হজরত ইবরাহিমের স্মৃতিধন্য ‘ওয়াদি আসসালাম’


  • ফারজানা তানিয়া
  • ১৭ এপ্রিল ২০২১, ১৪:২৭

ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী, ইহকাল এবং পরকালের মধ্যবর্তী একটা জীবন থাকে, তাকে বলা হয় আলমে বারযাখ। সেখানে মানুষ মৃত্যুর পর থেকে কিয়ামত পর্যন্ত অবস্থান করবেন। এ জীবনটা বেশ দীর্ঘ। ধর্ম বলে, যারা নেক আমল করেন, তারা কবরে সুখে-শান্তিতে বসবাস করেন; যারা মন্দ আমল করেন, তাদের সেখানে কঠোর শাস্তি পেতে হয়। মুসলিমদের একটি শ্রেণির প্রগাঢ় বিশ্বাস, ইরাকে অবস্থিত ‘ওয়াদি আসসালাম’-এ যাদের কবর দেওয়া হবে, তারা কবরের আজাব থেকে নাজাত পাবেন। তারা কিয়ামত পর্যন্ত শান্তিতে সেখানে অবস্থান করবেন।

পৃথিবীর বৃহত্তম এবং প্রাচীনতম এ কবরস্থানকে ঘিরে জানার আগ্রহের কমতি নেই। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের সমাগম ঘটে এ কবরস্থান দেখতে। তারা প্রশান্ত কবরবাসী আত্মার সঙ্গে নিজের আত্মার সম্মিলন ঘটানোর চেষ্টা করেন। নিজেরাও প্রশান্তি পান। নিজেরাও সেখানে সমাধিস্থ হওয়ার বাসনা পোষণ করেন। শুধু মুসলিম নন, প্রতিবছর অন্য ধর্মাবলম্বী লাখ লাখ পর্যটকও আসেন জায়গাটি দেখতে। এ জায়গার ঐতিহাসিক গুরুত্বও অনেক।

ওয়াদি আসসালাম ইরাকের নাজাফ শহরে অবস্থিত। সমাধিস্থলটির আয়তন ১ হাজার ৪৮৫ দশমিক ৫ একর। এখানে ৬০ লাখ মৃতদেহ সমাহিত আছে বলে বিভিন্ন বর্ণনায় পাওয়া যায়।

শুধু বিশ্বের বৃহত্তম কবরস্থান হিসেবেই নয়, ধর্মীয় গুরুত্ব বিবেচনায়ও এটি মুসলিমদের কাছে, বিশেষ করে শিয়া মতাবলম্বীদের কাছে আকর্ষণীয় একটি স্থান। এখানেই হযরত হুদ আলাইহিস সালাম এবং হযরত সালেহ আলাইহিস সালাম-এর কবর আছে বলে বিশ্বাস করা হয়। এছাড়া ইসলামের চতুর্থ খলিফা এবং শিয়াদের প্রথম ইমাম হযরত আলী রাদিআল্লাহ আনহু এবং ইমাম জাফর আল সাদিক রাদিআল্লাহু আনহু’র মাজারও এ কবরস্থানের পাশেই অবস্থিত।

মুসলিমদের একটি শ্রেণির বিশ্বাস, হযরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম তার পুত্র হযরত ইসহাক আলাইহিস সালামকে সঙ্গে নিয়ে একবার ইরাকের নাজাফে এসেছিলেন। সে সময় এ অঞ্চলে নিয়মিত ভূমিকম্প হতো। কিন্তু হযরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম যতদিন এখানে অবস্থান করেছিলেন, ততদিন ছোটবড় কোনো ভূমিকম্প হয়নি। পরে এক রাতে ইবরাহিম আলাইহিস সালাম পাশের একটি গ্রামে গেলে সেদিনই নাজাফে ভূমিকম্প হয়। তখন এলাকাবাসী তাকে সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করার জন্য অনুরোধ করেন।

মুসলমানদের বিশ্বাস তাদের অনুরোধ রক্ষা করতে না পারলেও হযরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম তাদের কাছ থেকে নিজের নামে এক টুকরো জমি ক্রয় করেন। সেই জমির টুকরোটিই বর্তমানে ওয়াদি আসসালাম কবরস্থান। শিয়াদের বিশ্বাস অনুযায়ী, হযরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম ভবিষ্যদ্বাণী করেন, এই স্থানে এক সময় একটি মাজার এবং কবরস্থান গড়ে উঠবে। সেই কবরস্থানে শায়িতদের মধ্যে ৭০ হাজার মানুষ বিনা হিসাবে বেহেশত লাভ করবেন।

হুসেইন আলী হায়দার নামে স্থানীয় এক শিক্ষাবিদ বার্তা সংস্থা আনাদুলুকে জানান, এখানে অনেক নবী-পয়গম্বরকেও সমাহিত করা হয়েছে। তার মতে, হজরত আদম, নূহ, হুদ এবং সালেহ আলাইহিমুস সালামের মতো অনেক নবী এখানে শায়িত আছেন।

ইমাম সাজ্জাদের বর্ণনা অনুযায়ী, হযরত আলী রাদিআল্লাহু আনহু বলেছিলেন, ওয়াদি আসসালাম হচ্ছে বেহেশতের একটি খণ্ড। বিশ্বের প্রতিটি মুমিন ব্যক্তি, তিনি যেখানেই মৃত্যুবরণ করেন না কেন, তার রূহ বা আত্মাকে এ কবরস্থানে উপস্থিত করা হবে। এসব বিশ^াসের কারণে অনেকের কাছে নাজাফ শহর এবং এ কবরস্থানের মর্যাদা অনেক বেশি।

ওয়াদি আসসালামে দাফন করার আগে শিয়ারা কিছু আচার-অনুষ্ঠান পালন করে থাকেন। লাশ গোসল এবং কাফনের কাপড় পরানোর কাজটি সাধারণত কবরস্থানেই করা হয়। এরপর হযরত আলী রাদিআল্লাহু আনহুর মাজার-সংলগ্ন মসজিদে জানাজা পড়ানো হয়। তারপর দাফন করার আগে লাশ নিয়ে মাজারের চারদিকে তিনবার প্রদক্ষিণ করা হয়।

ওয়াদি আসসালাস বিশ্বের সবচেয়ে বড় কবরস্থান। সেখানে কত মানুষ দাফন করা হয়েছে তার প্রকৃত হিসাব জানা যাবে না। হাজার বছরের কবরস্থানটি শুধু ইরাক নয় বিশ্বের লাখো মানুষের আগ্রহের বিষয়। কেমন সেই কবরস্থান আসুন দেখে আসি।

ওয়াদি আসসালামের অধিকাংশ কবরই মূলত পোড়ামাটির ইটের তৈরি। অধিকাংশ কবরের ইটের ওপর প্লাস্টার করা এবং তার ওপর পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন আয়াতের ক্যালিগ্রাফি খোদাই করা। কবরগুলো বিভিন্ন আকার, আকৃতির এবং উচ্চতার। ব্যক্তিগত একক কবরের বাইরে কিছু আছে পারিবারিক সমাধিকক্ষ, যেগুলোর ওপর সাধারণত গম্বুজ থাকে। কিছু ভূগর্ভস্থ সমাধিকক্ষও আছে, যেখানে মইয়ের সাহায্য প্রবেশ করা যায়। এ সমাধি কক্ষগুলোর প্রতিটি ৩০ থেকে ৫০ জনের লাশ ধারণ করতে সক্ষম।

১৯৩০ এবং ১৯৪০-এর দশকে নির্মিত কবরগুলোর আবার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে। সেগুলোর অধিকাংশ ৩ মিটার উঁচু এবং গোলাকার চূড়া বিশিষ্ট, যেন পাশের লোকালয়ের উঁচু ভবনগুলোর ছাদ থেকেও সেগুলোকে চিহ্নিত করা যায়।

