লাদাখ : চীন-ভারত যুদ্ধক্ষেত্র


  • ফারজানা তানিয়া
  • ২০ অক্টোবর ২০২১, ১৭:২৬

বৈঠক হয়, চুক্তি হয়, কদিন পর সেই চুক্তি লঙ্ঘনও হয়, তৈরি হয় যুদ্ধাবস্থা, এরপর বিপুল প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি। এভাবেই চলছে চীন-ভারত সীমান্ত অঞ্চল লাদাখের অবস্থা। দৃশ্যত, এ নিয়ে সমাধানসূত্র মেলা অসম্ভব।

ভারত এবং চীনের মধ্যে প্রায় চার হাজার কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। এর মধ্যে একটি বড় অংশ লাদাখে। বাকি অংশ উত্তরপূর্ব ভারতের সিকিম এবং অরুণাচলে।

লাদাখ ভারতের কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল। এ অঞ্চলের উত্তরে কুনলুন পর্বতশ্রেণি এবং দক্ষিণে হিমালয়। লাদাখের পূর্বে তিব্বত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল। দক্ষিণে হিমালয়ের পর ভারতের হিমাচল রাজ্য এবং ভারত-শাসিত জম্মু-কাশ্মীর। পশ্চিমে পাকিস্তান-শাসিত গিলগিত-বালতিস্তান এবং চীনের জিনজিয়াং প্রদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ। উত্তরে কারাকোরাম পাস। লাদাখ কারাকোরাম পাসের সিয়াচেন হিমবাহ থেকে দক্ষিণে হিমালয় পর্যন্ত বিস্তৃত। এ এলাকার অধিবাসীরা ইন্দো-আর্য এবং তিব্বতী বংশোদ্ভূত। লাদাখ ভারতের জনবিরল এলাকাগুলোর একটি।

লাদাখ সীমান্তের একটি বড় অংশে মানুষের বসবাস নেই। এই ভৌগোলিক অঞ্চলকে মূলত আকসাই চীন বলা হয়। ভারত মনে করে, আকসাই চীন তাদের অংশ। চীন মনে করে, আকসাই চীন তাদের। ১৯৬২ সালের যুদ্ধের পরে যাদের সেনা যেখানে ছিল, সেটাকেই প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বলে ধরে নেওয়া হয়। কিন্তু দুই দেশই নিজেদের এলাকা বাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে।

সীমানা বিরোধ নিয়ে ১৯৬২ সালের যুদ্ধে চীনের কাছে ভারত পরাজিত হয়। চীন তিব্বত দখল করার পর ভারতের বর্তমান অরুণাচল প্রদেশ ও আকসাই চীনকে চীনের অন্তর্ভুক্ত এলাকা বলে দাবি করে। এভাবে যে সীমান্ত সমস্যার শুরু হয়, তা শেষ পর্যন্ত যুদ্ধের সূচনা করে। যুদ্ধে চীন জয়ী হয়ে একতরফা যুদ্ধবিরতি জারি করে, আকসাই চীন দখলে রাখে কিন্তু অরুণাচল প্রদেশ ফিরিয়ে দেয়।

অতীতে এ সীমান্তে বিবাদ হতো অরুণাচল প্রদেশ কিংবা সিকিমের আশপাশে। সবশেষ ১৯৬৭ সালে এই ফ্রন্টের নাথুলা পাসে একদফা সংঘর্ষ হয়, যাতে ৮৮ জন ভারতীয় সেনা মারা যান। এরপর আরও কয়েকবার এ সীমান্তে উত্তেজনা দেখা দিলেও তা আগের মতো খুনোখুনিতে গড়ায়নি। ভুটানের পাশে দোকলামেও দুই দেশ ২০১৭ সালে একদফা রক্তপাতহীন বিবাদে লিপ্ত ছিল প্রায় আড়াই মাস।

লাদাখ সীমান্ত নিয়ে বিতর্ক নতুন নয়, তবে তা এক অন্য পর্যায়ে পৌঁছায় ২০২০ সালের জুনে। গালওয়ানে দুই দেশের সেনার হাতাহাতিকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ শুরু হয়। প্রায় সারা রাত ধরে চলা সংঘর্ষের পর ২০ জন ভারতীয় সেনার লাশ উদ্ধার করা হয়। চীন স্বীকার করে, সংঘর্ষে তাদের চার সেনা নিহত হয়েছে। তারপর থেকে লাগাতার অচলাবস্থা চলছে দুই দেশের মধ্যে। সীমান্তের দুই ধারে দুই দেশই সেনা মোতায়েন করে রেখেছে।

