বিশ্বব্যাপী মসজিদ বানাচ্ছে তুরস্ক


  • আহমেদ বায়েজীদ
  • ০৫ ডিসেম্বর ২০২১, ১৭:০৮

ইউরোপ থেকে আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য থেকে আমেরিকা- বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মুসলিমদের মসজিদ নির্মাণে সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে তুরস্ক। দেশটির সরকার ২০১৫ সালে বিভিন্ন দেশে ৩০টির বেশি মসজিদ নির্মাণের মাস্টারপ্ল্যান হাতে নেয়। সে অনুযায়ী অনেক দেশেই তুরস্কের সহযোগিতায় নির্মিত হয়েছে দৃষ্টিনন্দন মসজিদ। কোথাও নির্মাণকাজ চলছে, কোথাও বা চলছে কাজ শুরুর প্রস্তুতি। তুরস্ক চাইছে, এর মধ্যেমে মুসলিমবিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক আরও উন্নত করতে। আর সমালোচকরা বলছেন, প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান ফিরিয়ে আনতে চাইছেন ওসমানীয় যুগের দিনগুলো।

পূর্ব আফ্রিকার দেশ জিবুতিতে ২০১৯ সালে বড় একটি মসজিদ নির্মিত হয় তুর্কি অর্থায়নে। মসজিদটিকে বলা হচ্ছে ‘তুরস্কের পক্ষ থেকে জিবুতির জন্য উপহার’। তুর্কি সরকারের অর্থায়নে পরিচালিত দাতব্য সংস্থা দ্য টার্কিস দিয়ানেত ফাউন্ডেশন-টিডিভি ২০১৭ সালে মসজিদটির নির্মাণ কাজ শুরু করে। ভারত মহাসাগর উপকূলে দেশটির প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের কাছে ১০ হাজার বর্গমিটার জায়গা জুড়ে নান্দনিক নির্মাণশৈলিতে গড়ে তোলা হয়েছে মসজিদটি। এর নকশায় রয়েছে প্রাচীন ওসমানীয় শিল্প ও নির্মাণশৈলী। একসঙ্গে ৫ হাজার লোক নামাজ পড়তে পারে এখানে। মসজিদ ছাড়াও এর পাশে আছে একটি বাগান ও মাঠ, যা অনেকটা তুরস্কের ঐতিহাসিক ব্লু মসজিদের স্টাইলে তৈরি। মসজিদের একটি অংশ রয়েছে ভারত মহাসাগরের পানিতে, যে কারণে এর নির্মাণ কাজটি ছিলো খুব চ্যালেঞ্জিং।

মসজিদটিতে আছে ৪৫ মিটার উঁচু দুটি মিনার এবং একটি বড় ও চারটি ছোট গম্বুজ। ভেতরে আছে ঝুলন্ত ঝাড়বাতি। মসজিদ এলাকার একটি অংশ আছে শিশুদের ধর্মীয় শিক্ষার জন্য, মাঠের মাঝখানে আছে একটি ঝর্ণা। মসজিদ তৈরির বেশির ভাগ উপকরণ আনা হয়েছে তুরস্ক থেকে।

ভারত মহাসাগরের তীরে অবস্থিত ছোট্ট দেশ জিবুতির জনসংখ্যা ১০ লাখেরও বেশি। জনসংখ্যার ৯৪ শতাংশ মুসলিম। দেশটিতে সাম্প্রতিক সময়ে বেশি কিছু উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সহযোগি হয়েছে তুরস্কের একে পার্টির সরকার। তারই অংশ হিসেবে তৈরি হয়েছে মসজিদটি।

জিবুতি মুসলিম প্রধান দেশ বলেই নয়। অন্য অনেক দেশেও একই উদ্যোগ নিয়েছে তুরস্ক। ২০১৫ সালে রাশিয়ার রাজধানী মস্কোর কেন্দ্রিয় মসজিদ হিসেবে পরিচিত মস্কো সেন্ট্রাল মস্ক পুণনির্মাণ করা হয়। মস্কোর অলিম্পিয়াস্কি অ্যাভিনিউতে অবস্থিত মসজিদটিতে একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারে ১০ হাজার মুসল্লি। মসজিদটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ১০৯ মিলিয়ন ইউরো। ছয় তলা বিশিষ্ট এই মসজিদটি নির্মাণে উদ্যোক্তা ও খরচের একটি অংশ বহন করেছে তুরস্কের দিয়ানেত ফাউন্ডেশন।

জিবুতি ও রাশিয়ায় নির্মিত মসজিদ দুটো উদাহরণমাত্র। বিশ্বের অনেক দেশেই এমন মসজিদ তৈরি করছে তুরস্ক। তুরস্ক বলছে, সারা বিশ্বের মুসলিমদের জন্য এটি তাদের উপহার। মসজিদ নির্মাণে সহযোগিতার মাধ্যমে তারা সৌহার্দ্য আর আন্তরিকতার পরিবেশ ছড়িয়ে দিতে চাইছে মুসলিম উম্মাহর মাঝে। এসব মসজিদ নির্মিত হচ্ছে তুর্কি সরকার কিংবা দেশটির কোন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। আবার সংশ্লিষ্ট দেশের বিভিন্ন দানশীল ব্যক্তিদেরও যুক্ত করা হচ্ছে। যেমন মস্কোর সেন্ট্রাল মস্ক নির্মাণের খরচের সবেেচয় বেশি অংশ বহন করেছেন ধনকুবের সুলাইমান করিমভ।

বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মুসলিমদের জন্য এই উদ্যোগ নিয়েছে তুরস্ক। শুধু যে মসজিদ নির্মাণে আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতা দিচ্ছে তা নয়, অমুসলিম প্রধান দেশগুলোতে মসজিদ নির্মাণের সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর অনুমোদনের ব্যবস্থাও করছে তুরস্ক কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে।

২০১৫ সালে মধ্য আমেরিকা অঞ্চলের দেশ কিউবা সফরে গিয়ে দেশটির প্রেসিডেন্ট রাউল ক্যাস্ট্রোর কাছে মসজিদ নির্মাণের জন্য অনুমতি ও জায়গা বরাদ্দ চান তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। কঠোর কমিউনিস্ট শাসনের দেশ কিউবায় মুসলিম জনগোষ্ঠির সংখ্যা মোট জনসংখ্যার তুলনায় খুবই সামান্য। তারা মোট জনসংখ্যার ০.২ শতাংশ মাত্র। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান কিউবান মুসলিমদের জন্য রাজধানী হাভানায় মসজিদ নির্মাণের প্রস্তাব দেন দেশটির সরকারের কাছে।

২০১৮ সালে লাতিন আমেরিকা অঞ্চলের দেশ ভেনেজুয়ালার মুসলিমদের জন্য একটি মসজিদ নির্মাণের পরিকল্পনা শুরু করে তুরস্ক। প্রেেিসডন্ট এরদোয়ান জানিয়েছেন, ভেনেজুয়েলার সরকারের অনুরোধের প্রেক্ষিতে তার দেশ এই উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে।

এভাবেই বিশ্বের নানা প্রান্তের মুসলিমদের জন্য তুর্কি অর্থায়নে গড়ে উঠেছে দৃষ্টিনন্দন সব মসজিদ। উসমানীয় সাম্রাজ্যের যুগে তুর্কি শাসকরা বিশ্বের যেখানেই রাজ্য জয় করেছেন, সেখানেই মানুষকে ইসলামের দাওয়াত দিয়েছেন, আর নির্মাণ করেছেন অনেক মসজিদ। আজো বিশ্বের নানা প্রান্তে ইসলামের সোনালী অতীতের সাক্ষী হয়ে আছে প্রাচীন তুর্কি স্থাপত্য নকশার অনেক মসজিদ।

বর্তমানে তুরস্কের একে পার্টির সরকার তার দেশের শাসকদের সেই প্রাচীন এতিহ্যকেই আবার ফিরিয়ে আনতে চাইছে। যে কারণে তারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মুসলিমদের জন্য মসজিদ তৈরি করে দিচ্ছে নিজস্ব অর্থায়নে। এসব মসজিদ নির্মাণে ইসলামিক স্থাপত্যরীতির পাশাপাশি রাখা হচ্ছে তুর্কি সংস্কৃতির ছাপ।

একটা সময় সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মসজিদ তৈরির জন্য প্রচুর অনুদান দিয়েছে। গত দুই দশক ধরে তাদের সেই প্রবণতা অনেকটাই কমেছে। তবে একই কাজ শুরু করেছে তুরস্কের রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের সরকার। ২০১৫ সালে তুরস্ক বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে অন্তত ৩০টি মসজিদ নির্মাণের একটি বড় পরিকল্পনা হাতে নেয়। এরপর ধীরে ধীরে এর নির্মাণ কাজ শুরু হয়।

এখন পর্যন্ত তুরস্ক যেসব দেশে মসজিদ নির্মাণ করেছে তার মধ্যে বেশির ভাগই ইউরোপের দেশ। রাশিয়া, জার্মানি, ব্রিটেন, আলবেনিয়া, বসনিয়া, উত্তর সাইপ্রাস ও নেদারল্যান্ডে মসজিদ নির্মাণ করেছে তুরস্ক। পরিকল্পনা রয়েছে কিংবা কাজ শুরুর অপেক্ষায় রয়েছে রোমানিয়া, বুলগেরিয়া, হাঙ্গেরি, বেলারুশ, রাশিয়া অধিকৃত ইউক্রেনের ক্রাইমিয়া ও জর্জিয়ায় মসজিদ নির্মাণ।

