পবিত্র ভূমির বেদুঈনদের রোমাঞ্চকর গল্প

-

  • রওশন আলম
  • ২১ জুলাই ২০২১, ১১:৫৯

আরবের ইতিহাসে বেদুঈনরা রোমাঞ্চ আর স্বাধীনচেতা জীবনের প্রতীক হিসেবে পরিচিত। আমাদের বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামও তার ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় লিখেছেন-
‘আমি বেদুইন, আমি চেঙ্গিস
আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্নিশ।’

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ আবার তার ‘দুরন্ত আশা’ কবিতায় আরব বেদুঈনদের রোমাঞ্চকর বা বাঁধনহারা জীবনের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেছেন-
‘ইহার চেয়ে হতেম যদি
আরব বেদুয়িন!
চরণতলে বিশাল মরু
দিগন্ত বিলীন।’

আরবিতে প্রচলিত উপভাষা বদয়ি থেকে বেদুঈন শব্দের উৎপত্তি। বদয়ি আবার এসেছে বাদিয়া থেকে। অর্থাৎ যারা বাদিয়া বা মরুভূমিতে অবস্থান করছে, তাদের বেদুঈন বলে। বেদুঈনদের বোঝাতে ‘বেদেয়া’ শব্দও ব্যবহার করা হয়। যার অর্থ হলো আরম্ভ। বেশিরভাগ আরব জনগোষ্ঠীর বিশ্বাস, বেদুঈনরাই প্রথম আরবে এসে বসতি স্থাপন করে। আরবের ইতিহাসে তাদের আরবের উৎস এবং হযরত মুহাম্মাদ সা.-এর নবুয়তের পর দলে দলে ইসলাম গ্রহণের কারণে তাদের ইসলামের সত্ত্বাও বলা হয়। তাই গোত্রভিত্তিক জীবনযাপন করা বেদুঈনরা প্রকৃত আরব দাবি করে নিজেদের ‘গৌরবের উত্তরাধিকারী’ হিসেবে অভিহিত করে। প্রাথমিক যুগে বেদুঈনরা ‘দ্য হলি ল্যান্ড’ বা বর্তমান ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের অধিবাসী ছিল। বেদুঈনদের তাই পবিত্র ভূমির বাসিন্দা হিসেবেও ধরে নেওয়া হয়। মনে করা হয়, ইব্রাহিম আ., ইসহাক ও ইয়াকুব আ. বেদুঈন গোত্রের লোক ছিলেন। পরবর্তীতে বেদুঈনরা আরব উপদ্বীপ অর্থাৎ বর্তমান ইয়েমেন, আরব আমিরাত এবং মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।

যাযাবর বেদুঈনরা তাঁবুর লোক হিসেবেও পরিচিত। কারণ তারা যখন একস্থান থেকে অন্যস্থানে যায়, তখন স্বাভাবিকভাবেই তাঁবুর নিচে বসাবাস করে। বেদুঈনরা মরুভূমির জাহাজ খ্যাত উটে চড়ে বেড়ায় এবং ভেড়া, ছাগল, গবাদিপশু লালন-পালন করে জীবিকা নির্বাহ করে। আর এই পশু চরাতে তারা খড়-খাগড়া ও ঘাসের সন্ধানে বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়ায়।

একসময় বেদুঈনরা মূলত প্যাগান বা প্রকৃতি পূজারি ছিল। মহানবী হযরত মুহাম্মদ সা. আরবে ইসলামের প্রচার শুরু করলে বেদুঈনদের অনেক গোত্র দলে দলে এসে ইসলাম গ্রহণ করে। অর্থাৎ বেদ্ঈুনরা মূলত মুসলমান। তবে এখনো কিছু বেদুঈন গোত্র রয়েছে যারা খ্রিস্ট ধর্ম পালন করে। বেশিরভাগ বেদুঈন সুন্নি মুসলিম এবং মুসলমানদের সকল আচার-অনুষ্ঠান পালন করে। তাদের মধ্যকার ধর্ম বিশেষজ্ঞ সকল ব্যবস্থাপনা ও ধর্ম শিক্ষা প্রচারের দায়িত্বে থাকেন। অনেক বেদুঈন জিন, রাক্ষস এবং আহল আল-আরদের মতো মন্দ আত্মায় বিশ্বাস করে। যারা কখনো কখনো মরুভূমিতে একাকি যাতায়াতের ক্ষেত্রে মানুষের ক্ষতিসাধন করে। তারা লাশ দাফন-কাফনের ক্ষেত্রেও ইসলামিক রীতি-নীতি মেনে চলে। আরবের অন্যান্য মানুষের মতো বেদুঈনদের ভাষাও আরবি। তবে বেদুঈনরা আরবির ভিন্ন ভিন্ন উপভাষা ব্যবহার করে।

হাজার বছর ধরেই বেদুঈনরা পশুপালন করে আসছে। এসব পশু তারা অন্যান্য পেশাজীবী মানুষদের কাছে বিক্রি করতো। উট, ঘোড়া ও গাধা মালবাহী প্রাণী হিসেবে এবং ভেড়া ও ছাগল খাদ্য ও উলের পোশাক তৈরিতে কাজে আসতো। তৎকালীন ব্যবসা-বাণিজ্যের অনেকটাই বেদুঈনদের উপর নির্ভর করতো, কারণ এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে মালামাল পরিবহনের জন্য বেদুঈনদের উপর নির্ভর করতে হতো। বেদুঈনরা এসব মালবাহী দলের জন্য গাইড রূপে কাজ করতো। এরা মরুভূমির মধ্যে পথ দেখিয়ে তাদের নিয়ে যেত ও নিরাপত্তা দিত।

বেদুঈন সমাজ গোষ্ঠীগত এবং পিতৃতান্ত্রিক। তারা সাধারণত যৌথ পরিবার গঠন করে। বেদুঈন সমাজের ভিত্তি হলো বিশ্বস্ততা ও আত্মীয়তা। তাদের মধ্যে একক পরিবারকে বলা হয় তাবু। এই পরিবারে সাধারণত ৩ থেকে ৪ জন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি এবং যেকোনো সংখ্যার শিশু থাকে। যখন বেশি খাদ্যের উৎস খুঁজে পাওয়া যায় তখন অনেকগুলো তাবু মিলে গউম হিসেবে তারা সেখানে ভ্রমণ করে। কোনো কোনো সময় গউমে বিয়ে অথবা পরিচিতির ভিত্তিতেও সদস্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বেদুঈনদের সবচেয়ে বড় পরিবারের প্রধানকে শেখ বলে ডাকা হয়। শেখের সহকারী হিসেবে সমাজের গণমান্যদের নিয়ে একটি কাউন্সিল থাকে।

বেদুঈনদের খাদ্যতালিকা খুবই সাধারণ। বলতে গেলে খেজুর তাদের সারা বছরের সাধারণ খাদ্য। এমনও সময় গেছে যখন বেদুঈনরা সারা মাস শুধু খেজুর খেয়েই কাটিয়ে দিয়েছে। তারা নিজেরা খেজুরের চাষ করে, খেজুরগুলো রোদে শুকিয়ে তা শীতকালে খাওয়ার জন্য সংরক্ষণ করে।

তবে খেজুর ছাড়া বেদুঈনদের প্রধান খাদ্য হলো রুটি, দই, দুধ এবং বিভিন্ন রকমের মাংস। মাঝেমধ্যে তারা ভাতও খেয়ে থাকে, তবে সেটা উৎসব বা কোনো বিশেষ উপলক্ষে। তারা ছাগলের মাংস ও চাল একসাথে রান্না করে খেতে পছন্দ করে, যেটা অনেকটা বিরিয়ানীর মতোই। সকালের নাস্তায় সাধারণত থাকে দই, রুটি ও কফি।

বেদুঈনদের রুটি অনেকটা আমাদের দেশে তৈরী চা-পাতি রুটির মতোই। আটা দিয়ে খামির তৈরী করে গোল গোল বল আকৃতির মতো করে রাখা হয়। এরপর গম্বুজাকৃতির একটি ধাতব পাত্র চুলার উপর রেখে তার উপরে রুটি সেঁকা হয়। খুব বেশি খাদ্য সংকট না থাকলে মূলত এই রুটিই বেদুঈনদের প্রাত্যহিক খাদ্য।

কফি বেদুঈনদের এক উল্লেখ করার মতো ঐতিহ্য। বেদুঈনরা দিনের একটা বড় সময়জুড়ে কফি পান করে। আসলে মরুভূমির ভেতর চিত্ত-বিনোদনের তেমন কোনো ব্যবস্থা না থাকায় কফি পান করাও তাদের বিনোদনেরই একটা উৎস। বেদুঈনরা ঘন ও দানাদার কফি পান করে থাকে, যার মধ্যে এলাচ ও আদার শিকড় থাকে। এগুলো সব একটি পাত্রে নিয়ে ফুটিয়ে তৈরী করা হয়। বেদুঈন সংস্কৃতিতে অতিথি এলে তাকে এই কফি ও খেজুর পরিবেশন করে স্বাগত জানানো হয়। বেদুইনরা নিজেরাই এসব কফি উৎপাদন করে থাকে। বখশিশ বা উপঢৌকন হিসেবেও তারা একে অন্যকে কফি বীজ দিয়ে থাকে।

বিশেষ উৎসবে বিনোদন হিসেবে তারা উটের দৌড়ের আয়োজন করে। উটকে তারা আল্লাহ প্রদত্ত উপহার হিসেবে বিবেচনা করে। এছাড়া বেদুঈনদের রয়েছে নিজস্ব গান ও সুর। গানের সুর তোলার জন্য ড্রাম, এক তারের বাদ্যযন্ত্র এবং বাতাসচালিত বাদ্যযন্ত্র রয়েছে। সেইসঙ্গে যুগ যুগ ধরে প্রচলিত কিন্নর নামক বাদ্যযন্ত্রও রয়েছে তাদের।

বেদুঈনরা বেশ কলহপ্রবণ বলে পরিচিত। মরুভূমির চরম প্রতিকূল পরিবেশ তাদের চিত্তকে সেভাবেই গড়ে তুলেছে। আগেকার দিনে এক গোত্র আরেক গোত্রকে আক্রমণ করতো পানীয় জলের উৎস, যেমন কুয়া বা জলাধারের দখল নিতে। এছাড়া পালিত পশুদের জন্য চারণভূমির দখল নিতেও যুদ্ধ হতো। ফলে গোত্রগুলো নিজেরা বেশ একতাবদ্ধ এবং সবাই কিছু কঠোর নিয়ম মেনে চলে, যেখানে পরিবারের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। কোনো হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হলে প্রতিশোধ নেয়াকে সবকিছুর থেকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। ‘রক্তের বদলে রক্ত’ এখানে মূলমন্ত্র। কোনো পরিবারের কেউ নিহত হলে ওই পরিবারের প্রথম ৫ জন ভাই বা চাচাতো ভাইদের দায়িত্ব খুনীকে খুঁজে বের করে হত্যা করা। যদি খুনীকে খুঁজে পাওয়া না যায় তাহলে বেদুঈন প্রথা অনুযায়ী খুনীর পরিবারে অন্য কোনো পুরুষ সদস্যকে হত্যা করা হয়।

বহু শতাব্দী আগে কিছু বেদুঈন গোত্রের জন্য হজ্ব কাফেলাগুলোকে আক্রমণ করাও স্বাভাবিক ঘটনা ছিলো। যেমন- ১৭৫৭ সালে বনি সাকর গোত্রের কাদান আর ফাইয়াজের নেতৃত্বে একটি বেদুঈন দল একটি হজ্ব কাফেলাকে আক্রমণ করলে প্রায় ২০ হাজার হজ্বযাত্রী মারা যায়।

বেদুঈনরা মরুভূমির নাড়িনক্ষত্র সম্পর্কে অবগত, মরুভূমির বালিতে সামান্য অচেনা আঁচড়ও তাদের দৃষ্টি এড়ায় না। হাজার বছর ধরে এই দক্ষতা বেদুঈনদের প্রবৃত্তিতে মিশে গেছে। ঠিক এই দক্ষতাকেই কাজে লাগিয়েছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। বিশ্বের একমাত্র এই ইহুদী রাষ্ট্রের সীমান্ত পাহারার দায়িত্বে রয়েছে বিশেষায়িত মুসলিম বেদুঈনরা! ইসরায়েলি সেনাবাহিনীতে বেদুঈন ট্র্যাকিং ইউনিট নামের এই শাখায় আরব বেদুঈনরা বহু বছর ধরে তাদের মিলিটারি সার্ভিস দিয়ে আসছে।

তবে গত শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে বেদুঈনরা যাযাবর জীবন ছেড়ে দিতে থাকে। মধ্যপ্রাচ্যে তেল আবিষ্কার হওয়ার পর অর্থনৈতিক উন্নতিই এর মূল কারণ। বেদুঈনদের সামান্য কিছু গোত্র বাদে সবাই এখন স্থায়ী শহুরে জীবনে যোগ দিয়েছে, যেখানে রয়েছে শান-শওকত। তাদের অনেকে এখন ব্যবসা করে। অর্থনৈতিক অবস্থারও পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু ঐতিহ্যস্বরূপ তারা তাদের সাংস্কৃতিক বিষয়গুলোকে লালন করে। যা এখন মধ্যপ্রাচ্যের পর্যটন শিল্পের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। মধ্যপ্রাচ্যের ধনী দেশগুলোতে রয়েছে অনেক বেদুঈন ক্যাম্প, যেখানে পর্যটকরা যান একদিনের বেদুঈন হওয়ার স্বাদ নিতে।