সে যুগ হয়েছে বাসি!

নানা বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও চীন ও আসিয়ানের মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ দু'টোই বেড়েছে - চায়না ডটঅর্গ

  • হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী
  • ২৬ নভেম্বর ২০২০, ১৬:০৭

একটা সময় ছিল, যখন বিভিন্ন দেশ মিলে সামরিক জোট গড়তো। কবি-র মতো ''সে যুগ হয়েছে বাসি'' বলার সময় এখনও আসেনি। তবে সময়ের পরিক্রমায় সামরিক জোটের পাশাপাশি এগিয়ে এসেছে অর্থনৈতিক জোট। এশিয়ার দেশগুলোকে নিয়ে একটি অর্থনৈতিক জোট গড়ার ধারণাটি প্রথম উচ্চারিত হয় আজ থেকে প্রায় এক দশক আগে। অবশেষে গত ১৫ নভেম্বর ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠিত এক আঞ্চলিক শীর্ষ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে জোটটি আত্ম প্রকাশ করলো। কারা আছে এই জোটে আর এর প্রভাবই বা কেমন হবে আজ জানাবো সেই বিশ্লেষণ।

নতুন এই জোটের নাম দ্য রিজিওনাল কম্প্রিহেনসিভ ইকনমিক পার্টনাশিপ বা আরসিইপি। জোটের সদস্যসংখ্যা ১৫। সদ্যগঠিত জোটে আসিয়ান জোটের ১০ সদস্যদেশ ছাড়াও আছে চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও নিউ জিল্যান্ড। এখন এটিই হতে যাচ্ছে বিশ্বের বৃহত্তম মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি।

ভার্চুয়াল শীর্ষ সম্মেলনে দেখা যায়, সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর নেতারা তাদের বাণিজ্যমন্ত্রীদের পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন আর মন্ত্রীগণ চুক্তির কপিতে একে একে সই দিয়ে যাচ্ছেন। চুক্তিভুক্ত দেশগুলোতে বাস করে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ মানুষ। তাদের জিডিপি-ও একই। খানিকটা অবাক করার মতো হলেও সত্য যে, নতুন এ মুক্ত বাণিজ্য চুক্তিতে এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ দেশ ভারত নেই। এ চুক্তির অন্তর্ভুক্ত হলে দেশীয় শিল্প প্রতিষ্ঠান ও উৎপাদকরা ক্ষতির শিকার হবেন - এমন আশঙ্কায় গত বছর এ উদ্যোগ থেকে সরে আসে ভারত।

চুক্তিতে সইদাতা দেশগুলোর মিলিত জিডিপি ২৬ দশমিক দুই ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো-কানাডা অ্যাগ্রিমেন্ট এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের জিডিপি-র চাইতেও বেশি।

আরসিইপি দেশগুলো আগামী ২০ বছরের মধ্যে নিজেদের মধ্যে বাণিজ্যে শুল্কহার ৯০ শতাংশ পর্যন্ত রেয়াত দেবে এবং ই-কমার্স, ট্রেড ও মেধাসম্পদের বিষয়ে অভিন্ন নীতি প্রণয়ন করবে। তবে শ্রম ও পরিবেশ বিষয়ে তাদের কোনো অঙ্গীকারের কথা জানা যায়নি।

আরসিইপি চুক্তিভুক্ত দেশগুলোর বিভিন্ন কম্পানি ও ব্যবসায়ীরা এসব দেশের যে-কোনোটিতে তাদের পণ্য রফতানি করতে পারবে, প্রত্যেক দেশের জন্য আলাদা করে কিছু করতে হবে না। এর ফলে অনেক খরচ ও সময় বাঁচবে। আশা করা হচ্ছে, আগামী বছরই এ চুক্তি কার্যকর হবে।

এই জোটের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, এশিয়ার অর্থনৈতিক পাওয়ারহাউস নামে পরিচিত তিন দেশ চীন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া এই প্রথম বারের মতো একসাথে একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত হলো। যা এশিয়ার অর্থনৈতিক সর্ম্পকের ওপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে যাচ্ছে বলে ধারনা করা হচ্ছে।

এশিয়া মহাদেশের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলীয় এ তিন দেশ একটি ত্রিপক্ষীয় মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদনের জন্য ২০১২ সাল থেকে আলোচনা চালিয়ে আসছে। কিন্তু ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা তীব্রতর হওয়ায় চুক্তি সম্পাদনের পর্যায়ে উপনীত হতে পারেনি।

এখন মনে করা হচ্ছে, চীনকে দক্ষিণপূর্ব এশিয়া পর্যন্ত পৌঁছে দেবে আরসিইপি, করোনা অতিমারীর প্রাদুর্ভাব সত্ত্বেও যেখানে এ বছর ব্যবসা-বাণিজ্যের আকার বেড়েছে।

করোনা অতিমারীর কারণে আসিয়ান দেশগুলোর যে অর্থনৈতিক বিপর্যয় ঘটেছে, আরসিইপি তা থেকে এসব দেশকে উদ্ধার করবে বলে আশা করা হচ্ছে। তার চাইতেও বড় বিষয় হলো, আরসিইপি-গঠনের মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলের গুরুত্বের ওপর প্রতীকীভাবে হলেও আলোকপাত করা হলো। এ অঞ্চল আগামী দিনে ''এশিয়ান সেঞ্চুরি'' নামে পরিচিত হবে বলে অনেক বিশ্লেষক বিশ্বাস করেন।


বিভিন্ন পূর্বাভাস থেকে ধারণা করা হচ্ছে, চলতি দশকের শেষ নাগাদ আশিয়ান ব্লক হবে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতি। গত বছর জোটভূক্ত দেশগুলোর সম্মিলিত জিডিপি ছিল দুই দশমিক ৫৭ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার।

এ চুক্তির মূল কারিগর চীন। তাই অনেকেই মনে করছেন, আরসিইপি-কে অনেকটা টেনে নিয়ে যাবে চীন। এর মধ্য দিয়ে দেশটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট বাইডেনের শিবিরকে দেখিয়ে দেবে যে, ট্রাম্পের একতরফা ও আত্মকেন্দ্রিক শাসনামলেও চীন কিভাবে তার বহুমুখী মুক্ত বাণিজ্য এজেন্ডাকে এগিয়ে নিয়ে গেছে।

প্রকৃতপক্ষে আরসিইপি যে বিশ্বের বৃহত্তম বাণিজ্যচুক্তি হতে পেরেছে তা ট্রাম্পের একটি পদক্ষেপের কারণে। ২০১৭ সালের গোড়ার দিকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রথম যেদিন সারাদিন অফিস করেন, সেদিনই তিনি তাঁর দেশকে ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ বা টিপিপি থেকে বের করে আনেন। তাঁর এ কাজে আমেরিকার এশিয়ান মিত্র দেশগুলো, বিশেষ করে জাপান, সিঙ্গাপুর ও ভিয়েতনাম চরম হতাশ হয়।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে বাইডেনের দায়িত্ব গ্রহণের আর মাত্র মাস দুয়েক বাকি থাকতেই স্বাক্ষরিত হলো আরসিইপি। অন্যদিকে ট্রাম্প যে চুক্তি থেকে আমেরিকাকে বের করে এনেছিলেন সেই ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ-এর নতুন নামকরণ হয়েছে কম্প্রিহেনসিভ অ্যান্ড প্রগ্রেসিভ অ্যাগ্রিমেন্ট ফর ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ বা সিপিটিপিপি। বাইডেন ঘোষণা দিয়েছেন তিনি আমেরিকাকে ওই চুক্তিতে ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন। কিন্তু সমস্যা হলো, এ কাজ করতে গিয়ে বাইডেন দেশের ভেতরেই বিপুল বাধার মুখে পড়তে পারেন।

টিপিপি থেকে আমেরিকাকে বের করে আনার পক্ষে ট্রাম্পের পক্ষে যুক্তি ছিল, এ চুক্তিতে থাকার কারণে মার্কিন চাকরির বাজার ও ম্যানুফ্যাকচারিং খাত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কিন্তু সিপিটিপিপি-তে আরসিইপি-র চাইতেও বেশি হারে এবং দ্রæত গতিতে ট্যারিফ নির্মূলের কথা বলা হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, এতে শ্রম ও পরিবেশ ইস্যুকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যা আরসিইপি-তে নেই।

ট্রাম্প প্রশাসনের আরেকটি পদক্ষেপেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুনামহানি ঘটে। সেটি হলো চলতি বছরের আসিয়ান শীর্ষ সম্মেলনে এবং ভিয়েতনামে অনুষ্ঠিত ইস্ট এশিয়া শীর্ষ সম্মেলনে একজন জুনিয়র অফিসারের নেতৃত্বে মার্কিন প্রতিনিধিদল পাঠানো।

গত বছর আসিয়ান শীর্ষ সম্মেলনের পাশাপাশি ব্যাংককে অনুষ্ঠিত আসিয়ান-ইউএস শীর্ষ সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজে আসেননি, এমনকি তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স কিংবা পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেওকেও পাঠাননি। এতে আসিয়ান নেতাদের অনেকেই ক্ষুব্ধ হন, কেউ-কেউ ওই শীর্ষ সম্মেলন বর্জনও করেন।

চীনা পণ্যের ওপর শুল্ক বাড়িয়ে ট্রাম্প চীনের বিরুদ্ধে যে বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু করেছিলেন, তা থেকে চীনকে কিছুটা হলেও স্বস্তি দেবে আরসিইপি। চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র তাই বলেন, নানা বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও চীন ও আসিয়ানের মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ দু'টোই বেড়েছে।

আসলেই তাই। আসিয়ান চেয়েছে, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নকে ডিঙিয়ে ২০২০ সালের প্রথম আট মাসে তারাই হবে চীনের বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার। হয়েছেও তাই। চীনের সরকারি হিসেবেই বলা হচ্ছে, ওই সময় চীন-আসিয়ান বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৪১৬ দশমিক ছয় বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

চীন-আসিয়ান বাণিজ্যের বহর যেভাবে বাড়ছে তাতে করে ইউরোপ থেকে চীনের আমদানি ব্যাপকভাবে কমে যাবে। এ অবস্থায় আগামী বছরগুলোতে তারা আবার চীনের বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাবে।

আরসিইপি নিয়ে সংবাদমাধ্যমগুলো যখন মাতামাতি করছে, চুক্তিভুক্ত দেশগুলো তখন নিজেদের মধ্যে সহযোগিতার নতুন নতুন ক্ষেত্র খুঁজে বের করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। এর একটি হলো দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে জরুরী ওষুধের মজুদের পরিমাণ প্রকাশ। এটি করা হলে সদস্য দেশগুলো অপেক্ষাকৃত সহজে জরুরি ওষুধ পেতে পারবে। এতে কম্বোডিয়ার মতো দেশগুলো উপকৃত হবে।
ইতিমধ্যেই আসিয়ানের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগের সাথে একমত হয়েছে আরসিইপি। অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন, এ উদ্যোগের মধ্য দিয়ে মনে হচ্ছে এ অঞ্চলের দেশগুলো বিদেশের ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকতে চায় না। জোটের ধনী দেশগুলোই বরং তাদের দরিদ্র প্রতিবেশীদের সাহায্য করতে আগ্রহী।

এ নিয়ে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মহিউদ্দীন ইয়াসিন বলেন, করোনা যদি আমাদের বড় কোনো শিক্ষা দিয়ে থাকে তা হলো, বর্তমানে বা ভবিষ্যতে যে কোনো অপ্রত্যাশিত সঙ্কটে আসিয়ানকে হতে হবে স্বনির্ভর।

ফিলিপিন্সের প্রেসিডেন্ট রড্রিগো দুতার্তের মতে, আমাদের দেখিয়ে দিতে হবে যে আমাদের অঞ্চলের ভাগ্যবিধাতা আমরাই এবং লক্ষ্য অর্জন ও সমস্যা সমাধানে আমরা সবাই একজোট হয়ে কাজ করতে পারি।

চুক্তিতে সই করা দেশগুলোর নেতাদের আশাবাদ সত্ত্বেও এখানে কিছু সমস্যার কথা আলোচিত হচ্ছে। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে যেটা বড় হয়ে উঠছে সেটা হলো, ২০২০ সাল শেষ হতে যাচ্ছে একটি বিশাল সাফল্যের মুকুট পরে। তা হলো বিশ্বের বৃহত্তম বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদন। এ জোট কাজ শুরু করবে আগামী বছর অর্থাৎ ২০২১ সালে। সবার চোখ এখন সেদিকেই।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে