পাকিস্তান কেন বহুজাতিক মহড়ার আয়োজন করছে?

-

  • আহমাদ আব্দুল্লাহ
  • ২৫ নভেম্বর ২০২১, ১৭:১৯

সামরিক মহড়ার মধ্যদিয়ে সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ, দৃঢ়তা ও সকট মোকাবিলার দক্ষতা বাড়ে। আন্তর্জাতিক মহড়া যে কোনো দেশের সঙ্গে অন্য দেশের সম্পর্কের গতিপ্রকৃতি প্রমাণ করে। কিছুদিন থেকে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী বেশ কিছু আন্তর্জাতিক মহড়ায় অংশ নিয়েছে। এরমধ্যে কিছু মহড়া হয়েছে মধ্য এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে। আবার নিজ দেশেও বেশ কয়েকটি মহড়ার আয়োজন করেছে।

চলতি বছর পাকিস্তান অনেকগুলো বহুজাতিক নৌমহড়া পরিচালনা করেছে। এরমধ্যে আমান টোয়েন্টি টোয়েন্টি ওয়ান নামে একটি বড় আকারের মহড়াও ছিল। অতিসম্প্রতি দেশটির সামরিক বাহিনী অংশ নিয়েছে নুসরেত টোয়েন্টি টোয়েন্টি ওয়ান নামে আরেকটি মহড়ায়। এসব মহড়ার উদ্দেশ্য ছিল আরব সাগরে পাকিস্তানের নৌ শক্তিমত্তাকে প্রতিষ্ঠিত করা। অন্যদিকে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী জিদার-উল হাদিদ এবং তাসখির-ই-জাবাল নামক দুটি মহড়া চালিয়েছে, যার উদ্দেশ্য ছিল মরুভূমি ও পাহাড়ি অঞ্চলেও সামরিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা।

পাকিস্তান যখন চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে আমান টোয়েন্টি টোয়েন্টি ওয়ান দ্বিবার্ষিক বহুজাতিক নৌমহড়া চালায়, তখন ভারতীয় গণমাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে অনেক আলোচনা সমালোচনা হয়। এ মহড়াকে যথেষ্ট উন্নত পর্যায়ের মহড়া হিসাবে দেখা হয়েছিল। এসব মহড়ার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছিল, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা, সন্ত্রাসবাদ, জলদস্যুতাসহ নৌপথে নানা অপরাধ দমন করা।

এসব মহড়া আয়োজনে আঞ্চলিক নৌ শক্তিগুলোর মধ্য ব্যবধান কমিয়ে আনার একটি উদ্দেশ্য থাকে। একই জলসীমা যখন কয়েকটি দেশ শেয়ার করে, তখন প্রত্যেকেরই সামনে সাধারণ কিছু হুমকি থাকে। এই ধরনের মহড়া সেই হুমকিগুলো মোকাবিলায়ও পরস্পরের মধ্যে সমন্বয় প্রতিষ্ঠা করে। আমান টোয়েন্টি টোয়েন্টি ওয়ান মহড়ায় ৪৫টি দেশের নৌবাহিনী অংশ নেয়। যার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন ও তুরস্ক ছিল।

এছাড়া পাকিস্তানের বিমান বাহিনী এসিইএস মিট টোয়েন্টি টোয়েন্টি ওয়ান- পার্ট ওয়ান এবং এসিইএস মিট টোয়েন্টি টোয়েন্টি ওয়ান- পার্ট টু নামে দুটি মহড়ায় অংশ নেয়। বিমানবাহিনীর এই মহড়াগুলোতে এয়ারবোর্ন সিস্টেম, যুদ্ধবিমান, প্রাথমিক সতর্কতা, কন্ট্রোল এয়ারক্রাফট এবং মিলিটারি স্যাটেলাইটের মতো বিষয় ছিল।

বিমান মহড়া আয়োজনের উদ্দেশ্য ছিল আকাশপথ এবং স্থলপথের সামরিক তৎপরতার মধ্যে সমন্বয় ঘটানো। পাকিস্তানের তিন বাহিনীর এতগুলো মহড়া দেশটির সামরিক সক্ষমতা বাড়াতে ভূমিকা রাখছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, এ ধরনের বড় আকারের মহড়ার মাধ্যমে পাকিস্তান হয়তো কিছু বার্তাও দিতে চায়।

দুই দশকের বেশি সময় আগে পাকিস্তান ও ভারত- আনুষ্ঠানিকভাবে পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হওয়ার ঘোষণা দেয়। কিন্তু এরপরও দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধের ঝুঁকি উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ভারত বরাবরই পারমাণবিক শক্তির ভয় দেখিয়ে পরিস্থিতিকে নিজেদের অনুকূলে নেওয়ার চেষ্টা করেছে। পুরোপুরি যুদ্ধের আওয়াজ না তুললেও ভারত সংক্ষিপ্ত পরিসরে যুদ্ধের একটি সম্ভাবনা জারি রেখেছে।

পাকিস্তানের ব্যাপারে ভারতের নীতি যথেষ্ট আক্রমণাত্মক। পাকিস্তানের ভূখণ্ডে সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের ধারণা এর প্রমাণ। আবার সামরিক প্রযুক্তিতে উৎকর্ষ অর্জনের জন্য ভারত বিপুল বিনিয়োগ করেছে। যা পাকিস্তানের নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা সব সময় হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে আসছে। বাস্তবতা হচ্ছে, দক্ষিণ এশিয়ায় সবসময়ই একটি আবছা যুদ্ধের আবহ বজায় থাকায় পরিস্থিতি উত্তপ্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

অনেক বিশ্লেষক মনে করে, আঞ্চলিক এ উত্তেজনা যেকোনো সময়ে একটি পূর্ণমাত্রার যুদ্ধের দিকে নিয়ে যেতে পারে। তেমনটা হলে ভারত ও পাকিস্তান উভয়ের জন্যই বিপর্যয়ের কারণ হবে।

রাজনৈতিক পরিকল্পনা এবং সামরিক প্রস্তুতি একটি দেশের বিশ্বাসযোগ্য প্রতিরোধের মূলমন্ত্র। যেকোনো দেশের জন্যই প্রতিরোধের উদ্দেশ্য হলো যুদ্ধকে দীর্ঘায়িত করে প্রতিপক্ষের লক্ষ্য অর্জনে বিলম্ব করা। প্রতিপক্ষের পক্ষে যুদ্ধকে অসাধ্য করে তোলা। প্রচলিত পদ্ধতির প্রতিরোধ প্রক্রিয়ায় পারমাণবিক শক্তি প্রয়োগের ভয় দেখিয়ে প্রতিপক্ষকে আগ্রাসী ভূমিকা থেকে বিরত রাখে।

দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা পরিস্থিতি যেভাবে অগ্রসর হচ্ছে, তার আলোকে পাকিস্তান যুদ্ধ কৌশল গ্রহণ করছে। প্রচলিত এবং অপ্রচলিত উভয়ক্ষেত্রেই প্রতিপক্ষের আগ্রাসী পরিকল্পনার বিরুদ্ধে দ্বিমুখী কৌশল গ্রহণ করছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। পাকিস্তানের ফুল-স্পেকট্রাম ডিটারেন্স বা প্রতিরোধ কৌশল অপ্রচলিত স্তরে শত্রুকে নিরস্ত্র করার জন্য যথেষ্ট কার্যকর। এর পাশাপাশি দেশটি শত্রুর লক্ষ্যবস্তুতে যে কোনো সক্রিয় যুদ্ধ কৌশল বা পাল্টা শক্তির জন্যও পুরোপুরি প্রস্তুতি নিচ্ছে। উন্নত প্রশিক্ষণ, অনুশীলন এবং অপারেশনাল প্রস্তুতির দিকে সে কারণে হয়তো দেশটি গুরুত্ব দিচ্ছে।

নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, পাকিস্তানও সম্ভবত প্রচলিত ও অপ্রচলিত দুই পথেই অগ্রসর হয়েছে। পাকিস্তান ২০১৯ সালের পুলওয়ামা-বালাকোট সংঘাতের সময় ভারতের পদক্ষেপকে মোকাবিলা করেছে। দেশটির বিমানবাহিনীর যথেষ্ট প্রস্তুতি লক্ষ্য করা গেছে। বর্তমানে তিন বাহিনীর একের পর এক মহড়া এ প্রস্তুতিকে বেগবান করার জন্য বলে মনে করা হয়।

ভারত যেভাবে তার সামরিক খাতকে আধুনিকায়ন করছে, পাকিস্তান সে তুলনায় পিছিয়ে আছে। এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে সীমিত অর্থনৈতিক সামর্থ্য নিয়ে নিজেদের সামরিক সক্ষমতাকে বাড়ানোর চেষ্টা করেছে। এখন দেশটি আন্তর্জাতিক মহড়ার মাধ্যমে নিজেদের দক্ষতা বাড়ানোর কৌশল নিয়েছে।

যখন দুটি প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ পরস্পরের কৌশল ভেস্তে দিতে সক্ষম হয়, তখন উভয় দেশই এক ধরনের অসহায়ত্ব ও দুর্বলতায় পড়ে যায়। অন্যদিকে, কোনো দেশ যদি তার প্রতিরক্ষা ব্যুহকে শক্তিশালী করতে পারে, প্রচলিত পদ্ধতিতে সামরিক মহড়া পরিচালনা করতে পারে, তাহলে প্রতিপক্ষের মাঝে এক ধরনের উদ্বেগ ও ভয় তৈরি হয়।

অনেক সময় এ ধরনের উদ্বেগ বড় ধরনের আক্রমণ বা অভিযান থেকে একটি অঞ্চলকে পরোক্ষভাবে হলেও সুরক্ষা দেয়। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, দক্ষিণ এশিয়ায় যেভাবে সামরিক ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়েছে, তাতে আন্তর্জাতিক মহড়া কিছুটা হলেও ইতিবাচক ফল বয়ে আনতে পারবে। প্রতিপক্ষ যে শক্তিহীন ও বন্ধুহীন নয়, তা প্রমাণ হয়।

সব পরাশক্তি এখন ভারত মহাসাগরে নিজেদের প্রভাব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে যাচ্ছে। এ অঞ্চলে কৌশলগত কিছু চেকপয়েন্ট আছে। যা বিভিন্ন দেশের বন্দরগুলোর মধ্যে পরিচালিত ব্যবসা, পণ্য সরবরাহ ও নৌ যোগাযোগের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে। ভারত মহাসাগর বিশ্ববাণিজ্যের বিবেচনায়ও গুরুত্বপূর্ণ নৌপথ। ভারত মহাসাগরে রয়েছে ভারতের বিশাল নৌবহর। এটি ভারতের নিজের আঙিনা হিসেবে পরিচিত। সে তুলনায় পাকিস্তান নৌবাহিনী অনেক পিছিয়ে আছে। এখন পাকিস্তান নৌশক্তির দিকে নজর দিচ্ছে।

বিশ্বের তেলবাহী জাহাজগুলোর ৮০ শতাংশ ভারত মহাসাগরের বিভিন্ন রুট ব্যবহার করে। এ অঞ্চল ব্যবহার করেই দুইশ কোটিরও বেশি মানুষের চাহিদা মেটানো হয়। ভারত মহাসাগরকে ঘিরেই বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বিকাশমান অর্থনীতি। এ অঞ্চলে পৃথিবীর অর্ধেক প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে বলে মনে করা হয়। এককথায় বলতে গেলে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ভৌগলিক ও কৌশলগত কারণে এ অঞ্চলটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।

ফলে পাকিস্তান যখন এই অঞ্চলকে ঘিরে বড় আকারের নৌমহড়ার আয়োজন করে, ভারতের নীতি নির্ধারকরা তাকে গুরুত্বের সঙ্গে নেবে এটাই স্বাভাবিক। কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসনের মর্যাদা বিলুপ্তির পর দুই দেশের সম্পর্ক এখন আর স্বস্তিদায়ক জায়গায় নেই। নীতি নির্ধারকদের পাশাপাশি ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো পাকিস্তানের সামরিক তৎপরতাকে নেতিবাচকভাবে তুলে ধরেছে।

পাকিস্তান গত ফেব্রুয়ারিতে আমান টোয়েন্টি টোয়েন্টি ওয়ান শেষ করার পর ইরান ও রাশিয়া মিলে ভারত মহাসাগরের উত্তর প্রান্তে আরেকটি মহড়া শুরু করে। আনুষ্ঠানিকভাবে আমন্ত্রিত না হলেও আমান মহড়ার প্রতিক্রিয়ার অংশ হিসেবেই ভারত সেই মহড়ায় অংশ নেয়। এ ধরনের অংশগ্রহণকে ইতিবাচক হিসাবে দেখা হচ্ছে। যা দুই দেশের সামরিক বাহিনীর মধ্যে সম্পর্ক তৈরিতে ভূমিকা রাখতে পারে।