পরমাণু অস্ত্রের মজুদ বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় যুক্তরাষ্ট্র ও চীন


  • মোতালেব জামালী
  • ০২ ডিসেম্বর ২০২১, ১৭:০৩

মার্কিন প্রতিরক্ষা দফতর পেন্টাগন চলতি মাসের প্রথম দিকে চীনের সামরিক বাহিনী ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নয়নের ওপর একটি সমীক্ষা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে পারমাণবিক অস্ত্রের মজুদ বাড়ানোর ব্যাপারে চীনের উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনার কথা তুলে ধরা হয়েছে। এর প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ সেনা কর্মকর্তা ও নীতি নির্ধারকরা চীনের পারমাণবিক অস্ত্রের হুমকি মোকাবিলায় নিজেদের পরমাণু অস্ত্রের সক্ষমতা ও মজুদ বাড়ানোর তোড়জোড় শুরু করেছেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, চীনের সামরিক শক্তি বৃদ্ধিকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র তার পারমাণবিক অস্ত্রের মজুদ কয়েকগুণ বাড়িয়ে নিতে চাইছে।

মার্কিন কংগ্রেসে উপস্থাপন করা বার্ষিক প্রতিবেদনে পেন্টাগন বলেছে, চীন পরমাণু অস্ত্রের মজুদ ২০৩০ সালের মধ্যে চারগুণ বাড়াবে। সংখ্যা দাঁড়াবে ১০০০-এ। পেন্টাগনের গত বছরের প্রতিবেদনে যে সংখ্যার কথা বলা হয়েছিল, এবারের প্রতিবেদনে সেই সংখ্যা আড়াই গুণ বেশি।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, আগামী এক দশকে চীন পরমাণু খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ করবে। এই পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে পারমাণবিক অস্ত্রের আধুনিকায়ন ও বহুমুখী করা। দেশটি উদ্যোগ নিয়েছে স্থল, সাগর ও আকাশে পরমাণু অস্ত্র ছোড়ার প্ল্যাটফর্মের সংখ্যা বাড়ানোর।

পেন্টাগনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চীন আগামী দিনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান নিরাপত্তা হুমকি। বেইজিং পিপলস লিবারেশন আর্মিকে বিশ্বমানের একটি বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলছে। ২০৪৯ সালের মধ্যে তাদের এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ শেষ হবে।

মার্কিন কর্মকর্তারা মনে করেন, চীন তার পরিকল্পনা এমনভাবে সাজাচ্ছে, যাতে বিশ্বমঞ্চে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যে কোনো ধরনের চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে পারে। চীনা জাতির ‘মহা পুনরুজ্জীবনের’ মাধ্যমে বেইজিং ২০৪৯ সালের মধ্যে সবদিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সমকক্ষ হতে চায়। এমনকি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব ও শক্তিকে ছাড়িয়ে যাওয়ার টার্গেটও আছে। চীন চাইছে, সামরিক শক্তি অর্র্জনের মাধ্যমেই ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র ও নিরাপত্তা অংশীদারদেরকে হটিয়ে দিতে।

পেন্টাগনের মতে, চীন চাইছে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাকে জাতীয় স্বার্থ ও কর্তৃত্ববাদী প্রভাব বলয়ের আওতায় আনতে। পেন্টাগনের স্যাটেলাইটে ধারণকৃত চিত্রে দেখা যাচ্ছে, চীন ভূগর্ভে অন্তত তিনটি ক্ষেপণাস্ত্র মজুদাগার ও ছোড়ার মঞ্চ তৈরির কাজ এগিয়ে নিচ্ছে।

চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পেন্টাগনের এই প্রতিবেদনের সমালোচনা করে বলেছে, এই প্রতিবেদন বাস্তব অবস্থার সাথে মোটেও সঙ্গতিপূর্ণ নয়। প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে বাস্তবতাকে পাশ কাটিয়ে অনুমানের ওপর ভিত্তি করে।

ফেডারেশন অব আমেরিকান সাইন্টিস্টস-এর পরিচালক হানস ক্রিসটেনসেন চীনের পরমাণু অস্ত্রের মজুদ বাড়ানোর উদ্যোগকে অস্বাভাবিক বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, আমরা আর কখনও চীনের এ ধরনের উদোগ দেখিনি। চীন তাদের আগের সব সীমাকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। ২০০৪ সালে চীন জানিয়েছিল, পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী ৫টি দেশের মধ্যে তাদের পরমাণু অস্ত্রের সংখ্যাই সবচেয়ে কম।

পরবর্তী দেড় দশকে দেশটি তার পরমাণু অস্ত্রের সংখ্যা কিছুটা বাড়িয়েছে বলে ধারণা করা হয়। পশ্চিমা গোয়েন্দাদের ধারণা, চীন গত দেড় দশকে তার পরমাণু অস্ত্রের সংখ্যা কয়েকশ বাড়িয়েছে। কিন্তু চীনের বর্তমান উদ্যোগ খুবই নাটকীয় এবং দেশটির আগের নীতির সাথে সাংঘর্ষিক।

চীনা নেতারা জনসমক্ষে সব সময়ই বলে আসছেন যে, তারা কোনো ধরনের অস্ত্র প্রতিযোগিতার অংশ হতে চান না। কিন্তু বর্তমানে চীন তার সামরিক শক্তি বাড়ানোর জন্য যে উদ্যোগ নিচ্ছে, তা অবশ্যই বিশ্বের অন্য সামরিক শক্তিগুলোর মোকাবিলায় নিজের সামর্থ্য বাড়ানোর জন্যই। যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার সাথে পরমাণু অস্ত্র প্রতিযোগিতায় নিজের অবস্থান সংহত করতেই চীন এই নতুন উদ্যোগ নিয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক পররাষ্ট্র উপমন্ত্রী বনি জেনকিনস গত সেপ্টেম্বরে ন্যাটোকে চীনের অস্ত্র কর্মসূচি সম্পর্কে সতর্ক করেন। তিনি বলেছেন, স্নায়ু যুদ্ধের সময় পরমাণু অস্ত্র প্রতিযোগিতা ও সহযোগিতার ক্ষেত্রে রাশিয়ার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের যে ধরনের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল চীনের সাথে সেই সম্পর্ক গড়ে উঠছে না।

ফেডারেশন অব আমেরিকান সাইন্টিস্টস-এর পরিচালক হানস ক্রিসটেনসেন মনে করেন, চীন যেমন পরমাণু অস্ত্রের মজুদ বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে, আবার একইসঙ্গে অনুসরণ করছে প্রথমে অস্ত্রের ব্যবহার না করার নীতি। এখন কোনো দেশ চীনের এই নীতির প্রতি আস্থা রাখতে পারবে কিনা সেটা ভিন্ন বিষয়।

সামরিক খাতে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যয় বিশ্বে সর্বোচ্চ। প্রতি বছর বিশ্বে সামরিক খাতে ব্যয় করা হয় প্রায় ১ দশমিক ৯ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই ব্যয়ের ৪০ শতাংশই করে থাকে যুক্তরাষ্ট্র। ২০২০ সালে সামরিক খাতে যুক্তরাষ্ট্রের বাজেট ছিল ৭৭৮ বিলিয়ন ডলার, যা ২০১৯ সালের চেয়ে ৪ দশমিক ৪ শতাংশ বেশি।

অন্যদিকে সামরিক শক্তি বৃদ্ধির জন্য চীনের জোরালো উদ্যোগের পরও এ খাতে দেশটির সামগ্রিক ব্যয় এখনও যুক্তরাষ্ট্রের মোট ব্যয়ের এক তৃতীয়াংশ মাত্র। ২০২০ সালে সামরিক খাতে চীনের মোট বাজেট ছিল ২৫২ বিলিয়ন ডলার। যা ২০১৯ সালের চেয়ে ২ দশমিক ২ শতাংশ এবং গত দশকের চেয়ে ৭৬ শতাংশ বেশি।

চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক দিন দিনই খারাপের দিকে যাচ্ছে। অনেকেই মনে করেন, দুই দেশের সম্পর্কটা স্নায়ু যুদ্ধের দিকে গড়াচ্ছে। তবে বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব ও শক্তি যেখানে আস্তে আস্তে কমছে, সেখানে চীন তার সামরিক শক্তি দিন দিন বাড়িয়েই চলেছে।

মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক স্যামুয়েল পি. হান্টিংটন বলেছিলেন, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর যুক্তরাষ্ট্র পরিচয়ের সংকটে ভুগছে। স্নায়ু যুদ্ধই যদি না থাকে, তাহলে কিসের ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্র তার পরিচয় টিকিয়ে রাখবে? চীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সেই শূন্যস্থানটা পূরণ করছে। নতুন করে শুরু হতে যাচ্ছে স্নায়ু যুদ্ধ।

