আরব আমিরাত এখন কোন কৌশল গ্রহণ করবে?

-

  • মোতালেব জামালী
  • ২০ জানুয়ারি ২০২১, ১১:০৩

সৌদি আরবের প্রাচীন শহর আল উলায় সম্প্রতি উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদ বা জিসিসির শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে কাতারের ওপর আরোপিত অবরোধ প্রত্যাহার করে একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এর মাধ্যমে জিসিসির সদস্য দেশগুলোর মধ্যে গত কয়েক বছর ধরে চলা টানাপড়েনের অবসান হয়। কিন্তু একটি প্রশ্ন বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে- সংযুক্ত আরব আমিরাতের ভূমিকা কী হবে?

এ কথা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না যে, জিসিসির সদস্য দেশগুলোর মধ্যে বিরোধের আপাত অবসান হলেও যে শর্তে চুক্তি হয়েছে তা কাতারের পক্ষেই গেছে। কাতারের ওপর জিসিসিভুক্ত দেশগুলোর আরোপিত অবরোধ সাড়ে তিন বছর ধরে চলেছে। কিন্তু এ সময় কাতার অবরোধ আরোপকারী দেশগুলোর শর্ত মেনে নিয়ে তাদের কাছে আত্মসমর্পণ করেনি।

দেশটি তার স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব অটুট রেখে সব প্রতিকূল পরিস্থিতির মোকাবিলা করেছে। অবরোধ আরোপকারী দেশগুলো তাদের অবরোধ প্রত্যাহারের জন্য কাতারকে ১৩টি শর্ত দিয়েছিল। কিন্তু কাতার তাদের একটি শর্তও মেনে নেয়নি। তাদের দাবি মেনে কাতার তার পররাষ্ট্রনীতিরও পরিবর্তন করেনি। শেষ পর্যন্ত কোনো দাবি পূরণ না হলেও সৌদি আরবসহ জিসিসির অন্য সদস্যরা অবরোধ প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এটা কাতারের জন্য একটি বড় বিজয়। প্রতিবেশীদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে শেষ পর্যন্ত কাতারই জিতেছে।

কাতারের ওপর থেকে অবরোধ প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তে জিসিসির সদস্য দেশগুলোর মধ্যে সবচয়ে বেশি অসন্তষ্ট হয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। আদর্শিক কারণের চেয়ে বরং এই অঞ্চলে ইসলামপন্থী দলগুলোর শক্তি বৃদ্ধি ও গণতন্ত্রের প্রসার ঘটানোর ক্ষেত্রে কাতারের ভূমিকাকে বেশি দায়ী করছে আরব আমিরাত। এ কারণেই দেশটি কাতারের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়েছে।
ওয়াশিংটনে আরব গালফ স্টেটস ইন্সটিটিউশনের ফেলো হুসাইন আইবিশ বলছেন, কাতার যে পর্যন্ত ইসলামি আন্দোলনের প্রসার ঘটানোর বিষয়ে তাদের পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন না আনবে ততদিন পর্যন্ত আরব আমিরাত কাতারকে বয়কট অব্যাহত রাখবে।

মধ্যপ্রাচ্যের আরো অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, সৌদি আরবের আল উলায় স্বাক্ষরিত চুক্তি কাতারের সাথে জিসিসি’র সব দেশের সাথে সমঝোতার পথ প্রশস্ত করবে নাকি কেবল সৌদি ও কাতারের মধ্যেই এটি সীমিত থাকবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। আল উলা চুক্তির পর আরব আমিরাতের সরকারি বার্তা সংস্থার এক বিশ্লেষনে বলা হয়েছে, এই সমঝোতা আরব জনগণের স্বার্থকেই সমুন্নত ও জিসিসি’র ঐক্যকে আরো সুদৃঢ় করবে। এতে আরো বলা হয়, এটা ‘সংকট অবসানের একটি আশাব্যঞ্জক সূচনা।

চুক্তি স্বাক্ষরের পর আমিরাতের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আনোয়ার গারগাস চুক্তিকে সমর্থন করে টুইট করে বলেছিলেন, ঐতিহাসিক আল উলা চুক্তির মাধ্যমে আরব শক্তি সংহত হয়েছে। এর মাধ্যমে আমাদের এই অঞ্চলের দেশগুলো ও তাদের জনগণের নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা ও সমদ্ধি অর্জনের বিষয়টি আরো অগ্রাধিকার পাবে।

চুক্তি স্বাক্ষরের সময় তিনি সিএনএনকে বলেছিলেন, অবরোধ আরোপকারি দেশগুলোর দেয়া ১৩ দফা শর্ত পূরণ নিয়ে আলোচনা সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। এর দুই দিন পর তিনি এক ব্রিফিংয়ে বলেন, আল উলা চুক্তির আলোকে তার দেশ কাতারের জন্য বিমান ও জাহাজ চলাচল এবং বাাণজ্য শুরুর ব্যাপারে আগামী এক সপ্তহের মধ্যে প্রয়োজনীয় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এর পর দিন জানানো হয় আরব আমিরাত স্থল, জল ও আকাশ পথ কাতারের জন্য খুলে দেবে।

এসব অগ্রগতির পরও আনোয়ার গারগাস বলেন, কাতারের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হতে আরো সময় লাগবে। কারণ তুরস্ক ও ইরানের সাথে সম্পর্ক এবং ইসলামপন্থি বিভিন্ন সংগঠনের প্রতি কাতারের সমর্থণ দেয়ার মতো স্পর্শকাতর ইস্যুগুলো এখানে একটি বাধাঁ সৃষ্টি করেছে। তিনি বলেন, কিছু সমস্যার সমাধান করা সহজ এবং কিছু সমস্যার সমাধান করতে অনেক সময়ের প্রয়োজন হবে।

আমিরাত আল উলা চুক্তি মেনে আংশিকভাবে হলেও যেসব সিদ্ধান্ত নিচ্ছে তাও যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অব বৈরুতের অধ্যাপক রামি জি খুরি বলেন, কাতারের সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ক পুনরায় চালু করার যে উদ্যোগ নিয়েছে তা দেশটির অনুসৃত ব্যর্থ নীতিরই আনুষ্ঠানিক প্রতিফলন। তিনি বলেন, আমিরাতের একটি কূটনৈতিক নথিতে এ সম্পর্কে যে সব কথা বলা হয়েছে তাতেই তাদের ব্যর্থ নীতির স্বীকৃতির প্রতিফলন দেখা যায়। এর মাধ্যমে আশা করা যায় যে, আরব দেশগুলোর পররাষ্ট্র নীতি প্রনয়ণের ক্ষেত্রে এটি হবে একটি টার্ণিং পয়েন্ট।

আরব আমিরাত উপসাগরীয় দেশগুলোর ঐক্য ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা জোরদারে কাভিড-১৯ মহামারি, জলবায়ু পরিবর্তণ, ইরানের সাথে এই অঞ্চলের অন্য দেশগুলোর বৈরিতা ইত্যাদি ইস্যুতে পররাষ্ট্র নীতিতে কতটুকু পর্যন্ত ভূমিকা নেয় সেটাও দেখার বিষয়। বিশেষ করে তুরস্কের ব্যাপারে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি কি হয় সেটাও গুরুত্বপূর্ণ।

তুরস্ক সমর্থিত লিবিয়ার জাতীয় ঐক্য সরকার বা জিএনএর সাথে মিসরের সাম্প্রতিক যোগাযোগ থেকে মনে করা হচ্ছে, কায়রো জিএনএ ও তুরস্কের সাথে সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটাতে চায়। এখন লিবিয়ার চলমান রাজনৈতিক সংকটের সমাধানে আমিরাতের পররাষ্ট্র নীতিতে জিএনএ সরকারের অবস্থান কী হয় তা দেখার বিষয়।

জেনেভা ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ এর গবেষক জালাল হারশায়ী মনে করেন, আমিরাত লিবিয়ায় তুরস্কের অবস্থানকে বেদনাদায়ক করতে ও অস্থিতিশীলতার মধ্যে ফেলতে সর্বাত্মক চেষ্টা করবে। তিনি নিউ আরব পত্রিকাকে বলেন, লিবিয়ায় তুরস্ককে যেন অনেক মূল্য দিতে হয় তা নিশ্চিত করার জন্য কোনো চেষ্টাই বাকি রাখবে না আমিরাত।

আল উলায় জিসিসি সম্মেলনে কাতারের ওপর থেকে অবরোধ প্রত্যাহারের চুক্তিকে এই অঞ্চলের অন্যান্য পক্ষ কি ভাবে নিয়েছে সেটাও বিবেচনার বিষয়। মৌরিতানিয়ার সরকার, লিবিয়ার তবরুক ভিত্তিক পার্লামেন্ট হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভ বা এইচ আর ও দক্ষিণ ইয়েমেনের সাউথার্ন ট্রানজিশনাল কাউন্সিল বা এসটিসি কাতারের ওপর থেকে অবরোধ আরোপের সিদ্ধান্তে মোটেই খুশি নয়। এরা সবাই কাতারবিরোধী শক্তি।