লাদাখে ভারত ও চীনের মধ্যে ছয়টি এলাকা নিয়ে বিতর্ক আছে। পরিভাষায় যাকে হটস্পট বলা হয়। এর মধ্যে কিছু জায়গা নিয়ে রফাসূত্রে পৌঁছানো গেলেও কিছু অঞ্চল নিয়ে এখনও বিতর্ক চলছে। প্যাংগং লেকের দুই প্রান্ত, গালওয়ানের মতো এলাকাগুলোর সাময়িক সমাধানসূত্র মিলেছে। কিন্তু ডেপসাং, গোগরা এবং হটস্প্রিং অঞ্চল নিয়ে এখনও তুমুল বিতর্ক রয়েছে। এবং বছর-দেড়েক ধরে ওই এলাকায় দুই দেশের সেনারা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছেন। সম্প্রতি ভারতীয় সেনাবাহিনী জানিয়েছে, এখনও লাদাখে প্রায় পঞ্চাশ হাজার সেনা মোতায়েন রয়েছে। উল্টোদিকে চীনও সীমান্তের ধারে সমপরিমাণ সেনা দাঁড় করিয়ে রেখেছে।

মূলত গত বছরের মাঝামাঝি থেকে সমস্যাটা প্রকট হয়। ওই বছরের জুনের সংঘর্ষে বড় ক্ষয়ক্ষতির পর আগস্টের শেষের দিকে ভারতে ঢোকার চেষ্টা করে চীন। এরপর ভারত ও চীনের ব্রিগেড কমান্ডার স্তরের বৈঠক হয়। সেপ্টেম্বরে পূর্ব লাদাখের প্যাংগং লেকের দক্ষিণে সব কটি পোস্ট দখল করার দাবি করে ভারতীয় সেনাবাহিনী। অবশ্য, এ দাবি অস্বীকার করে চীন। পূর্ব লাদাখ নিয়ে চলতে থাকে চীন-ভারত টানাপড়েন।

এরপর সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি লাদাখ নিয়ে চীন-ভারত মতৈক্য হয়েছে বলে খবরে বলা হয়। মস্কোয় মুখোমুখি বৈঠকে বসেন ভারত ও চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। ওই বৈঠকে পাঁচটি পয়েন্ট স্থির করা হয়। ওই পাঁচ পয়েন্টের মাধ্যমেই সীমান্তে ভারত ও চীনের সংঘাত কমানোর চেষ্টা হবে বলে দুই দেশের মন্ত্রীরা সিদ্ধান্ত নেন। মস্কোয় এ নিয়ে বৈঠক করেন দুই দেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রীও। সীমান্তের আর বাড়তি সেনা পাঠানো হবে না বলে সিদ্ধান্ত নেয় পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল দুই প্রতিবেশী দেশ।

কিন্তু, চার মন্ত্রীর বৈঠকের পরও সীমান্তে উত্তেজনা কমার লক্ষণ দেখা যায়নি। দুইপক্ষের কেউই সৈন্য সরায়নি। বরং রসদ ও সমরাস্ত্র জড়ো করার মাত্রা বাড়ানো হয়। সীমান্তে গুলি করার অনুমোদন দেওয়াসহ ভারতের বেশ কিছু সিদ্ধান্ত ও বক্তব্য নিয়ে চীনের ভেতর ক্ষোভ ও সন্দেহ তৈরি হয়।

শুরু হয় নবম পর্যায়ের সেনা বৈঠক। আলোচনার জেরে এ বছরের জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে দুইপক্ষই দ্রুত সেনা প্রত্যাহার করার ব্যাপারে সম্মত হয়। ফেব্রুয়ারিতে সীমান্তের বিভিন্ন এলাকা থেকে ভারত ও চীন তাদের সৈন্য সরিয়ে নিতে শুরু করে। তখন চীনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানায়, লাদাখের প্যাংগং লেকের দক্ষিণ ও উত্তর তীরে চীন-ভারতের যে সেনা মোতায়েন রয়েছে, তারা সুশৃঙ্খলভাবে ও সমতা বজায় রেখে পিছিয়ে যেতে শুরু করেছে।

এ বছরের জুনের শেষের দিকে পরিস্থিতি আবার বদলাতে শুরু করে। লাদাখে চীন-ভারত সীমান্তের পশ্চিম সেক্টরে সামরিক তৎপরতা বাড়ায় দুই দেশ। বিশেষ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নতুন সৈন্যদের প্রস্তুত করা হয়। সেখানে মোতায়েন সৈন্যের সংখ্যা অন্তত অর্ধলাখ বাড়ায় নয়াদিল্লি।

জুলাই-র শেষ দিকে লাদাখে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা থেকে সেনা সরানো নিয়ে ১২ দফার কোর কমান্ডার পর্যায়ের বৈঠকে বসে দুই দেশ। হটস্প্রিংস এবং গোগরা হাইট থেকে সেনা সরানো নিয়েই দুই দেশের মধ্যে এ বৈঠক। এর প্রেক্ষিতে আগস্টের শুরুর দিকে গোগরা এলাকায় দুই দেশের মধ্যে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর মোতায়েন সেনা প্রত্যাহার করে নেয় দুই দেশ। চুক্তি অনুসারে সেখানকার অস্থায়ী অবকাঠামোও সরিয়ে নেওয়া হয়।

কিন্তু, অক্টোবরের শুরুর দিকে লাদাখ সীমান্তে আবারও সেনা মোতায়েন করে চীন। একে কেন্দ্র করে উত্তেজনা বাড়তে থাকে। ভারতীয় গণমাধ্যমের দাবি, লাদাখ সীমান্তের দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় অত্যাধুনিক ট্যাংকবহর কে-নাইন বজ্র পাঠায় ভারত। সীমান্তের বিতর্কিত যে অঞ্চলে গত বছর সংঘর্ষে জড়িয়েছিল ভারত ও চীনের সেনারা, ঠিক সেখানেই এ বহর পাঠিয়ে নিজেদের উপস্থিতি জোরদার করে নয়াদিল্লি।

উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে সর্বশেষ ১০ অক্টোবর ডাকা দুই দেশের সেনা কর্মকর্তাদের বৈঠক ভণ্ডুল হয়ে যায়। বৈঠকের পর ভারতীয় সেনাবাহিনী যে বিবৃতি প্রকাশ করেছে, তাতে বলা হয়েছে, একাধিকবার চীনকে সেনা পিছিয়ে নেওয়ার অনুরোধ করা হয়েছিল। সমাধানসূত্রে পৌঁছাতে গেলে সেনা পেছোতে হবে, এটাই ভারতের দাবি। কিন্তু চীন সে কথা মানতে রাজি হয়নি। ভারতের লক্ষ্য ছিল গোগরা ও হটস্প্রিং সমস্যার প্রতিকার করা। কারণ ডেসপাং উপত্যকার বিষয়টি জটিল ও সময়সাপেক্ষ। বৈঠকে দুই দেশের সীমান্ত এলাকা থেকে সেনা সরানোর জন্য দাবি তোলে চীন। কিন্তু ভারতের পক্ষে বলা হয়, আগে গোগরা ও হটস্প্রিং এলাকা থেকে সেনা সরাতে হবে চীনকে, তবেই পদক্ষেপ নেবে ভারত।

অন্যদিকে চীনের পিপলস আর্মি যে বিবৃতি প্রকাশ করেছে, তাতে বলা হয়েছে, ভারত যে প্রস্তাব দিচ্ছে, তা অবাস্তব। এবং সে কারণেই বৈঠক ব্যর্থ হয়েছে।

এখন লাদাখ সীমান্তে যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে। সীমান্তে ট্যাঙ্ক রেজিমেন্ট মোতায়েন করেছে চীনের সেনাবাহিনী। চীনের রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারমাধ্যম সিসিটিভি জানিয়েছে, কারাকোরাম পর্বতে ৫ হাজার মিটার উচ্চতায় ভারতীয় সেনাদের মুখোমুখি হওয়া চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মির জিনজিয়াং মিলিটারি ডিস্ট্রিক্টকে উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন করা হয়েছে। সেখানে অনেক উঁচুতে যুদ্ধ পরিচালনায় সক্ষম- এ রকম উন্নত প্রযুক্তির ট্যাংকগুলোকে সক্রিয় করা হয়েছে।

চীনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমের আরেকটি প্রতিবেদনে বলা হয়, একটি ব্রিগেড প্রথমবারের মতো পশ্চিম সিচুয়ানে গ্রেনেড লঞ্চারের লাইভ অ্যামুনিশন ফায়ারের পরীক্ষাও চালিয়েছে।

লাদাখে চীন-ভারত সমস্যা নিয়ে দফায় দফায় বৈঠকের পর সাময়িকভাবে সমাধান এলেও তা কখনও স্থায়ী সমাধানের দিকে ধাবিত হয়নি। এর স্থায়ী সমাধান সম্ভব- এমনটা মনে করেন না বিশ্লেষকরাও। ভারতীয় সেনাবাহিনী সাবেক লেফটন্যান্ট জেনারেল উৎপল ভট্টাচার্য বলেন, লাদাখের বিতর্কিত অঞ্চলগুলোতে দুই দেশের সেনাই পেট্রলিং করতে যায়। কারণ, দুই তরফই ওই অঞ্চল নিজেদের বলে দাবি করে। বিতর্কিত অঞ্চল থেকে সেনা সরানোর অর্থ হলো- নিজেদের দাবি থেকে সরে যাওয়া। সে কারণেই চীন সেনা সরাতে চাচ্ছে না বলে মনে করেন তিনি।

বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, যে দুইটি অঞ্চল নিয়ে এখন বিতর্ক চলছে, সেই দুইটি স্ট্র্যাটেজিক জায়গা। ভারত-চীন কোনো পক্ষই সেই স্ট্র্যাটেজিক জায়গার দখল ছাড়তে চায় না। ফলে সমাধানসূত্রে পৌঁছানো যাচ্ছে না।

বস্তুত, প্যাংগং এবং গালওয়ান নিয়েও একই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। বেশ কয়েকমাস অচলাবস্থা চলার পর দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বৈঠক করে সাময়িক সমাধানের রাস্তা বের করেছিলেন। কিন্তু তাতেও যে পুরো সমস্যার সমাধান হয়নি, তা স্পষ্ট। প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতায় নামা দুই দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ে এ সমস্যার স্থায়ী সমাধান যে হবে না, তা অনেকটা নিশ্চিত। সেনা স্তরের বৈঠক করে এ বিতর্ক মেটানো যে একেবারেই অসম্ভব, তা নিশ্চিত করে বলছেন বিশ্লেষকরা।