১৯৭৮ সালে চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়। ওয়াশিংটন ধারণা করেছিল যে তার নেতৃত্বে গড়ে ওঠা বিশ্ব নেতৃত্বে ছোট ভাই হিসেবেই দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করে যাবে চীন। সেভাবেই গত তিন দশকে দেশ দুটির মধ্যে সহযোগিতার সম্পর্ক চলে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে চীন তার স্বতন্ত্র অবস্থানটা ঠিকই তৈরি করে।

সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে এসে সেই সম্পর্কে বড় ধরনের টানাপড়েন সৃষ্টি হয়। ২০১৭ সাল বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে ট্রাম্প চীনের বিরুদ্ধে এমন কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেন, যা নিয়ে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।

চীনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তর কৌশলের শুরুটা হয়েছিল প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার আমলে। প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব খর্ব করতে ওবামা পূর্বমুখী বা এশিয়মুখী নীতি গ্রহণ করেন। কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীন এরইমধ্যে তার সামরিক অবস্থান সংহত করতে সক্ষম হয়। এই অঞ্চলে চীনের আগ্রাসী নীতির মুখে যুক্তরাষ্ট্রকে এখন আত্মরক্ষামূলক অবস্থান গ্রহণ করা ছাড়া উপায় নেই।

কৌশলগত যুদ্ধের পাশাপাশি এখন চীন ও যুক্তরাষ্ট্র অবতীর্ণ হচ্ছে বাকযুদ্ধে। তীব্র ভাষায় একে অপরকে আক্রমণ করে কথা বলছে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বলেছেন, ‘বিশ্বে সব বিশৃঙ্খলার মূলে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটি চীনের উন্নয়ন ও নিরাপত্তার জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি।

অন্যদিকে মাকির্ন সেনাবাহিনী প্রধান ও জয়েন্ট চীফস অব স্টাফের চেয়ারম্যান মার্ক মিলি গত জুলাই মাসে বলেছেন, চীন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য মারাত্মক নিরাপত্তা হুমকি হয়ে উঠেছে। চীনকে মোকাবিলায় আমাদের সামরিক সক্ষমতা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। চীনের কথা মাথায় রেখেই আমরা আমাদের সক্ষমতা, কর্মসূচি, প্রশিক্ষণ, দক্ষতা, তৎপরতা সবই বাড়াচ্ছি। এ ব্যাপারে ছাড় দেওয়ার কোনো অবকাশ নেই।

যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা ড্যান গ্রেজিয়ার মনে করেন, পেন্টাগনের কর্মকর্তারা প্রতিরক্ষা খাতে বিপুল বাজেট পাসের যৌক্তিকতা প্রমাণের জন্য চীনের হুমকি ইস্যুটিকে কাজে লাগাচ্ছে। কংগ্রেসকে তারা বলছেন, চীনকে প্রতিহত করার জন্য অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সমরাস্ত্র তৈরিতে বিপুল অর্থ প্রয়োজন। কংগ্রেস সেটা বরাদ্দ না দিলে চীনের হুমকি মোকাবেলা করা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কঠিন হয়ে পড়বে। ফলে কংগ্রেসও প্রতিবছর সামরিক খাতে বরাদ্দ দিচ্ছে বিপুল অর্থ।

আবার অনেক বিশ্লেষক বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যেসব দেশে নানা বিপর্যয়ের সৃষ্টি হতে পারে, চীন সেগুলোর একটি। আগামী দুই বা তিন দশকে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব চীনে এমনভাবে পড়বে তা মোকাবিলা করতেই চীনা সেনাবাহিনীকে মোতায়েন করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যুদ্ধ করার সময় বা সুযোগই হয়তো চীনা সেনাবাহিনীর সামনে আসবে না। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকরা জলবায়ু পরিবর্তনের এ বিষয়টিকে মাথায় নিতে রাজি নন।

বিশ্লেষকদের মতে, পরমাণু অস্ত্রের চেয়েও ভয়ঙ্কর হতে পারে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব। সেটা মোকাবিলা করতেই হিমশিম খাবে চীন। ফলে চীনের হুমকি মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ব্যয় বৃদ্ধির কোনো প্রয়োজন নেই। কিন্তু পেন্টাগনের চোখে সবচেয়ে বড় হুমকি চীনের পরমাণু অস্ত্রের সংখ্যা বাড়ানো। এ বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে কংগ্রেসে বিপুল অঙ্কের বাজেট পাস করানোর চেষ্টা হচ্ছে।