তিলাওয়াতের আফ্রিকান শিল্প


  • ফারজানা তানিয়া
  • ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১২:৩৭

মধ্যপ্রাচ্যের ঐতিহ্যে পবিত্র কুরআন তিলাওয়াতের আফ্রিকান রীতিই একসময় প্রভাব বিস্তার করে রেখেছিল। সময়ের বিবর্তনে ম্লান হয়ে যায় সেই রীতি। নুরীন মোহাম্মদ সিদ্দিক আবার সেই ধারা ফিরিয়ে এনেছেন। সেই অন্যন্য ধারা এখন মাতিয়ে রেখেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম।

তিনি যখন কুরআন তিলাওয়াত করেন, ঈমান চাঙা হয়ে ওঠে। খোদাভীরুতার কাতরতা তৈরি হয়। গভীর অনুভুতি জাগ্রত করে। একেবারে আলাদা বৈশিষ্ট্যময়।

এ অনন্য সুরের কারণে মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় তিলাওয়াতকারীর অভিধা বহন করছিলেন নুরীন মোহাম্মদ। এরপর গত নভেম্বরে সুদানে গাড়ি দুর্ঘটনায় মাত্র ৩৮ বছর বয়সে তিনি যখন স্রষ্টার কাছে চলে গেলেন, পাকিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্র, সর্বত্র শোকের ছায়া আচ্ছন্ন করে মুসলিম সমাজকে।

টেক্সাসের ইমাম ওমার সুলাইমানি টুইট করলেন, ‘আমাদের সময় বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর কণ্ঠকে হারাল বিশ্ব।’

তিলাওয়াতের সময় অর্থের সঙ্গে সমন্বয় রেখে তার শরীরী ভাষায়ও তা প্রতিফলিত হতো। তিনি কাঁদতেন এবং স্রোতা ও মুক্তাদিদের কাঁদাতেন। সবাই সম্মোহিত হতেন তার তিলাওয়াতে।

সুদানি-মার্কিন আন্তঃধর্মীয় শিক্ষাবিদ হিন্দ মাক্কি বললেন, তার যে অসাধারণত্ব ছিল, তা বর্ণনা করা কঠিন। নির্ভেজাল আফ্রিকান কণ্ঠ। তার কণ্ঠ থেকে ঠিক কী নির্গত হচ্ছে, তা লোকে যথাযথ শব্দে চিত্রায়িত করতে পারেনি, তবে তারা তা পাগলের মতো ভালোবেসেছে।’

জাদুকরি তিলাওয়াতের এ ধারাটা কীভাবে এলো, এ নিয়ে গবেষণা হয়েছে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি নিবন্ধ করেছে তাকে নিয়ে। কথা বলেছে গবেষকদের সঙ্গে।

গবেষকরা বিবিসিকে বলেছেন, নুরীনের কুরআন পড়ার যে ধারা, তার সঙ্গে ব্লুজ সঙ্গীতের তুলনা হতে পারে। ইতিহাসবিদ সিলভিয়ানি দিউফের মতে, পশ্চিম আফ্রিকার মুসলিম ক্রীতদাসদের গান, প্রার্থনা ও তিলাওয়াতের সুর অনেকটা সাহেল অঞ্চল থেকে সুদান-সোমালিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত মুসলিমদের সুরের মতোই। এই সুর থেকেই সম্ভবত ব্লুজ সঙ্গীতের সৃষ্টি। এই সুর তাদের মজ্জাগত।

সুন্দর করে মনের মাধুরী মিশিয়ে কুরআন তিলাওয়াতকে ইসলাম উৎসাহিত করেছে। বুখারি শরিফের ৭৫৪৬ নম্বর হাসিদে বলা হয়েছে, বারা রাদিআল্লাহু আনহু বলেন, ‘আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এশার নামাজে সুরা ত্বীন পড়তে শুনেছি। আমি তার চেয়ে সুন্দর কণ্ঠে আর কাউকে তিলাওয়াত করতে শুনিনি।’ বুখারির ৭৫২৭ নম্বর হাদিসে বলা হয়েছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘সে আমার উম্মত নয়, যে সুর করে কুরআন তিলাওয়াত করে না।’

হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুন্দর সুরসহ কুরআন তিলাওয়াতকে উৎসাহিত করেছেন। মুসলিমরা ঐতিহ্যগতভাবে এ পবিত্র মহাগ্রন্থ সাধারণত সুমিষ্ট সুর নিয়ে তিলাওয়াত করেন।

পবিত্র রমজানের তারাবির মতো ধর্মীয় উপলক্ষ নিয়ে যখন মুসলিমরা একত্রিত হন, তখন বিশেষভাবে সুরেলা তিলাওয়াতকে উৎসাহিত করা হয়। মসজিদে মসজিদে খতম তারাবি হয়, আর মুসল্লিরা হাফেজে কুরআনের সুরেলা তিলাওয়াতের মাধ্যমে আল্লাহর কাছাকাছি হন।

এখন কুরআন তিলাওয়াতের অনেক আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা হয়। বিভিন্ন ধাঁচের সুরের বৈচিত্র্যে শ্রোতাদের বিমোহিত করে রাখেন তিলাওয়াতকারীরা। সঙ্গত কারণে তিলাওয়াতের প্রতি প্রতিযোগিতামূলক ঝোঁকও বেড়েছে মুসলিমদের মধ্যে। অসাধারণ সব সুর দিয়ে তিলাওয়াতকে আকর্ষণীয় করে তুলতে পারার প্রতিযোগিতা এখন সুন্দর শিল্প। যিনি যত সুন্দর সুর করে বিশুদ্ধভাবে কুরআন পড়তে পারেন, তিনি তত বড় শিল্পী।

ভূগোল, সংস্কৃতি ও ঐতিহাসিক ভিন্নতায় বিশাল মুসলিম বিশ্বে তিলাওয়াতের সুর ও উচ্চারণেও ভিন্নতা রয়েছে।

নুরীন মোহাম্মদ সিদ্দিকের আকস্মিক ইন্তেকালের পর তিলাওয়াতের ঐতিহ্যগত আফ্রিকান স্টাইলে বৃহত্তর মনোযোগ পড়েছে। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সুদানের রাজধানী খার্তুমের পশ্চিমে অবস্থিত আল-ফারাজাব গ্রামের একটি সাধারণ কুরআনিক স্কুলে পড়ার সময় এ সুর রপ্ত করেন তিনি।

তিনি যখন পরে খার্তুমে যান, শহরের প্রধান কয়েকটি মসজিদের ইমামতির দায়িত্ব পান তিনি। এ সময় তার তিলাওয়াতে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ হয়। তার মুখ-নিঃসৃত কুরআনের আয়াত শোনার জন্য পেছনে মুক্তাদির সংখ্যা বাড়তে থাকে। তাকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দাওয়াত দেওয়া শুরু হয়। তার তিলাওয়াতের ভিডিও ইউটিউবসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আপলোড হওয়ার পর তার খ্যাতি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়তে থাকে।

মধ্যপ্রাচ্যে সাত-নোটের হেপ্টাটোনিক স্কেলের তিলাওয়াত জনপ্রিয়, কিন্তু সিদ্দিকের তিলাওয়াত পাঁচ নোটের। সাহেল এবং ‘হর্ন অব আফ্রিকা’র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলোতে সাধারণত এভাবেই কুরআন তিলাওয়াত করা হয়।

সুদানের তিলাওয়াতকারী আল-জাইন মুহাম্মাদ আহমাদ বললেন, ‘এ সুরের আবহে মরুভূমিতে আমার বেড়ে ওঠা। শৈশব থেকে এ সুর শুনে আসছি। সুদানের লোকগানের সুরের ধরন এমনই।’

পশ্চিম এশিয়ার পূর্ব-ভূমধ্যসাগর অঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকার তিলাওয়াতকারীরা তাদেরপরিচিত মেলোডিতেই তিলাওয়াত করেন। মিসর, হিজাজ, আফ্রিকা ও অন্যান্য স্থানেও তা-ই করা হয়।

কানাডার ‘ইউনিভার্সিটি অব আলবার্তা’র সঙ্গীতের অধ্যাপক মাইকেল ফ্রিশককের মতো সঙ্গীতজ্ঞ এ দৃষ্টিভঙ্গিকে সমর্থন করলেন।

তিনি সাব-সাহারান আফ্রিকাকে এক ধ্বনীতরঙ্গের ঐতিহ্যে ফেলার বিষয়ে সাবধানী হলেও নিশ্চিত করেছেন যে, এ অঞ্চলে পেন্টাটোনিক স্কেলের ব্যাপক উপস্থিতি রয়েছে।

তিনি বলেন, ‘বিস্তারিত বলতে গেলে আপনি মিসরে পেন্টাটোনিক কিংবা হেক্সাটোনিক তিলাওয়াত খুঁজে পাবেন না, যা আপনি পাবেন নাইজার, সুদান, ঘানা ও গাম্বিয়ায়।

সৌদি আরবের ‘ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব মদিনা’ থেকে গ্র্যাজুয়েট করা ওয়াশিংটনের ওলিম্পিয়ার ইমাম ওমার জাব্বি। সিয়েরা লিওনে তার জন্ম। সেনেগাল ও গাম্বিয়ায় প্রথম কুরআন তিলাওয়াত শিখেছেন। তিনি ব্যাখ্যা করলেন, ‘সেখানে আমি অনেক কুরআনিক টোন শিখেছি।’

সাম্প্রতিক দশকগুলোতে, কুরআন তিলাওয়াতের মাধ্যপ্রাচ্য স্টাইল আফ্রিকার অনেক অঞ্চল এবং বিশ্বব্যাপী শহুরে এলাকাগুলোতে প্রাধান্য বিস্তার করে। ভিনাইল রেকর্ড, শর্টওয়েভ রেডিও সম্প্রচার, অডিও ক্যাসেট ও সিডির মাধ্যমে শ্রোতারা যেসব তিলাওয়াত শুনেছেন, তা মিসর ও সৌদি আরবের বিভিন্ন সংস্থার প্রযোজনা, সরবরাহ ও বিক্রি করা।

মিসরেরর আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয় এবং মদিনা ইসলামিক ইউনিভার্সিটি থেকে পড়ে আসা শিক্ষার্থীরা এবং উপসাগরীয় দেশগুলোর তহবিলে চলা দাতব্য সংস্থাগুলোর কারণে বিশ্বব্যাপী অনেক তিলাওয়াতকারীর মধ্যে মধ্যপ্রাচ্য স্টাইল বিস্তৃত ও জনপ্রিয় হয়। সাব-সাহারান আফ্রিকার কেউ কেউ এ ধারাকে গ্রহণ না করলেও মোটাদাগে সেখানেও এ ধারার ঢেউ লাগে।

স্থানীয় ঐতিহ্যকে জলাঞ্জলি দিয়ে কেউ কেউ এটাকে অধিকতর প্রামাণিক হিসেবে গ্রহণ করেন এবং এর পক্ষে প্রচারও করতে থাকেন।

কিন্তু ইন্টারনেট, বিশেষত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম শ্রোতাদের মনোযোগ ঐতিহ্যগত ধারার দিকে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। বিশেষত তরুণ সমাজ ঐতিহ্যগত ধারায় আকৃষ্ট হয়।

ইসলামি সমাজবিজ্ঞানের গবেষক অধ্যাপক এমবাই লো ব্যাখ্যা করলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও আধুনিক প্রযুক্তির গণতান্ত্রিক শক্তির কাছে সেখানে প্রভাব হারাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্য স্টাইল।

২০১৬ সালে প্রতিষ্ঠিত খার্তুমভিত্তিক মিডিয়া প্রডাকশন কোম্পানি নাকা স্টুডিও’র ইলেবিয়াদ এলশাফিয়া বিষয়টি খোলাসা করলেন।

তিনি বলেন, স্যাটেলাইট টেলিভিশন স্টেশনের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অতকিছুর প্রয়োজন নেই। খরচ কম, আইনি প্রতিবন্ধকতাও কম।

২০১৭ সাল থেকে নিজের ইউটিউব চ্যানেলের জন্য ইমাম জাব্বির তিলাওয়াত রেকর্ডিং করছেন সৌখিন ভিডিওগ্রাফার আহমাদ আবদেল কাদের।

তিনি বললেন, ‘তার সবচেয়ে জনপ্রিয় ভিডিও রেকর্ডিং হলো আফ্রিকান আদলের দোয়া। ২০ লাখ ভিউ হয়েছে এটি। যারা দেখেছেন তাদের অধিকাংশই ফ্রান্স ও পশ্চিম আফ্রিকান মুসলিম। এরপর বেশি ভিউ হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে।

এ অনলাইন রেকর্ডিংগুলো হিফজুল কুরআন ও কিরাতের বিভিন্ন স্কুলেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।

পড়ার ক্ষেত্রে কিছু শব্দ আলাদা থাকলেও সাতটি কুরআন হিফজ প্রতিষ্ঠানকে মুসলিমদের জন্য আদর্শ হিসেবে ধরা হয়।

বর্তমানে এ ধারাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সুপরিচিত হলো ‘হাফস’। বিজিত অঞ্চলে অটোমান তুর্কের নির্দেশে এটি পরিচালিত হতো। কায়রো এবং মক্কা থেকে কুরআন শরিফের ছাপা কপি এনে প্রতিষ্ঠানগুলোতে ব্যাপকভাবে এর শিক্ষা দেওয়া হতো।

মুসলিম বিশ্বের কিছু অংশে, বিশেষত আফ্রিকা মহাদেশের শহুরে এলাকাগুলোর হিফজ স্কুলগুলো সুদানের আলদুরি রেওয়াজ অনুকরণ করা হতো। এই রেওয়াজই তিলাওয়াতের সময় অনুকরণ করতেন সিদ্দিক।

তার তিলাওয়াতের স্টাইল মুসলিমদের মধ্যে বৈশ্বিক চলমান ধারা ও বিবিধ ঐতিহ্যের সমন্বয়-স্মারক হিসেবে কাজ করে। অনেক অনুসারী এবং পর্যবেক্ষকদের জন্য এখানে পরিষ্কার একটি শিক্ষা রয়েছে।

অধ্যাপক ফ্রিশকফ ব্যাখ্যা করলেন, ‘কুরআনের বিষয়বস্তু ও হরফে দ্বিমত না থাকলেও এ আলাদা তিলাওয়াতের আদল একটি বৈশ্বিক বার্তা ছড়িয়ে দেয়, যাতে বৈশ্বিক শব্দবিদ্যা এবং স্থানীয় ধ্বনির সুন্দর সমন্বয় প্রকাশিত হয়।

বিবিসিকে ফ্রিশকফ বললেন, ‘এটাই মূল বিষয়।’