গির্জায় যৌন নিপীড়ন নিয়ে উদ্বেগ

-

  • ফারজানা তানিয়া
  • ০৩ নভেম্বর ২০২১, ১৭:০৪

যেখানে নৈতিকতার পাঠ দেওয়া হয়, সেটাই যদি হয় অনৈতিকতার চারণক্ষেত্র, তাহলে ধার্মিকতা প্রশ্নবিদ্ধ হবেই। গির্জার কথা বলছি। গির্জায় অনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে এখন হৈ চৈ চলছে পশ্চিমা বিশ্বে। প্রাপ্তবয়স্কের চেয়ে শিশুরা নিগ্রহের শিকার হচ্ছে বেশি। নারী তো যথারীতি লক্ষ্যবস্তু, পুরুষও বাদ যাচ্ছে না। প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে কোথায় মানুষ পবিত্র হবে? সমাজ বিশুদ্ধ করার বার্তা আসবে কোথা থেকে?

এক ফরাসি পুরোহিতের হাতে যৌন নিগ্রহের শিকার হয়েছিলেন লরেন্স পাউজাদে। এরপর মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন তিনি। পাউজাদে সেই কষ্টকর স্মৃতি রোমন্থন করেছেন।

ফরাসি খ্রিস্টান সম্প্রদায়ে নিগ্রহের শিকার যারা, তাদের জন্য কাজ করে সেন্টিনেল অ্যাসোসিয়েশন। এই সংস্থার প্রধান ৫৫ বছর বয়সী পাউজাদে কথা বলেছেন তুরস্কের আনাদুলু এজেন্সির সঙ্গে। তিনি বলেছেন, ২৫ বছর আগে তিনি যখন ধর্ম প্রচারের কাজে গিনি গিয়েছিলেন, তখন এক পুরোহিতের নষ্ট চোখ পড়েছিল তার শরীরের দিকে।

প্রথমে একটা খবর শুনে নিই।

১৯৫০ সাল থেকে ফরাসি গির্জাগুলোতে ২ লাখ ১৬ হাজার শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে বলে যে তথ্য উদ্ঘাটিত হয়েছে, তাতে রীতিমতো উত্তাল ফ্রান্স। ক্যাথলিক চার্চের সঙ্গে সম্পৃক্ত বেসরকারি স্কুল এবং প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের হাতে সংঘটিত নিগ্রহের ঘটনা যদি এর সঙ্গে যুক্ত হয়, সংখ্যাটি গিয়ে দাঁড়ায় ৩ লাখ ৩০ হাজারে।

ইন্ডিপেন্ডেন্ট কমিশন অন সেক্সুয়াল অ্যাবিউজ ইন চার্চেস সংক্ষেপে সিয়াসে-র প্রকাশ করা রিপোর্ট অনুযায়ী, গত ৭০ বছরে ১৫ হাজার প্রাপ্তবয়স্ক গির্জায় যৌন নিগ্রহের শিকার হয়েছেন। গির্জা-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোতে সংঘটিত ঘটনা এতে যুক্ত করা হলে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৫ হাজারে।

স্বাধীন ওই কমিশনের প্রধান জঁ-মার্ক সোভ বলেছেন, নিপীড়নের এ পরিসংখ্যান অসহনীয়। প্রতিবেদন প্রকাশের পর ফ্রান্সের চার্চগুলো শিশু নিপীড়নের ঘটনাকে ‘লজ্জাজনক এবং ভীতিকর’ বলে উল্লেখ করে ক্ষমা চেয়েছে।

বিভিন্ন দেশে যৌন কেলেঙ্কারির ঘটনা ফাঁস হওয়ার পর ফরাসি ক্যাথলিক গির্জা কর্তৃপক্ষ ২০১৮ সালে তদন্তের আদেশ দিয়েছিল। প্রায় আড়াই বছর ধরে ১ লাখ ১৫ হাজারের বেশি পাদ্রী ও অন্যান্য গির্জা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত চালানো হয়। আদালত, পুলিশ, গির্জার নথি, ভুক্তভোগীদের সাক্ষাৎকার ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য সংগ্রহ করে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়।

আড়াই হাজার পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ভুক্তভোগীদের মধ্যে ‘বিশাল সংখ্যক’ প্রাক-কিশোর বয়সের ছেলে। তদন্তে দেখা গেছে, ভুক্তভোগীদের ৬০ শতাংশই পরবর্তী জীবনে তাদের মানসিক এবং যৌন জীবনে মারাত্মক ব্যাঘাতের শিকার হয়েছেন।

পাউজাদের বক্তব্যে ফিরে আসি। তিনিও এ সংখ্যাকে উদ্বেগজনক এবং অতিশয় বেদনাদায়ক বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, এটি একটি সুনামির মতো। জঘন্য একটি বিষয়। তিনি বলেন, যে সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে তা কিন্তু গড়পড়তা। আসল সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি। কারণ, এমন অনেকে আছেন, যারা কথা বলেননি। অনেকে মারাও গেছেন।