তুরস্ক যেসব মসজিদ নির্মাণ করেছে তার মধ্যে ব্রিটেনে বহুল প্রশংসীত পরিবেশ বান্ধব ক্যামব্রিজ সেন্ট্রাল মসজিদের কথা এর বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই মসজিদটি ইউরোপের প্রথম পরিবেশ বান্ধব মসজিদ। মসজিদটিতে এমন সব উপকরণ ব্যবহার করা হয়েছে যা থেকে কোন কার্বন নিঃসরণ হবে না। সূর্যের আলো প্রবেশের এমন ব্যবস্থা রাখা হয়েছে যে, মসজিদটিতে দিনের বেলা বাতি জ¦ালানোর দরকারও হবে না। আবার মসজিদের ছাদে রাখা হয়েছে বৃষ্টির পানি প্রক্রিয়াজাত করার ব্যবস্থা। চারপাশে আছে দৃষ্টিনন্দন ফোয়ারা ও বাগান।

এই মসজিদে একসঙ্গে ১ হাজার মুসল্লি­ নামাজ পড়তে পারেন। এছাড়া জনকল্যাণমূলক নানা সুবিধার ব্যবস্থা করা হয়েছে এ মসজিদে। স্থানীয় মুসলিম ও অমুসলিমদের সেমিনার আয়োজনের ব্যবস্থা রয়েছে। রয়েছে শিশুদের জন্য প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা। ২০০৮ সালে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজের লেকচারার ড. টিমোথি উইন্টার এই মসজিদ নির্মাণের উদ্যোগ নেন এবং তহবিল সংগ্রহ শুরু করেন। আর তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে মোট খরচের দুই-তৃতীংশ খরচ বহন করে তুরস্ক।

মধ্য এশিয়ার দেশ কাজাখস্তান ও কিরগিজস্থানে মসজিদ নির্মাণ করেছে তুরস্ক। মধ্য আমেরিকার দেশ হাইতিতেও তারা একটি মসজিদ নির্মাণ করেছে। আফ্রিকা মহাদেশের দেশগুলোর মধ্যে জিবুতি, সোমালিয়া, মালিতে মসজিদ নির্মিত হয়েছে তুর্কি অর্থায়নে। আরও দুয়েকটি দেশে নির্মাণের বিষয়ে আলোচনা চলছে। ২০১৬ সালের এপ্রিলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যারিল্যান্ড অঙ্গগরাষ্ট্রে তুরস্কের অর্থায়নে নির্মিত একটি মসজিদ উদ্বোধন করেন রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান।

বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মুসলিমদের জন্য তুরস্কের এই উদ্যোগ প্রশংসা কুড়াচ্ছে। বিশেষ করে ইউরোপের দেশগুলোতে যখন ইসলামফোবিয়া মারাত্মক আকার ধারণ করেছে, বিভিন্ন স্থানে মুসলিমরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন- সে সময় ওইসব দেশগুলোতে মসজিদ নির্মাণের ঘটনা মুসলিমদের অবস্থানকে জোরালো করতে ভূমিকা রাখবে। তুরস্ক সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এসব মসজিদ সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে অন্য ধর্মের মানুষের সঙ্গে মুসলিমদের সম্পর্ক উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে। যা মুসলিমদের প্রতি বৈষম্য হ্রাসে কাজ করবে। পাশাপাশি এসব মসজিদ থেকে সমাজকল্যানমূলক কাজ করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, যা ইসলামফোবিয়া দূর করতে ভূমিকা রাখবে।

কিউবা, ভেনেজুয়েলার মতো দেশগুলোতে মুসলিমদের সংখ্যা খুবই কম, আবার সেসব দেশে চলছে কঠোর কমিউনিস্ট শাসন। এমন দেশগুলোর মুসলিমদের জন্য মসজিদ তৈরি করে দেওয়া সহজ কথা নয়। তুরস্ক কূটনৈতিক সম্পর্ক কাজে লাগিয়ে এই উদ্যোগ নিয়েছে। আবার ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায়ও তারা মসজিদ নির্মাণ করেছে।

অবশ্য এরদোয়ান সরকারের সমালোচকরা বলছেন, তুরস্ক আবার মুসলিম বিশ্বে নিজেদের পুরনো প্রভাব ফিরিয়ে আনতে চায়। যে কারণে সারা বিশ্বে তারা মসজিদ তৈরি করছে। এর মধ্যেমে এরদোয়ান চাইছেন সারা বিশ্বের মুসলিমদের মাঝে তুরস্কের প্রতি আস্থা বাড়াতে। বিশেষ করে পশ্চিমা গণমাধ্যম ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এই পদক্ষেপকে আঙ্কারার মসজিদ কূটনীতি হিসেবেও আখ্যায়িত করছে। কেউ কেউ বলছেন, এটি এরদোয়ানের সফট পাওয়ার ছড়িয়ে দেওয়ার কৌশল।

প্রেেিসডেন্ট এরদোয়ান সব সময়ই মুসলিম বিশ্বের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আন্তর্জাতিক ফোরামে সবচেয়ে জোরালো ভূমিকা রাখেন। সব সময়ই মুসলিম বিশ্বের মাঝে ঐক্য সৃষ্টির প্রতি গুরুত্বারোপ করেন তিনি। তাই তো তার সরকারের এই মসজিদ নির্মাণের পরিকল্পনাকে দেখেন, মুসলিমদের মাঝে সৌহার্দ্য বৃদ্ধির উপলক্ষ হিসেবে।