অক্সফোর্ড বিশ^বিদ্যালয়ের গবেষক স্যামুয়ের রামানী বলেন, এইচ ও আর এবং এসটিসির অবস্থান থেকেই স্পষ্ট হয়েছে যে, আমিরাত কাতারের সাথে বিরোধ অবসানে কতটুকু আগ্রহী বা ইচ্ছুক। বরং আমিরাত তাদের সমর্থিত এসব শক্তিকে কাতারের বিরুদ্ধে ব্যবহারের সর্বেবা চেষ্টা করবে। যদি সেটাই হয়, তাহলে কাতার ও আমিরাতের মধ্যে বিরোধের অবসান ঘটার পরিবর্তে বরং ভবিষ্যতে তাদের মধ্যে শত্রুতা আরো বাড়বে।

বৃহত্তর ভূ-রাজনৈতিক দৃশ্যপট থেকে দেখলে এটা স্পষ্ট যে, আল উলা সম্মেলন এই অঞ্চলের ব্যাপারে আমিরাত সরকারের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিকেই তুলে ধরেছে। বিশেষ করে তুরস্ক ও কাতারের জোটের বিরুদ্ধে আরব দেশগুলোর কোনো জোটকে নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষমতা যে আরব আমিরাতের নেই তা স্পষ্ট হয়ে গেছে। কাতারে তুরস্কের সামরিক ঘাটি বন্ধ করাসহ কাতারকে দেয়া ১৩ দফা শর্ত পরিত্যাগ করে আমিরাত মূলত জিসিসিভুক্ত অঞ্চলে কাতারের সামরিক উপস্থিতি কার্যত মেনে নিয়েছে।

সৌদি আরব নতুন বছরে যদি তুরস্কের সাথে সম্পর্কের উন্নতি ঘটাতে পারে, তাহলে আমিরাত সেটাকে কিভাবে নেয় তাও দেখার বিষয়। আমিরাত মনে করে তুরস্ক হচ্ছে একটি সম্প্রসারণবাদী শক্তি যারা আরব দেশগুলোর জন্য হুমকি হয়ে উঠছে। দেশটি চায়না তুরস্কের সাথে সৌদি আরবের সম্পর্ক উন্নত হোক।

আগামীতে কাতারকে নিয়ে আমিরাত যে চরম উদ্বেগের মধ্যে থাকবে তা সহজেই বলা যায়। আমিরাত কাতারের পররাষ্ট্র নীতি নিয়েও উদ্বিগ্ন। তুরস্ক ও ইরানের সাথে দোহার সুসম্পর্কের কারণেই ২০১৪ সালে কাতার থেকে নিজেদের রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার করেছিলো। ২০১৭ সালের জুন মাসে কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছিল । বিভিন্ন ইসলামপন্থি সংগঠনের সাথে কাতারের সম্পর্ক রাখা, তুরস্ক ও ইরানের সাথে সখ্য, আল জাজিরাসহ স্বাধীন গণমাধ্যমের মতো বিষয়গুলো আমিরাত নিজেদের জন্য বড় হুমকি হিসেবে মনে করে আরব আমিরাত।

আল উলা সম্মেলন জিসিসির ফাটল জোড়া লাগানোর ক্ষেত্রে সফল উদ্যোগ হলেও এর মাধ্যমে কাতারকে নিয়ে সংকট সমাধানের মূলে যেতে পারেনি সদস্য দেশগুলো। যেসব কারণে কাতারের সাথে সম্পর্কের অবণতি ঘটেছিল তার একটিরও কোনো সুরাহা হয়নি। কাতারের আঞ্চলিক নীতির মোকাবেলা আমিরাত কিভাবে করবে তা এখনো স্পষ্ট নয়।

কাতারকে নিয়ে আমিরাতের নেতিবিাচক মনোভাব দূর হয়নি। আমিরাত যে আবারও কাতারের বিরুদ্ধে কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক পদক্ষেপ নেবেনা তা হলফ করে কেউই বলতে পারেনা। কাতারকে কেন্দ্র করে আমিরাত যে আবারও জিসিসির মধ্যে সংকট তৈরি করবেনা তা গ্যারান্টি দিয়ে বলার উপায় নেই।