উচ্চরক্তচাপ যে কথা জেনে রাখা ভালো

-

  • ডা. মিজানুর রহমান কল্লোল
  • ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১৩:৪৪

এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, হাইপারটেনশন বা উচ্চ রক্তচাপ জীবনের জন্য হুমকিস্বরূপ। সাধারণত কোনো বয়স্ক ব্যক্তির সংকোচন চাপ ১৪০ ও প্রসারণ চাপ ৯০ মি.মি. পারদের উপরে হলেই রক্তচাপ সম্পর্কে সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। তবে কোনো যুবকের ক্ষেত্রে প্রসারণ চাপ ৯০ হলেই চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করা উচিত। অনেককেই দেখা যায় উচ্চ রক্তচাপের কেয়ার করেন না, শোনেন না চিকিৎসকের উপদেশ; এসব মানুষের জন্য অপেক্ষা করে দুর্যোগপূর্ণ ভবিষ্যৎ। যেকোনো সময় মৃত্যু এসে কড়া নাড়তে পারে দরজায়।
কেন এই উচ্চ রক্তচাপ
যদিও ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে উচ্চ রক্তচাপের কারণ সঠিকভাবে জানা যায়নি তবু কিছু কিছু ঘটনা ও পরিস্থিতি উচ্চ রক্তচাপের সৃষ্টি করে। যেমন-
জীবনযাপন : কোনো কোনো মানুষের ক্রমাগত হতাশা ও মানসিক চাপ থেকে উচ্চ রক্তচাপ হতে পারে।
বংশগত : উচ্চ রক্তচাপের ক্ষেত্রে রয়েছে বংশগত ধারার ব্যাপক ভূমিকা। কিন্তু তাই বলে পরিবারের একজন উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হলে অন্য সদস্যও যে আক্রান্ত হবে এমনটি বলা যায় না।
অতিরিক্ত সোডিয়াম ও চর্বি : খাদ্য তালিকায় অতিরিক্ত সোডিয়াম (খাবার লবণ থেকে) ও চর্বি থাকলে কিংবা শরীরে সোডিয়াম নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা না থাকলে উচ্চ রক্তচাপ হতে পারে।
কিডনির অসুবিধা : সাধারণত কিডনি আক্রান্ত হলে রক্তে রেনিন নামক হরমোনের নিঃসরণ মাত্রা বেড়ে যায় এবং রক্তচাপ বৃদ্ধি পায়।
অতিরিক্ত খনিজ : খাদ্য কিংবা পানীয়তে ক্যাডমিয়াম নাইট্রেটের মতো গৌণ খনিজ উপস্থিত থাকলে রক্তচাপ বেড়ে যায়।
লিঙ্গ : সাধারণত পুরুষদের উচ্চ রক্তচাপের প্রবণতা মহিলাদের চেয়ে বেশি। কালো পুরুষরা সাদাদের চেয়ে দ্বিগুণ পরিমাণ উচ্চ রক্তচাপে ভোগেন। তবে মহিলারা, বিশেষ করে গর্ভবতী অবস্থায় কিংবা জন্ম নিরোধক ওষুধ সেবনকালে উচ্চ রক্তচাপে ভুগতে পারেন।
শারীরিক গঠন : ছোটখাটো, মোটা বিশেষত যাদের ওজন তুলনামূলক বেশি উচ্চ রক্তচাপে ভোগার ঝুঁকিও তাদের বেশি।

উচ্চ রক্তচাপের সম্ভাব্য লক্ষণগুলো
* মাথা ঝিমঝিম করা
* শ্বাসকষ্ট হওয়া
* মাথা ব্যথা করা
* বমি বমি ভাব হওয়া
* কখনো কখনো আপাতভাবে বিনা কারণে নাক দিয়ে রক্ত পড়া
* ধীরে ধীরে দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়া

কী চিকিৎসা নিতে হবে
উচ্চ রক্তচাপের প্রধান চিকিৎসা হলো চিকিৎসকের নির্দেশ আজীবন অনুসরণ করা। সুস্থবোধ করলেও চিকিৎসা বাদ দেয়া যাবে না। এবং ওষুধে কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ঘটলেও তা চিকিৎসককে জানাতে হবে। কোনো ওষুধ বন্ধ করা যাবে না।
উচ্চ রক্তচাপ কমাতে আপনাকে নিম্নলিখিত ব্যবস্থা নিতে হবে-
১. ওজন কমান : উচ্চ রক্তচাপের প্রধান শত্রু হলো দেহের ওজন বেড়ে যাওয়া। যদি আপনি ওজন কমাতে পারেন তাহলে আপনার হৃৎপিণ্ডের ওপর চাপ কমে যাবে এবং আপনি সুস্থবোধ করবেন।
২. ক্ষতিকর খাবার বাদ দিন : উচ্চ রক্তচাপ কমাতে হলে আপনি খাদ্যতালিকা থেকে অতিরিক্ত সোডিয়াম লবণ, চর্বিযুক্ত গোশত এবং কোলেস্টেরল বাদ দিন।
৩. বিশ্রাম নিন : টেনশনমুক্ত হয়ে বিশ্রাম নিন। চমৎকার ঘুম নিশ্চিত করুন।
৪. ব্যায়াম করুন : কখনোই অতিরিক্ত নয়। ক্লান্ত হওয়ার আগেই ব্যায়াম বন্ধ করুন।
৫. নিয়মিত ওষুধ খান : কখনোই ওষুধ বন্ধ করবেন না। চিকিৎসকের পরামর্শমতো নির্দিষ্ট মাত্রায় নিয়মিত ওষুধ সেবন করুন।
উচ্চ রক্তচাপের রোগী হিসেবে আপনার করণীয়
আপনার উচ্চ রক্তচাপ থাকলে আগে চিকিৎসকের মাধ্যমে তাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার ব্যবস্থা রাখুন, সেই সাথে অনুসরণ করুন নিচের পরামর্শগুলো :
* সর্বদা চিকিৎসকের পরামর্শ অনুসরণ করবেন। এর ফলে আপনি রক্ষা পাবেন জটিলতার হাত থেকে।
* প্রতিদিন সময়মতো ওষুধ খাবেন। উচ্চ রক্তচাপের কোনো লক্ষণ নেই ভেবে ওষুধ খাওয়া বন্ধ করবেন না।
* নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করান। কোনো ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বা লক্ষণ দেখা দিলে চিকিৎসককে বলুন।
* ধূমপান একেবারেই করবেন না। মনে রাখবেন ধূমপানের ফলে উচ্চ রক্তচাপ আরো বৃদ্ধি পায় এবং হার্ট অ্যাটাকেরও ভয় থাকে।
* রক্তচাপ মাপার যন্ত্র এবং স্টেথোস্কোপ সাথে রাখবেন। মনে রাখবেন উচ্চ রক্তচাপ রোধের একমাত্র উপায় হচ্ছে নিয়মিত রক্তচাপ পরীক্ষা করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া।

উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসা না করালে কী ক্ষতি হতে পারে
* হার্ট অ্যাটাক
* আর্টারিও স্কে¬রোসিস (রক্তনালীর বাইরের দেয়ালে ক্ষত সৃষ্টি হওয়া ও শক্ত হওয়া)
* অ্যাথেরো স্কে¬রোসিস (রক্তনালীর ভেতরের দেয়ালে চর্বি ও অন্যান্য পদার্থ জমে রক্তপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হওয়া।
* হৃৎপিণ্ডে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি
* স্ট্রোক বা পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হওয়া, মস্তিষ্কের স্থায়ী ক্ষতিসাধন ঘটা
* চোখের রক্তনালীর ওপর ক্রমাগত চাপ পড়ে স্ফীত হওয়া ও অন্ধত্বের সৃষ্টি হওয়া
* কিডনি কার্যকরভাবে শরীরের বর্জ্য অপসারণ করতে পারে না বলে শরীরে বিষক্রিয়ার সৃষ্টি হওয়া।

উচ্চ রক্তচাপ সম্পর্কে দ্বন্দ্বের নিরসন
* উচ্চ রক্তচাপ একবার হলে তা চিরতরে না-ও ভালো হতে পারে। তবে এটি নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় ও জটিলতার আশঙ্কা কমানো যায়।
* বয়স বাড়ার সাথে সাথে রক্তচাপ বাড়তে পারে এ কথা সত্য।

উচ্চ রক্তচাপ সম্পর্কে আরো দ্বন্দ্বের নিরসন
একটু বয়স হলেই লোকজন হাইপারটেনশন নিয়ে চিন্তায় পড়ে যান। রক্তচাপ কী বেড়ে যাচ্ছে? কী করা উচিত? এসব নানাবিধ প্রসঙ্গ। অনেকের ভুল ধারণা রয়েছে এ ব্যাপারে। দ্বন্দ্বের নিরসনে প্রশ্নোত্তর দেয়া হলো যা আপনাকে অনেকখানি সাহায্য করবে।
হাইপারটেনশন বা উচ্চ রক্তচাপের প্রধান কারণগুলো কী?
বলা হয়ে থাকে যে, দুই ধরনের হাইপারটেনশন রয়েছে। প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি। হাইপারটেনশনের ৯০ শতাংশ ভোগেন প্রাইমারি বা এসেনশিয়াল হাইপারটেনশনে যার কারণ হলো বংশগত বা পারিবারিক। বাকি শতাংশ ভোগেন সেকেন্ডারি হাইপারটেনশনে- কিছু রোগের জন্য যা ঘটে, যেমন কুশিংস সিনড্রোম বা দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ অথবা কিছু নির্দিষ্ট ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে হাইপারটেনশন ঘটে। যারা প্রাইমারি হাইপারটেনশনে ভোগেন তাদেরকে অবশ্যই বুঝতে হবে যে, তাদের অবস্থাটা নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে কিন্তু রোগমুক্তি হবে না। সেকেন্ডারি হাইপারটেনশনের কারণ খুঁজে বের করার জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে চিকিৎসার মাধ্যমে রোগমুক্তি ঘটে।

হাইপারটেনশন এবং হৃদরোগের মধ্যে সম্পর্কটা
অনিয়ন্ত্রিত হাইপারটেনশনের রোগীদের অন্যদের চেয়ে করোনারি হৃদরোগের প্রকোপ বেশি। কারণ দীর্ঘকালীন হাইপারটেনশন যেমন ধমনী হৃৎপিণ্ডে রক্ত সরবরাহ করে সেসবসহ বিভিন্ন ধমনীতে ক্ষতিসাধন ও পরিবর্তন করে বিপরীতভাবে। যখন প্ল্যাক ধমনীর দেয়ালের মধ্যে জড়ো হয়ে তাদের সরু বানায়, এসব সরু ধমনীর ভেতর দিয়ে রক্ত চলাচল করতে এবং বিভিন্ন অংশে পৌঁছানো নিশ্চিত করতে হৃৎপিণ্ডের কঠিন কাজ করতে হয়। এর অর্থ হলো রক্তকে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি চাপ প্রয়োগ করতে হয় যার পরিণতিতে রক্তচাপ বেড়ে যায়।
এটা সাধারণভাবে জানা যায় যে, যখন উচ্চ রক্তচাপ উচ্চমাত্রার কোলেস্টেরলের সাথে জোড়াবাঁধে, হৃদরোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
বছর পেরিয়ে গেলে হাইপারটেনশন ধীরে ধীরে রক্তনালীগুলোকে (বিশেষ করে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের ক্ষুদ্র থেকে মাঝারি আকৃতির রক্তনালীগুলো) ক্ষতিগ্রস্ত করে। সুতরাং অনিয়ন্ত্রিত এবং দীর্ঘকালীন উচ্চ রক্তচাপের কারণে চোখ, মস্তিষ্ক, হৃৎপিণ্ড এবং কিডনির ক্ষতি হতে পারে। দীর্ঘকালীন হাইপারটেনশন হার্ট ফেইলিওর ঘটায়। অনির্ণীত এবং অনিয়ন্ত্রিত হাইপারটেনশন পায়ের রক্তনালীগুলোকেও আক্রমণ করতে পারে এবং হাঁটার সময় পায়ের মাংসপেশিতে ব্যথা সৃষ্টি করে।

হাইপারটেনশন নিয়ন্ত্রণে ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
হাইপারটেনশন নিয়ন্ত্রণ করতে এন্টিহাইপারটেনসিভ হিসেবে যেসব ওষুধ সচরাচর প্রেসক্রাইবড করা হয় সেগুলো হচ্ছে বিটাব্লকার, ডাই ইউরেটিক ক্যালসিয়াম এন্টাগনিস্ট, এসিই, ইনহিবিটর এবং ভ্যাসোডাইলেটরগুলো। অন্য কারো কিছু ওষুধ ক্লিনিক্যাল প্র্যাকটিসে ব্যবহার করা হয়। বিটা ব্লকারগলো যেমন প্রোপ্রানল, মেটোপ্রোনল এবং এটেনোনল কখনো কখনো অবসাদ, ক্লান্তি, শীতলতা ঘটাতে পারে এবং কখনো কখনো মানসিক দ্বিধাগ্রস্ততা ঘটায়। এগুলো ব্রংকিয়াল অ্যাজার অবনতি ঘটায়। হৃৎস্পন্দন কমায়, এমনকি হার্ট ফেইলিওরের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। বিরল পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে পুরুষত্বহীনতা। ডাই ইউরেটিকগুলো যেমন থায়াজাইড এবং ফ্রুসেমাইড শরীরে দুর্বলতা ও পানিস্বল্পতা ঘটাতে পারে, ডায়াবেটিসকে আরো খারাপ করে এবং বাত বৃদ্ধি করে। ক্যালসিয়াম এন্টাগনিস্টগুলো যেমন নিফিডিপিন এবং ডিলটিয়াজেম মুখমণ্ডলে আকস্মিক রক্তোচ্ছ্বাস, বুক ধড়ফড়ানি, কোষ্ঠকাঠিন্য প্রভৃতি ঘটায় এবং হৃৎস্পন্দন কমায়। এসিইইনহিবিটর ওষুধগুলো যেমন ক্যাপটোপ্রিল ও ইনালাপ্রিনের প্রথম মাত্রা কখনো কখনো হঠাৎ করে রক্তচাপ কমায় এবং কিছু সমস্যার সৃষ্টি করে। এসব সমস্যার মধ্যে রয়েছে মাথা ঝিমঝিম করা বা মাথা ঘোরা, মূর্ছা অনুভূতি বোধ করা প্রভৃতি। এসিই ইনহিবিটগুলো কিডনির কাজে খারাপ প্রতিক্রিয়া ঘটাতে পারে এবং রক্তে শ্বেতকণিকার সংখ্যা কমিয়ে দেয়। কিছু কিছু রোগীর অন্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায় যেমন- কফের শুষ্কতা।

হাইপারটেনশন সম্পর্কে কি অন্য কোনো ভুল ধারণা রয়েছে যা রোগীদের মধ্যে দেখতে পাওয়া যায়?
হ্যাঁ, রোগীদের কাছ থেকে এমন অনেক অদ্ভুত কথাই শোনা যায়। তাদের এ ভুল ধারণাটা অবশ্যই ভাঙা দরকার। যেমন যখন আপনি নিজের রক্তচাপ পরিমাপ করেন তা সঠিক হয় না কারণ রক্তচাপ পরিমাপের সঠিক পদ্ধতি প্রয়োগ করা আপনার জন্য সম্ভব হয় না। সঠিক পরিমাপের জন্য নির্ভুলভাবে বাহু ও কব্জি স্থাপন করতে হয় এবং সতর্কভাবে স্টেথেস্কোপের মাধ্যমে বিভিন্ন শব্দ শুনতে হয় এবং এর জন্য কিছুদিন পরিপক্বতা প্রয়োজন। কিন্তু এক বাহু অচল থাকলে নিজের রক্তচাপ গ্রহণ কঠিন হয়ে পড়ে। সঠিক পরিমাপ পেতে সময় সময় ইনস্ট্রুমেন্ট সংশোধন করার প্রয়োজন হয়। ইলেকট্রনিক ইনস্ট্রুমেন্টের ক্ষেত্রে এটা বিশেষভাবে সত্য। সুতরাং আপনি কখনোই আপনার নিজস্ব রক্তচাপ পরীক্ষা থেকে সঠিক ফল লাভ করতে পারেন না।