দশ বছরে দ্বিগুণ মুসলিম জাপানে


  • মুরশিদুল আলম চৌধুরী
  • ২২ জানুয়ারি ২০২১, ০৭:২৭

জাপানের বড় দ্বীপগুলোর একেবারে দক্ষিণে কিয়ুশু দ্বীপ। এ দ্বীপের বেপ্পু-কে বলা হয় ‘হট স্প্রিং’ বা উষ্ণ প্রস্রবণের মক্কা।

শুক্রবার। বেপ্পু শহরের সাদামাঠা চারতলা এক ভবনের দিকেই সবার পথ। সবাই যাচ্ছেন দলে দলে। নারী-পুরুষ সবাই। আছেন রিতসুমেইকান এশিয়া-প্যাসিফিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরাও। শহরের এখানে-ওখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা হোটেলকর্মী কিংবা ফিশিং বোট ও শিপইয়ার্ডে কাজ করা লোকজনও আছেন। তারা সবাই জুমার নামাজ আদায় করতে যাচ্ছেন। কী অসাধারণ মনজুড়ানো দৃশ্য! এক সময় জাপানের মতো দেশে এ ধরনের চিত্র সহজে মিলত না। এখন বেশ দেখা যায়।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিদেশি শ্রমিক ও শিক্ষার্থীদের স্বাগত জানিয়েছে জাপান সরকার। অনেক মুসলিম যাচ্ছেন কাজ করতে কিংবা পড়ালেখা করতে। এ কারণে সেখানে মুসল্লিদের এ ধরনের সারি বাড়ছে। এ কারণের সঙ্গে বড় যে বিষয়টি উল্লেখ করার মতো, সেটা হলো, জাপানে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের ঘটনা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় নিয়ে শান্তি খুঁজছেন তারা।

ওয়াসেদা বিশ্ববিদ্যালয়ের তানাদা হিরোফুমি জানালেন, দেশটিতে গত এক দশকে দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে মুসলিম ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা। ২০১০ সালে যে সংখ্যাটা এক লাখ ১০ হাজার ছিল, সেটি ২০১৯ সালে হয়েছে দুই লাখ ৩০ হাজার। এর মধ্যে আছেন ৫০ হাজার জাপানি, যারা ইসলাম গ্রহণ করেছেন। এখন সেখানে ১১০টিরও বেশি মসজিদ। অস্থায়ী নামাজের ঘর বা এবাদতখানা যোগ হলে সেটা ২০০ ছাড়িয়ে যাবে।

মুসলিমদের সংখ্যা বৃদ্ধিকে কাক্সিক্ষত পরিবর্তন হিসেবে বর্ণনা করেছেন এশিয়া-প্যাসিফিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং বেপ্পু মুসলিম অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান মুহাম্মদ তাহির আব্বাস খান। গ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থী হিসেবে ২০০১ সালে তিনি যখন পাকিস্তান থেকে জাপান আসেন, তখন দেশটিতে মাত্র ২৪টি মসজিদ ছিল। কিয়ুশু দ্বীপে একটা মসজিদও ছিল না।

জাপানে কখন ইসলামের আলো প্রবেশ করেছে, সে ইতিহাস পরিষ্কার নয়। ধারণা করা হয়, অষ্টম শতাব্দীতে জাপানে ইসলামের বাণী পৌঁছে। তবে মেইজি শাসনামলের ১৮৬৮ থেকে ১৮৯০ সাল পর্যন্ত সময়ে জাপান যখন বিশ্বব্যাপী তাদের উপস্থিতির অংশ হিসেবে উসমানীয় সাম্রাজ্য এবং মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে বাণিজ্য ও তথ্যবিনিময় শুরু করে, তখন থেকেই তারা ইসলাম ও মুসলিমদের সংস্পর্শে আসতে শুরু করেন। কারণ, মুসলিমদের ইতিহাস যেটুকু পাওয়া যায়, তা এ সময় থেকেই।

১৯৬৬ সালে জাপানে ইন্টারন্যাশানাল ইসলামিক সেন্টার প্রতিষ্ঠিত হয়। ইসলামিক সেন্টার ‘আস সালাম’ নামে একটি ত্রৈমাসিক পত্রিকাও বের করে। এছাড়া, সেন্টারের পক্ষ থেকে জাপানি শিশুদের প্রাথমিক ধর্মীয় শিক্ষার ব্যবস্থা ও হজ গমনে ইচ্ছুকদের হজে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। এই সেন্টারকে কেন্দ্র করেই জাপানে ইসলাম সম্প্রসারণের কাজ চলছে জোরালোভাবে। এ সেন্টারে আরবি, পাকিস্তানি, তুর্কি ও খোদ জাপানি মুসলিমরাও রয়েছেন। এ সেন্টারের পক্ষ থেকে অনেক বই জাপানি ভাষায় প্রকাশ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে পবিত্র কুরআনের অনুবাদও।

এসব তৎপরতার ফলে জাপানে দ্রুত প্রসার হচ্ছে ইসলাম। ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত জাপানে স্থানীয় মুসলিমদের সংখ্যা ৩ হাজার বলা হতো, এখন সরকারি হিসাব মতে সেখানে এ সংখ্যা ৫০ হাজার।

গত কয়েক বছরে দেশটিতে মুসলিমদের সংখ্যা বাড়লেও সে তুলনায় তাদের ধর্মীয় প্রয়োজন পূরণের সুযোগ বাড়েনি। এখনও সেখানে ধর্মীয় তৎপরতার সেই পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি, যা ইউরোপ ও আমেরিকার অনেক দেশে হয়েছে।

মুসলিম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে বেড়েছে কবরস্থানের সংকট। জাপানিদের ৯৯ শতাংশ মৃতদেহ দাহ করা হয়। যে কারণে স্থানীয়রা কবর দেওয়ার জন্য জায়গা দিতে চান না। কিন্তু ইসলাম ধর্মে মৃতদেহ পোড়ানো হারাম। যে দেশে প্রায় সব মরদেহই দাহ করা হয়, এমন একটা দেশে কবর দেওয়ার জন্য মাটি খুঁজে পাওয়া বড় একটি সমস্যা।

এ প্রেক্ষাপটে জাপানে বসবাসরত কিছু মুসলিম নিজ উদ্যোগে কিছু কবরস্থান গড়ে তুলেছেন। নাগয়া কবরস্থান জাপানের প্রথম কবরস্থান। পরে ইবারাকী-কেন, ইয়ামানাশি-কেন ও গুনমা-কেনে কবরস্থান বানানো হয়। এ কবরস্থানগুলোতে মিয়ানমার, ইরান, গানা, নাইজেরিয়া ও বাংলাদেশিদের কবর দেওয়া হয়।

বিভিন্ন দেশ থেকে আসা মুসলিমরা শরণার্থী হয়ে এখানে থাকেন; অর্থের অভাবে তাদের লাশ দেশে পাঠানো যায় না। জাপানের হাসপাতাল থেকে একটি লাশ পাঠানোর প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে বিমান ভাড়াসহ বাংলাদেশ, ভারত কিংবা পাকিস্তানে পাঠাতে প্রয়োজন হয় বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা। তাই অনেকের শেষ সমাধি জাপানের কবরস্থানগুলোতে হয়ে থাকে। পাকিস্তান সরকার অবশ্য নিজ দেশের নাগরিকদের কথা বিবেচনা করে ২০০০ সাল থেকে বিনামূল্যে লাশ বহন করে আসছে। বাংলাদেশিদের উদ্যোগে গুনমাকেন হোনজু এলাকায় আনুমানিক ৫ বিঘা জমি কিনে কবরস্থান তৈরি করা হয়েছে।

জাফর সায়ীদ নামের ৩৯ বছর বয়সী এক পাকিস্তানি নাগরিক জানালেন কষ্টকর অভিজ্ঞতার কথা। গর্ভপাতের কারণে ৯ বছর আগে তার বড় ছেলে পৃথিবীতে আসার আগেই মারা যায়। ছেলের জন্য কবরের জায়গা ম্যানেজ করতে পৌর অফিসে কয়েক ঘণ্টা ছোটাছুটি করতে হয় তাকে। বেপ্পু শহরের পাহাড়ে ক্যাথলিক কবরস্থানের এক কোণে সমাহিত করা হয় জাফর সায়ীদের বড় ছেলেকে।

সায়ীদ বলেন, এই কবরস্থানে প্রায় ২০ জন মুসলিমকে কবর দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এখন সেখানে আর জায়গা অবশিষ্ট নেই।

২০০০ সালে পাকিস্তান থেকে জাপান আসেন সায়ীদ; তখন থেকে সেখানেই আছেন। তিনি বলেন, ‘আমি আমার মৃত্যুর পর বেপ্পুর মাটিতেই সমাহিত হতে চাই। আমার সন্তানের কাছাকাছি সমাধিস্থ হতে পারলে শান্তি পাব।’

জাপানে কবর দেওয়ার জায়গা এককথায় খুবই কম। জাপানের আইন যদিও কবর দেওয়াকে নিষেধ করে না, তবু একটি কবরস্থান তৈরি করতে অনেক বাধার সম্মুখীন হতে হয়। বেশিরভাগ বিরোধিতা আসে স্থানীয় সম্প্রদায় থেকে।

কোনো কোনো এলাকায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধ্যাদেশের মাধ্যমে ‘স্বাস্থ্যসম্মত সর্বজনীন জায়গা’ নির্ধারিত করে সেখানে কবর দেওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে। জাপানের পশ্চিমাংশের চুগোকু, শিকোকু ও কিয়ুশু অঞ্চলে কোনো কবরস্থান নেই।

ফুকুওকা প্রিফেকচারে বসবাস করেন একজন পাকিস্তানি, যিনি অন্তত ১০ জন মুসলমানকে কবর দিতে সহায়তা করেছেন। জাপানে মুসলিমদের কবর দেওয়ার কাজটা কত কঠিন, তা সহজে বোঝার জন্য অনেক গল্প তার কাছে আছে। তিনি একবার একটি মরদেহ নিয়ে কিয়ুশু থেকে ইয়ামানশি পর্যন্ত প্রায় ৭০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়েছিলেন। আরেকবার ওকিনাওয়া থেকে বিমানে করে একটি মরদেহ পাঠিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘এই কাজগুলো অনেক সময় এবং টাকা নষ্ট করে। ফলে জাপানের মুসলিমরা তাদের কবর নিয়ে চিন্তিত।’

এই সমস্যার সমাধানে একটি মুসলিম সংগঠন হিজি শহরের পাশের পাহাড়ে ৮ হাজার বর্গমিটারের মতো জায়গা কিনেছেন কবরস্থান বানানোর উদ্দেশ্যে। যেখানে প্রায় ১০০টি কবরের জায়গা হবে।

তবে পরিকল্পনাটি বাধার মুখে পড়ে। এই সংগঠনটি শহরের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কবরস্থান তৈরির ব্যাপারে প্রাথমিক কথাবার্তা বলে রাখলেও ১০০ জন স্থানীয় বাসিন্দার একটি গ্রুপ এই প্রজেক্টের বিপক্ষে পৌরসভা সরকারের কাছে পিটিশন দাখিল করে।

পিটিশনে বলা হয়, এই পরিকল্পিত স্থানের পাশেই একটি সেচ পুকুর এবং আরেকটি পুকুর রয়েছে, যেটি খাওয়ার পানির উৎস। তাদের দাবি, এই কবরস্থান তাদের ফসলের ক্ষতি করতে পারে। যদিও একটি কবরস্থান নির্মাণের জন্য স্থানীয় মানুষের মতামতের প্রয়োজন নেই, তবুও পৌরসভা কর্তৃপক্ষ পরিকল্পনাটি মঞ্জুর করেনি।

বেপ্পু মুসলিম অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান মুহাম্মদ তাহির আব্বাস খান জানান, তিনি কবরস্থানের জন্য জায়গা খুঁজে বের করতে এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে তা ব্যাখ্যা করতে ১০ বছর পার করেছেন। উদ্বেগ নিয়ে সিটি কর্পোরেশনের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় থাকা খান বলেন, ‘সময় পার হয়ে যাচ্ছে। এই প্রজেক্ট যদি ব্যর্থ হয়, তাহলে আমাদের আর কোনো বিকল্প থাকবে না।’

সরকারি তথ্যানুযায়ী, এশিয়ার মুসলিমপ্রধান দেশগুলো থেকে জাপানে গমনকারী মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের তথ্যানুযায়ী প্রায় ৬৬ হাজার ৮০০ জন ইন্দোনেশীয় নাগরিক জাপানে বসবাস করেন, যা চার বছর আগের সংখ্যার চেয়ে ৮৬ শতাংশ বেশি। এছাড়া ১৬ হাজার ৬০০ জন বাংলাদেশি এবং ১৭ হাজার ৭০০ জন পাকিস্তানি নাগরিকও জাপানে বসবাস করছেন।

কবরস্থান ছাড়া বাকি বিষয়গুলোতে জাপানে বসবাসরত মুসলিমদের জন্য সুখকর অনেক কিছু আছে। যেমন: ফুকুকা বিমানবন্দরে নামাজের জায়গা করা হয়েছে, কিছু কিছু হালাল শপ ও রেস্টুরেন্ট রয়েছে, সে সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়ছে। কয়েকটি ইসলামিক স্কুল রয়েছে, যেখানে পূর্ণাঙ্গভাবে ইসলামি শিক্ষা প্রদান করা হয়। বেপ্পুর স্থানীয় মানুষ মুসলিমদের ওপর সন্তুষ্ট। ২০১৬ সালে ভূমিকম্পের পর মুসলিমদের উদ্যোগে বিপুল খাবার রান্না করে উদ্বাস্তুদের কাছে বিতরণ করা হয়েছিল। বিষয়টি স্থানীয়রা মনে রেখেছেন। জাপানিদের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার উদ্দেশ্যে মুসলিমদের উদ্যোগে প্রতি সপ্তাহে মসজিদে ফ্রি ডিনারের ব্যবস্থা করা হয়। প্রতিবছর উৎসবের আয়োজন করা হয়।

ইসলামের সুশীতল ছায়ায় জাপানিদের দাওয়াত দিচ্ছে সেখানকার মুসলিম সম্প্রদায়। জাপানিদের সঙ্গে সম্পর্ক ধীরে ধীরে প্রগাঢ় হচ্ছে। মুসলিমদের আশা, এর রেশ ধরে কবরস্থানের মতো সমস্যাগুলোর দ্রুত সুরাহা হবে।