জ্বালানী নিয়ে পুতিনের নতুন চাল

বিশ্বের প্রাকৃতিক গ্যাসের ১৭ শতাংশ উৎপাদন করে রাশিয়া - ছবি : সংগ্রহীত

  • মোতালেব জামালী
  • ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ২২:৪০

........ সে রকম কিছু ঘটলে ইউরোপে রাশিয়ার গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এজন্য রাশিয়া তেল গ্যাসের বাজার হিসেবে চীনকে বেছে নিচ্ছে। আগামি দিনে রাশিয়ার জ্বালানীর বাজারের গতিপথ বদলে গেলে বিশ্বের জ্বালানী নিরাপত্তার ওপর এর প্রভাব পড়বে।

 

রাশিয়া ২০১৯ সাল থেকে চীনে গ্যাস রপ্তানী শুরু করে। এখন তা আরো বাড়ছে। অর্থাৎ পশ্চিম থেকে পূর্বমূখী হচ্ছে রাশিয়া। অন্যদিকে জ্বালানীর জন্য রাশিয়ার উপর নির্ভরতা কমানোর বিকল্প উৎস খুজছে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র। এজন্য যুক্তরাষ্ট্র কাতারের সাথে আলোচনা শুরু করেছে। এ পরিস্থিতিতে বিশ্বের জ্বালানী বাণিজ্যে বড় ধরণের দিক বদল হতে যাচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্র দেশগুলোর সঙ্গে রাশিয়া ও চীনের সম্পর্কের চরম অবণতি হয়েছে। ইউক্রেন নিয়ে রাশিয়ার সাথে এবং তাইওয়ান ও দক্ষিন চীন সাগর ইসুতে চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের চলছে উত্তেজনা। যুক্তরাষ্ট্রকে অভিন্ন শত্রু মনে করে চীন ও রাশিয়া।

এই অভিন্ন শত্রুকে যৌথভাবে মোকাবেলা করার কৌশল নিয়েছে বিশ্বের এই দুই পরাশক্তি। এ কারণেই দেশ দুটির মধ্যে গড়ে উঠেছে ঐক্য। গত কয়েক বছর ধরেই বাণিজ্যিক ও অথনৈতিক থেকে শুরু করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই ঐক্য সম্প্রসারিত হচ্ছে। চীন এখন রাশিয়ার তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের প্রধান ক্রেতা। চীনের পাশাপাশি রাশিয়া পাইপলাইনের মাধ্যমে পাকিস্তানেও গ্যাস সরবরাহের পরিকল্পনা নিয়েছে বলে রুশ কর্মকর্তারা আভাস দিয়েছেন। চীন সফর শেষ করে পাকিস্তান ঘোষণা দিয়েছে- প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান রাশিয়া সফরে যাবেন। ইতোমধ্যে আফগানিস্তান ঘিরে পাকিস্তানের সাথে রাশিয়ার সর্ম্পক যে কোনো সময়ের চেয়ে ঘনিষ্ট হয়েছে।

বিশ্বের প্রাকৃতিক গ্যাসের ১৭ শতাংশ উৎপাদন করে রাশিয়া। আর এই গ্যাসের জন্য রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল ইউরোপীয় দেশগুলো। ইউরোপীয় ইউনিয়নের তথ্যমতে, ১৯৭০ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে ইউরোপ প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি শুরু করে। সম্প্রতিক বছরগুলোতে ইউরোপের সেই নির্ভরতা আরও বেড়েছে।

ইউক্রেন নিয়ে সংকটের মধ্যে ইউরোপীয় দেশগুলো রাশিয়ার বিকল্প হিসেবে অন্য কোন দেশ থেকে গ্যাস আমদানির চেষ্টা করছে। অন্যদিকে ইউরোপীয় গ্রাহকদের সঙ্গে উত্তেজনা বাড়ার কারণে রাশিয়াও একটি নতুন পাইপলাইনের মাধ্যমে চীনে গ্যাস সরবরাহ বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে।

ইউক্রেন ইস্যুকে কেন্দ্র করে রাশিয়ার উপর নতুন কঠোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার হুমকি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা। যদি এ ধরনের কিছু ঘটে তাহলে রাশিয়াকে এই নিষেধাজ্ঞা মোকাবেলায় সহযোগিতা করার আভাস দিয়েছে চীন। রাশিয়ার এই সংকটময় সময়ে শীতকালীন বেইজিং অলিম্পিকর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং এর আমন্ত্রণে বেইজিং যান রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। পুতিনের চীন সফর দুই দেশের মধ্যেকার শক্তিশালী সম্পর্ককে আরো জোরদার করার বার্তা দেয়।

যুক্তরাষ্ট্রের আশঙ্কা ইউক্রেন সংকটকে কেন্দ্র করে রাশিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তার গ্যাসকে ভূরাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন। তিনি ইউরোপে গ্যাসের সরবরাহ অনেক কমিয়ে দিতে পারেন। এতে জার্মানী, পোল্যান্ড ও ইতালীসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশ সবচেয়ে বেশি জ্বালানী সংকটে পড়বে। এই সংকট মোকাবেলা করতেই কাতারের দিকে হাত বাড়িয়েছেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। কেননা কাতারই হতে পারে এক্ষেত্রে একটি নির্ভরযোগ্য বিকল্প।

ইউক্রেন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ন্যাটোর বিরুদ্ধে রাশিয়াকে জোরালো সমর্থন দিচ্ছে চীন; কিন্তু তার অর্থ এই নয়, ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণকে চীন সমর্থন করবে বা স্বাগত জানাবে। ইউক্রেনের সাথেও চীনের সুসম্পর্ক রয়েছে। চীনের যোগাযোগ অবকাঠামো নেটওয়ার্ক বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী দেশ হচ্ছে ইউক্রেন। ফলে চীন চাইবে না এ অঞ্চলে কোনো ধরনের অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হোক।

বেইজিং সফরকালে পুতিন চীনে তেল ও গ্যাস রপ্তানির জন্য দেশটির সঙ্গে ১১৭ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি করতে সম্মত হয়েছেন। রাশিয়া থেকে চীনে প্রতি বছর ১০ বিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাস রপ্তানি করা হবে।

ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ জানিয়েছেন, চীনের সঙ্গে তেল ও গ্যাস রপ্তানী চুক্তির সময়সীমা ২৫ বছর। অবশ্য চীনের একটি শিল্প প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, সেই চুক্তির মেয়াদ বাড়িয়ে ৩০ বছর করা হয়েছে। ২০১৩ সালে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী রোসনেফটের চীনে ৩২৫ মিলিয়ন টন তেল রফতানী করার কথা ছিল। ২০০৫ সাল বর্তমান সময় পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি চীনে ৪২৫ মিলিয়ন টন তেল রপ্তানী করেছে বলে রাশিয়ার সরকারি মিডিয়ার খবরে বলা হয়েছে।

রাশিয়া ২০১৪ সালে ইউক্রেনের কাছ থেকে ক্রিমিয়া দখল করে নেয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্র দেশগুলো রাশিয়ার ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। সে সময়ও চীন রাশিয়ার পাশে দাঁড়িয়েছিল। তখন বেইজিং রাশিয়ার কাছ থেকে তেল-গ্যাস কেনার জন্য ৪০০ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি সই করেছিল। এই বিশাল চুক্তি সে সময় রাশিয়াকে বড় ধরণের অর্থনৈতিক সংকট থেকে থেকে রক্ষা করেছিল।

রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখল করা নিয়ে চীনের মধ্যে অস্বস্তি থাকলেও তুলনামূলক কম দামে এবং সহজ শর্তে রাশিয়ার কাছে থেকে গ্যাস কেনার সুযোগ হাতছাড়া করেনি বেইজিং। পাওয়ার অব সাইবেরিয়া পাইপলাইন-১ এর মাধ্যমে ২০১৯ সাল থেকে থেকে চীনে গ্যাস রপ্তানি শুরু করে রাশিয়া। এখন পাওয়ার অব সাইবেরিয়া পাইপলাইন-২ নির্মাণ করে সেটির মাধ্যমে আরো গ্যাস সরবরাহ করা হবে।

নতুন পাইপলাইনটি রাশিয়ার শাখালিন দ্বীপ থেকে জাপান সাগর হয়ে মঙ্গোলিয়ার ভেতর দিয়ে চীনের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় হেইলংজিয়াং প্রদেশে গিয়ে পৌছবে। এজন্য রাশিয়ার গ্যাস সরবরাহকারি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান গ্যাজপ্রমের সাথে চুক্তি হয়েছে চীনের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান সিএনপিসি’র। নতুন এই পাইপ চীনে পৌছবে। এছাড়াও রাশিয়া চীনে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসও রপ্তানি করছে জাহাজের মাধ্যমে। ২০২১ সালে চীনে ১৬ দশমিক ৫ বিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাস রপ্তানি করেছে রাশিয়া।

এই প্রতিবেদনের ভিডিও দেখুন:

 

পাওয়ার অব সাইবেরিয়া পাইপলাইনের মাধ্যমে ইউরোপে গ্যাস সরবরাহের কোন সংযোগ নেই। ফলে আগের পরিকল্পনা অনুযায়ী, রাশিয়া এই পাইপলাইন দিয়ে ২০২৫ সালের মধ্যে চীনকে ৩৮ বিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাস সরবরাহ করতে চায়।

এ ছাড়া রাশিয়ান তেল রপ্তানীকারী রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান রোসনেফ্ট কাজাখস্তানের মাধ্যমে ১০ বছরে ১০০ মিলিয়ন টন তেল সরবরাহ করতে চীনের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান চায়না ন্যাশনাল পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন ’র সঙ্গে ৮০ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি করেছে।

বেইজিংয়ে চীনের একটি টিভি চ্যানেলকে দেয়া সাক্ষাৎকারে পুতিন বলেন, চীন ও রাশিয়ার সম্পর্ক মর্যাদাপূর্ণ এবং অভূতপূর্ব। ইউক্রেন সংকট ছাড়াও দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সংক্রান্ত নিয়ে আলোচনা করেন পুতিন ও শি জিন পিং। পুতিন জানান, রাশিয়া চীনের কাছে গ্যাস রপ্তানি বাড়াতে প্রস্তুত। এ জন্য রাশিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় সাইবেরিয়া থেকে নতুন একটি পাইপলাইনের মাধ্যমে বছরে ১০ বিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাস চীনে সরবরাহ করা হবে। এর ফলে রাশিয়া থেকে চীনে গ্যাস রপ্তানির পরিমাণ বছরে ৪৮ বিলিয়ন ঘন মিটারে দাঁড়াবে।

শুধু তেল-গ্যাস নয়, রাশিয়ার অত্যাধুনিক সব অস্ত্রের বড় ক্রেতাও চীন। রাশিয়ার মোট রপ্তানি আয়ের ২৫ শতাংশ চীন থেকেই আসে। ২০১৫ সালে চীন ও রাশিয়ার মধ্যে বাণিজ্যের পরিমান ছিল মাত্র ৬৮ বিলিয়ন ডলার। ২০২১ সালে এসে তা ১৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। চলতি বছর বাণিজ্যের পরিমাণ ২০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি হবে বলে আশা করছে দেশ দুটি।

চীন বিশ্বের প্রধান জ্বালানী ব্যবহারকারী ও আমদানীকারক দেশ। ২০২১ সালে চীন ৫১৩ মিলিয়ন টন অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করে। যদিও ২০২০ সালের তুলনায় এ আমাদানির পরিমাণ ৫ দশমিক ৪ ভাগ কম। ২০২০ সালে চীন ৫৪২ মিলিয়ন টন অপরিশোধিত তেল আমদানি করে। দৈনিক হিসেবে এর পরিমাণ ১ কোটি ৩০ লাখ ব্যারেল। চীন সবচেয়ে বেশি অপরিশোধিত তেল আমদানি করে সৌদি আরব ও রাশিয়া থেকে। অপর দিকে ২০২১ সালে বিশ্বের শীর্ষ লিকুইফাইড ন্যাচারাল গ্যাস আমদানিকারকও ছিল চীন।

অপরদিকে রাশিয়া বিশ্বের তৃতীয় বৃহৎ তেল রপ্তানিকারক দেশ। রাশিয়া দৈনিক ১ কোটি ৫ লাখ ব্যারেল তেল উত্তোলন করে। বিশ্বের ১১ ভাগ তেল রপ্তানি করে রাশিয়া।

ইউক্রেন নিয়ে যুদ্ধ বেধে গেলে রাশিয়ার উপর যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্রদের চাপ বাড়বে। নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি অর্থ লেনদেনকারি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্টান সুইফট থেকে রাশিয়াকে বের করে দেয়া হলে তখন রাশিয়াকে আরো বেশি চীনের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়তে হবে।
সে ক্ষেত্রে রাশিয়াকে চীনের সাথে দেশটির আন্তঃসীমান্ত ব্যাংকিং লেনদেন ব্যবস্থা বা ক্রস-বর্ডার ইন্টার ব্যাংক পেমেন্ট সিস্টেমের মাধ্যমে প্রয়োজন মেটাতে হবে। এই সিস্টেমটি সুইফট এর বিকল্প চীনা ব্যবস্থা। চীন ২০১৫ সালে এটি চালু করলেও এখনো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তেমন গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। তবে রাশিয়া তার সংকটের সময়ে চীনের এই প্রতিষ্ঠানের সহায়তা কাজে লাগিয়ে বিপদমুক্ত হতে পারবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।