তুরস্ক-আরব আমিরাত : বন্ধু নাকি শত্রু


  • আহমেদ বায়েজীদ
  • ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৪:৪৪

একদিকে মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশ তুরস্ক, অন্যদিকে সম্পদশালী সংযুক্ত আরব আমিরাত। একটি সেক্যুলার অতীতকে পেছনে ফেলে ক্রমশ ফিরে আসছে ইসলামিক মূল্যবোধের রাষ্ট্রীয় নীতিতে। অন্যটি চলছে তার বিপরীত পথে। আরব রাষ্ট্র হয়েও গা ভাসাচ্ছে পশ্চিমা স্রোতে। সব কিছুর ওপরে প্রাধান্য দিচ্ছে শাসকদের গদি রক্ষা আর অর্থনীতিকে। গুরুত্বপূর্ণ দেশ দুটির মাঝে তাই প্রায় সব ইস্যুতেই তৈরি হয়েছে বৈরিতা। তা সত্ত্বেও কিছু বিষয়ে আছে সহযোগিতার সম্পর্ক, ইতিহাসও সাক্ষ্য দিচ্ছে দুই দেশের ঘনিষ্ঠতার।

১৯৭১ সালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা পায় সংযুক্ত আরব আমিরাত। স্থানীয় শেখদের দ্বারা শাসিত কয়েকটি আমিরাত মিলে গঠিত হয় একটি ফেডারেল রাষ্ট্র। অন্যদিকে তুরস্ক তখন ওসমানীয় শাসনামলের স্বর্ণযুগ পেছনে ফেলে মার্কিনপন্থী সেক্যুলার রাষ্ট্র হওয়ার চেষ্টা করছে। আরব আমিরাত যদিও কখনও ওসামনীয় শাসনের অধীনে ছিল না। এরপরও ওসমানীয় শাসকদের বিষয়ে আরব শেখদের ইতিবাচক মানসিকতা ছিল না।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশদের সহযোগিতায় ওসমানীয় শাসন থেকে বের হয়ে পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে কয়েকটি আরব ভূখণ্ড। সংযুক্ত আরব আমিরাত আরও অনেক বছর ব্রিটিশ শাসনের অধীনে থাকলেও তুরস্কের প্রতি তাদের মানসিকতাও ছিল অন্য আরব দেশগুলোর মতোই নেতিবাচক। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে আরবদের বড় একটি অংশ তুরস্কের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল, যেটি ওই যুদ্ধে তুরস্কের পরাজয় ও ওসমানীয় খিলাফতের যুগের সমাপ্তির উল্লেখযোগ্য কারণ বলে মনে করা হয়।

একসময় এসব পেছনে ফেলে উভয় দেশ ঘনিষ্ঠ হয়েছে বিভিন্ন ইস্যুতে। বাণিজ্য ও বিনিয়োগের সম্পর্কে লাভবান হয়েছে উভয় পক্ষ। দুই দেশের নাগরিকদের মাঝেও সাংস্কৃতিক যোগাযোগ বৃদ্ধিতে নেওয়া হয়েছে নানা পদক্ষেপ। তুরস্ক সব সময়ই আবর ভূখণ্ডের প্রতি বিশেষ টান অনুভব করে, কারণ পবিত্রভূমি মক্কা ও মদিনাসহ আরব বিশ্বের অধিকাংশ এলাকা একসময় তুরস্কের ওসমানীয় খিলাফতের অধীনে ছিল।

কিন্তু গত কয়েক দশকে তুরস্কের সাথে আবরদের সম্পর্ক ভালো তো যাচ্ছেই না, বরং বিভিন্ন ইস্যুতে বিরোধে জড়িয়ে পড়ছে উভয় পক্ষ। এর মধ্যে তুরস্কের সাথে বিরোধিতায় সংযুক্ত আরব আমিরাত ছিল আরও বেশি এগিয়ে। অন্তত ১০টি ইস্যুতে তারা তুরস্কের সাথে ছায়াযুদ্ধে নেমেছে আরব আমিরাত। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এই দুটি দেশের মধ্যে মিল আছে এমন ইস্যু খুঁজে পাওয়া কঠিন।

গত দুই দশকে সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ছে ইসলামপন্থী রাজনীতি নিয়ে পরস্পরের বিরোধী অবস্থান। আরব বসন্তের পর সংযুক্ত আরব আমিরাতের শাসকদের কাছে নতুন আতঙ্ক হয়ে দেখা দিয়েছে পলিটিক্যাল ইসলাম বা ইসলামপন্থী গণতান্ত্রিক রাজনীতি। মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোতে এই রাজনীতির ধারা ঠেকাতে সবার আগে মাঠে নামে আবুধাবি। অন্যদিকে তুরস্কে গত দুই দশক ধরে ক্ষমতাসীন দল একে পাটি বিভিন্ন দেশে এই ধারার দলগুলোর সাথে সম্পর্ক রক্ষা করে আসছে।

মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুড, তিউনিসিয়ার আন-নাহদার মতো দলগুলোর সাথে আঙ্কারার সম্পর্ক বেশ ঘনিষ্ঠ। অন্যদিকে এসব দলকে ঠেকাতে মরিয়া সংযুক্ত আরব আমিরাত। এর বাইরেও ইরান, কাতার, লিবিয়া, ভূমধ্যসাগরসহ বিভিন্ন ইস্যুতে আঙ্কারা ও আবুধাবি পরস্পরের মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছে।

আবার এতসব বৈরিতা সত্ত্বেও দেশ দুটির মাঝে বিভিন্ন ইস্যুতে সহযোগিতার সম্পর্ক বর্তমানেও রয়েছে। যেমন তুরস্কের উৎপাদিত সমরাস্ত্রের শীর্ষস্থানীয় ক্রেতাদের একটি আরব আমিরাত। ২০২১ সালের প্রথম চার মাসে তুরস্কের অস্ত্রের সেরা তিন ক্রেতা দেশের একটি ছিল সংযুক্ত আরব আমিরাত। তুরস্কের প্রতিরক্ষা শিল্প শক্ত ভিত পাওয়ার পর থেকেই স্থল যুদ্ধের বিভিন্ন সরঞ্জাম তুরস্কের কাছ থেকে কেনে আবুধাবি। এছাড়া দুই দেশের বাণিজ্য সম্পর্কও বেশ মজবুত। দেশ দুটির মাঝে বাণিজ্যিক লেনদেনের পরিমাণ বছরে ৭০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের আশপাশে।

তুরস্ক থেকে বিভিন্ন ধাতু, বিমানের যন্ত্রাংশ ও যন্ত্রাংশ তৈরির কাঁচামাল আমদানি করে আরব আমিরাত। এছাড়া দেশটিতে জ¦ালানি সংশ্লিষ্ট পণ্য, যন্ত্রাংশ, লোহা স্টিল ও বৈদ্যুতিক সামগ্রীও যায় তুরস্ক থেকে। বিপরীতে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে সোনা, অ্যালুমিনিয়াম, গহনা, রাসায়নিক পদার্থ, জ¦ালানি তেল প্রভৃতি আমদানি করে তুরস্ক। বাণিজ্যিক স্বার্থে উভয় দেশ একটি যৌথ অর্থনৈতিক কমিশন গঠন করেছে। এছাড়া আছে তুরস্ক-আমিরাত বিজনেস কাউন্সিল নামের আরেকটি সংস্থা।

পারস্পারিক স্বার্থে আরও কিছু সেক্টরে সহযোগিতার সম্পর্ক আছে দেশ দুটির; কিন্তু রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক দিক থেকে পরস্পরের সম্পর্ক আদায়-কাচকলায়। সেটি আরব বসন্তের পর ব্যাপক আকার ধারণ করলেও বহু আগ থেকেই উভয় দেশের মধ্যে এই অম্ল-মধুর সম্পর্ক চলে আসছে।

১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভ করা আরব আমিরাতে তুরস্ক তার দূতাবাস স্থাপন করে ছিল ৮ বছর পরে। তারও চার বছর পর আবুধাবি তার রাষ্ট্রদূত পাঠিয়েছে আঙ্কারায়। এরপর কূটনীতিতে খুব বেশি অগ্রসর হয়নি কোনো পক্ষই। আন্তর্জাতিক ফোরাম ছাড়া দুই দেশের নেতাদের খুব একটা দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি। তবে খুব বেশি ঘনিষ্ঠতা না থাকলেও তিক্ততাও ছিল না। দীর্ঘদিন আরব বিশ্বে তুরস্কের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার ছিল আরব আমিরাত। তুরস্কে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের অন্যতম বড় উৎস ছিল দেশটি। এমনকি ২০০০ সালের পর মধ্যপ্রাচ্যে তুরস্ক তার কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়ালেও আরব আমিরাত সেটি খারাপ চোখে দেখেনি, বরং বড় প্রতিবেশী দেশগুেেলার সাথে তুরস্কের প্রতিযোগিতা শুরু হলে তা আবুধাবিকে অনেক ক্ষেত্রে সুবিধা এনে দিয়েছে। এবং অনেক ক্ষেত্রেই তারা এই প্রতিযোগিতা উপভোগ করেছে নিরপেক্ষ দর্শক হিসেবে।

তবে দুই দেশের সম্পর্ক সবচেয়ে খারাপ সমেেয় এসে পড়েছে আরব বসন্তের পর। এর প্রধান কারণ ইসলাপন্থী রাজনীতি নিয়ে দুই রাষ্ট্রের বিপরীতমুখী অবস্থান। আবর আমিরাতের ভীতি আছে এই ধারার রাজনীতি নিয়ে। অন্যদিকে আরব বসন্তের পর ওই অঞ্চলের বিভিন্ন দেশে গণতান্ত্রিক পথ চলা শুরুর আভাস পাওয়া গেলে তুরস্ক তাতে সমর্থন জোগাতে থাকে। আর এতেই আঙ্কারাকে শত্রুজ্ঞান করতে থাকে আবুধাবি। বিশেষ করে মুসলিম ব্রাদারহুডেেক নিয়ে সম্পর্কে বড় ফাটল দেখা দেয়।

মিসরের সামরিক শাসক হুসনি মোবারকের পতনের পর দেশটিতে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত অবাধ নির্বাচনে জয় পায় ব্রাদারহুডের প্রার্থী মোহাম্মাদ মুরসি, যার প্রতি তুরস্কের ছিলো অকুণ্ঠ সমর্থন। অন্যদিকে আরব বিশ্বে গণতন্ত্রের ঢেউ আছড়ে পড়তে দেখে আতঙ্কিত হয়ে ওঠে আরব শাসকরা। গদি হারানোর ভয় পেয়ে বসে তাদের, যে কারণে এই রাজনীতিকে ঠেকাতে মাঠে নামে আবর আমিরাতসহ আরও কয়েকটি দেশ।

মিসরে শেষ পর্যন্ত ব্রাদারহুডকে ক্ষমতাচ্যুত করার মাধ্যমে আমিরাতের ইচ্ছারই জয় হয়। ব্রাদারহুড ইস্যুতে এরপর তারা সৌদি আরবের সাথে জোট বেঁধে কাতারের ওপর অবরোধ আরোপ করলে তুরস্ক পাশে দাঁড়ায় ছোট্ট দেশটির। তারা খাদ্য ও অন্যান্য সামগ্রী সরবরাহ করে কাতারকে টিকে থাকতে সহযোগিতা করে। তুরস্ককে বিপদে ফেলতে আরব আমিরাত এরপর ইন্ধন দেওয়া শুরু করে তুরস্কের বিচ্ছিন্নতাবাদী কুর্দি সংগঠন পিকেকের প্রতি। তুর্কি সংবাদমাধ্যম ইয়েনি সাফাকের তথ্য মতে, গ্রুপটিকে রিয়াদ ও আবুধাবি মিলে এক বিলিয়ন ডলার অর্থ সহায়তাও দিয়েছে।

লিবিয়া এবং সর্বশেষ তিউনিসিয়াতেও তুরস্ক ও সংযুক্ত আরব আমিরাত পরস্পরের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। লিবিয়ায় তুরস্ক যখন জাতিসঙ্ঘ সমর্থিত সরকারের পাশে দাঁড়িয়েছে, আরব আমিরাত তখন সেনা কমান্ডার খলিফা হাফতারের বাহিনীকে দেশটির ক্ষমতা দখলে সহযোগিতা করে চলছে। এমনকি তারা বিভিন্ন দেশ থেকে ভাড়াটে যোদ্ধা সংগ্রহ করেও পাঠিয়েছে হাফতার বাহিনীর জন্য।

তিউনিসিয়ায় সম্প্রতি পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়ে যে বেসামরিক ক্যু হয়েছে- তার পেছনে ইন্ধন ছিলো আবুধাবির। এছাড়া ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্থাপন এবং কাশ্মির ইস্যুতে নরেন্দ্র মোদি সরকারের প্রতি আরব আমিরাতের সমর্থনেরও সমালোচনা করেছে তুরস্ক। ২০১৬ সালে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান চেষ্টাও সমর্থন ছিল আরব আমিরাতের।

তুরস্ক অভিযোগ করছে, আরব বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে তাদের অর্থনৈতিক কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করতে চাইছে আরব আমিরাত। এছাড়া বিভিন্ন দেশে তুরস্কের স্বার্থবিরোধীদের কোটি কোটি ডলারের অর্থসহায়তাও দিচ্ছে তারা। কাজেই এই বৈরিতা যে আর রাজনৈতিক অঙ্গনে সীমাবদ্ধ নেই তা বোঝাই যাচ্ছে।

ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মাদ বিন জায়েদের পরিকল্পনায় মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায় প্রভাব বিস্তারে আরব আমিরাত গত এক দশকে ব্যাপক পদক্ষেপ নিয়েছে; কিন্তু ইরান ও কাতারের সাথে ঘনিষ্ঠতাসহ ওই অঞ্চলে তুরস্কের তৎপরতা তাদের জন্য বাধা হয়ে দেখা দিয়েছে। যে কারণে আঙ্কারার সাথে আবুধাবির সম্পর্ক ক্রমশই খারাপের দিকে যাচ্ছে। নিকট ভবিষ্যতে সেটি আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।