সৌদি আরবকে যেভাবে বদলাতে চান এমবিএস


  • আহমেদ বায়েজীদ
  • ২৩ নভেম্বর ২০২১, ১৬:৫৭

সৌদি আরবের প্রতাপশালী ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মাদ বিন সালমান। পদবীতে ক্রাউন প্রিন্স হলেও তিনিই কার্যত দেশটির শাসক। বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ তার বাবা। বাবার অসুস্থতার কারণে হোক কিংবা নিজের দাপটে- কয়েক বছর ধরে সৌদি আরব চলছে বিন সালমানের পরিকল্পনায়। ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে তার দায়িত্ব গ্রহণও ছিল বিতর্কিত। তবুও এই পদে এসে অনেকগুলো বড় সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এমবিএস। এর কিছু বিষয় বিতর্কিত হলেও সৌদি আরবে যুগান্তকারী কিছু পরিবর্তন আনার চেষ্টাও রয়েছে তার।

২০১৮ সালের শুরুর দিকে যুক্তরাষ্ট্রের সিবিএস টিভি চ্যানেলের ‘সিক্সটি মিনিটস’ অনুষ্ঠানে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মোহাম্মাদ বিন সালমানকে প্রশ্ন করা হয়েছিল- সৌদি আরব পারমাণবিক অস্ত্র পেতে চাইছে কিনা? জবাবে এমবিএস বলেন, সৌদি আরবের পারমাণবিক অস্ত্রের মালিক হওয়ার ইচ্ছা নেই। তবে ইরান যদি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করে, তখন আমরাও তা পাওয়ার চেষ্টা করব।

এমবিএসের এই বক্তব্য ছিল মূলত তার দেশের সামরিক উচ্চাভিলাস ও ইরানের সাথে রাজনৈতিক বৈরিতার প্রশ্নে নিজের দেশের শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রাখার অঙ্গীকার। শুধু যে সামরিক খাতে তার এমন পরিকল্পনা- তা নয়। সৌদি আরবের আর্থ সামাজিক খাতগুলোকেও আমূল বদলে দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নেমেছেন যুবরাজ। শিক্ষাব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা, অর্থনীতি, পর্যটনসহ সব সেক্টরেই এই পরিবর্তনটা আনতে চান তিনি। যুবরাজের ঘনিষ্ঠ লোকদের দাবি এর মাধ্যমে সৌদি আরবকে আরও বেশি বিশ্ব পরিমণ্ডলে জায়গা করে দিতে, দেশের মানুষের জীবনযাত্রায় ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে ও অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করতে চান। এমবিএসের দাবি, অর্থনৈতিক সংস্কারের মাধ্যমে তেল নির্ভরতা কাটিয়ে ওঠা আর সামাজিক সংস্কারের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী সৌদি আরবকে আরও বেশি উদার রাষ্ট্র হিসেবে তুলে ধরা হবে।

যদিও তার এই সংস্কার কার্যক্রম শুরুর পর্বটাই ছিল বিতর্কিত। ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার কিছুদিন পরই যুবরাজ তার দেশের অনেক সরকারি কর্মকর্তা, সাবেক মন্ত্রী ও রাজপরিবারের কয়েকজন সদস্যকে ডেকে আনেন রিয়াদের রিজ-কার্লটন হোটেলে। সেখানে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় সরকারি সম্পদ আত্মসাতের। দুর্নীতি দমনের নামে ওই ব্যক্তিদের গ্রেফতার করে রাখা হয় রিজ-কার্লটন হোটেলে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, এমবিএস নিজের ক্ষমতার প্রতি যাদের হুমকি মনে করতেন তাদের গ্রেফতার করা হয় ওই অভিযানে। অনেককে মুচলেকা দিয়ে, অনেকের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে কয়েক সপ্তাহ পর মুক্তি দেওয়া হয়। বলা হয় সেবার গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে যে পরিমাণ অর্থ আদায় করা হয়েছে, তা দিয়েই এমবিএস তার সংস্কার কার্যক্রমের সূচনা করেছিলেন।

