উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র যে সমরাস্ত্রের ওপর নির্ভর করবে

এমভি টুয়েন্টি টু অসপ্রে টিলট্রোটর বিমানগুলো হেলিকপ্টারের মতো খাড়াভাবে উড্ডয়ন ও অবতরণ করতে পারে - সংগৃহীত

  • আহমাদ আব্দুল্লাহ
  • ১৪ নভেম্বর ২০২১, ১৭:২৬

বেশ কয়েক বছর ধরেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে উত্তর কোরিয়ার সম্পর্কে একটি টানাপড়েন চলছে। মাঝে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের চার বছরে উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে দূরত্ব কমিয়ে আনতে দুই শীর্ষ নেতার বৈঠকসহ নানামুখী উদ্যোগ নেওয়া হলেও সেগুলোর কোনোটাই কার্যকর হয়নি। সাম্প্রতিক সময়ে দুই দেশের মধ্যে সামরিক উত্তেজনা আবারও বৃদ্ধি পেয়েছে।

কোরীয় উপদ্বীপে যদি কোনো বড়ো ঘটনা ঘটে, সেই সুযোগে যুক্তরাষ্ট্র এবং দক্ষিণ কোরিয়ার নেতৃত্বাধীন সেনারা উত্তর কোরিয়ার নেতা কিং জং উনকে উচ্ছেদ করার চেষ্টা করবে। উত্তর কোরিয়ায় যে কোনো অভিযান চালানোর ক্ষেত্রে দেশটিতে থাকা গণবিধ্বংসী অস্ত্রগুলোকেও নিরাপদে অকার্যকর করতে চাইবে। তবে, সম্ভাব্য এ অভিযানটি সমুদ্রপথেই ঘটবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। মার্কিন মেরিন কোর বা ইউএসএমসি-র সেনারাই সম্ভাব্য এ অভিযানে নেতৃত্ব দিতে পারেন। আর কোরিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করতে গিয়ে মার্কিন মেরিন সেনারা ৫টি সমরাস্ত্র বেশি ব্যবহার করবে বলে মনে করা হচ্ছে।

এক্ষেত্রে মেরিন সেনাদের প্রথম পছন্দ হলো উভচর পর্যায়ে আক্রমণ করা যায় এমন যান। ১৯৭০ সালে মার্কিন মেরিন সেনারা প্রথম এ ধরনের একটি নৌযান প্রচলন করে। একেকটি যানে ২১ জন মেরিন সেনা তাদের সমরাস্ত্রগুলো নিয়ে থাকতে পারে। উভচর যান বলতে এমন নৌযানগুলোকে বোঝানো হয়, যেগুলো ওয়াস্প ক্লাস অ্যাসল্ট শিপ বা এ ধরনের রণতরীর ডেক থেকে পানিতে নেমে যেতে পারে। নিজস্ব শক্তি ব্যবহার করেই পানিতে ভাসতে পারে। নির্ধারিত স্থানে গিয়ে সেনা নামিয়েও দিয়ে আসতে পারে। আবার এই একই যান দিয়েই সেনাবাহিনীর পদাতিক সেনাদেরকেও ভূমিতে যেকোনো স্থানে পরিবহন করা সম্ভব হবে।

উভচর যানগুলো পানির মধ্যে প্রতি ঘণ্টায় ৮ মাইল পথ অতিক্রম করতে পারে। আবার স্থলপথেও ঘণ্টায় ৪৫ মাইল পথ যেতে পারে। এ উভচর যানগুলো হালকা ধরনের অস্ত্রে সজ্জিত থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এ যানগুলো ৪০ মিলিমিটারের গ্রেনেড লঞ্চার বা ৫০ ক্যালিবারের মেশিনগান বহন করে। এ যানগুলোর প্রতিরক্ষা ব্যুহও খুব একটা কঠিন হয় না। সর্বোচ্চ ১৪ দশমিক ৫ মিলিমিটারের মেশিনগানের গুলি বা আর্টিলারি অস্ত্রের আঘাত এগুলো সহ্য করতে পারে। এই দুর্বল প্রতিরক্ষা ব্যুহ উভচর যানগুলোর নেতিবাচক দিক। পাশাপাশি, বড় সংখ্যায় সেনা বহনে অক্ষম হওয়ায় আধুনিক যুদ্ধক্ষেত্রেও এ যানগুলো এখন খুব একটা কার্যকর বলে আর বিবেচিত হয় না।

দ্বিতীয় পছন্দের সমরাস্ত্র হিসেবে ব্যবহার হতে পারে এমভি টুয়েন্টি টু অসপ্রে। আধুনিক সময়ের উভচর যানগুলো মেরিন সেনারা সমুদ্রপথে বা আকাশপথে- উভয়ক্ষেত্রেই ব্যবহার করতে পারে। যুদ্ধবিমানগুলো যেকোনো সাধারণ উভচর বা অ্যামফিবিয়াস অ্যাসল্ট শিপ বা ল্যান্ডিং ক্রাফটের তুলনায় অনেক দ্রুতগতিতে চলাচল করতে পারে। সমুদ্রতীর থেকে অনেক দূরেও অবতরণ করতে পারে। ফলে, এগুলো ব্যবহার করে সেনা সদস্যদের সংখ্যা যেমন দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি করা যায়, তেমনি নিজ সেনাবাহিনীকে সুরক্ষাও দেওয়া যায়।

এমভি টুয়েন্টি টু অসপ্রে টিলট্রোটর বিমানগুলো হেলিকপ্টারের মতো খাড়াভাবে উড্ডয়ন ও অবতরণ করতে পারে। অন্যদিকে, ইঞ্জিনের বাইরের দিকটি ৯০ ডিগ্রি অ্যাংগেলে ঘুরানো যায়। এভাবে এই বিশেষ বিমানগুলো মুহূর্তেই প্রথাগত বা সাধারণ ধরনের বিমানের মতো চলতে পারে। এ বিমানগুলো দিয়ে ২৪ ঘণ্টাই মেরিন সেনাদের নিয়ে যাতায়াত করা যায়। পাশাপাশি, সমরাস্ত্র কিংবা যানবাহন চলাচলে সহায়ক হিসেবেও তা ব্যবহৃত হতে পারে।

অসপ্রেগুলো প্রতি ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ২৭৭ মাইল স্পিডে যাতায়াত করতে পারে। ওয়েইট ক্লাসের হিসেবে এটি বিশ্বের তৃতীয় সর্বোচ্চ গতির হেলিকপ্টার হিসেবে বিবেচিত হয়। মধ্য আকাশে একবার তেল ভরে নিলে এই হেলিকপ্টার দিয়ে ৫০০ মাইল পথও অতিক্রম করা সম্ভব।

উত্তর কোরিয়ার ভৌগলিক অবস্থানের কারণে, এমভি টুয়েন্টি টু অসপ্রে দিয়ে অ্যাসল্ট ফোর্সদেরকে শত্রুপক্ষের অবস্থান থেকে কয়েক মাইল দূরেই নামিয়ে দেওয়া যায়। এমভি টুয়েন্টি টু-গুলো সমুদ্রতীরকে সুরক্ষিত করার পর এক ল্যান্ডিং জোন থেকে অন্য ল্যান্ডিং জোনে লাফ দিয়ে যাতায়াতও করতে পারে। সেক্ষেত্রে শত্রুপক্ষ বুঝতেই পারে না যে, এটি কোথায় ল্যান্ড করবে। পাঁচ মাইল দূরে নাকি ৫০০ মাইল দূরে। ফলে, প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেওয়ার ক্ষেত্রেও শত্রুপক্ষের দুর্বলতা থেকে যায়। ফলে, এমভি টুয়েন্টি টু অসপ্রে ব্যবহারকারী দেশগুলো বাড়তি সুবিধা ও সময় পেয়ে যায়।

তৃতীয় অস্ত্রটি হলো সিএইচ-ফিফটি থ্রি স্টলিয়ন। যতক্ষণ পর্যন্ত উভচর যান দিয়ে সেনারা কোনো বিমান বা নৌঘাঁটি দখল করতে পারছে, ততক্ষণ পর্যন্ত সেনাদের রসদ জোগানো ও সরবরাহ করার বিষয়টি হেলিকপ্টার দিয়েই চালাতে হয়। মার্কিন সেনারা এখন যতগুলো হেলিকপ্টার ব্যবহার করছে, তার মধ্যে সিএইচ-ফিফটি থ্রি সুপার স্টলিয়ন হচ্ছে সর্ববৃহৎ হেলিকপ্টার।

সিএইচ-ফিফটি থ্রি সুপার স্টলিয়ন হেলিকপ্টারগুলো ১৬ টন পে-লোড বহন করতে পারে। পাশাপাশি ৫৫ জন মেরিন বা অন্য যেকোনো সেনাও বহন করতে পারে। হেলিকপ্টারগুলো আপাতত ৫০০ মাইল অবধি যেতে পারে। তবে, হেলিকপ্টারের ভেতরের জিনিসপত্রের ওজন হলে স্বাভাবিকভাবেই হেলিকপ্টারের গতি কমে যায়। তবে, এই হেলিকপ্টারে আকাশে ভাসমান অবস্থায় তেল নেওয়ার ব্যবস্থা থাকায় হেলিকপ্টারটি তার নির্ধারিত দূরত্বের চেয়ে আরও বেশি পথও অতিক্রম করতে পারে।

মার্কিন মেরিন সেনারা প্রচণ্ড ভারী জিনিসপত্র বহন করার জন্য সুপার স্টলিয়ন ব্যবহার করে। বিশেষ করে আর্টিলারি এবং এলএভি-টোয়েন্টি ফাইভের মতো হালকা ওজনের গাড়িগুলোকে স্টলিয়ন হেলিপ্টারগুলো যেকোনো সময় যুদ্ধজাহাজ থেকে নিরাপদ স্থান পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারে। পাশাপাশি, যুদ্ধক্ষেত্রে পড়ে থাকা আহত সেনাদেরকে উন্নত চিকিৎসার জন্য নিকটস্থ যুদ্ধজাহাজে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রেও এই হেলিকপ্টারগুলো অনেক সময়ই ব্যবহার করা হয়।

চতুর্থ আকর্ষণীয় অস্ত্র হলো লাইট আরমারড ভেহিকেল বা এলএভি। এর মধ্যে এলএভি-টোয়েন্টি ফাইভ হলো আট বাই আট আকৃতির একটি হালকা যান। যেখানে ২৫ মিলিমিটারের এমটু ফোরটি টু বুশমাস্টার ক্যানন ব্যবহার করা হয়। এলএভি টুয়েন্টি ফাইভগুলোর কাঠামো খুবই ব্যতিক্রমী। এটি এলসিএসি হোভারক্রাফট ব্যবহার করে সমুদ্রেও অবতরণ করতে পারে।

মেরিন সেনা সদর থেকে যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যাটালিয়নকে রসদ সরবরাহ করা বিশেষত অ্যান্টি ট্যাংক, কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল, মর্টার ও লজিস্টিক ক্যারিয়ার সরবরাহের দায়িত্ব এলএভিকে প্রদান করা হয়েছে।

এলএভি যানগুলো সাগর বা আকাশপথ ব্যবহার করে পৌঁছে যেতে পারে। আর নির্ধারিত গন্তব্যে পৌঁছেও যানগুলো খুব দ্রত সময়ের মধ্যে সেনাবাহিনীর শক্তি বৃদ্ধিতে প্রয়োজনীয় সকল কাজ সম্পন্ন করতে পারে। এলএভি টুয়েন্টি ফাইভ যানগুলোকে অতিসম্প্রতি এলএভি টোয়েন্টি ফাইভ এটুতে উন্নীত করা হয়েছে।

পঞ্চম পছন্দনীয় অস্ত্র হতে পারে হাই মোবিলিটির আরমারড রকেট সিস্টেম। ২০০০ সালের মাঝামাঝি সময়ে মেরিন আর্টিলারি বাহিনী এই রকেট সিস্টেমকে তাদের সঙ্গে সংযুক্ত করে। যেকোনো ৫ টনের ট্রাকে এই সিস্টেমটি স্থাপন করা যায়, যা দিয়ে একই সময়ে একসঙ্গে সর্বোচ্চ ৬টি রকেট নিক্ষেপ করা সম্ভব হবে।

এ রকেট সিস্টেমকে দ্রততম সময়ের মধ্যে সমুদ্রতীরে নিয়ে ক্রাফট এয়ার কুশন হোভারক্রাফটের মাধ্যমে অবতরণ করানো যায়। দুয়েক মিনিটের মধ্যেই এ সিস্টেমটি তার টার্গেটটি সঠিকভাবে নির্ণয় করতে পারে।

এই সিস্টেম থেকে ছোড়া রকেটগুলো ৪৩ মাইল অবধি পথ যেতে পারে। গাইডেড মাল্টিপল লঞ্চ সিস্টেম সংযোজন করার পর এই রকেটি সিস্টেমটি এখন একবার চেষ্টা করেই প্রতিপক্ষের টার্গেট নির্ধারণ ও শনাক্ত করতে পারে। অতি সম্প্রতি, মেরিন সেনারা সাধারণ ট্রাকের পাশাপাশি উভচর যানেও এ সিস্টেমের কার্যকারিতা পরীক্ষা করেছে।

মার্কিন মেরিন সেনাদের এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষার উদ্দেশ্য হলো উভচর যানগুলোকে এতটা নিরাপদ ও উন্নত করা, যাতে এ যানগুলো নিজেদের সেনাসদস্যসহ লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে শত্রুপক্ষের এলাকায় ঢুকে অভিযান চালিয়ে আবার নিরাপদে ফিরে আসতে পারে।