আরবি শব্দ ‘ওয়াদি আসসালাম’-এর অর্থ হচ্ছে ‘শান্তির উপত্যকা’। এ শান্তির উপত্যকায় বিশিষ্ট ইসলামী ব্যক্তিত্ব, ধর্মীয় নেতা, আলেম, রাজনৈতিক নেতাসহ বহু সাধারণ লোকের কবর রয়েছে।

ইমাম সাজ্জাদের মতের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে স্থানীয় মুসলিমরা মনে করেন, এটি জান্নাতেরই একটি অংশ। তাই অধিকাংশ লোকই সেখানে কবরের জায়গা পাওয়ার জন্য আবেদন করেন। কবরস্থানটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সেখানে ধনী-গরিব, রাজনৈতিক অথবা ধর্মীয় নেতাসহ সমাজের সব শ্রেণির লোকের কবর দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। ওয়াদি আসসালামে শুধু ইরাকি নন, বাইরের অনেক দেশ যেমন- ভারত, দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়া, লেবাননসহ বেশকিছু দেশের লোকেদেরও কবর দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল।

সাম্প্রতিক সময়ে সেখানে নির্মিত কবরগুলোর নির্মাণশৈলীতে আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। পর্যটকরা সেখানে গিয়ে এ নির্মাণশৈলী উপভোগ এবং ধর্মীয় ভাবাবেগের সমন্বয় ঘটান।

২০০৩ সালে ইরাকে সংঘটিত যুদ্ধের ফলে এ কবরস্থানের জায়গা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। সে সময় মার্কিন সেনাদের ব্যাপক হত্যাযজ্ঞের কারণে এত লোকের দাফন করার প্রয়োজন পড়ে যে, প্রায় তিন বর্গমাইল জায়গা কবরস্থানটির সঙ্গে যুক্ত করা হয়। এমন কথাও চালু আছে, যুদ্ধের সময় ইরাকের যেসব সেনাসদস্য মার্কিন হস্তক্ষেপের বিরোধী ছিলেন, তারা এ কবরস্থানে ওঁৎ পেতে থাকতেন, আর সুযোগ পেলে মার্কিন সেনাদের হত্যা করতেন। এখনও স্থানীয় অনেকে এ সমাধিস্থলে আত্মগোপনে থাকতে পারেন।

ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসনের কারনে শুধু কবরস্থানে লাশের সংখ্যা বাড়েনি। ২০০৬ থেকে ২০০৭ সালে শিয়া এবং সুন্নিদের সাম্প্রদায়িক হত্যাকাণ্ডের কারণেও দাফন করার সংখ্যা বেড়েছে।

তবে ইরাক যুদ্ধের চরম মুহূর্তে যে পরিমাণ লাশ দাফনের প্রয়োজন পড়ত, এখন তারচেয়ে কম লাশ দাফন হয়। ফলে এখন কবরস্থানটির আয়তন বাড়লেও তার গতি মন্থর।

বহু মুসলিম রাজা-বাদশা এবং কোরআন-হাদিস বিশেষজ্ঞ এখানে সমাহিত হয়েছেন। প্রতিদিন শত শত মরদেহ দাফন করা হচ্ছে ১৪০০ বছরের পুরনো এ সমাধিস্থলে। শিয়াদের মতে, ওয়াদি আসসালাম হচ্ছে পবিত্র মানুষদের কবরস্থান। তাদের বিশ^াস, এখানে শায়িত দেহ পবিত্রতা লাভ করে এবং তারা শান্তিতে ঘুমিয়ে থাকেন কিয়ামত পর্যন্ত।

এ কারণে ইরাকে যারা মারা যান, তাদের অনেকের ইচ্ছা থাকে, যেন তাদের এখানে কবর দেওয়া হয়। কিয়ামত পর্যন্ত কবরের আজাব থেকে রেহাই পাওয়ার উদ্দেশ্যে ইরাকের প্রায় ৯০ শতাংশ শিয়া মতাবলম্বীর কবর এখানে দেওয়া হয়েছে। জায়গাটির গুরুত্ব বিবেচনায় জাতিসঙ্ঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা ইউনেস্কো ২০১১ সালে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসাবে এ সমাধিস্থলকে অন্তর্ভুক্ত করে।