ফিলিস্তিনের মুক্তির জন্য কারা কীভাবে সংগ্রাম করছে


  • মোতালেব জামালী
  • ৩১ মে ২০২১, ১৭:২৬

অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড গাজা উপত্যকা ও পশ্চিমতীরে ইসরায়েলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে লড়াই করছে বেশ কিছু সংগঠন। এসব সংগঠন বিভিন্ন আদর্শে বিশ্বাসী। এরমধ্যে ধর্মীয় মনোভাবাপন্ন হামাস ও ইসলামিক জিহাদের মতো সংগঠন যেমন আছে, তেমনি আছে ধর্মনিরপেক্ষ ফাতাহ ও সমাজতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অব প্যালেস্টাইনের মতো সংগঠনও। এর বাইরেও আরও কয়েকটি ছোট সংগঠন আছে, যেগুলো ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধ করে।

যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাজ্য হামাসকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও জাতিসংঘ কখনও পশ্চিমা বিশে^র এই সিদ্ধান্তকে গ্রহণ করেনি। ফিলিস্তিনি জনগণ ও তাদের বিভিন্ন মিত্র দেশ মনে করে হামাস ও ইসলামিক জিহাদ ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ন্যায়সঙ্গতভাবেই প্রতিরোধ যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে।

ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ২০০৬ সালে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হয় হামাস। এর মাধ্যমে প্রমাণিত হয় যে, সংগঠনটি ফিলিস্তিনিদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয়। কিন্তু হামাসের ক্ষমতায় আসা ঠেকাতে নানাভাবে চেষ্টা চালাতে থাকেন ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের পশ্চিমা বিশে^র সমর্থনপুষ্ট প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস। পশ্চিমা মিডিয়া ও সরকারগুলো এমনভাবে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সঙ্ঘাতকে তুলে ধরতে শুরু করে যে, মনে হতে পারে, কেবল হামাস ও ইসলামিক জিহাদই ইসরায়েলের বিরোধিতা করছে। কারণ, এ দুটি গ্রুপ ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে বিশেষ করে গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধ লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।

বাস্তবতা হচ্ছে- ঐতিহাসিকভাবেই ফিলিস্তিনিদের সব রাজনৈতিক দল ও গ্রুপ ইসরায়েলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে যুগ যুগ ধরে লড়াই করে আসছে। যদিও অভ্যন্তরীন রাজনীতির কারণে এসব দল ও সংগঠন পরস্পরের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে থাকে। ইসরায়েলি রাজনৈতিক ও প্রোপাগান্ডা মেশিনগুলো সব সময়ই এই চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করে থাকে যে, ‘ফিলিস্তিনের কট্টরপন্থি ইসলামী গ্রুপগুলোই তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। কেবল মুসলিম ফিলিস্তিনিরাই তাদেরকে সমর্থণ করে।

বাস্তব পরিস্থিতি সে কথা বলেনা। পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অব প্যালেস্টাইনের প্রতিষ্ঠাতা জর্জ হাবাস একজন খ্রিষ্টান। তিনি সমাজতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। ২০০৮ সালে তিনি জর্ডানে মারা যান। ফিলিস্তিনি খ্রিষ্টানরা ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পপুলার ফ্রন্টকে সমর্থন করে থাকে।

ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে চলতি সংঘাতও ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধ যুদ্ধের বহুমুখি চিত্রকে তুলে ধরছে। কেবল গাজার ফিলিস্তিনিরাই নয়, অধিকৃত পূর্ব জেরুসালেম এবং পশ্চিমতীরের ফিলিস্তিনিরাও এবারের প্রতিরোধ যুদ্ধকে সাদরে গ্রহণ করেছে। পশ্চিমতীরেই ফাতাহর নেতৃত্বাধীন প্যালেস্টিনিয়ান লিবারেশন অর্গানাইজেশন বা পিএলও এর সদর দফতর। ১৯৫০ এর দশক থেকে ফিলিস্তিনিরা ইসরায়েলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে যে সব সংগঠনের নেতৃত্বে লড়াই-সংগ্রাম করে আসছে আসুন জেনে নেই সে সব সংগঠন সর্ম্পকে কিছু তথ্য।

ফাতাহ। ফাতাহ একটি আরবি শব্দ। এর অর্থ হচ্ছে বিজয়। ইয়াসির আরাফাত ও তার তিন বন্ধু সালাহ খালাফ, খলিল আল ওয়াজির এবং খালেদ ইয়াশ্রুতি ১৯৫৯ সালে কুয়েতে ফাতাহ সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেন। খালাফ এবং ওয়াজির তিউনিশিয়ায় আততায়ীর হাতে নিহত হন। অন্যদিকে ইয়াশ্রুতি লেবাননের রাজধানী বৈরুতে রহস্যজনকভাবে মারা যান। ফিলিস্তিনিদের ধারণা যে, তাকে বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করা হয়েছে।

বছরের পর বছর ধরে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি আগ্রাসন বন্ধ করতে আরবদের ব্যর্থতার প্রেক্ষাপটেই গঠন করা হয় ফাতাহ সংগঠনটি। এ কারণে সংগঠনের নেতারা প্রাথমিকভাবে ফিলিস্তিনিদের নিয়ে একটি জাতীয় প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলার দিকে মনোযোগ দেন। অনেক বিশ্লেষক ও বিশেষজ্ঞ মনে করেন, ইসরায়েলে ফাতাহর দুর্ধষ হামলা ও ইয়াসির আরাফাতের ক্যারিশমেটিক নেতৃত্ব ফিলিস্তিনিদের দুর্দশার প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোযোগ আকর্ষণ করতে সহায়তা করে।

কিন্তু ১৯৯৩ সালে ইসরায়েলের সাথে ব্যর্থ অসলো শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের পর আরাফাত ও তার নেতৃত্বাধীন ফাতাহ সংগঠন সমালোচনার মুখে পড়ে। এই চুক্তি ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধ সংগ্রামকে রাজনৈতিকভাবে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং ফিলিস্তিনিরাও বিভক্ত হয়ে পড়েন। এরপর ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের দ্বিতীয় ইন্তিফাদা বা গণঅভ্যুত্থানের সময় হামাস ও ইসলামিক জিহাদের পাশাপাশি ফাতাহর সামরিক শাখা আল আকসা মার্টায়ার্স ব্রিগেডও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তারা দখলদার ইসরায়েলি বাহিনীর যথেষ্ট ক্ষতি করতে সক্ষম হয়।

আল আকসা মার্টায়ার্স ব্রিগেড এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মারওয়ান বারগুতি। তিনি ছিলেন ওসলো শান্তি চুক্তির বিরোধী। ফাতাহ নেতা মারওয়ান বারগুতিকে ইসরায়েল ২০০২ সালে গ্রেফতার করে কারারুদ্ধ করে। এরপর থেকে আল আকসা মার্টায়ার্স ব্রিগেডের তৎপরতা অনেকটাই স্তিমিত হয়ে পড়ে। অন্যদিকে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের বর্তমান প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের নরম এবং কূটনীতি নির্ভর নেতৃত্ব ও দৃষ্টিভঙ্গির কারণে সাধারণ ফিলিস্তিনিদের উপর ফাতাহর প্রভাবও বহুলাংশে হ্রাস পায়।

১৯৯০ এর দশকের শুরুর দিকে হামাস নামে ইসলামপন্থী সংগঠনটির জন্ম হয়। এই সংগঠনটি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধের মতাদর্শে বিশ্বাস করে। সংগঠনটি শুরুতে মিসরে ইসলামী আদশে গড়ে উঠা রাজনৈতিক সংগঠন মুসলিম ব্রাদারহুডের ফিলিস্তিনি শাখা ছিল। কিন্তু ১৯৮৭ সালে ইসরায়েলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে ফিলস্তিনিদের প্রথম ইন্তিফাদা বা গণঅভ্যুত্থানের সময় শেখ আহমদ ইয়াসিন, আব্দুল আজিজ আল রানতিসি, মাহমুদ জাহার, মোহাম্মদ তাহাসহ কয়েকজন ফিলিস্তিনি নেতা মিলে হামাস প্রতিষ্ঠা করেন। আসুন জেনে নেই এই সংগঠনটি সর্ম্পকে কিছু তথ্য।

ফিলিস্তিনিদের দ্বিতীয় ইন্তিফাদা চলাকালে ২০০৪ সালে গাজায় একটি জানাজায় যাওয়ার সময় ইসরায়েলি ক্ষেপনাস্ত্র হমলায় নিহত হন হামাসের প্রতিষ্ঠাতা ও আধ্যাত্মিক নেতা শেখ আহমেদ ইয়াসিন। হত্যাকাণ্ডের শিকার হন আরেক প্রভাবশালী নেতা আব্দুল আজিজ রানতিসি। ইসরায়েলি বিমান ও ক্ষেপনাস্ত্র হামলায় শেখ আহমদ ইয়াসিনসহ হামাসের অনেক নেতা নিহত হলেও সংগঠনের কর্মকাণ্ডের গতি কখনোই স্তিমিত হয়ে পড়েনি।

একজন নেতা নিহত হওয়ার পর অত্যন্ত দ্রুততার সাথে তার স্থান বা পদটি পূরণ করা হয়েছে আরেকজনকে দিয়ে। এ কারণে হামাসের মধ্যে কখনোই নেতৃত্বের সংকট তৈরি হয়নি। সংগঠনে ইসরায়েলি অনুচরদের প্রবেশ রোধে এবং সংগঠনের রাজনৈতিক ও সামরিক নেতাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সংগঠনের মধ্যে অত্যাধুনিক পন্থায় কঠোর গোপনীয়তা বজায় রেখে চলা হয়। এ কারণে শেখ আহমদ ইয়াসিন নিহত হবার পর গাজায় হামাসের অতি পরিচিত কোন নেতার কথা শোনা যায় না।

২০০৬ সালের নির্বাচনে হামাসের বিজয়কে ফিলিস্তিনি মুক্তি আন্দোলন বা পিএলও মেনে না নেয়ায় ফাতাহ ও হামাসের মধ্যে মারাত্মক দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। এরপর ২০০৭ সালে হামাস গাজার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। এরপর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত গাজার নিয়ন্ত্রন হামাসের কাছেই রয়েছে। ২০০৬, ২০০৮-০৯ এবং ২০১৪ সালে ইসরায়েল গাজায় সর্বাত্মক হামলা। প্রতিটি সময়েই হামাস ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলায় সংগঠনটি ফিলিস্তিনিদের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী ও বিশ^স্ত একটি সংগঠনে পরিণত হয়েছে। ধারণা করা হয় যে গাজায় হামাসের ৪০ হাজার থেকে ৫০ হাজারের মতো যোদ্ধা রয়েছে।

পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অব প্যালেস্টাইনের বা পিএফএলপি পিএফএলপি ফিলিস্তিনিদের সবচেয়ে পুরনো রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর একটি। এছাড়া ফিলিস্তিনে আরেকটি প্রভাবশালী সংগঠন হচ্ছে ইসলামিক জিহাদ। ইরান এই সংগঠনটিকে সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে থাকে। আসুন জেনে নেই এই দুই সংগঠন সর্ম্পকে নানা তথ্য

ফিলিস্তিনি খ্রিষ্টান জর্জ হাবাস ১৯৬৭ সালে এই সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেন। সংগঠনটি তার সমাজতান্ত্রিক আদর্শের জন্য সুপরিচিত। প্যালেস্টাইন লিবারেশ অর্গানাইজেশনের পর পর কয়েক দশক ধরে পপুলার ফ্রন্ট ফিলিস্তিনিদের মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে টিকে ছিল। হামাসের মতোই পপুলার ফ্রন্টও ইসরায়েলের অস্তিত্ব স্বীকার করেনা এবং তারা এক রাষ্ট্র সমাধানে বিশ্বাসী। সংগঠনটি ইসরায়েলের সাথে যে কোন ধরণের আলোচনায় বসারও বিরোধী। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন হামাস ও ইসলামিক জিহাদের মতে পপুলার ফ্রন্টকে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তালিকাভূক্ত করেছে। গ্রুপের বর্তমান নেতা আহমদ সাদাত এখন ইসরায়েলের কারাগারে রয়েছেন। তাকে ৩০ বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

১৯৮১ সালে ফাথি সাফাকি, আব্দুল আজিজ আওদা, রামাদান সালাহ ও অন্য ৪ জন ফিলিস্তিনি নেতা মিলে গাজায় ইসলামিক জিহাদ সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেন। আরো ৬টি ফিলিস্তিনি রাজনৈতিক সংগঠনের মতো ইসলামিক জিহাদও অ্যালায়েন্স অব প্যালেস্টিনিয়ান ফোর্সেস নামে একটি জোটের সদস্য। এসব সংগঠন ইসরায়েলের সাথে স্বাক্ষরিত শান্তি চুক্তিকে মানতে নারাজ। ইরান ইসলামিক জিহাদকে সমর্থন দিয়ে থাকে। সংগঠনটির ১০ হাজারের মতো যোদ্ধা রয়েছে বলে ধারণা করা হয়।

সুপরিচিত এসব সংগঠন ছাড়াও আরও বেশ কিছু ফিলিস্তিনি সংগঠন রয়েছে, যেগুলো ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। এর বাইরে সাধারণ ফিলিস্তিনিদের কিছু সংগঠন গড়ে উঠেছে, যেগুলো অহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে ইসরায়েলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে যাচ্ছে। এসব সংগঠনের প্রতিও অনেক ফিলিস্তিনির সমর্থন আছে।