ইরান-ইসরায়েল নৌযুদ্ধ কি অনিবার্য

এমভি মার্সার স্ট্রিট - সংগৃহীত

  • আহমাদ আব্দুল্লাহ
  • ১৬ আগস্ট ২০২১, ১৪:৩৪

লন্ডনভিত্তিক জোডিয়াক মেরিটাইমের এমভি মার্সার স্ট্রিট নামের তেলের ট্যাঙ্কারে ২৯ জুলাই ড্রোন হামলার ঘটনা ঘটে। এই প্রতিষ্ঠানের মালিক ইসরায়েলের ধনকুবের ইয়াল ওফার। ট্যাঙ্কারটি লাইবেরিয়ার পতাকা বহন করলেও মূলত এটি ছিল জাপানের। ওই ড্রোন হামলায় ট্যাঙ্কারে থাকা দুই ক্রু নিহত হন। তাদের একজন যুক্তরাজ্যের নিরাপত্তা প্রহরী এবং অপরজন রোমানিয়ার নাগরিক। যিনি জাহাজের ক্যাপ্টেন হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তবে এই ঘটনায় ইরান তার সম্পৃক্ততার দায় অস্বীকার করলেও আগামীতে এই ঘটনার প্রভাবে ইরান ও পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে কৌশলেও পরিবর্তন আসতে পারে।

আরব সাগরে ইসরায়েলি তেল ট্যাঙ্কারে হামলার পেছনে ইরান জড়িত রয়েছে বলে মনে করছে ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। ইরান আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করেছে- এমন দাবি করে দেশগুলো পাল্টাজবাব দেওয়ার অঙ্গীকার করেছে।

শীর্ষ ধনী সাত দেশের জোট জি-সেভেন-এর পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা বলেছেন, যেসব তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে, তাতে এটা স্পষ্ট যে, ট্যাঙ্কারে হামলার পেছনে রয়েছে ইরান। এই ঘটনার পর পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে ইরানের উত্তেজনা আরেক দফা বেড়ে যায়। লন্ডন ও তেহরান একে অপরের কূটনীতিককে ডেকে পাঠায়। তেহরান শুরু থেকেই ট্যাঙ্কারে হামলার দায় অস্বীকার করে আসছে। ইরান বলছে, হামলায় তাদের জড়িত থাকার কোনো প্রমাণ যদি থেকে থাকে, তবে তা প্রকাশ্যে আনা হোক।

সম্প্রতি, ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেনি গান্তজ ইরানের বিরুদ্ধে সরাসরি আক্রমণ চালানোর হুমকি দেওয়ার পর ইরানের শীর্ষ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তাদের দেশের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের সামরিক আগ্রাসন হলে তারা দ্রুত এবং শক্তভাবে এর জবাব দেবে।

ইরান ও ইসরায়েলের নৌযুদ্ধ বা সংঘাতের এমন আশঙ্কা ২০১৯ সাল থেকে বেড়ে গেছে। বিগত দুই বছরে অন্তত ১৪টি ইরানি বাণিজ্যিক জাহাজ এবং সিরিয়াগামী তেল জাহাজ ইসরায়েলিদের আক্রমণের শিকার হয়েছে। ইরানের সাবিত ট্যাঙ্কারটি ২০১৯ সালের ১১ অক্টোবর এবং শাহর-এ-কর্দ কন্টেইনার জাহাজটি ২০২১ সালের ১১ মার্চ লোহিত সাগরে এবং ভূমধ্যসাগরে ইসরায়েলিদের টার্গেটের শিকার হয়।

ইসরায়েলি এই আক্রমণগুলোর উদ্দেশ্য ছিল ইরানের তেলবাহী জাহাজগুলোর যাতায়াত বন্ধ করা। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের ধারণা যে, ইরানের এই জাহাজগুলো দিয়েই সিরিয়া ও ইয়েমেনে অস্ত্র পাচার করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবুজ সংকেতে ইসরায়েল নিয়মিত বিরতিতে এই আক্রমণগুলো পরিচালনা করে আসছে।

অন্যদিকে, ইরানের বিরুদ্ধে বিগত ৬ মাসে ৫ বার ইসরায়েলি জাহাজ আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে। ইরান বলছে, ইসরায়েলি আক্রমণের প্রতিক্রিয়ায় তারা এই হামলাগুলো চালাতে বাধ্য হয়েছে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ইরান ইসরায়েলের হেইলস রেই নামের একটি বাণিজ্যিক জাহাজ এবং ২৫ মার্চ একটি লরিতে হামলা চালিয়েছে। এরপর ৬ এপ্রিল ইরানের সেভিজ নামের জাহাজটি আক্রমণের শিকার হওয়ার পরও ইসরায়েলের দিকে অভিযোগের তীর ছোড়া হয়। ইসরায়েলি লরিতে হামলার দিনকয়েক পরই এ হামলার ঘটনা ঘটে।

সেভিজ ছিল লোহিত সাগরে ইরানের একটি পণ্যবাহী জাহাজ। ইরানের মোতায়েনকৃত অন্যান্য জাহাজে সেভিজ দিয়েই তেলসহ জরুরি অন্যান্য সামগ্রী সরবরাহ করা হতো। ইসরায়েলের দাবি, সেভিজ দিয়েই ইরান অনেকগুলো জাহাজে অস্ত্র পাচার করেছে। তবে, এই সব হামলায় বড়ো আকারের সংঘাত সৃষ্টি না হলেও সর্বশেষ মার্সার স্ট্রিট ট্যাঙ্কারে হামলার ঘটনা শুধু ইরান ও ইসরায়েল নয়, বরং গোটা মধ্যপ্রাচ্যেই উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। এ ঘটনার জের ধরে সামনে বড়ো ধরনের সংঘাতও শুরু হয়ে যেতে পারে বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন।

সরাসরি যুদ্ধ না হলেও ইরান ও ইসরায়েলের ভেতর নৌপথে বিগত কয়েক বছর ধরেই ছায়াযুদ্ধ চলছে। এরই অংশ হিসেবেই দুই দেশ একে অপরের ট্যাঙ্কারে হামলা চালাচ্ছে। বাণিজ্যিক জাহাজগুলোতে আক্রমণ করে এগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছে। ইরানের দাবি, ইসরায়েল ইচ্ছাকৃতভাবে সিরিয়ায় ইরানের সামরিক ঘাঁটিতে হামলা চালিয়েছে। ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোকেও স্যাবোটেজ করার মাধ্যমে নিয়মিত বোমা হামলা চালাচ্ছে। এ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে সাময়িক উত্তেজনা তৈরি হলেও বৈশ্বিক টালমাটাল ঘটনায় আস্তে আস্তে আবার তা ম্লান হয়ে যায়।

এবারের ইসরায়েলি ধনকুবেরের মালিকানাধীন মার্সার স্ট্রিট নৌযানে হামলার প্রভাব এত সহজেই শেষ হবে বলে মনে হচ্ছে না। অনেকেই মনে করছেন, সম্প্রতি সিরিয়ার আল কুসাইর অঞ্চলের আল দাবা বিমানবন্দরে ইসরায়েল যে হামলা চালিয়েছে, তার প্রতিক্রিয়াতেই ইরান এই হামলা করতে পারে। কোনো কোনো বিশ্লেষক মনে করেন, পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে, সব দিক বিবেচনা করেই ইরান সম্ভবত তাদের এতদিনের কৌশলে পরিবর্তন নিয়ে আসতে চাইছে।

শর্তসাপেক্ষ শান্তির কৌশলটি ইরান গ্রহণ করেছিল দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির সময়ে। পশ্চিমারা হাসান রুহানির এ কৌশলকে অস্থিরতা কমানোর প্রয়াস হিসেবেই মূল্যায়ন করেছিল। এই কৌশল গ্রহণের সময়ে ইরান আশা করেছিল যে, প্রতিপক্ষ দেশগুলোও একই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি লালন করবে। কিন্তু তা কার্যকর না হওয়ায় ইরান এখন শক্ত বার্তা দেওয়ার নীতি গ্রহণ করেছে।

রুহানিকে মধ্যপন্থী একজন প্রেসিডেন্ট হিসেবেই মনে করা হতো। ২০০৩ সালে তিনি যখন ইরানের পারমাণবিক প্রকল্পের প্রধান সমঝোতাকারী হিসেবে কর্মরত ছিলেন, তখনই ইরান ও পশ্চিমা বিশ্ব প্রথমবারের মতো একটি চুক্তিতে পৌঁছাতে সক্ষম হয়। ইরান তখন স্বেচ্ছায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণও স্থগিত করেছিল। ২০১৩ সালে দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর রুহানি ঘোষণা করেছিলেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য পশ্চিমা দেশের সাথে বিদ্যমান সংঘাতপূর্ণ ইস্যুগুলোকে সমাধান করা তার প্রধান দায়িত্ব।

রুহানি পশ্চিমা বিশ্বের সাথে দুরত্ব কমিয়ে আনার জন্য পশ্চিমামুখী জাভেদ জারিফকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন। হাসান রুহানি এবং জাভেদ জারিফের প্রচেষ্টায় প্রেসিডেন্ট ওবামার শাসনামলের শেষদিকে ২০১৫ সালে ইরানের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক চুক্তিটি সাক্ষরিত হয়, যা জয়েন্ট কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন বা জেসিপিওএ নামে পরিচিত।

এই চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার পর থেকে ২০১৮ সালে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের চুক্তি থেকে বের হয়ে যাওয়া পর্যন্ত পুরোটা সময়ে ইরানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ইতিবাচক দিকেই অগ্রসর হচ্ছিল। ইরানের পারমাণবিক প্রকল্পের কারণে মধ্যপ্রাচ্যে আঞ্চলিক সংঘাত হওয়ার সম্ভাবনাও অনেকটা সীমিত হয়ে যায়। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর হাসান রুহানিও ইরানের এই প্রক্রিয়ার ওপর আর নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে পারেননি।

ইরানের একটি অংশ পারমাণবিক চুক্তিটি নিস্ক্রিয় হয়ে যাওয়ায় হাসান রুহানির সমালোচনাও করে থাকে। এরপর থেকে ইরানের রিভোলিউশনারি গার্ড এই প্রক্রিয়ার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। ট্রাম্প চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর থেকে ইরানের রিভোলিউশনারি গার্ড দেশটির পররাষ্ট্রনীতিতে হস্তক্ষেপ বাড়িয়ে দেয়। কোনো কোনো মহল অবশ্য দাবি করছে যে, রুহানি প্রশাসন মার্সার ট্যাঙ্কার আক্রমণের মতো এই ধরনের ঘটনা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে, যাতে যুক্তরাষ্ট্রকে সম্ভাব্য সংলাপে ধরে রাখা যায়।

ডেকিন বিশ্ববিদ্যালয়ে মিডলইস্ট স্টাডিজ ফোরামের আহবায়ক অধ্যাপক শাহরাম আকবারজাদেহ মনে করেন, ইরান এখনই ইসরায়েলের সাথে সরাসরি যুদ্ধে জড়াতে চায় না। যদি কোনো ইরানি ড্রোন এই হামলায় জড়িত থাকে, তাহলে হয়তো তা তেহরান প্রশাসনের সিদ্ধান্তে হয়নি। সম্ভবত স্থানীয় কোনো কমান্ডার ভুলবশত এমনটা করে থাকতে পারেন।

রুহানির ক্ষমতার শেষ দিকে, ইরানকে সংলাপে রাখার অনেক চেষ্টাই হয়েছিল। কিন্তু পরিস্থিতি এতটাই অস্থিতিশীল হয়ে যায় যে, ইরানের নীতি নির্ধারকদের ধৈর্যচ্যুতিও ঘটে। হয়তো সে কারণেই ইরান এখন শর্তসাপেক্ষ শান্তির পথ থেকে সরে এসে বরং কিছুটা আক্রমণাত্মক কৌশল গ্রহণ করেছে।

ইরানের পারমাণবিক চুক্তি থেকে ট্রাম্পের বেরিয়ে যাওয়া এবং ইরানের একাদশ সংসদ নির্বাচনে কট্টরপন্থী রাইসির বিজয়। সব কিছু মিলিয়ে ইরান সরকার আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী এডিশনাল প্রোটোকল স্থগিত করার প্রক্রিয়া থেকে সরে আসে। পাশাপাশি ২০ শতাংশ বা তার বেশি ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণও আবার জোরেশোরে শুরু হয়েছে। সবকিছুই ইরানের নতুন প্রশাসনের কমকৌশলের অংশ। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামনেয়ী মনে করেন, পশ্চিমের সাথে উত্তেজনা কমিয়ে আনার প্রক্রিয়া মূলত নিষ্ফল হয়েছে। ভবিষ্যত নেতৃত্বকে এ বিষয়টিকে বিবেচনায় নিয়েই কাজ করতে হবে। এরই মধ্যে পরিস্কার হয়ে গেছে যে, ইরানের নতুন প্রশাসন পশ্চিমা বিশ্বকে বিশ্বাস করে না।

মার্সার ট্যাঙ্কারে হামলার ঘটনায় যদি ইরান আসলেই জড়িত থাকে, তাহলে বুঝতে হবে যে, এর মাধ্যমে ইরান ইসরায়েলকে শক্ত বার্তা দিয়েছে। ইরান জানিয়ে দিয়েছে যে, যদি ইরানের স্বার্থ এবং ইরান সমর্থক গ্রুপগুলোকে কোনো হামলা করা হয়, তাহলে ইরান আর নিষ্ক্রিয় বসে থাকবে না। ইরান নতুন করে কোনো সংঘাতে বা উত্তেজনাকর পরিস্থিতিকেও ভয় পায় না।

একই সাথে ইরান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকেও বুঝিয়ে দিয়েছে, আজ হোক বা কাল, তাকেও ইরানের সাথে সংলাপে বসতেই হবে। ইরান এড়িয়ে যাওয়ার মতো কোনো বিষয় নয়। যদিও প্রেসিডেন্ট বাইডেন ইরানের সাথে সরাসরি যুদ্ধে জড়াতে আগ্রহী নন। তারপরও ইরান তাকে কোনো রকমের ছাড় না দিয়ে বরং সমীহ আদায় করে নিতে চাইছে। সব মিলিয়ে মার্সার ট্যাঙ্কারে আক্রমণের এ ঘটনা মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে নতুন একটি মেরুকরণের বার্তা দিয়েছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।