বিজেপিকে মোকাবেলার মোক্ষম অস্ত্র হলো অর্থনীতি

মহানবী সা: অবমাননার প্রতিবাদে বিক্ষোভ - আরব নিউজ

  • হায়দার সাইফ
  • ১২ জুন ২০২২, ১০:০৮

 

আরব উপদ্বীপে ভারতীয়রা বাস করে আসছে প্রায় কয়েক শতাব্দি আগে থেকে। সেখানকার ভারতীয়রা মূলত অরাজনৈতিক ও শান্তিপ্রিয়। কিন্তু ভারতে যে হিন্দু জাতীয়তাবাদের উত্থান শুরু হয়েছে, এবং ভারতে সংখ্যালঘুদের পরিস্থিতির যে অবনতি শুরু হয়েছে, তার কারণে এই প্রবাসী ভারতীয়রা চাপের মধ্যে পড়ে গেছে।

২০২০ সালে ইসলামবিদ্বেষী বক্তব্যের কারণে হাতে গোনা কিছু ভারতীয় কর্মীকে সংযুক্ত আরব আমীরাত থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। চলতি বছরের শুরুর দিকে, হিজাব পরিহীত নারীর সাথে বৈষম্যের অভিযোগে বাহরাইনের একটি ভারতীয় রেস্তোরাঁ বন্ধ করে দেয়া হয়।

আবারও একই ধরণের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপির দুই নেতা ইসলাম ও নবী মোহাম্মদ সা. কে নিয়ে আপত্তিকর কথা বলায় সেটা নিয়ে সোশাল মিডিয়ায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। এর প্রতিক্রিয়ায় সেখানে ভারতীয় পণ্য বয়কটের ডাক দেয়া হয়েছে। ভারত সরকার বাধ্য হয়ে দুই কর্মকর্তাকে বহিষ্কার করেছে এবং তাদের নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে।

তবে উপসাগরীয় দেশগুলোতে বসবাসকারী এবং সেখানকার নাগরিকদের কাছে হিন্দুত্ববাদের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার বিষয়টি বিপুল সংখ্যক প্রবাসী ভারতীয় থাকার পরও এর আগে কখনও অতটা জটিল হয়নি। কারণ ভারতের সাথে উপসাগরীয় অঞ্চলের দুই বৃহত্তম দেশ সৌদি আরব আর সংযুক্ত আরব আমীরাতের বহু আগে থেকেই গভীর ভূ কৌশলগত সম্পর্ক রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভারতের ক্ষমতায় আসার পর থেকে এই পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে। কারণ তখন থেকেই ভারতের রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে মুসলিম বিদ্বেষের আচরণ প্রকাশ পেতে শুরু করেছে।

ভারতে গভীরভাবে যে ধারণা প্রচলিত রয়েছে, সেটা হলো আরব অভিজাত শ্রেণীর লোকেরা সুবিধাবাদী, এবং ইসলামের ব্যাপারে তাদের তেমন আবেগ অনুভূতি নেই। সাধারণ ভারতীয় থেকে নিয়ে সেখানকার বিশেষজ্ঞ সবারই ধারণা হলো, আব্রাহাম অ্যাকোর্ডস মুসলিম মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষমতাসীন অভিজাতবর্গের রাজনৈতিক শঠতার বহিপ্রকাশ মাত্র। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। এই ধারণার মধ্যে ফিলিস্তিনি ইস্যু আর মুসলিম দেশগুলোর ধর্মপরায়নতাকে গুলিয়ে ফেলা হয়েছে। ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়ার প্রশ্নে সৌদি আরব সংযুক্ত আরব আমীরাতের সাথে যোগ দেয়নি। এতে বোঝা যায় সৌদি আরবের জনমতের প্রতি সেখানকার ক্ষমতাসীন শ্রেণী কোন পর্যায়ের স্পর্শকাতর।

বিজেপির শীর্ষ পর্যায়ের দুই-দুইজন কর্মকর্তা এ ধরণের বেপরোয়া আপত্তিকর মন্তব্য করেছেন। ধারণা করা যায় যে, দলের শীর্ষ পর্যায়ে এমন ধারণা রয়েছে যে, শিখদের সাথে যতক্ষণ পর্যন্ত সমঝোতার ভিত্তিতে ব্যবসাটা চলছে, ততক্ষণ পর্যন্ত মুসলিম বিদ্বেষী কর্মকাণ্ড চালিয়ে পার পাওয়া যাবে।

কিন্তু এটা খুবই অপরিপক্ক মনোভাব। ইসলামী আদর্শের ধারণাটা ইতিহাসের একটা বাস্তবতা। সে কারণে ভুল পদক্ষেপ নিয়ে মুসলিম বিশ্বের রোষের মুখে পড়েছে ভারত সরকার। উপসাগরীয় অঞ্চলের অধিকাংশ দেশই কূটনৈতিক পর্যায়ে তাদের অসন্তোষ জানিয়েছে বলে জানা গেছে। এমনকি মধ্যমপন্থী ইসলামের দেশ হিসেবে পরিচিত জর্ডানও ভারতের অবস্থানকে প্রত্যাখ্যান করেছে। সোশাল মিডিয়ায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা গেছে, পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলো ভারত সরকারের কাছে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়ার দাবি জানিয়েছে।

মোদি সব সময়ই তার উগ্রপন্থী চিন্তার জন্য পরিচিত। তিনি মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালেই স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে অন্যতম কুখ্যাত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছিল। এর ধারাবাহিকতায় যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন এবং ইউরোপিয় দেশগুলো তাকে বয়কট করেছিল। কিন্তু তিনি যখন প্রধানমন্ত্রী হলেন, তখন এমনকি সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমীরাত, এবং বাহরাইনের মতো দেশও তাকে সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মানে ভুষিত করেছে।

২০০৮ সালের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা, এর পরের আরব বসন্ত এবং আরব উপদ্বীপ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নিজেকে গুটিয়ে নেয়ার পর বেশ কিছু উপসাগরীয় দেশ পূর্বে মুখ ফিরিয়েছে। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নিরাপত্তার জন্য তারা চীন আর ভারতের সাথে যুক্ত হয়েছে। আরব আমীরাত আর সৌদি আরব এখন ভারতের শীর্ষ পাঁচটি বাণিজ্য অংশীদার দেশের অন্তর্ভুক্ত।

উপসাগরীয় অঞ্চলে ভারতের সবচেয়ে বেশি প্রবাসী বাস করছে সংযুক্ত আরব আমীরাতে। শুধু তাই নয়, সেখানে রয়েছে ভারতীয় বংশোদ্ভুত ১৩ জন বিলিয়নেয়ার। সংখ্যার দিক থেকে যেটা বিশ্বের অন্য যে কোন দেশের তুলনায় বেশি। দেশে রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য প্রবাসী ব্যবসায়ীদের তোষণের ক্ষেত্রে মোদি সরকার কখনও পিছু হটেনি। আরব আমীরাত সফরে মোদি এমনকি ভারতীয় ব্যবসায়ীদের সাথে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেছিলেন বলেও কিছু সংবাদে জানা যায়। কিছু সূত্র জানিয়েছে, এই ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে তিনি বিতর্কিত জম্মু ও কাশ্মীরে বিনিয়োগের ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি নিয়েছেন। বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে ওই অঞ্চলে মানবাধিকার পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি হয়েছে।

মোদির অধীনে ভারতে ইসলাম-বিদ্বেষ ছড়ানোর ব্যাপারে কুয়েত সবসময়ই প্রতিবাদ করেছে। উপসাগরীয় অঞ্চলের এই দেশটিতে মোদি এখন পর্যন্ত সফর করেননি। চলতি বছরের শুরুর দিকে, ভারতের কর্নাটকে হিজাব পড়ার কারণে মুসলিম শিক্ষার্থীদের শ্রেণীকক্ষে ঢুকতে না দেয়ার পর কুয়েতের পার্লামেন্টের একটি গ্রুপ জোর দাবি জানিয়েছিল, যাতে কুয়েতে বিজেপির কোন সদস্যদেরকে ঢুকতে দেয়া না হয়।

ভারতে নবী মোহাম্মদ সা. কে নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্যের ঘটনায়, কুয়েত ও কাতারে দুই দেশেই ভারতীয় রাষ্ট্রদূতদের তলব করা হয়েছিল। কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভারত সরকারের প্রতি দাবি জানিয়েছে, যাতে তারা এই ঘটনার জন্য প্রকাশ্যে ক্ষমা চায়।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ব মোটা দাগে গ্লোবাল নর্থ আর গ্লোবাল সাউথে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। ভারত, আরব আমীরাত, সৌদি আরব, আর ইসরাইল এখন অনানুষ্ঠানিক রাজনৈতিক ব্লকের অংশ হয়ে পড়েছে। কারণ এই দেশগুলোর ভূ-অর্থনৈতিক কৌশল এবং রাশিয়ার অভিযানের ব্যাপারে নিরপেক্ষ অবস্থান তাদেরকে এক জায়গায় নিয়ে এসেছে।

অন্যদিকে, কুয়েত ও কাতারের মতো দেশগুলোর ইসলামী ঐতিহ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম ন্যাটো-বহির্ভূত মিত্র হিসেবে তাদের অবস্থান হয়েছে কিছুটা ভিন্ন। তারা এখন খোলামেলা ইসলাম বিদ্বেষের কারণে ভারত সরকারের উপর কূটনৈতিক চাপ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

মোদির আমলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি প্রশাসনই ভারতে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা বৃদ্ধি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে। কিন্তু ভারত সে সবে পাত্তা দেয়নি। একমাত্র উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর প্রতিক্রিয়ার পরই ভারত ত্বরিৎ পদক্ষেপ নিলো।

কিন্তু, এই সামান্য পদক্ষেপে ভারতের মুসলিমদের দীর্ঘমেয়াদি কোন ইতিবাচক পরিবর্তন নিশ্চিত হবে না। বিজেপি শুধু জাতীয় নির্বাচনে দুইবার বিজয়ীই হয়নি, বরং তারা এখন দেশের সবচেয়ে ধনী রাজনৈতিক দল। নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে তারা যে কোন পাবলিক প্রতিষ্ঠানকে জলাঞ্জলি দিতে কুণ্ঠাবোধ করবে না।

এমনকি বলিউডকেও এখানে ছাড় দেয়া হয়নি। মোদির আমলে বলিউড অন্যতম কোমল শক্তির অস্ত্রে পরিণত হয়েছে। মুসলিমদের নেতিবাচকভাবে উপস্থাপনের জন্য উপসাগরীয় দেশগুলোতে বেশ কিছু ভারতীয় সিনেমা নিষিদ্ধ হয়েছে।

ভারতে হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের সাথে এবং উপসাগরীয় অঞ্চলে তাদের কোমল শক্তির সাথে লেনদেনের ক্ষেত্রে অর্থনীতিকে প্রধান ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। প্রবাসী ভারতীয়রা বিজেপির আয়ের সবচেয়ে বড় উৎস। যদিও কিছু উপসাগরীয় দেশে এরই মধ্যে ভারতীয় পণ্য বয়কটের প্রক্রিয়া চলছে, কিন্তু তাদেরকে অর্থনৈতিকভাবে আরও চাপে ফেলতে আরও সামষ্টিক কৌশল গ্রহণ করা দরকার। তবে অসহায় মানুষ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেদিকেও দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন।