মহামারিতে বদলে যাচ্ছে পৃথিবী

বৈশ্বিক উষ্ণতার সাথে করোনার সম্পর্ক। ইলাস্ট্রেশনটি করেছেন রোহিত ফোরে - ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস

  • সেতারা কবির সেতু
  • ১৮ জুলাই ২০২০, ১৯:২৫

১৯২৯ সালের ৪ সেপ্টেম্বর স্টক বাজারের দর পতনের পর যুক্তরাষ্ট্রে শুরু হয় মহামন্দা। ১৯২৯ -১৯৩২ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী জিডিপি ১৫ শতাংশ হ্রাস পায়। ব্যক্তিগত আয়, কর, মুনাফা ও মূল্যমানের ব্যাপক পতন ঘটে। আন্তর্জাতিক বানিজ্য ৫০ শতাংশ কমে যায়। শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই বেকারত্ব ২৫ শতাংশ বেড়ে যায়। কিছু কিছু দেশে বেকারত্বের হার দাঁড়ায় ৩৩ শতাংশে।

ডব্লিউএফপি এর প্রধান ডেভিড ব্যাসলি কানাডার 'দ্যা গ্লোব অ্যান্ড মেইল ' পএিকাকে দেওয়া সাক্ষাতকারে আশংকা প্রকাশ করেছেন যে, প্রয়োজনীয় তহবিল পাওয়া না গেলে বৈশ্বিক মহামারির এ সময়ে অনাহারে অন্তত ৩ কোটি মানুষের মৃত্যু হতে পারে।আর সেটি হতে পারে মাএ ৩ মাসে।করোনা পরবর্তী সময়ে প্রতিদিন ৩ লাখ মানুষের মৃত্যু হতে পারে।

বিশ্বের প্রায় সব দেশই বলছে করোনা পরবর্তীতে অর্থনৈতিক সংকট হবে দীর্ঘমেয়াদি।এ সময় বিশ্বব্যাপী দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে।ভারী শিল্পের উপর এর প্রভাব পরবে বেশি।প্রয়োজনীয় উপকরণের স্বল্পতা, বন্যার জন্য কৃষিখাতও চরম ঝুঁকিতে পরবে।

বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ।বিশ্বব্যাংকের হিসাব মতে,বাংলাদেশ এখনো প্রায় ৮৭ ভাগ মানুষের আয়ের উৎস কৃষি। শহরে বসবাসকারী ১১ শতাংশ মানুষ সরাসরি কৃষিকাজে যুক্ত। দেশের মোট শ্রমশক্তির ৪৫.৭ শতাংশ কৃষিতে নিয়োজিত রয়েছে। কিন্তু করোনার আগ্রাসন থেকে রেহায় পায়নি কৃষিখাতও। বর্তমান পরিস্থিতে কৃষক তার উৎপাদিত ফসল বিক্রি করতে পারছে না। আবার উপকরন সরবরাহের অপ্রতুলতা এবং বন্যার জন্য আগামীতে উৎপাদন কমে আসার শঙ্কা করা হচ্ছে। দেশে খাদ্য সংকট দেখা দেওয়ার আশংকা রয়েছে।

এ অবস্থায় আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে খাদ্য নিরাপত্তা র উপর।বৃদ্ধি করতে হবে খাদ্যের উৎপাদন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শুরু থেকেই খাদ্য উৎপাদনের উপর গুরুত্ব দিয়ে আসছেন।তিনি করোনা পরিস্থিতির প্রথম থেকেই বলছেন বিন্দু পরিমাণ জমিও যেন অনাবাদী না থাকে।খাদ্য মজুদ রাখলেই আগামীতে আমরা নিরাপদ থাকব।

বর্তমান পরিস্হিতিতে আমরা সকলেই খাদ্যের নিরাপত্তার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারছি।তাই আমরা বাড়ির আশপাশ, ফাঁকা জায়গাগুলোতে শাক,সবজি চাষ করতে পারি।এই সবজি নিজের পরিবারের চাহিদা পূরনের পাশাপাশি প্রতিবেশীদেরও চাহিদা পূরন করবে।

বাংলাদেশে মোট গ্রাম ৮৭,৩১৯ টি। মোট জনসংখ্যার অধিকাংশ বসবাস করে গ্রামে।গ্রামের ৮৭ শতাংশ মানুষের আয়ের উৎস কৃষি। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে আমরা খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারি। বাংলাদেশের কর্মসংস্থানের সবচেয়ে বড় খাত কৃষি। ২০১৭-২০১৮ অর্থ বছরে দেশের জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ১৪.২৩ শতাংশ এবং ২০১৮-২০১৯ অর্থ বছরে জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ১৩.৬৫ শতাংশ। পরিসংখ্যানে দেখা যায় দিন, দিন অর্থনীতিতে কৃষি খাতের অবদান কমছে। কৃষি খাতের উন্নয়নের মাধ্যমে আমরা গ্রামীণ অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে পারি।

কৃষি খাতের উন্নয়নের পাশাপাশি গ্রামীণ অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা ও তত্ত্বাবধান করতে পারি।

শিক্ষার সম্প্রসারণ
২০১৯ সালের সমীক্ষা অনুযায়ী বর্তমানে বাংলাদেশে শিক্ষার হার ৭৩.৯ শতাংশ। সংবিধানের ১৭ নংঃ অনুচ্ছেদে শিক্ষা সম্পর্কে বলা হয়েছে - বাংলাদেশের শিক্ষা হবে একই ধরনের জনমুখী ও সার্বজনীন। কিন্তু আমরা একটু লক্ষ্য করলেই দেখতে পায়, শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রায় আধুনিক সুযোগ, সুবিধা ভোগ করছে শহরের শিক্ষার্থীরা।গ্রামের অনেক শিক্ষার্থী এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত।

তবে সরকার গ্রামে আধুনিক শিক্ষা সম্প্রসারণের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে এবং সেগুলো পরিচালনা করছে। শিক্ষার মাধ্যমেই মানুষ নিজেকে দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারে। তাই গ্রামগুলোতে শিক্ষা এবং নারী শিক্ষার ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটাতে হবে।

প্রশিক্ষণ
প্রত্যেক মানুষের মধ্যে সুপ্ত প্রতিভা রয়েছে। যথাযথ শিক্ষা, প্রশিক্ষণ এবং উপযুক্ত সুযোগ পেলে মানুষ সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটিয়ে নিজের এবং সমাজের উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পারে।কিন্তু দেখা যায়, গ্রামের অসংখ্য যুবক সঠিক দিক নির্দেশনার অভাবে তারা বুঝতে পারে না কি করবে। স্কুল, কলেজ থেকে ঝরে পড়া অনেক কিশোর মাদকে আসক্ত হয়ে যায় আবার অনেকেই জীবিকার সন্ধানে শহরে পাড়ি জমায়। এসকল যুবক ও কিশোরদের যথাযথ কারিগরি ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ দেওয়ার মাধ্যমে সমাজের গঠনমূলক কাজে সম্পৃক্ত করা যায়।

উদাহরণ
★ সবজি চাষের সকল প্রশিক্ষণ দিয়ে তরুণ, বেকার, উদ্যোমী যুবকদের উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।

★ মৎস্য ও পশু পালনের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের খামারী হতে সাহায্য করা যেতে পারে।

★ বীজ রোপন,গাছের পরিচর্যা, উৎপাদন বৃদ্ধি এসকল বিষয়েও প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে।

এক্ষেত্রে প্রশিক্ষণের পাশাপাশি সহজ শর্তে ঋণ প্রদানের বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে।

সম্পদের সদ্ব্যবহার
গ্রাম বাংলায় যে সম্পদগুলো আছে সেগুলোর যথাযথ ব্যবহার করা হলে গ্রামের মানুষদের জীবিকার তাগিদে আর শহরে আসার প্রয়োজন হয় না। গ্রামের প্রায় সকল মানুষই ধান,গমসহ অন্যান্য সবজি চাষাবাদ করে। গ্রামের অধিকাংশ বাড়িতে বছরের খাবার হিসেবে ধান সিদ্ধ করে চাল করে নেওয়া হয়। অনেকেই সবজি চাষাবাদ করে। ফলে নিজেদের খাদ্যের চাহিদা তারা পূরণ করতে পারে।আবার অনেকেরই পুকুর আছে সেগুলোতে বানিজ্যিক ভাবে মাছ চাষের পাশাপাশি নিজেদের পরিবারের চাহিদাও তারা পূরণ করে।গরু,ছাগল, হাঁস, মুরগী আছে অনেকের। এগুলো তাদের অর্থনৈতিকভাবে সমর্থন দেওয়ার পাশাপাশি আমিষের চাহিদা পূরণ করতেও সহায়তা করে।তাই সবাই নিজেদের সম্পদের সদ্ব্যবহার করে নিজেদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়নের পাশাপাশি সমাজের উন্নয়নেও অবদান রাখতে পারে।

সহজ শর্তে ঋণ প্রদান
কৃষকরা যাতে সহজ শর্তে এবং স্বল্প সুদে ঋণ পেতে পারে সেই বিষয়ের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে।অনেক ভূমিহীন ও প্রান্তিক কৃষক রয়েছে যারা শুধু অর্থের অভাবে অন্যের জমিতে বর্গাচাষ করে।এসকল কৃষকরা যে অনুযায়ী পরিশ্রম করে সেই অনুযায়ী পারিশ্রমিক পায় না। তাই কৃষি ঋণের ক্ষেত্রে সকল জটিলতা দূর করতে হবে।সেই সাথে অসহায় ও দরিদ্র কৃষকরা যাতে ঋণ সুবিধা থেকে বঞ্চিত না হয় সেই বিষয়ের প্রতিও গুরুত্ব দিতে হবে।

প্রণোদনার সুষম বণ্টন
১২ এপ্রিল কৃষি খাতে ৫০০০ কোটি টাকার একটি প্রণোদনা ঘোষণা করেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ৪ শতাংশ সুদে ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকরা এই প্রণোদনা পাবে।কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কৃষি ও পল্লী ঋণ নীতিমালা অনুযায়ী, ব্যাংগুলোর মোট লক্ষ্যমাত্রার নূন্যতম ৬০ শতাংশ শস্য ও ফসল খাতে ঋণ বিতরণের নির্দেশনা রয়েছে।সে হিসেবে চলতি ২০১৯-২০২০ অর্থ বছরে ব্যাংকগুলোর জন্য নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা ২৪ হাজার ১২৪ কোটি টাকার ৬০ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ১৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা শস্য ও ফসল খাতে ঋণ বিতরণ করা যাবে।শস্য ও ফসল খাত ছাড়া কৃষির অন্যান্য চলতি মূলধন নির্ভরশীল খাত যেমন- মৌসুম ভিক্তিক ফুল ও ফল চাষ,মৎস্য চাষ,পোল্ট্রি, ডেইরী ও প্রাণিসম্পদ খাতে এই তহবিল থেকে ঋণ দেওয়া যাবে।তবে কোন একক খাতে ব্যাংকের অনুকূলে বরাদ্দ ঋণের ৩০% বেশি ঋণ বিতরণ করা যাবে না।আমাদের সকলের প্রত্যাশা কৃষকদের জন্য প্রণোদনার যে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে তা যেন কৃষকদের মাঝে সুষমভাবে বন্টন করে দেওয়া হয়।

# যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, স্বাস্থ্য সেবা বৃদ্ধি, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, সচেতনতা সৃষ্টি ইত্যাদির মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতি শক্তিশালী করা যায়।

বাংলাদেশের সংবিধানের ১৬ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, শহর ও গ্রামের মধ্যে বৈষম্য দূর করতে হবে। আর এই লক্ষ্য অর্জনে সম্মিলিতভাবে সবাইকে কাজ করতে হবে। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং গ্রামীণ অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা সম্ভব।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে