যে কারণে লিবিয়ায় থাকতে চায় তুরস্ক

লিবিয়ার প্রধানমন্ত্রী ফায়াজ আল সেরাজের সঙ্গে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান - সংগৃহীত

  • মুরশিদুল আলম চৌধুরী
  • ০৪ জানুয়ারি ২০২১, ০৯:১৫

২০২০ সালের জানুয়ারিতে লিবিয়ায় পা রাখেন তুর্কি সেনারা। এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে দেশটির সেনারা সেখানে আরও ১৮ মাস অবস্থান করবেন বলে একটি প্রস্তাবে সায় দিয়েছে তুরস্কের পার্লামেন্ট। প্রশ্ন হলো, কেন তারা অবস্থানের মেয়াদ বাড়ালেন? কেন তারা লিবিয়া ছাড়তে চাচ্ছেন না?

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, অস্থিতিশীলতা সৃষ্টিকারীদের মূলোৎপাটনে যতদিন পর্যন্ত লিবিয়ার বৈধ সরকার মনে করবে সেখানে আঙ্কারার সহযোগিতা প্রয়োজন, ততদিন দেশটিতে সামরিক উপস্থিতি অব্যাহত রাখবে তুরস্ক।

লিবিয়ায় সেনা মোতায়েনের মেয়াদ বাড়ানো সংক্রান্ত যে প্রস্তাব অনুমোদন করেছে তুর্কি পার্লামেন্ট, সেখানে বলা হয়েছে, ‘তুরস্ক এবং এ অঞ্চলে লিবিয়া থেকে ঝুঁকি ও হুমকি আসছে। তথাকথিত লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মি সংক্ষেপে এলএনএ’র হামলা নতুন উদ্যমে ফের শুরু হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ভূমধ্যসাগরের জলরাশি এবং উত্তর আফ্রিকায় তুরস্কের স্বার্থ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে লিবিয়ার বৈধ সরকারের সমর্থনে সেনা উপস্থিতির মেয়ার বাড়ানোর বিকল্প নেই।’

লিবিয়ায় গৃহযুদ্ধের প্রেক্ষাপট একটু বলে নিই। লিবিয়া সঙ্ঘাতের সূচনা ২০১১ সালে আরব বসন্তের মধ্য দিয়ে। এ সময় লিবিয়ার শাসক মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে হত্যা করা হয়। এরপর থেকেই দেশটিতে গৃহযুদ্ধ চলছে। কয়েক বছরের সঙ্ঘাতের পর জাতিসঙ্ঘের সহায়তায় সরকার গঠন করেন প্রধানমন্ত্রী ফায়াজ আল সেরাজ। রাজধানী ত্রিপোলিভিত্তিক তার সরকারের লক্ষ্য ছিল দেশকে স্থিতিশীল করা।

কিন্তু সবাই এতে সম্মত হননি বরং একসময়কার গাদ্দাফির সহযোগী জেনারেল খলিফা হাফতার নিজেই ক্ষমতা চেয়ে বসেন। তিনি তবরুক ও বেনগাজি শহরকে কেন্দ্র করে ‘লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মি’ গঠন করেন। তার দাবি, একমাত্র তিনিই নিরাপত্তা পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও ইসলামপন্থীদের হঠিয়ে দিতে পারবেন।

লিবিয়ার দ্বিতীয় প্রধান শহর বেনগাজি থেকে ইসলামপন্থীদের তাড়িয়ে ২০১৪ সালে জেনারেল খলিফা হাফতারের উত্থান ঘটে। এক সময় কর্নেল গাদ্দাফির সহযোগী থাকলেও হাফতার লিবিয়ায় পরিচিত হন গাদ্দাফির সঙ্গে বৈরিতার কারণে। তিনি নির্বাসিত হিসেবে অনেক বছর আমেরিকার ভার্জিনিয়ার ল্যাংলিতে কাটিয়েছেন। এই শহরেই মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ’র প্রধান দফতর। এখানে বসেই গাদ্দাফির পতনের ছক আঁকতেন জেনারেল হাফতার।

ইসলামপন্থীদের হঠানোর চেষ্টায় হাফতার বাহিনী গত বছরের এপ্রিল থেকে ত্রিপোলি অভিমুখে এগোতে থাকে এবং ডিসেম্বরে গুরুত্বপূর্ণ শহর সিরত দখল করে নেন তারা। লিবিয়ায় বিভিন্ন শহরভিত্তিক মিলিশিয়ারাও একে অন্যের সঙ্গে লড়াই করছে, যাদের মধ্যে ইসলামিক স্টেটের একটি অংশও রয়েছে।

মিসর, জর্দান, ফ্রান্স, আরব আমিরাত ও সৌদি আরব বলছে, তারা এ অঞ্চলে ইসলামপন্থীদের থামাতে চান। তারা জেনারেল হাফতারকে নানা সহায়তা দিচ্ছেন। ওই অঞ্চলে প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টারত রাশিয়াও শেষ পর্যন্ত হাফতারের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে নিয়েছেন। অন্যদিকে জাতিসঙ্ঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি, তুরস্ক, কাতারসহ বেশ কয়েকটি দেশ প্রধানমন্ত্রী সেরাজকে সমর্থনে দিচ্ছে।

তুরস্ক বলেছে, সেখানে মূলত জাতিসংঘের পৃষ্ঠপোষকতায় তৈরি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করতে ২০১৫ সালে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ‘গভর্নমেন্ট অব ন্যাশনাল অ্যাকর্ড’ সংক্ষেপে জিএনএ সরকারকে সমর্থন দিচ্ছে দেশটি। জাতিসংঘ এ সরকার গঠন করেছিল ন্যায্য, সমন্বিত, দীর্ঘস্থায়ী ও শান্তিপূর্ণ সমাধানে আসার উদ্দেশ্যে। কিন্তু, ২০১৯ সালের এপ্রিলে যুদ্ধবাজ হাফতার এবং তার স্বঘোষিত ‘লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মি’ জাতিসংঘ-সমর্থিত জিএনএ সরকার হটিয়ে ত্রিপোলি দখলের পদক্ষেপ নেয়। হাফতারের এ আক্রমণাত্মক ভূমিকা শুধু রাজনৈতিক প্রক্রিয়ারই ক্ষতিসাধন করেনি, বরং ত্রিপোলি সরকারের প্রতি তুর্কি সরকারের সমর্থনকেও আবশ্যিক করে তোলে।

হাফতার বাহিনীতে ড্রোন, ট্যাঙ্ক, ভারী অস্ত্রশস্ত্র এমনকি ভাড়াটে বিদেশি সৈন্যও রয়েছে। ২০১৪ থেকে লিবিয়ায় চলা ভয়াবহ সঙ্ঘাতে হাফতারকে প্রধানত অর্থায়ন করছে আরব আমিরাত ও মিশর। এ আঞ্চলিক দুই শক্তি রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও লজিস্টিক সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে তাদের।

ঘটনা-পরিক্রমায় হাফতারের হামলা থেকে সরকার ও জনগণকে রক্ষা করতে তুরস্কের কাছে সহায়তা কামনা করে জিএনএ। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৯ সালের নভেম্বরে আঙ্কারা ও জাতিসংঘ-সমর্থিত সরকারের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ২০২০ সালের ২ জানুয়ারি জিএনএকে সমর্থন দিতে লিবিয়ায় সেনা মোতায়েনের প্রস্তাব অনুমোদন করে তুরস্কের পার্লামেন্ট। তুরস্ক জিএনএকে সশস্ত্র ড্রোন ও আকাশ প্রতিরক্ষা সিস্টেমসহ আবশ্যকীয় সামরিক সহায়তা প্রদান করে।

তুরস্কের সামরিক সহায়তা নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় জাতিসংঘ-সমর্থিত জিএনএকে রক্ষা করতে সক্ষম হয় এবং হাফতারের এলএনএ পরিচালিত হামলাগুলোকে প্রতিহত করে। যুদ্ধক্ষেত্রে এলএনএ বাহিনীকে পরাজিত করার মাধ্যমে ২০২০ সালের এপ্রিল পর্যন্ত শক্ত অবস্থানে ছিল জিএনএ। জিএনএ’র জয়ের পর জাতিসংঘের ফ্রেইমওয়ার্ক ফের সক্রিয় করার কূটনৈতিক উদ্যোগ নেওয়া হয়। দীর্ঘস্থায়ী এ সমস্যার সুরাহা নিয়ে আলোচনা চলতে থাকে।

এ বছরের আগস্ট পর্যন্ত সেখানে যুদ্ধবিরতি কার্যকর ছিল। জাতিসংঘের রাজনৈতিক কর্মসূচিও এগিয়ে যাচ্ছিল। জাতিসংঘের পৃষ্ঠপোষকতায় ‘লিবিয়ান পলিটিক্যাল ডায়ালগ ফোরাম’ জাতীয় ঐক্যের লক্ষ্যে পক্ষগুলোকে নিয়ে সবার অংশগ্রহণে একটি ঐকমত্যের সরকার গঠন করতে চেয়েছিল।

শান্তি আলোচনায় একটি রাজনৈতিক চুক্তিতে উপনীত হয়ে লিবিয়া সংকটের স্থায়ী সমাধানের সুযোগও তৈরি হয়েছিল। কিন্তু, এরই মধ্যে হাফতারের এলএনএ বেশ কয়েকবার যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে। জাতিসংঘ সমর্থিত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলি আল-শরিফ সম্প্রতি বলেছেন, লিবিয়ার অভিবাসী ও তেলসমৃদ্ধ কৌশলগত অঞ্চল উবারিতে যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করেছেন হাফতার।

সিনিয়র এ লিবিয়ান কর্মকর্তা জানান, সর্বশেষ দক্ষিণ লিবিয়ায় হাফতারের বাহিনী ফ্রান্সের নির্দেশে বড়সড় সামরিক অভিযান পরিচালনা করেছে। তেলসমৃদ্ধ এলাকাগুলোতে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠাই ছিল এর উদ্দেশ্য। এর মাধ্যমে সাহেল ও সাহারা অঞ্চলে তাদের উপস্থিতি মজবুত করতে চেয়েছেন তারা। এরপর লিবিয়ার পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে।

এখানে জাতিসংঘ সমর্থিত সরকারকে তুর্কি বাহিনী সহায়তা দিয়েছে মাঠে ভারসাম্য আনার উদ্দেশ্যে। তুরস্ক চেয়েছে, সঙ্ঘাতের সমাপ্তি ঘটুক এবং লিবিয়ানরা নিজেদের জন্য একটি চুক্তিতে উপনীত হোক। দেশটিতে অস্থিতিশীলতা ডেকে আনা বিদেশি চালকদের প্রভাব সংকুচিত হোক।

তুরস্ক এটাও চায় যে, পূর্ব ভূমধ্যসাগরের জলরাশিতে তুরস্ক এবং লিবিয়ার অধিকার ও স্বার্থ অক্ষুণ্ন থাকুক। তুরস্ক-লিবিয়া সমুদ্রসীমা চুক্তি অনুযায়ী দুই দেশ পরস্পরকে সমুদ্রসীমা বাড়ানোর অধিকার দিয়েছে।

লিবিয়ায় বহুবিধ স্বার্থ রয়েছে তুরস্কের। দেশটিতে অর্থনৈতিক ও ভূকৌশলগত বিভিন্ন স্বার্থ তো আছেই, সঙ্গে আছে পূর্ব ভূমধ্যসাগরের বিষয়। তুর্কি সরকারের উদ্বেগ রয়েছে যে, লিবিয়ান গৃহযুদ্ধ এ অঞ্চলে এক ভয়াবহ প্রভাব ফেলবে। এ যুদ্ধের মাধ্যমে দীর্ঘস্থায়ী অস্থিতিশীলতা তৈরি হবে, সঙ্গে তুর্কিবিরোধী শক্তির উত্থান আরো প্রবল হবে। এ কারণে আমিরাত, মিশর, রাশিয়া ও ফ্রান্সের প্রভাব থেকে লিবিয়াকে মুক্ত রাখতে চায় তুরস্ক। লিবিয়া এসব দেশের জালে আবদ্ধ হয়ে গেলে সেখানে তুরস্কের ভূকৌশলগত ও অর্থনৈতিক স্বার্থ ঝুঁকির মধ্যে পড়বে।

লিবিয়া ও তুরস্কের মধ্যে রয়েছে সামরিক প্রশিক্ষণ ও সহযোগিতা চুক্তি। এর অংশ হিসেবে তুরস্ক লিবিয়ার বিমানবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। মিলিটারি রিসোর্স ও অভিজ্ঞতা বিনিময়ও চলছে।

খবরে বলা হয়েছে, লিবিয়ার দুটি সামরিক ঘাঁটি ব্যবহার করবে তুরস্ক। এ নিয়ে জিএনএ’র সঙ্গে তাদের আলোচনা হয়েছে। ঘাঁটি দুটি হলো: মিসরাতা নৌঘাঁটি ও আল ওয়াতিয়া বিমানঘাঁটি। জিএনএ’র অনুগত বাহিনী হাফতারের হাত থেকে ঘাঁটি দুটি পুনরুদ্ধার করেছিল। তার মানে, পূর্ব দিক থেকে হামলা এলে নৌ ও বিমান ঘাঁটি থেকে সমানভাবে যত দ্রুত সম্ভব প্রত্যুত্তর দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে তুরস্ক।

সাদামাঠাভাবে বললে, লিবিয়ার বৈধ সরকারের আমন্ত্রণে সেখানে অবস্থান করছে তুরস্ক। সুতরাং, জিএনএ’র বাহিনীগুলোকে প্রশিক্ষণ দেওয়া অব্যাহত রাখতে তাদের কোনো সমস্যা নেই। বলা বাহুল্য, বৈধ জিএনএ সরকার যতদিন আঙ্কারার সমর্থন প্রয়োজন মনে করবে, তুরস্ক ততদিন লিবিয়ায় অবস্থান করবেই।

জনসংখ্যা ৭০ লাখেরও কম, কিন্তু আফ্রিকার সবচেয়ে বড় তেল-গ্যাসের রিজার্ভ আছে লিবিয়ায়। এর অবস্থান ইউরোপের ঠিক উল্টো দিকেই। এখানকার হাইড্রোকার্বন ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে সরাসরি রপ্তানি হতে পারে। অন্যদিকে উপসাগরীয় এলাকার প্রতিদ্বন্দ্বী তেল-গ্যাস উৎপাদকদের জাহাজগুলোকে আসতে হয় বিপজ্জনক সমুদ্রপথ দিয়ে। এক কথায় লিবিয়া একটি আকর্ষণীয় দেশ।

তেল, গ্যাস, হাইড্রোকার্বন আর ভৌগলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এ মাটির সুবিধা নিতে মরিয়া স্বার্থন্বেষী আন্তর্জাতিক মহল। সেখানে, ভূমধ্যসাগরের প্রতিবেশিকে রক্ষা করতে এরদোয়ান এগিয়ে আসবেন, এটাই তো স্বাভাবিক।