এমবিএসের পরিকল্পনায় সামাজিক সংস্কারে অনেক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে সৌদি আরবে। শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর প্রক্রিয়া ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে। যুগোপযোগী ও কর্মমুখী শিক্ষাকে আরও বেশি গুরুত্ব দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে নতুন কারিকুলাম। বেকারত্বের হার শূন্যে নামিয়ে আনতে তরুণদের পরিশ্রমী ও সৃজনশীল করে গড়ে তোলা হবে এর উদ্দেশ্য। পাশাপাশি অতি রক্ষণশীল সমাজব্যবস্থাকেও পাল্টে দিতে চান এমবিএস। উদার সামাজিকতাকে সৌদি আরবে আরও বেশি জায়গা করে দিতে চান।

বিন সালমান দায়িত্ব নেওয়ার কিছুদিন পরই সৌদি নারীদের গাড়ি চালানোর লাইসেন্স দেয় দেশটির সরকার। বিন সালমানের এই উদ্যোগ বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়। এর পাশাপাশি সৌদি আরব অনুমতি দেয় নারীদের স্টেডিয়ামে গিয়ে খেলা দেখার। ক্রীড়া সংস্থার প্রধানের পদেও আনা হয় এক নারীকে। দেশটিতে সিনেমা হল চালু হয়। বিদেশি শিল্পীদের এনে কনসার্টের আয়োজন করা হয়। শিক্ষা, চিকিৎসা, বিদেশি শ্রমিক নিয়োগসহ অনেক ক্ষেত্রে নেওয়া হয় যুগান্তকারী কিছু সিদ্ধান্ত। নারীদের একাকি ওমরাহ পালনের সুযোগও দেওয়া হয়েছে। এসবের কোনোটি সমালোচিত হয়েছে, আবার কোনোটি হয়েছে প্রশংসিত।

তবে সৌদি আরবের জন্য এমবিএস সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্তটি নিয়েছেন অর্থনীতির বিষয়ে। সৌদি আরবের অর্থনীতি কয়েক দশক ধরেই পুরোপুরি তেলনির্ভর। প্রতিদিন তেল উৎপাদন করে সেই তেল বিক্রির টাকায় চলে দেশটির অর্থনীতির চাকা। কিন্তু মাটির নিজের এই সম্পদ এক সময় ফুরিয়ে যেতে পারে। তখন কী হবে দেশটির? তেল উত্তোলন কমে গেলে বিশাল অর্থনীতির পরিসর যদি হঠাৎ করেই ছোট হয়ে যায়- তার সাথে কীভাবে মানিয়ে নেবে দেশটি? এই চিন্তাটা সৌদি আরবের কোনো শাসকের মাথায়ই আসেনি। অথবা এলেও তারা বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে চাননি। কিন্তু মোহাম্মাদ বিন সালমান অর্থনীতির ভবিষ্যত নিয়ে শুরুতেই যুগান্তকারী এক পরিকল্পনা নিয়েছেন। তিনি তেল নির্ভরতা থেকে বের করে আনতে চান সৌদি আরবকে।

এমন সামাজিক ও অর্থনৈতিক নানামুখী সংস্কারকে সামনে রেখেই এমবিএস ২০১৬ সালে ঘোষণা করেন ভিশন ২০৩০ নামের একটি মাস্টারপ্ল্যান। বর্তমানে সৌদি আরবের মোট জাতীয় উৎপাদনের প্রায় ৪০ শতাংশ আসে তেল শিল্প থেকে। আরেক হিসাবে বলা হয়েছে, সৌদি সরকার এখনও তার বাজেটের ৭৫ শতাংশ অর্থ পায় তেল রফতানি থেকে। যে কারণে তেলের ওপর সৌদি অর্থনীতি কতটা নির্ভরশীল তা বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়।

এমবিএসের ভিশন ২০৩০ এর প্রধান স্তম্ভ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে তিনটি বিষয়কে। সেগুলো হলো- সৌদি আরবকে আবার মুসলিম ও আরব বিশ্বের কেন্দ্রে পরিণত করা, বৈশ্বিক বিনিয়োগের পাওয়ার হাউজ হয়ে ওঠা এবং এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের যোগাযোগের সংযোগস্থল হিসেবে সৌদি আরবকে গড়ে তোলা। আর এর মাধ্যমে কিছু সুর্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জন করতে চায় সৌদি আরব। সেগুলো হলো- সৌদি সমাজব্যবস্থাকে আরও উজ্জীবিত ও গতিশীল করা। এজন্য নগরায়ন, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ও বিনোদন, খেলাধুলা, ওমরাহ এবং গড় আয়ুবৃদ্ধি করাসহ অনেকগুলো সেক্টরে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড শুরু করা হয়েছে।

অর্থনীতিকে আরও গতিশীল করতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, নারীদের কর্মক্ষেত্রে আরও বেশি যুক্ত করা, সরকারি বিনিয়োগ তহবিল গঠন, সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার দিকে জোর দেওয়া হয়েছে। তেল ছাড়া অন্যান্য শিল্পে রফতানি বৃদ্ধি করা হবে। এসবের সাথে থাকবে তেল ছাড়াও অন্যান্য খাত থেকে রাজস্ব আয়, সরকারকে আরও কার্যকর করা, সরকারি কার্যক্রমকে ডিজিটালাইজড করা, ব্যক্তিগত পর্যায়ে উপার্জন ও সঞ্চয় বৃদ্ধি এবং সেবামূলক কাজ বৃদ্ধি করা।

বিশাল এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে লোহিত সাগরের উপকূলে ২৬ হাজার ৫০০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে গড়ে তোলা হচ্ছে নিওম নামের একটি স্মার্ট সিটি। এই শহরে সব কিছুই গড়ে তোলা হচ্ছে ভবিষ্যতের পৃথিবীর কথা মাথায় রেখে, যেখানে মানুষ চলাচল করবে উড়ন্ত ট্যাক্সিতে। নিরাপত্তা ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কাজ করবে রোবট।

সৌদি যুবরাজ চাইছেন, প্রযুক্তির দিক থেকে শহরটি হবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালির মতো, বিনোদনের দিক থেকে হবে হলিউডের মতো আর অবসর কাটানোর জন্য হবে ফ্রেঞ্চ রিভিয়েরার মতো। রাতের বেলায় নিওমের আকাশে থাকবে কৃত্রিম চাঁদ। যেটি সারাক্ষণ জোছনা ছড়াবে। মরুভূমিতে নামানো হবে কৃত্রিম বৃষ্টি। শিক্ষাব্যবস্থা হবে হলোগ্রাফিক। শহরটিতে জুরাসিক পার্কের মতো একটি দ্বীপও থাকবে, যেখানে কৃত্রিম ডাইনোসরের দেখা পাওয়া যাবে।

২০২৫ সাল নাগাদ এই শহরের প্রথম ধাপের কাজ শেষ করতে চাইছে কর্তৃপক্ষ। ইতোমধ্যে সেখানকার বিমানবন্দরটি চালু হয়ে গেছে। মূলত বিদেশি বিনিয়োগ, বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ ও বিদেশি ধনীদের সেকেন্ড হোম নির্মাণের জন্য আকর্ষণ করতেই এই শহরটি গড়ে তোলা হচ্ছে। পর্যটন সেক্টরকে আরও আকর্ষণীয় করতে সৌদি আরবের বিভিন্ন স্থানে নতুন নতুন পর্যটন কেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে। ৪৯টি দেশের পর্যটকদের জন্য ভিসা ফি কমানো ও অন অ্যারাইভাল ভিসার সুযোগ চালু করা হয়েছে।

তবে এ সবের পাশাপাশি সৌদি নাগরিকদের জন্য কর বৃদ্ধি, সরকারি ভর্তুকি কমানোসহ অনেক সুবিধা কমানো হবে। সরকারি সম্পদের ওপর জনগণের নির্ভরতা কমবে। যেটি নাগরিককে অসন্তুষ্ট করছে। আবার উদার সমাজব্যবস্থার কথা বলা হলেও, ভিন্নমত দমন করা হচ্ছে কঠোর হাতে। ভিন্নমতের আলেম, সাংবাদিক, সমাজকর্মীদের ওপর নির্যাতনের খড়্গ চলছে আগের মতোই। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কঠোরতা আরও বেড়েছে। সাহিত্য, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এমনকি আলেমদের ফতোয়ার ওপরও সরকারি বিধিনিষেধ অনেক বেড়েছে। এছাড়া ইয়েমেন যুদ্ধ, জামাল খাশোগি হত্যাকাণ্ডসহ বেশ কিছু ঘটনায় এমবিএস নিজেও বিতর্কিত হয়েছেন।

অর্থাৎ, এই যুবরাজ সৌদি অর্থনীতিতে কার্যকর পরিবর্তন আনার চেষ্টা করলেও নিজের ক্ষমতা ও প্রভাবের ক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র ছাড় দিতে রাজি নন। বরং ক্ষমতা আরও মজবুত ও স্থায়ী করতে যা দরকার, তার সবই তিনি করছেন।