরপেক্ষ হিন্দুদেরও সঙ্গে নিতে চান ওয়াসি।

ওয়াইসিকে অনেকে বলেন, ‘হায়দরাবাদ কে মহল্লা কা লিডার’ বা হায়দারাবাদের ছোট নেতা। তবে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, ভারতের গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যগুলোতে মুসলমানরা জয় পরাজয়ের নির্ধারক হওয়ায় ওয়াইসি ভবিষ্যতে কিং মেকার হতে পারেন।

ভারতের হিন্দিভাষী অঞ্চলের রাজনীতিতেও প্রভাব বিস্তার শুরু করেছেন ওয়াসি। সেখানে মুসলিম ভোট কথিত সেক্যুলাররা পেয়ে আসছেন। ওয়াইসি চাচ্ছেন মুসলিম ভোটকে সংহত করে বিভিন্ন রাজ্যে অন্যান্য দলের সঙ্গে জোট করে আসন বাড়াতে। এজন্য আঞ্চলিক দল বহুজন সমাজ পার্টি ও রাষ্ট্রীয় লোক সমতা পার্টির সঙ্গে জোট করেছেন ওয়াইসি।

ভারতের সবচেয়ে জনবহুল রাজ্য উত্তর প্রদেশ নির্ধারণ করে থাকে ভারতের কোন দল কেন্দ্রে সরকার গঠন করবে। সেখানে ২০ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে মুসলিম জনসংখ্যা সাড়ে চার কোটির মত। জনসংখ্যার ২০ ভাগই মুসলিম। কে না জানে ২০ ভাগের মধ্যে বড় একটা অংশের সমর্থন পেলে তিনিই হতে পারেন কিং মেকার। ওয়াইসির পক্ষে সেটা অসম্ভব নয়।

ভারতে বাস করেন ২০ কোটির বেশি মুসলমান। ভারত বিশে^র দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম জনসংখ্যার দেশ। দেশটির জনসংখ্যার ১৫ শতাংশের বেশি মুসলমান। বিশে^র মোট মুসলিমের ১২ শতাংশের বাস দেশটিতে। শতশত বছর মুসলমানরা ভারত শাসন করেছে। কিন্তু এখন শিক্ষাদীক্ষা, সংসদে প্রতিনিধিত্ব ও সরকারি চাকরিসহ সব জায়গায় তারা চরমভাবে পিছিয়ে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারতের মুসলমানরা দেখছে যে বিভিন্ন ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দল তাদের শুধুই ভোট ব্যাঙ্ক হিসাবে ব্যবহার করে এসেছে এতদিন। কোনও দলেই বড়মাপের কোনও নেতা নেই যিনি মুসলিম বা দলিত শ্রেনী থেকে উঠে এসেছেন। এই শ্রেণীর মানুষের মধ্যে যে আকাঙ্খা তৈরি হয়েছে, সেটার বহিঃপ্রকাশের জায়গা নেই। এই জায়গাটাই কাজে লাগাচ্ছেন ৫১ বছর বয়সী আসাদউদ্দিন ওয়াইসি।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে