ড্রোন নির্মাণে যেভাবে এগিয়ে গেল ইরান


  • আহমেদ বায়েজীদ
  • ১২ আগস্ট ২০২১, ১৪:১৫

ড্রোন বা মনুষ্যবিহীন আকাশযান এখন যুদ্ধের অন্যতম সেরা হাতিয়ার। পশ্চিমা অবরোধ সত্ত্বেও এই সেক্টরে ব্যাপক উন্নতি করেছে ইরান। মনে করা হয়, ইরান ড্রোন শক্তিতে যেকোন দেশের সাথে পাল্লা দিতে পারে। ইসরায়েলি সাংবাদিক ও জেরুসালেমের আল কুদস ইউনিভার্সিটির সাবেক শিক্ষক সেথ জে ফ্রাৎসম্যান তার ‘ড্রোন ওয়ার্স’ বইয়ে একটি আলাদা অধ্যায় লিখেছেন ড্রোন শিল্পে ইরানের উন্নতি এবং এর বিভিন্ন পর্যায় নিয়ে। যেখানে তুলে ধরা হয়েছে ইরানের ড্রোন সেক্টরে শক্তিশালী হয়ে ওঠার চিত্র।

বিশে^ অনেক ড্রোনই এখন একটি আরেকটি মতো। যারাই ড্রোন বানাচ্ছে, দেখলে মনে হবে, একটি আরেকটি নকল। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ইরানের তৈরি সায়েজ ড্রোনটি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের লকহিড মার্টিনের তৈরি সেন্টিনেল ড্রোনের অনুকরণে তৈরি। ২০১৪ সালে এই ড্রোনটি প্রথম উড্ডয়ন করে। ইরানের বিপ্লবী গার্ডের অ্যারোস্পেস ফোর্সের কমান্ডার আমির আলী হাজিজাদের নেতৃত্বে সায়েজ ড্রোনটিতে চারটি পর্যন্ত মিসাইল সংযুক্ত করেছিল ইরান। আবার একই বছর মোতায়েনকৃত জেট ইঞ্জিন চালিত শাহেদ-১৭১ সিমোরঘ ড্রোনটিও সেন্টিনেলের অনুকরণে তৈরি।

মূলত ২০১১ সালে ইরান যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টিনেল ড্রোন ভূপাতিত করার পরই ড্রোন প্রযুক্তি সারা বিশে^ ছড়িয়ে পড়ে। সুপার পাওয়ার যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি বহু দেশ ড্রোন নির্মাণ শুরু করে। এটিই ড্রোন যুদ্ধের সমীকরণ পাল্টে দেয় এবং বিশ^ব্যাপী ড্রোন হুমকিও বাড়িয়ে তোলে।

শুরু থেকেই ইরানের পরিকল্পনা ছিল একটি শক্তিশালী ড্রোন বহর তৈরি করা। আশির দশকে ইসরায়েল যেভাবে ড্রোন শিল্পে এগিয়ে গেছে কিংবা তারও আগে যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে ড্রোনের ক্ষেত্রে একক আধিপত্য উপভোগ করেছে- ইরানের টার্গেট ছিল ঠিক ওই জায়গাটিতে যাওয়ার। কমান্ডার হাজিজাদের সময়ে সেন্টিনেল ছাড়াও ইরান ২০১৯ সালে ভূপাতিত করেছে ইউস গ্লোবাল হক ড্রোন। এখন তারা ইয়েমেনেও ড্রোন পাঠাচ্ছে বলে মনে করা হয়। যার ফলে গত কিছু বছরের মধ্যে বিশ^ প্রবেশ করেছে ড্রোন বিপ্লবের একটি যুগে।

যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের মোকাবেলা করতে গিয়ে ইরান নেমেছে এক দীর্ঘ ও রক্তাক্ত পথে। ১৯৭৯ সালের বিপ্লবের সময় ইরানের হাতে ছিল যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি কিছু টার্গেট ড্রোন, যেগুলো শাহের শাসনামলে তেহরানকে দিয়েছিল ওয়াশিংটন; কিন্তু ইরানের নতুন নেতৃত্বের হাতে সময় ছিল না সেগুলোর ব্যবহার শেখার। ১৯৮০ সালের ২২ সেপ্টেম্বর ইরান-ইরাক যুদ্ধ শুরু হলে ইরাকি যুদ্ধবিমান হামলা চালাতে শুরু করে ইরানের ভূখণ্ডে। ওই সময় ইরাক সামরিক প্রযুক্তিতে খুবই অগ্রসর ছিলো। তাদের হাতে ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ের তৈরি যুদ্ধবিমান ও বিষাক্ত গ্যাস।

ওই সময় ইরানের নবগঠিত বিপ্লবী গার্ড বাহিনী দ্রুত ড্রোন নিয়ে কাজ শুরু করে। ১৯৮৬ সালে কাশেম সোলাইমানির নেতৃত্বে ইরাকের সেনারা বসরা সীমান্ত এলাকা দিয়ে ৯৫০ বার ড্রোন পাঠায় ইরাকে, যারা ৫৪ হাজার ছবি তোলে বলে ইরানি সংবাদ মাধ্যমে বলা হয়। সেটি ছিল ইরানের ড্রোন বিপ্লবের সূচনা পর্ব।

১৯৮০-র দশকেই ইরান তৈরি করে কুদস মোহাজের ড্রোন, কুদস অ্যাভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রির তৈরি ড্রোনটি প্রথম আকাশে ওড়ে ১৯৮৫ সালে। এরপর শত শত ছোট ও মাঝারি আকারের ড্রোন তৈরি করে দেশটির ইঞ্জিনিয়াররা। ১৯৮৬ সালে সার্ভিসে যুক্ত হয় আবাবিল, যার ৪০০টি ড্রোন তৈরি করা হয় অল্প সময়ের মধ্যে।

আবাবিল ড্রোনটি তৈরি করেছিল ইরান এয়ারক্রাফট ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি, যারা বিপ্লবের আগে বেল হেলিকপ্টার তৈরি করেছিল। আবাবিল ড্রোনটি বিস্ফোরক নিয়ে উড়তো, যেটি অনেকটা ক্রুজ মিসাইলের মতো কাজ করতো। ট্রাকের ওপর স্থাপিত একটি ক্যাটাপাল্ট থেকে এটি উড্ডয়ন করা হতো। পরবর্তীতে লেবানন ও ইয়েমেনে এই ধরণের ড্রোন রফতানি করা হয়েছে।

এছাড়া ইসরায়েলের ড্রোনের নাড়ি নক্ষত্রও দেখার সুযোগ হয়েছে ইরানিদের। ১৯৯১ সালে তারা ইসরায়েলের দুটো পাইওনিয়ার ড্রোন ভূপাতিত করে। এছাড়া ২০১৫ সালে সিরিয়ায় ইসরায়েলের একটি প্রিডেটর ড্রোন ভূপাতিত হয়েছে। এছাড়া ইয়েমেনেও যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি স্ক্যান ঈগল ও রিপার ড্রোন ভূপাতিত হয়েছে। ইয়েমেনের হুথি ও সিরিয়ার বাশার আল আসাদের সরকার ইরানের ঘনিষ্ঠ মিত্র, যে কারণে এসব দেশের ভূপাতিত ড্রোনের ধ্বংসাবশেষ ইরানের হাতে পড়েছে বলেই ধরে নেয়া যায়।

তবে এসব ড্রোনের বাহ্যিক রূপ দেখে ধারণা নেয়া ইরানি ইঞ্জিনিয়ারদের জন্য সহজ হলেও তাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ ছিল এসব ড্রোনে নজরদারি কিংবা টার্গেট চিহ্নিত করার মতো কারিগরি দিক। কারণ এসবের কম্পোজিট ম্যাটেরিয়াল, গাইডেন্স সিস্টেম, ইলেক্ট্রো অপটিক্যাল সিস্টেমের মতো মার্কিন ও ইসরায়েলি প্রযুক্তিগুলো হাতে পাওয়া ইরানের জন্য কঠিন ছিলো। কারণ দেশটির ওপর রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা।

যদিও তারা ঠিকই আবাবিল ও মোহাজেরের মতো আধুনিক ড্রোন তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। ২০০৮ সালে জাতিসঙ্ঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী সুদানে একটি ড্রোন দেখতে পেয়ে তদন্ত শুরু করে। সুদান সরকার তাদের জানায়, জাগিলস নামের ওই ড্রোনটি মূলত ইরানের আবাবিল-৩ ড্রোনের একটি সংস্করণ। ওই সময় এর দুটো ড্রোন ভূপাতিত করেছিল সুদানী বিদ্রোহীরা। ২০০৭ সালে নজরদারির জন্য ভেনেজুয়েলাও ইরানের মোহাজের-২ ড্রোন কিনেছিলো।

১৯৮০ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে ইরান এসব ড্রোন তৈরি করেছে। শুরুতে এসব ড্রোনের রেঞ্জ ছিল সীমিত। শুরুতে ছোট ফুয়েল ট্যাংকের কারণেও বেশিক্ষণ উড়তে পারতো না মনুষ্যবিহীন আকাশযানগুলো। ২০২০ সালের এপ্রিলে ইরান তাদের সেনাবাহিনীর জন্য আবাবলি-৩ ড্রোন সার্ভিসে যুক্ত করে। বলা হয় এই ড্রোনগুলো গাইডেড বোমা বহন করতে পারে। এছাড়া নতুন ধরনের কারার ড্রোনও উদ্ভাবন করে তারা, যেট দেখতে অনেকটা ক্রুজ মিসাইলের মতো। তেহরান দাবি করে কারার ড্রোন দেড় হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত দূরত্বে কাজ করতে পারে এবং আকাশে ৪৫ হাজার ফুট উচ্চতায় উঠতে পারে।

২০২০ সালের মাঝামাