মোদির চ্যালেঞ্জ

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির চ্যালেঞ্জ নিয়ে কার্টুনটি করেছেন নীলাভ - ফার্স্ট পোস্ট ডটকম

  • মেহেদী হাসান
  • ১০ জুন ২০২০, ২১:২৬

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বড় ধরনের দুটি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন। একটি হলো অর্থনীতি। আরেকটি নিরাপত্তা। লকডাউন তুলে নেয়া হচ্ছে। কিন্তু তাতে তেমন সুফল আসছে না। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, শিল্প কারখানা চলছে না। কারণ একদিকে শ্রমিক সঙ্কট। অপর দিকে ক্রেতা নেই। রপ্তানি বন্ধ । লকডাউন শিথিলের পরও অর্থনীতির করুন চিত্রের আরেকটি বড় কারন হলো করোনা পরিস্থিতির ক্রমাবনতি। করোনা পরিস্থিতির অবনতির ফলে আশঙ্কা করা হচ্ছে আরো বড় ধরনের দুর্যোগের। ভারতের অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা পরিস্থিতির নানা দিক আজ আমরা তুলে ধরবো।

করোনার কারনে ভারতের অর্থনীতি যখন বিপর্যন্ত তখন ভারতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবর এসেছে লাদাখ সীমান্তে ভারতের অভ্যন্তরে অবস্থান করছে হাজার হাজার চীনা সৈন্য।

মাত্র কয়েক বছর আগেও ভারত চীনকে মনে করত তাদের প্রতিযোগী। কিন্তু হঠাৎ করে ভারত চীনকে গণ্য করে তাদের প্রধান শত্রু। চীন বিষয়ে ভারত ভ্রান্তির মধ্যে রয়েছে। ফলে বার বার সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হচ্ছে।

সামরিক, অর্থনীতি, প্রযুক্তি, রাজনীতিসহ গুরুত্বপূর্ণ সব দিক দিয়ে ভারত যে চীনের থেকে অনেক অনেক পেছনে এটি যেন ভারত মেনে নিতে পারছে না। বরং চীনের সাথে একটি অসম প্রতিযোগিতা আর লড়াইয়ের মুখোমুখি হয়েছে।

অপরদিকে চীনের সাথে নিজের শক্তির ভারসাম্যহীনতার কারনে যুক্তরাষ্ট্রকে তাদের প্রধান কৌশলগত মিত্র বানিয়েছে। কিন্তু সুফল তেমন মিলছে না। বরং চীন- যুক্তরাষ্ট্র ঠান্ডা লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়েছে এবার ভারত। চীনের বিশ্বাস ভারত এখন আরো বৃহত্তর পরিসরে ভূ-কৌলশগত গেমে যুক্তরাষ্ট্রের প্রক্সি হিসেবে ভূমিকা পালন করবে।

এমন পরিস্থিতির মধ্যে আড়াই মাস পর ধীরে ধীরে তুলে নেয়া হচ্ছে ভারতের লকডাউন। খুলছে ভারতের অর্থনীতি। আর সেই সাথে আসছে মহামন্দাও । ২২ বছরেরর মধ্যে সবচেয়ে কম বিনিয়োগের ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে এ বছর। লকডাউন শিথিলের মাধ্যমে অর্থনীতি চালু হওয়ার আশা করা হচ্ছে। কিন্তু পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে দীর্ঘ সময় লাগবে।

অর্থনীতিবিদদের মতে ২০২০-২১ অর্থ বছরে ভারতের জিডিপি মাইনাস ৭ থেকে শুন্যের ঘরে নেমে আসতে পারে। আর এটা হবে ১৯৭০ সালের চেয়েও বড় আকারের মন্দা।

সর্বশেষ সরকারি তথ্য অনুসারে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ভারতের অর্থনীতি বৃদ্ধি পেয়েছে ৪ দশমিক ২ ভাগ হারে যা গত এক দশকে সবচেয়ে ধীর গতির। ভারতে দীর্ঘ লকডাউনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত লাখ লাখ খুচরা বিক্রেতা, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা এবং কারাখানা আর সার্বিক ব্যবসা বানিজ্য। করোনায় আক্রান্ত আর মৃত্যুর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ার কারনে সামনের ভবিষ্যতও অন্ধকার।

লকডাউন শিথিলের কারনে অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলা হলেও পুরোপুরি সচল হচ্ছে না। কারন রপ্তানি বন্ধ এবং শ্রমিক সঙ্কট। ম্যানফ্যাকচারিং খাতের তথ্য অনুসারে লকডাউনে ভারতে উৎপাদন কমেছে ৫০ ভাগ। ম্যাস মাইগ্রেশনের ফলে বিভিন্ন রাজ্য ছেড়ে চলে গেছে শ্রমিকরা। রাজধানী দিল্লীতে শুধু নির্মান খাতে ৪০ ভাগ শ্রমিক ঘাটতি দেখা দিয়েছে।

ভারতে রয়েছে ৬ কোটি ৩০ লাখ ক্ষুদ্র, ছোট এবং মধ্যম আকারের ব্যবসা । জিডিপিতে তাদের অবদান ২৯ শতাংশ। সরকারি তথ্য অনুসারে ৩ লাখ ৩০ হাজার ছোট এবং ৫ হাজার মধ্যম মানের উদ্যোক্তা রয়েছে। ভারতের অর্ধেক রপ্তানির ক্ষেত্রে তারা মূল ভ’মিকা পালন করে। ভারতের অর্থনীতির মেরুদন্ড হিসেবে পরিচিত ছোট এবং মধ্যম মানের উদ্যোক্তা লকডাউনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

মে মাসের প্রথম তিন সপ্তাহে প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক ট্রেনে বাড়ি ফিরেছে। এদের মাধ্যম গ্রামে করোনা আরো ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে বলে মনে করা হচ্ছে। ভারতে করোনা আক্রান্ত সর্বোচ্চ স্তরে পৌছতে এখনো অনেক দেরি। জুলাইয়ে সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি সৃষ্টির আশঙ্কা করা হচ্ছে। চিকিৎসার দুরবস্থার কারনে বেড়ে যেতে পারে মৃত্যুর হার। যেভাবে প্রতিদিন আক্রান্ত এবং মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে চলেছে তাতে চিকিৎসকরা শঙ্কিত এটি নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যেতে পারে। সব রাজ্যে এক সাথে দেখা দেয়ার পরিবর্তে ধীরে ধীরে এটি একেক রাজ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা ভারতে করোনা অনেক দিন অব্যাহত থাকবে।

আভ্যন্তরিন এমন পরিস্থিতির মধ্যে নিরাপত্তা সংকটে পড়েছে ভারত। লাদাখে ভারতের সড়ক ও সামরিক অবকাঠামো নিয়ে চীন-ভারত মুখোমুখি দাড়িয়েছে। ভারতের দাবি লাইন অব কন্ট্রোলের ১০ কিলোমিটার ভেতরে চীনের পিপলস আর্মি রাস্তা নির্মান করছে। কিন্তু চীনের আপত্তি রয়েছে লাইন অব কন্ট্রোল নিয়ে।

ভারতের উত্তর পূর্বে চীন ৯০ হাজার বর্গকিলোমিটার নিজেদের এলাকা দাবি করে। ভারতের অভিযোগ পশ্চিম হিমলয়ে আকসাই চীনে তাদের ৩৮ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা চীন দখল করে রেখেছে। এর মধ্যে লাদাখের কিছু অংশ রয়েছে।

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে কূটনৈতিক চ্যনালে শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে চীন ভারত লাদাখ সীমান্ত সমস্যা সমধানে রাজি হয়েছে। ভারতের অভিযোগ চীনা সৈন্য মে মাসে তিনবার তাদের সীমান্তে প্রবেশ করেছে। সর্ব্বোচ্চ পর্যায়ের সেনা কমকর্তারা বৈঠক করেছেন। কিন্তু এরপরও সমস্যার দ্রুত সমাধান হবে এমন নয়।

চীনের সাথে উত্তেজনার মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার সাথে একে অপরের সামরিক ঘাটি ব্যবহারের চুক্তি স্বাক্ষর করেছে ভারত। এ অঞ্চলে চীনের সামরিক ও অর্থনৈতিক উত্থান মোকাবেলায় যে এ নিরাপত্তা চুক্তি তা বোঝা কঠিন নয়। ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় থেকে বলা হয়েছে এ চুক্তির ফলে উভয় দেশের সামরিক বিনিময় এবং ইন্দো-প্যাসেফিক অঞ্চলে মহড়ার পথ পরিষ্কার হলো।

চুক্তি অনুসারে উভয় দেশের রণতরী এবং যুদ্ধ জাহাজ জ্বালানি তেল সংগ্রহ, মেরামতসহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করতে পারবে। যুক্তরাষ্ট্রের সাথেও ভারতের সামরিক চুক্তি রয়েছে।

ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসহারে ভারতের বার্ষিক নৌ মহড়ায় যুক্তরাষ্ট্র, জাপানের সাথে অস্ট্রেলিয়াকেও যুক্ত করার চেষ্টা করছে। ২০০৭ সালে ভারত এ ধরনের চারদেশীয় যৌথ মহড়া চালায় যা চীনকে উদ্বিগ্ন করে তোলে।

চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং পিপলস লিবারেশন আর্মিকে যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণকে ভারতের প্রতি এখন পর্যন্ত সবচেয়ে যুদ্ধংদেহী বার্তা হিসেবে মনে করেন অনেক বিশ্লেষক ।

১৯৬২ সালের যুদ্ধে ভারতের শোচনীয় পরাজয় হয় এবং এ অঞ্চলে চীনের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে শুধু লাদাখ নয় চীন-ভারত সীমান্তে অনেক স্থানে দুদেশের সৈন্যরা মুখোমুখি দাড়িয়ে আছে। বর্তমানে লাদাখ ঘিরে যে উত্তেজনা চলছে তার শুরু হয়েছে মে মাসে। মে মাসের শুরুতে সিকিম সীমান্ত এলাকা থেকে উত্তেজনা শুরু হয়। ২০১৯ সালে কাশ্মীরের সাথে লাদাখকেও কেন্দ্রীয় শাসনের অধীনে নেয়ার ঘোষণা দেয় ভারত। এ থেকে মুলত সঙ্কটের শুরু। কিন্তু এর শেষ কোথায়?

অনেক দিন ধরে ভরতের উদীয়মান সুপার পাওয়ার হিসেবে আর্বিভুত হওয়ার কথা আলোচিত হচ্ছে। উদীয়মান এ সুপার পাওয়ার হওয়ার চেষ্টার ইমেজের বিপরীতে রয়েছে ভারতের ভিন্ন আরেক চিত্র।

আঞ্চলিক শক্তি হিসেবেও চীনের সাথে তুলনায় ভারতের অবস্থান অনেক পেছনে। অর্থনীতি, সামরিক, প্রযুক্তি, বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্বনির্ভরতার তুলনায় চীনের সাথে ভারতের তুলনার কোনো সুযোগ নেই। চীনের জিডিপ ১৪ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। অপর দিকে ভারতের জিডিপি ২ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ইউএস ডলার। চীনের জিডিপি ভারতের চেয়ে প্রায় ৫ গুন এবং সামরিক বাজেট তিনগুন বেশি।

২০১৯ সালের মার্চ পর্যন্ত চীনের সাথে ভারতের বাণিজ্য ঘাটতি ৫৩ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু ভারতের নীতি নির্ধারকরা চীনের সাথে তাদের ব্যবধান মানতে যেন রাজি নন। বিশেষজ্ঞদের মতে চীন বিষয়ে ভারত একটি বড় ধরনের ভ্রান্তি দ্বারা পরিচালিত। বিশেষজ্ঞদের মতে ভারত অনর্থক চীনকে তাদের প্রতিপক্ষ বানিয়েছে এবং অসম এক প্রতিযোগিতা ও লড়াইয়ে লিপ্ত হয়েছে।

চীনের মোকাবেলায় নিজের অসামর্থ্যের কারনে ভারক তাদের কৌশলগত মিত্র বানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রকে। চীনকে মোকাবেলায় তারা এ অঞ্চলে জাপান, অস্ট্রেলিয়াসহ অন্যান্য দেশের সাথে জোট গঠনের চেষ্টা করছে। এতে করে কেবল চীনের সাথে তাদের সম্পর্ক তিক্ত হচ্ছে ।

অপর দিকে যুক্তরাষ্ট্রকে কৌশলগত মিত্র বানালেও চীনের মোকাবেলায় ভারত যা অর্জন করতে চাচ্ছে বাস্তবে তা অর্জিত হচ্ছে না। ২০১৪ সাল পর্যন্ত ভারত চীনকে তাদের প্রতিযোগী হিসেবে বিবেচনা করছে। কিন্তু ২০১৫ সালের পর থেকে ভারত চীনকে প্রধান শত্রু গণ্য করা শুরু করে। কারো কারো মতে জয় শঙ্কর ভারতের পররাষ্ট্র সচিব নিযুক্ত করার পর থেকেই আকস্মিক এ পরিবর্তন ঘটে।

২০১৭ সালে চীন-ভারত ডোকলামে সংঘাতের দ্বারপ্রান্তে পৌছে। ডোকলামে ভারতের বড় ধরনের কূটনৈতিক পরাজয় ঘটে। ডোকলামে রাস্তা নির্মানে চীনা সৈন্যদের ভারতীয় সৈন্যরা বাধা দেয়ার পর সংঘাত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। ডোকলামকে ভুটান তখন নিজের বলে দাবি করে। ভারতের এ ধরনের ভুল সিদ্ধান্ত চীনের সাথে দেশটির সর্ম্পক আরো জটিল করে তুলবে।

প্রতিবেদনটির ভিডিও দেখুন

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে