লড়াকু এক জাতি : মরো মুসলিম


  • আহমেদ বায়েজীদ
  • ০৬ মার্চ ২০২১, ০৫:৩১

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ ফিলিপাইনের একটি জাতিগোষ্ঠি মরো মুসলিম। মিন্দানাও দ্বীপের এই মুসলিমদের রয়েছে দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাস। বহু বছর ঔপনিবেশিক শক্তির সাথে লড়াই এবং স্বাধীনতার পর ফিলিপাইন সরকারের সাথে লড়াই করতে হয়েছে তাদের। রক্তাক্ত পথ পাড়ি দিয়ে অবশেষে তারা পেয়েছে স্বায়ত্তশাসন। গঠিত হয়েছে বাংসামরো অটোনোমাস রিজিওন ইন মুসলিম মিন্দানাও।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ ফিলিপাইনের দক্ষিণাঞ্চলীয় দ্বীপপুঞ্জের মাঝে অবস্থিত মিন্দানাও দ্বীপ। মূল দ্বীপ ও সুলু দ্বীপপুঞ্জসহ এর আশপাশের ছোট ছোট কিছু দ্বীপ নিয়েই গঠিত মিন্দানাও। আয়তনে লুজন দ্বীপের পরই ফিলিপাইনের দ্বিতীয় বৃহত্তম দ্বীপ মিন্দানাও। পুরো এলাকাটিতে জনসংখ্যা আড়াই কোটির কিছু বেশি। মিন্দানাও ছয়টি প্রশাসনিক এলাকায় বিভক্ত। এর একটি বাংসামরো অটোনোমাস রিজিয়ন।

সমগ্র মিন্দানাওয়ের মোট জনসংখ্যার ২৪ শতাংশ মুসলিম। তবে বাংসামরো অঞ্চলটি মুসলিম প্রধান। অফিশিয়াল নাম বাংসামরো অটোনোমাস রিজিয়ন অব মুসলিম মিন্দানাও। ফিলিপাইন সরকারের একটি স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চল এটি। ২০১৯ সালে এক গণভোটের পর অঞ্চলটির সায়ত্বশাসন কার্যকর হয়। বর্তমানে অঞ্চলটির দায়িত্বে রয়েছে একটি ট্রানজিশন অথরিটি বা ক্ষমতা হস্তান্তর কর্তৃপক্ষ। ২০২৩ সালের মধ্যে এই কর্তৃপক্ষ স্বায়ত্বশাসন বাস্তবায়ন ও সরকার গঠন বিষয়ক সকল প্রস্তুতি শেষ করবে। ট্রানজিশন অথরিটির শীর্ষ পদ ওয়ালি। এই পদটি অনেকটা মন্ত্রীপরিষদ শাসিত সরকারের প্রেসিডেন্টের পদের মতো। সরকার পরিচালিত হবে একজন চিফ মিনিস্টারের নেতৃত্বে। অঞ্চলটির বর্তমান ট্রানজিশন অথরিটির ওয়ালি খলিফা ওসমান নানদু ও চিফ মিনিস্টার মুরাদ ইবরাহিম।

৫টি প্রদেশ, ৩টি শহর ও ১১৬টি পৌরসভা নিয়ে গঠিত বাংসামরো অঞ্চলটির বর্তমান প্রশাসনিক কেন্দ্র কোতাবাতো শহরে। ২০১৫ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী বাংসামরোর মোট জনসংখ্যা ৪০ লাখ ৮০ হাজার।

এই অঞ্চলের বাসিন্দারা প্রধানত মরো জাতির। মরো মুসলিম নামেই পরিচিত তারা। মরো মুসলিমদের কয়েক শতাব্দীর আন্দোলন সংগ্রামের ফসল এই স্বায়ত্বশাসন। মরো মুসলিমদের ইতিহাস বহু পুরনো। স্পেন, আমেরিকা ও জাপানীদের বিরুদ্ধে ৪০০ বছরের লড়াইয়ের ইতিহাস রয়েছে তাদের। ফিলিপাইন স্বাধীন হওয়ার পরও এই লড়াইয় অব্যাহত রয়েছে। যার ফসল হিসেবেই অঞ্চলটি আজ স্বায়ত্বশাসন পেয়েছে। মিন্দানাও, পালাওয়ান, সেলোসহ কয়েকটি দ্বীপে বসবাস মরোদের। ফিলিপাইনের মোট জনসংখ্যার১১ শতাংশ মরো মুসলিম। চতুর্দশ শতাব্দীতে এই অঞ্চলে ইসলামের আগমন ঘটে।

মরো আসলে একটি সামগ্রিক জাতিগত নাম- ১৭টি ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী এর অন্তর্গত। এর মধ্যে আছে সামা, বাজাও, জামা মাপুন, তাউসুগ, সুলুক, ইরানুন, কালাগান, মারানাও, মাগিন্দানাও, পালাওয়ানন, মলবগ, সাঙ্গিল, ইয়াকান, সুবানন, কালিবুগান, বাঙ্গিঙ্গি ও সাঙ্গির। এই জাতিগোষ্ঠি গুলোর মধ্যে ভাষাগত ভিন্নতাও রয়েছে। ফিলিপিনো, আরবিসহ বিভিন্ন স্থানীয় ভাষায় কথা বলে মরোরা।

মরো নামটি মুর শব্দ থেকে এসেছে। মুর মুসলিমরা এক সময় স্পেন শাসন করেছে। ৭৮১ বছর ধরে স্পেন শাসন করার সময় তাদের ‘মুর’ বলা হতো। মরো নামটিও স্পেনীয়দের দেয়া। ষষ্ঠদশ শতাব্দীতে ফিলিপাইনে উপনিবেশ স্থাপন করে স্পেনীয়রা।এসময় তারা দক্ষিণ ফিলিপাইনের মুসলিম জাতিগোষ্ঠীগুলোকে ‘মরো’ নামে ডাকতে শুরু করে।

অঞ্চলটিতে ইসলামের আগমন ১৩১০ সালে। আরবের ব্যবসায়ী ও সুফি সাধকদের মাধ্যমে ফিলিপাইনের সুলু ও জুলু দ্বীপে ইসলামের প্রচার ও প্রসার ঘটে। এ ক্ষেত্রে ‘তুয়ান মাশায়েখের’ নাম উল্লেখযোগ্য। সুলু দ্বীপে এসে তিনি বসবাস শুরু করেন এবং এখানে ইসলামের প্রচার করতে থাকেন। এক পর্যায়ে এখানকার গোত্রপ্রধানের মেয়েকে বিয়ে করেন। এরপর সমাজে তার প্রভাব বৃদ্ধি পায়, যা ইসলাম প্রচারে সহায়ক হয়েছে তার জন্য। ক্রমশ আশপাশের দ্বীপগুলোতেও ইসলামের প্রসার ঘটে।

আর ১৩৮০ সালে মালয় থেকে আসাকরিম আল মাখদুম নামের এক দরবেশ সুলু দ্বীপে প্রথম মসজিদ নির্মাণ করেন। এটি সমগ্র ফিলিপাইনেরই প্রথম মসজিদ। শেখ করিম আল মাখদুম মসজিদটি আজও দাড়িয়ে আছে সেই ইতিহাসের স্বাক্ষী হয়ে।১৩৯০ সালে সুমাত্রা দ্বীপের মিনাংকাবাউ রাজবংশের প্রিন্স বাগুইন্দারের নেতৃত্বে একটি নৌবহর জুলু দ্বীপে আগমন করে এবং সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। তিনি অল্প দিনের মধ্যেই নিজেকে সুলুর মুসলিমদের নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন।

ধীরে ধীরে সুলুতে ইসলামের ব্যাপক প্রসার ঘটে এবং সেখানে সুলু সালতানাত প্রতিষ্ঠিত হয়। ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম দিকে মিন্দানাও দ্বীপেও ইসলামের প্রসার ঘটে। পরবর্তীকালে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, চীন, ভারত ও পারস্য থেকে মুসলমানরা ফিলিপাইনে আসতে থাকে। ফলে মিন্দানাও ও আশপাশের দ্বীপগুলোতে বিশাল মুসলিম জনগোষ্ঠি গড়ে ওঠে।

এই অঞ্চলের মুসলিমরা ছিলো লড়াকু আর স্বাধীনচেতা। বহু বছর পরাশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করার ইতিহাস রয়েছে তাদের। তবু তারা হার মানেনি।ষোড়শ শতাব্দীতে স্পেনীরা ফিলিপাইনে উপনিবেশ স্থাপন করেন। অন্যান্য অঞ্চল দখলে নিলেও মরো মুসলিমরা তাদের বিরুদ্ধে বহু বছর লড়াই করেছে। ৩৩৩ বছর ধরে স্পেনের অধীনে থাকা ফিলিপাইনে মরোরাই শুধু স্পেনীয়দের আধিপত্য অস্বীকার করে চলেছিল। আঠারো দশকের শেষে এসে স্পেনীরা মরোদের অনেকখানি দুর্বল করে দিলেও তারা পুরোপুরি হার মানেনি।

এরই মধ্যে স্প্যানিশ-মার্কিন যুদ্ধ শুরু হলে ১৮৯৮ সালে স্পেনের আরও অনেক উপনিবেশসহ ফিলিপাইনও মার্কিন দখলে চলে যায়। কিন্তু এবার মার্কিন উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধেও তীব্র বিদ্রোহ করে মরোরা। ১৯০৪ সালে মার্কিন সেনারা মিন্দানাওকে দখল করতে সামরিক অভিযান চালায়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান মরোদের মাতৃভূমি মিন্দানাওসহ ফিলিপাইন ও পূর্ব এশিয়ার বিশাল এলাকা দখল করে। এ সময় জাপানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধেও সংগ্রাম করে মরোরা। মার্কিন বাহিনী কিংবা ফিলিপিনোদের সহায়তা ছাড়াই তারা জাপানিদের বিরুদ্ধে লড়াই করে যায়। বিশ^যুদ্ধের পর ১৯৪৬ সালে ফিলিপাইন স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাধীনতার পরপরই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে একটি পৃথক ভূখণ্ডগঠনের দাবি ওঠে; কিন্তু ম্যানিলা তা মেনে নেয়নি। ম্যানিলা সরকারের সাথে মুসলিমদের সঙ্ঘাত শুরু হয় এবং পরবর্তীকালে তা সশস্ত্র আন্দোলনে রূপ নেয়।

দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের পর অবশেষে ২০১৯ সালে সেই দাবি পূরণ হয় মরো মুসলিমদের। এর আগে অবশ্য সংলাপ, চুক্তিসহ দীর্ঘ কূটনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে তাদের। গণভোটও অনুষ্ঠিত হয়েছে দুই দফা। মরোদের দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামে বিভিন্ন সময়ে নেতৃত্ব দিয়েছে প্রধানত দুটি সংগঠন। মরো ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট ও মরো ইসলামিক লিবারেশন ফ্রন্ট।

মরো ইসলামিক লিবারেশন ফ্রণ্ট্রের প্রতিষ্টাতা মুরাদ ইব্রাহিমই বর্তমানে ট্রানজিশন অথরিটির চিফ মিনিস্টার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।মরো মুসলিমদের এসব আন্দোলন সংগ্রামে সবচেয়ে বেশি সহায়তা দিয়েছে লিবিয়ার মুয়াম্মার আল গাদ্দাফির সরকার। মালয়েশিয়াসহ দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য মুসলিম দেশগুলোও তাদের পাশে দাড়িয়েছে বিভিন্ন সময়।

ঔপনিবেশিক যুগে মরো অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে অন্য জাতির লোকদের এনে বসতি গড়ে তোলা হয়েছে। যার ফলে অনেক জায়গা থেকে মরোদের বিতাড়িতও করা হয়েছে। অনেক মরো নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে দেশ ছেড়েছেন। যার ফলে মিন্দানাওয়ের কিছু এলাকায় মরোদের চেয়ে খ্রিস্টানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। যে এলাকটিতে স্বায়ত্বশাসন দেয়া হয়েছে সেখানে অবশ্য মুসলিমরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। সেখানে আছে অল্পকিছু লুমাড ও খ্রিস্টান।

লড়াকু জাতি হিসেবে পরিচিত থাকলেও মরোরা আতিথিপরায়ন আর সংস্কৃতি প্রিয়। কয়েকশো বছর ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ব্যস্ত থাকলেও তারা ভুলে যায়নি নিজস্ব সংস্কৃতি, ঐতিহ্য। শৈশবেই ধর্মীয় শিক্ষা দেয়া পরিবার থেকে। সামাজিকভাবেও মক্তবসহ বিভিন্ন ধর্মীয় শিক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। স্বায়ত্বশাসন পুরোপুরি বাস্তবায়ন হলে এগুলো আরো বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এখনো যে কোন সামাজিক ও জাতীয় অনুষ্ঠানে রঙিন বাহারি পোশাকে মরো নৃত্য কিংবা নানান স্বাদের মরো খাবারের মেলা বসে। উৎসব প্রিয় মানুষ মরোরা। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে শিক্ষা সংস্কৃতিতে এগিয়ে যাচ্ছে মরো মুসলিমরা। প্রতি বছর অনেক মরো পরিবারের সন্তান এখন মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া কিংবা ইউরোপ-আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা নিতে যাচ্ছে। মার্কিনীদের গুড়িয়ে দেয়া সুলু সালতানাদের ফ্লাওয়ার প্যালেসসহ ঐতিহাসিক আমলের মুসলিম স্থাপনাগুলো সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে নতুন কর্তৃপক্ষ।

রক্তাক্ত ইতিহাস পাড়ি দিয়ে আসা বাংসামরোর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য খুবই আকর্ষণীয়। সবুজে ঘেরা পাহাড়ি দ্বীপগুলো যেন সাগরের মাঝে একেকটি মুক্তা। পাহাড়ি ভূখণ্ড হলেও বেশ উর্বর এখানকার কৃষিজমি। প্রচুর ফসল চাষ হয় অঞ্চলটিতে। আর আছে সাগরের মৎস সম্পদ। জনসংখ্যার বড় অংশই মাছ ধরা কিংবা মাঝ ব্যবসার সাথে জড়িত। নৌকা তৈরিতে খুবই দক্ষ বাংসামরোর লোকেরা। দ্বীপ এলাকা হওয়ায় নৌকাই তাদের চলাচলের প্রধান মাধ্যম। যে কারণে নৌকা তৈরিতে তাদের দক্ষতাও ঈর্ষণীয়। নানান ডিজাইনের নৌকা তৈরি করে এখানকার কারিগড়রা। এই শিল্পের সাথেও জড়িত অঞ্চলটির জন সংখ্যার বড় একটি অংশ।