মধ্যপ্রাচ্য নীতিতে কোণঠাসা ভারত

ভারতের জন্য মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব বিস্তারের পথ এখনও অনেকটাই বন্ধুর

  • আহমাদ আব্দুল্লাহ
  • ০৪ জানুয়ারি ২০২১, ১৫:০১

মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশের সঙ্গে ইসরাইলের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়ার বিষয়কে অনেকেই ভারতের জন্য ইতিবাচক মনে করলেও বিষয়টা এখনও ততটা সহজ নয়। ভারতের জন্য মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব বিস্তারের পথ এখনও অনেকটাই বন্ধুর। ভারতকে বরং ইসরাইলের দিকে একপেশেভাবে ঝুঁকে না পড়ে বরং আরব দেশগুলোর সাথেও ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

ইসরাইল কিংবা আরব বিশ্ব- দুটো শক্তিই ভারতের জন্য জরুরি। উপসাগরীয় দেশগুলোর সাথে ভারতের দীর্ঘদিন ধরেই রয়েছে বাণিজ্যিক সম্পর্ক। এ দেশগুলো থেকেই ভারত তার পেট্রোলিয়াম চাহিদার সিংহভাগ পূরণ করে। অন্যদিকে, ইসরাইলের সাথে ভারতের সম্পর্কটি মূলত প্রতিরক্ষা বিষয়ক। পাশাপাশি, দুই দেশের মধ্যে প্রযুক্তি বিনিময়ও শুরু হয়েছে।

আরব দেশগুলো ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করায় হয়তো ইসরাইলের সাথে ভারতের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ও তৎপরতা বৃদ্ধি করার পথ কিছুটা উম্মুক্ত হবে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের কূটনৈতিক পরিস্থিতির হিসাব মেলানো ভারতের জন্য বেশ কঠিন।

মধ্যপ্রাচ্য কখনও সরলরেখা ধরে চলে না। এখনও পর্যন্ত আঙ্কারা ও রিয়াদের মধ্যেও নানা বিষয়ে ভিন্নতা রয়েছে। তাই মুসলিম বিশ্বও এ দুটি দেশকে কেন্দ্র করে দুটো ভিন্ন ব্লক ধরে অগ্রসর হচ্ছে। সবার আগে সংযুক্ত আরব আমিরাত ইসরাইলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিক করলেও পরবর্তীতে বাহরাইন, ওমান এবং মরক্কোও এ পথে অগ্রসর হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দাবি করছেন, সৌদি আরবও এ পথে অনেকটাই এগিয়ে গেছে।

যদিও আবরাহাম চুক্তি নামে একটি সমঝোতার আড়ালেই এই সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ চলছে। আসলে একেশ্বরবাদী তিনটি ধর্ম খ্রিস্টান, ইহুদি ও ইসলামের অনুসারীদের মধ্যে একটি ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার দাবি নিয়েই ট্রাম্প এ পথে এগিয়েছেন, তারপরও প্রকৃত সত্য হচ্ছে, এটি মূলত যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের একটি যৌথ উদ্যেগ।

মধ্যপ্রাচ্য ও উপসাগরীয় অঞ্চলে তুরস্ক ও ইরানের ক্রমবর্ধমান প্রভাবকে প্রতিহত করার জন্যই এ প্রচেষ্টাটি চালানো হচ্ছে। সৌদি আরব ও তুরস্ককে কেন্দ্র করে মুসলিম দেশগুলোর দুটো ব্লকের মধ্যে যে উত্তেজনা, তাকে একটি দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য সম্পর্ক স্বাভাবিক করার নাটক পরিচালিত হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের রাজান্ত্রিক দেশগুলো এতে বিভক্ত হয়ে পড়ছে।

ইসরাইলের সাথে কয়েকটি আরব দেশের এ চুক্তিকে ভারত স্বাগত জানিয়েছে। ভারত মনে করে এ চুক্তি গোটা মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিয়ে আসবে। সৌদি আরব ও আমীরাত ভারতের এ অবস্থানকে সমর্থন জানিয়েছে। আবার ভারতকেও নানা দু:সময়ে এ আরব দেশগুলোও নানাভাবে সহায়তা করেছে। ভারত যখন কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করে গত বছর কাশ্মীরকে নিজ মানচিত্রে শামিল করে নেয় তখন সৌদি আরব ও আরব আমীরাত ভারতের এ সিদ্ধান্তের পক্ষে বলিষ্ঠভাবে অবস্থান নেয়। অন্যদিকে, তুরস্ক ইরান, মালয়েশিয়া ও পাকিস্তান কখনোই ভারতের কাশ্মীর বিষয়ক সিদ্ধান্তকে মানতে পারেনি। আন্তজার্তিক নানা ফোরামে ভারতের এ সিদ্ধান্তের সমালোচনাও করে।

আরব দেশগুলো ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন ও পাকিস্তানের সাথে উপসাগরীয় দেশগুলোর টানাপোড়েন সৃষ্টি হওয়ার ভারত নতুন করে মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের শক্তি ও প্রভাব বৃদ্ধি করার চেষ্টা করছে। এরই অংশ হিসেবে সম্প্রতি ভারতের সেনাবাহিনী প্রধান সংযুক্ত আরব আমীরাত, সৌদি আরব ও বাহরাইনও সফর করেছে। ভারতের মোট ব্যবসা বাণিজ্যের ৩০ শতাংশই পরিচালিত হয় ওআইসি সদস্যরাষ্ট্রগুলোর সাথে। এ বছরের জানুয়ারী থেকে অক্টোবরের হিসেব থেকে জানা যায়, ওআইসি সদস্য দেশগুলোর সাথে ভারত যতটুকু ব্যবসা করেছে তার অর্ধেকই ছিল উপসাগরীয় দেশগুলোর সাথে। আর একই সময়ে ভারতের মোট ব্যবসার মাত্র ১৩ শতাংশ পরিচালিত হয় তুরস্ক, মালয়েশিয়া, ইরান ও পাকিস্তানের সাথে।

করোনা মহামারির কারণে ভারতের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিশ্বজুড়ে বড়ো আকারের ধাক্কা খেয়েছে। ওআইসি দেশগুলোর সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্কও বেশ সংকটে পড়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারী থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ভারতের ব্যবসা বাণিজ্যের সাবির্ক পরিমাণ আগের বছরের তুলনায় ৩২ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। ওআইসি দেশগুলোর সাথে ভারতের ব্যবসা কমেছে প্রায় ৩৫ শতাংশ। আর তুর্কী নেতৃত্বাধীন জোটের সাথে ভারতের ব্যবসা কমেছে ৪৩ শতাংশ। যদিও তুরস্ক এবং এর মিত্র দেশগুলোর সাথে ভারতের ব্যবসা বাণিজ্যের পরিমাণ এখনও কম, তারপরও বিশ্লেষকরা মনে করছেন, অর্থনৈতিক এ দৈন্যদশায় ভারতের শুধু আরব রাষ্ট্র আর ইসরাইলের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলে হবে না। এরই মধ্যে ইরান ও মালয়েশিয়ার সাথে রাজনৈতিক ভিন্নতার কারণে ভারত পরিশোধিত তেল এবং পাম ওয়েলের ব্যবসায় হোচট খেয়েছে।

ভারতে ক্রুড তেলের সবচেয়ে বড়ো চালানটি আসে ইরাক থেকে। কিন্তু ইরাকী কর্তৃপক্ষ এখন ভারতের চেয়ে ইরান ও তুরস্কের সাথে ব্যবসা বাড়াতে বেশি আগ্রহী। অতি সম্প্রতি ইরাকের প্রধানমন্ত্রী মুস্তফা আল কাদিমি তুরস্কে গেলে তাকে প্রেসিডেন্ট রিজেপ তাইয়েপ এরদোয়ান উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান। তুরস্কের সাথে ইরাকের তেল ব্যবসা সামনের দিনগুলোতে উচ্চমাত্রায় পৌঁছবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। অন্যদিকে, ভারতে ইরাকের তেলের সরবরাহে যদি কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয় তাহলে ভারতের পরিশোধিত তেলের বাজারও বিরাট লোকসানের মুখে পড়বে।

বিশ্ব পরিস্থিতি যেভাবে পাল্টাচ্ছে, নিত্য নতুন জোট ও মিত্রতা যেভাবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে, তাতে ভারতের চলমান একপেশে পররাষ্ট্রনীতি নানা জটিলতার মধ্যে পড়তে যাচ্ছে। সব ডিম এক ঝুড়িতে রাখার ভারতীয় নীতি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। তুরস্ক নেতৃত্বাধীন দেশগুলোর বাণিজ্য সম্ভাবনাকে অগ্রাহ্য করে ভারত যদি যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়ায় তাতে ভারতের জন্যই বরং বেশি ক্ষতি নির্ধারিত হবে। রাশিয়া, চীন এবং তুরস্কেরও অনেক বেশি প্রভাব ও সম্ভাবনা রয়েছে।

ইসরাইলের মতো চিরচেনা শত্রুর সাথেও আরব দেশগুলো সম্পর্ক স্বাভাবিক করছে। অদূর ভবিষ্যতে সৌদি আরবের সাথেও তুরস্ক বা ইরানের সম্পর্ক মেরামত হয়ে যেতে পারে। ফলে অন্য দেশের কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক চালের দোলাচলে পড়ে ভারতের নিজের বৈদেশিক নীতি প্রণয়ন হতে পারে বিপজ্জনক। ভারতের বর্তমান বিপর্যস্ত অর্থনীতি গভীর সংকটে পড়ে যাবে যদি দেশটি আগামী দিনগুলোতেও একটি ব্লকের দিকেই ঝুঁকে থাকে এবং অপর ব্লকের অপার সম্ভাবনাকে অগ্রাহ্য করে যায়।

বিশ্ব পরিস্থিতি ক্রমাগত পাল্টে যাচ্ছে আর সে পালাবদলের হাওয়া লেগেছে ভারতের নিকট প্রতিবেশী দেশ আফগানিস্তানেও। আফগানিস্তানে প্রায় দুই দশকের বেশি সময় ধরে যুদ্ধ এখন পরিসমাপ্তির দিকে যাচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে আগামী জানুয়ারিতে দোহায় নির্ধারিত আফগান শান্তি আলোচনা একটি সফল পরিণতির দিকেই অগ্রসর হবে। সকল পক্ষই সংঘাত কমিয়ে একটি অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে চায়।

মধ্য জানুয়ারীতে আফগানিস্তানে মার্কিন সেনা সংখ্যা আড়াই হাজারে কমিয়ে নিয়ে আসার ঘোষণা দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান সম্প্রতিক কাবুল সফর করেছেন। দীর্ঘদিন পর ইমরান খানের সফরের মধ্য দিয়ে কোনো একজন পাকিস্তানী প্রধানমন্ত্রী আফগানিস্তান সফর করছেন। দুই প্রতিবেশি দেশ আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে যে তিক্ততাটুকু ছিল, আশা করা হচ্ছে ইমরানের এ সফরের মধ্য দিয়ে তা অনেকটাই হ্রাস পাবে।

আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার ও দেশটিতে তালেবানদের ফিরে আসা এশিয়ার রাজনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে। তালেবানদের ফিরে আসাকে ভারত ভালো ভাবে না নিলেও এটি এখন বাস্তবতা। তালেবানদের সাথে রয়েছে পাকিস্তানের গভীর সর্ম্পক। আফগান শান্তি প্রক্রিয়ার সাথে তুরস্ক ও ইরানের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সংযোগ থাকবে।

যতই শান্তি আলোচনা হোক না কেন, তালিবানের সাথে ক্ষমতা ভাগাভাগি করে নেয়ার বিষয়টি রাজনৈতিকভাবে এখনো আফগানিস্তানের জন্য বড়ো সংকট। আবার যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে শর্তসাপেক্ষে সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছে, তাও খুব একটা বাস্তব নয়। তালেবানদের সাথে কোনো শর্তকে জোর করে চাপিয়ে দেয়ার অবস্থাও যুক্তরাষ্ট্রের নেই।

তালেবানরা শান্তি আলোচনার মাঝেই হুমকি দিয়েছে যে, যদি আগামী মে মাসের মধ্যে আফগানিস্তান থেকে বিদেশী সেনাদেরকে সরিয়ে নেয়া না হয় তাহলে তারা ন্যাটো সেনাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করবে। শুধু তাই নয়, ইরানও আফগানিস্তানের ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশি দেশ হওয়ায় বাইডেন কীভাবে ইরানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের পারমানবিক চুক্তি সংক্রান্ত সংকটের সুরাহা করে তার ওপরও আফগানিস্তানের শান্তি ও স্থিতিশীলতা অনেকটা নির্ভরশীল। আর এবার যদি যুক্তরাষ্ট্রকে তেহরানের সাথে কোনো কার্যকর চুক্তি করতে হয় তাহলে তাদেরকে রাশিয়া ও বেইজিংকেও এ প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র অন্য সবাইকে বাদ দিয়ে খুব একপেশে চুক্তি করে মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটাতে পারবে না।

এ ক্ষেত্রে আফগানিস্তানকে ঘিরে নতুন যে মেরুকরণ ঘটছে তাতে কার্যত ভারতের কোনো ভূমিকা নেই। এক সময় ইরানের সাথে ভারতের ঘনিষ্টতা থাকলেও চীন ও ইরানের মধ্যে কৌশলতগত সর্ম্পক জোরদার হয়েছে। এ ক্ষেত্রে পাকিস্তানও ইরানের সাথে সর্ম্পক বাড়িয়েছে। যেখানে চীনের ভূমিকা রয়েছে। এমনকি চাবাহার বন্দরে চীনের বিনিয়োগ নিশ্চিত করা হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ভারত যত বেশি সৌদি-আমিরাতি ও ইসারইলি ব্লকে ঢুকে পড়বে তাতে অর্থনৈতিকভাবে আরো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।