পাউজাদে কীভাবে পুরোহিতের হাতে নিগৃহীত হয়েছিলেন, তার বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি বলেন, তিনি নিগ্রহের শিকার হওয়ার আগে ওই পুরোহিতের সঙ্গে তার আধ্যাত্মিক বন্ধন কিংবা যোগাযোগ কিছুই ছিল না।

তিনি বর্ণনা করেন এভাবে- উত্তেজিত পুরোহিত আমাকে মাটিতে ফেলে দেন। পড়ে যাওয়ার সুযোগে তিনি আমার ওপর নিপীড়ন চালান। আমি যখন একজন অনুমোদিত ব্যক্তির কাছে এ ঘটনা জানানোর চেষ্টা করি, আমার মুখ বন্ধ রাখার জন্য তিনি আমাকে মারধর করেন। এ সময় আমার বয়স ছিল ৩০।

তারা আমাকে পরিবারের সঙ্গে সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করতে বলেন এবং আমার সঙ্গে কী ঘটেছে, তা বলতে বারণ করেন। কিন্তু আমার পরিবার পরে তা বুঝতে পারে, কারণ আমার শরীরের আঘাতের চিহ্ন ছিল। তারা ক্ষত দেখতে পেয়েছিলেন। কী কারণে এ ক্ষত হয়েছে, তারা ব্যাখ্যা করার মতো বাকস্বাধীনতা আমার ছিল না। এসব জানালে গির্জায় আশ্রয় না পাওয়ার ভয়ের কথাও উল্লেখ করেন তিনি।

এ যৌন নিগ্রহের পর বিয়ে কিংবা সন্তান নেওয়া নিয়ে তার আগের ধারণায় প্রশ্ন তৈরি হয়েছিল। কিন্তু কোনো চিন্তা ভাগাভাগি করার জন্য তার পাশে তখন কেউ ছিল না।

তিনি বলেন, আমি ছয় বছর পর এ নিগ্রহ সম্পর্কে কথা বলা শুরু করতে পারি। এ দীর্ঘ সময়ে আমার মানসিক স্বাস্থ্য ভেঙে যায়। শারীরিক স্বাস্থ্যেরও ধীরে ধীরে অবনতি ঘটতে থাকে।

এরপর, পাউজাদের পরিবার যৌন নির্যাতনের মামলাগুলো লড়তে সেন্টিনেল অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি নিজে ১০ বছর সভাপতিত্ব করেন এ অ্যাসোসিয়েশনে।

সেন্টিনেলের সহায়তা পাওয়া ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, কীভাবে তারা যৌন নিপীড়নের পরিণতি ভোগ করেছেন এবং কীভাবে অনেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন।

পাউজাদে দুইবার ইন্ডিপেন্ডেন্ট কমিশন অন সেক্সুয়াল অ্যাবিউজ ইন চার্চেস-এ তার গল্প শুনিয়েছেন। তিনি বলেছেন, তার কিছু সুপারিশ কমিশনের সুপারিশে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। নারীরা যেভাবে গির্জায় তাদের কণ্ঠস্বর উঁচু করতে পারেননি, সেইভাবে কমিশনেও পারেননি।

পাউজাদে জানান, নিগ্রহের পর তার চাকরি পেতে অসুবিধা হয়েছিল এবং একই ধর্মীয় সম্প্রদায়ের লোক হওয়ার পরও তার সামাজিক ও পেশাগত জীবন শুরু করা সহজ ছিল না।

তিনি বলেন, অনেক বাবা-মা জানেন না, খ্রিস্টান ধর্মীয় সম্প্রদায়ের কাছে তাদের প্রাপ্তবয়স্ক সন্তান যৌন নিগ্রহের শিকার হচ্ছে। এটি অত্যন্ত উদ্বেগের কারণ যে, বাবা-মা মারা যাওয়ার পর অনেক শিশু বুঝতে পারবে যে তারা ভুল পথে আছে এবং তাদের দায়িত্বে রয়েছেন অবিশ্বস্ত পুরোহিতরা।

পাউজাদে গির্জায় সংঘটিত অনৈতিক ঘটনায় যারা দোষী, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া এবং ভিকটিমদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। তার সঙ্গে সুর মিলিয়েছেন আরও অনেকে।

ভুক্তভোগীদের নিয়ে গঠিত একটি সংস্থার প্রধান ফ্রাঙ্কোয়া ডেভাক্স তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশের সময় বলেছেন, অবশ্যই ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। এটা বিশ্বাসের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা, নৈতিকতার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা ও শিশুদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা।

অলিভিয়ার স্যাভিনাক নামে এক ভুক্তভোগী প্রকাশিত তদন্ত প্রতিবেদনকে ভূমিকম্পের সঙ্গে তুলনা করেছেন। একই সঙ্গে তিনি ক্ষতিগ্রস্তদের প্রকৃত ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি জানান।

লজ্জাজনক এসব ঘটনা যে শুধু ফ্রান্সের গির্জাগুলোতে ঘটেছে, তা নয়। বিশ্বের বিভিন্ন অংশে পুরোহিতদের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ অনেকদিন ধরেই। ক্যাথলিক গির্জার কিছু পুরোহিতের হাতে শিশুদের যৌননিগ্রহের শিকার হওয়ার ঘটনা নিয়ে ইউরোপের মানুষ এখন বেশ ক্ষুব্ধ। সম্প্রতি আয়ারল্যান্ড ও জার্মানিতেও এ ধরনের অসংখ্য ঘটনার কথা বেরিয়ে এসেছে।

আয়ারল্যান্ডে গত দশকে গির্জার পুরোহিতদের হাতে কয়েক হাজার শিশু যৌন নিগ্রহের শিকার হয়েছিল বলে জানা যায়। অনেক জায়গায় এ ঘটনা ঘটলেও আয়ারল্যান্ডের এসব ঘটনা সবার জন্য ছিল কল্পনাতীত। যে পুরোহিতদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছিল, তারা সবাই অপরাধ অস্বীকার করেন। এরপর নিগ্রহ বন্ধ করতে সরকার সক্রিয় হতে বাধ্য হয়। শুরু হয় তদন্ত। তিন হাজার পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদনে জানানো হয়, কয়েক হাজার শিশুর ওপর অমানবিক নির্যাতন চালানো হয়েছে। অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে এসব পীড়ন চালানো হতো। বাচ্চাদের দিয়ে কঠিন সব কাজ করানো হত, ঠিকমত খেতে দেওয়া হত না, চলত নির্মম যৌন নিগ্রহ।

জার্মানিতে এক জরিপে দেখা গেছে, শিশু-কিশোর থাকা অবস্থায় পুরোহিতদের হাতে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন এমন অন্তত ১ হাজার ৪১২টি অভিযোগ জমা পড়েছে গির্জার বিভিন্ন সংগঠনের কাছে। জার্মানির ধর্মীয় নেতাদের সংগঠন ডিওকে সম্প্রতি এ সংক্রান্ত একটি গবেষণা প্রকাশ করেছে। গবেষণায় নেতারা এ ইস্যুকে সঠিকভাবে মোকাবিলা করতে ব্যর্থতার কথাও স্বীকার করেছে। অভিযোগকারীদের ৮০ শতাংশই পুরুষ, বাকি ২০ শতাংশ নারী। অন্তত ৬৫৪ জন যাজক, যাজিকা এবং চার্চ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এসেছে এসব অভিযোগ।

শিশু যৌন নির্যাতনের দায়ে অস্ট্রেলিয়ার শীর্ষ পুরোহিত জর্জ পেলকে সম্প্রতি কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত। ১৯৯৬ সালে মেলবোর্নের প্রধান গির্জায় দুজন গায়ক ছেলের ওপর যৌন নিপীড়ন চালান তিনি। ৭৭ বছর বয়সী জর্জ পেল ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের প্রধান কেন্দ্র ভ্যাটিকানের ট্রেজারার। সেই সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে ক্ষমতাধর ধর্মীয় গুরু।

সম্প্রতি এক মার্কিন প্রতিবেদনে ৩০০ জন ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের নাম প্রকাশ করা হয়েছে, যাদের কাছে এক হাজারের বেশি যৌন নির্যাতনের শিকার। ধর্মযাজিকারাও এমন নির্যাতনের শিকার বলে খবর এসেছে। চার্চের উচ্চপদস্থ ধর্মীয় ব্যক্তিরা এসব অভিযোগ নানা সময় চাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন বলে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে। সেখানে থিওডোর ম্যাককারিক হলেন এ পর্যন্ত সবচেয়ে উচ্চ পদবীধারী ও প্রভাবশালী কোনো ক্যাথলিক ব্যক্তিত্ব, যার পুরোহিত পদবী কেড়ে নেওয়া হয়েছে যৌন নিগ্রহের কারণে।

এর আগে, শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতনের অপরাধে ভ্যাটিকানের আর্চবিশপ জোসেফ উইসোলোস্কিকে গ্রেফতার করা হয়। ডমিনিক প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রদূত থাকাকালে পোল্যান্ডের নাগরিক উইসোলোস্কির বিরুদ্ধে সাত বছরের এক ডমিনিক বালকের ওপর যৌন নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে।

উদ্বিগ্ন পশ্চিমা সমাজে এ লজ্জাজনক অপরাধ সাদামাঠা ঘটনায় পরিণত হয়েছে। তদন্ত হচ্ছে, প্রতিবেদন হচ্ছে, গ্রেফতার হচ্ছে, জেলও হচ্ছে, কিন্তু এসব ঘটনা বাড়ছে বৈ কমছে না। প্রশ্ন উঠেছে, খ্রিষ্টান ধর্মগুরুরা যদি এভাবে বিশ্বাসের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে থাকেন, সমাজ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? এমন একটা সময় কি আসবে, যখন ধার্মিকতা ও নৈতিকতার সম্পর্ককে মানুষ বিশ্বাসই করতে চাইবে না?