যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া বিরোধে তুরস্কের সম্ভাবনা

বাইডেন - এরদোয়ান ঘনিষ্ট হতে পারেন - সংগৃহীত

  • মেহেদী হাসান
  • ২২ জানুয়ারি ২০২২, ২২:১৬

 ইউক্রেন ঘিরে রাশিয়ার সাথে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর বিরোধ তুরস্কের জন্য নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। বিশ্লেষকদের মতে বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে পশ্চিমাদের কাছে তুরস্কের গুরুত্ব বেড়েছে। তুরস্কের সাথে শীতল সম্পর্কের অবসান চাইছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা দিয়েছে পূর্ব ভূমধ্য সাগর হয়ে ইসরাইল-গ্রিসের বিতর্কিত গ্যাস পাইপ লাইনকে তারা আর সমর্থন করে না। যুক্তরাষ্ট্র পররাষ্ট্র মন্ত্রী এন্টনি ব্লিনকেন এক টুইট বার্তায় বলেছেন, তুরস্কের সাথে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়নে পদক্ষেপ নেবে যুক্তরাষ্ট্র। ইরাক, লিবিয়া, কৃষ্ণ সাগর অঞ্চল, ইউক্রেন, সাব সাহারান আফ্রিকা ইস্যুতে ওয়াশিংটন-আঙ্কার অবস্থান এক ও অভিন্ন। সাব সাহারান আফ্রিকাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে চীন রাশিয়ার অব্যাহত অগ্রযাত্রা ঠেকাতে ওয়াশিংটন-আঙ্কারা সহযোগিতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে সম্পর্ক জোরদার করা ২০২২ সালে তুরস্কের অন্যতম লক্ষ্য। আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি তুরস্কের জন্য যেমন নতুন সুযোগ বয়ে এনেছে। তেমনি সৃষ্টি করেছে বড় ধরনের ঝুকি। এ ক্ষেত্রে যে কোন ভুল পদক্ষেপ দেশটির জন্য মারাত্মক পরিণতি বয়ে আনতে পারে। তুরস্ক আবার কাছাকাছি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের। রাশিয়ার সাথে ন্যাটো এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধ মেটানোর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে যাচ্ছে তুরস্ক। তুরস্কের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থা বর্তমানে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের জন্য পুরোপুরি অনকুলে নয়। বিভিন্ন কারনে তুর্কিদের জীবন কঠিন হয়ে পড়ছে। তুরস্ক বর্তমানে সম্ভাবনা ও ঝুকির এক জটিল অবস্থানে রয়েছে। অনেকে একে তুলনা করছেন ১০০ বছর আগে উসমানীয় সাম্রাজ্য ধ্বংসের প্রেক্ষাপটের সাথে। বছরের শুরুতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাষ্ট্রদূতদের সাথে বৈঠক করেছেন প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান।

তুরস্কের কৌশলগত অগ্রাধিকার হল ইউরোপীয় ইউনিয়নের পূর্ণ সদস্য পদ লাভ করা। এরদোয়ান বলেছেন, তুরস্ক -ইউরোপীয় ইউনিয়ন সহযোগিতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি মনে করে দেন তুরস্ক যদি সিরিয়ায় অনন্য সাধারণ ভূমিকা পালন না করত তাহলে সিরিয়া এবং ইউরোপকে ভিন্ন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হত। ওয়াশিংটনও তুরস্কের সাথে সমস্যা কাটিয়ে সম্পর্ক পুনস্থাপন করতে আগ্রহী। রাশিয়ার সাথে ন্যাটোর বিরোধ মীমাংসার ক্ষেত্রে তুরস্ক খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে যাচ্ছে। ন্যাটোর বিশ্বস্ত সদস্য তুরস্ক উভয় পক্ষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত অংশীদার।

গ্রিসের গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ একটি খবর। এতে বলা হয়েছে পূর্ব ভূমধ্য সাগর হয়ে ১ হাজার ৯শ কিলোমিটার গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্প বাস্তবায়নের বিষয়ে নতুন করে চিন্তা করছে ওয়াশিংটন। এ পাইপ লাইনের মাধ্যমে প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহ করা হবে ইউরোপে। ২০২০ সালে গ্রিস, সাইপ্রাস এবং ইসরাইল এ গ্যাস পাইপলাইন নির্মানের চুক্তি করে। ২০২৫ সাল নাগাদ এই গ্যাস পূর্ব ভূমধ্য সাগর হয়ে ইউরোপে যাওয়ার কথা। এ পাইপ লাইনের মাধ্যমে বছরে ১০ বিলিয়ন কিউবিক মিটার গ্যাস ইউরোপে সরবরাহ করা হবে। ৬ দশমিক আট পাঁচ বিলিয়ন ডলারের এ প্রকল্পে অর্থায়ন করার কথা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের। যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট ১৫ জানুয়ারি এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, তারা আর এখন এ প্রকল্প সমর্থন করছে না। এর পরিবর্তে যুক্তরাষ্ট্র জোর দিয়েছে আন্ত:মহাদেশীয় বিদ্যুৎ লাইন স্থাপনে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে আমরা সমর্থন করছি মিশর থেকে ক্রেট এবং গ্রিস পর্যন্ত ইউরোপ-আফ্রিকা আন্ত:বিদ্যুৎ লাইন । এ ছাড়া প্রস্তাবিত ইউরো-এশিয়া বিদ্যুৎ লাইন যা ইসরাইল, সাইপ্রিয়ট এবং ইউরোপকে এক গ্রিডে যুক্ত করবে তাতে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন আছে। পূর্ব ভূমধ্য সাগরের এ প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন অপরিহার্য। কিন্তু এ প্রকল্প থেকে ওয়াশিংটনের মুখ ফিরিয়ে নেয়া তাৎপর্যপূর্ন। পূর্ব ভূমধ্য সাগরের এ পাইপ লাইন প্রকল্পের ঘোর বিরোধী আঙ্কারা। কারন যে এলাকা দিয়ে এ পাইপ লাইন যাবে সেটি তুরস্ক তাদের সমুদ্র সীমা বলে দাবি করছে। আবার গ্রিসও ওই এলাকাকে তাদের বলে দাবি করে। এখন ওয়াশিংটন এ পাইপ লাইন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ায় আঙ্কারার জন্য বড় ধরনের সুযোগ সৃষ্টি করেছে।

পাইপলাইন নিয়ে ওয়াশিংটনের ইউটার্ন তুরস্ক-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। বিশ্লেষকদের মতে পূর্ব ভূমধ্য সাগরের গ্যাস পাইপ লাইন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া ওয়াশিংটনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। কারন ওয়াশিংটন জানে এ পাইপলাইন ইসরাইলের জন্য অর্থনৈতিকভাবে খুবই লাভজনক একটি প্রকল্প। নতুন বছরে তুরস্কের লক্ষ্য ন্যাটো এবং ইউরোপীয় ইউনয়নের মিত্রে পরিণত হওয়া। ডিসেম্বরের শেষে আঙ্কারা ওয়াশিংটনকে প্রস্তাব দিয়েছে এ ক্ষেত্রে একটি জয়েন্ট স্ট্রাটেজিক মেকানিজম প্রতিষ্ঠা করার। এরদোয়ানের অন্যতম সহযোগী ইবরাহীম কালিন কথা বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভানের সাথে। এরপর এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে ইউক্রেন সঙ্কট, কাজাখস্তান বিক্ষোভ, আর্মেনিয়ার সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করা, আফগানিস্তান, ইথিওপিয়া, বসনিয়া হার্জেগোভিনাসহ বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক বিভিন্ন ইস্যুতে আলোচনা হয়েছে।

ইবরাহিম কালিন জ্যাক সুলিভানকে বলেছেন, আঙ্কারা বিশ্বাস করে আলোচনা এবং সহযোগিতার মাধ্যমে ইউক্রেন সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। আর এক্ষেত্রে তুরস্ক সব উপায়ে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। একই সাথে তুরস্ক ইউক্রেনের ভৌগোলিক অখন্ডতা রক্ষায়ও বিশ্বাসী। এর আগে তুরস্কের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী হুলুসী আকর জানান, এফ-৩৫ ফাইটার জেট নিয়ে সমঝোতায় পৌছাতে তুরস্ক এং যুক্তরাষ্ট্র ওয়াশিংটনে আলোচনার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তুরস্ক মনে করে এ বিষয়ে একটি গ্রহণযোগ্য সমাধানে পৌছানো যাবে। এর ফলে তুরস্ক যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে এফ-৩৫ বিমান ডেলিভারি পাবে। যুক্তরাষ্ট্র ২০২০ সালে এফ-৩৫ কর্মসূচী থেকে বের করে দিলেও তুরস্কের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এখনো এ বিমানের পার্টস নির্মান ও সরবরাহের সাথে জড়িত। তুরস্কের শতাধিক এফ-৩৫ বিমান কেনার কথা ছিল। এ জন্য অগ্রিম ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগও করেছে তুরস্ক । সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এ অর্থ ফেরত চেয়েছে তুরস্ক। অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্র এ অর্থের বিনিময়ে এফ-১৬ ফাইটার জেট সরবরাহের প্রস্তুাব দিয়েছে। তুরস্ক এতে আগ্রহ প্রকাশ করলেও এখনো চূড়ান্ত হয়নি। এরই মধ্যে পরিবর্তিত বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারনে তুরস্ক আশা করছে তাদেরকে শেষ পর্যন্ত এফ-৩৫ বিমান হস্তান্তর করতে পারে যুক্তরাষ্ট্র।

ওবামা প্রশাসনের বিরুদ্ধে এরদোয়ান বিরোধী ২০১৬ সালের অভ্যুত্থানে মদদ দেয়ার অভিযোগ করে আংকারা। সেই থেকে ডেমোক্রেটদের সাথে তুরস্কের শীতল সম্পর্ক। কিন্তু ২০২০ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায় আসেন ডেমোক্রেট প্রার্থী জো বাইডেন। ফলে ওয়াশিংটন-আঙ্কার শীতল সম্পর্ক আরো শীতল হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। তবে বাইডেন প্রশাসন এখন নতুন করে আর আঙ্কারার সাথে সম্পর্ক খারাপ করার অবস্থানে নেই। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান মনে করছেন আঙ্কারর প্রতি ওয়াশিংটনের মনোভাবের পরিবর্তন হয়েছে। কারন বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের এখন তুরস্ককে প্রয়োজন। কৃষ্ণ সাগর অঞ্চল, ইউক্রেন, ইরাক, লিবিয়া ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র এবং তুরস্কের অবস্থান অনেকটা এক ও অভিন্ন। এ ছাড়া সাব-সাহারান আফ্রিকায় তুরস্কের পদচারানার কারনেও আঙ্কারা এখন ওয়াশিংটনের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। সাব সাহারান আফ্রিকায় রাশিয়া ও চীনের প্রভাব বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্র-তুরস্ক সম্পর্ক এসব ক্ষেত্রে গেম চেঞ্জারের ভূমিকা পালন করতে পারে।

অনেক বিশ্লেষকের মতে পশ্চিমারা তুরস্ককে আবার তাদের মাঝে ফিরে পেতে আগ্রহী। কিন্তু এরদোয়ানের বিষয়ে অনেক দেশের আপত্তি আছে। এর কারন তুরস্ক এক সময় পশ্চিমাদের থেকে সরে এসে সাংহাই কো অপারেশন অর্গানাইজেশনের দিকেও ঝুকে পড়ে। আবার তুরস্কের আরব প্রতিবেশীদের আশঙ্কা এরদোয়ান নিজেকে নতুন অটোম্যান শাসক হিসেবে দাড় করাতে চেষ্টা করছেন। এরদোয়ান মনে করেন, পশ্চিমা, ন্যাটো এবং রাশিয়ার জন্য তার প্রয়োজন রয়েছে। তিনি তার অবস্থান ধরে রাখার জন্য কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। তবে কাজাখস্তান নিয়ে আট দিন পরে তুরস্কের প্রতিক্রিয়া নানা প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে। তুরস্কের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে কাজাখস্তানে ইসলামপন্থীদের মদদ দিচ্ছে আংকারা। নতুন বছরে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান কথা বলেছেন রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে। এর দুই দিন পর তুরস্ক পররাষ্ট্র মন্ত্রী মেভলুত কাভুসগলু আলোচনা করেছেন যুক্তরাষ্ট্র পররাষ্ট্র মন্ত্রী এন্টনি ব্লিনকেনের সাথে।

আলোচনা বিষয়ে তুরস্কের প্রকাশিত বিবৃতিতে বলা হয়েছে রাশিয়া, ন্যাটো এবং ইউক্রেন বিষয়ে তারা আলোচনা করেছেন। এন্টনি ব্লিনকেন এক টুইট বার্তায় তুর্কী মন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেছেন, ইউক্রেনে রাশিয়ান আগ্রাসন মোকাবেলায় যুক্তরাষ্ট্র- তুরস্ক দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক অব্যাহত থাকবে। একই সাথে ন্যাটো সদস্য হিসেবে তুরস্কের সাথে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরো ঘণিষ্ঠ করবে যুক্তরাষ্ট্র। এন্টনি ব্লিনকেনের সাথে আলোচনার পর তুর্কী পররাষ্ট্র মন্ত্রী টেলিফোন আলোচনা করেন রাশিয়ান পররাষ্ট্র মন্ত্রী সার্গেই লাভরভের সাথে। দুই নেতা কাজাখস্তান, বসনিয়া হার্জেগোভিনা এবং ককেশাস অঞ্চল নিয়ে আলোচনা করেন। তুরস্কের সরকার ঘনিষ্ট ডেইলি সাবাহর বিশ্লেষনমূলক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে রাশিয়ার কারনে ২০২২ সালে ন্যাটো এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন আগের তুলনায় অনেক বেশি তুরস্কের দরজায় নক করবে। তবে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটের কারনে তুরস্কের গুরুত্ব বেড়েছে তাতে কোনো সন্দে নাই। তবে তুরস্কের জন্য ঝুকি বাড়ছে। শত বছর আগে এরকম এক পরিস্থিতিতে তুকী উসমানীয় সাম্রাজ্যকে অনেক বেশি মূল্য দিতে হয়েছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পক্ষে যোগ দেয়ার ভুল সিদ্ধান্তের চরম মূল্য দিতে হয়েছে উসমানীয় সাম্র্যাজ্য। এ ভুলের খেসরাত হিসেবে নিহত হয়েছে লাখ লাখ তুর্কী সৈনিক, ধ্বংস হয়ে গেছে বিশাল উসমানীয় সাম্র্যাজ্য ।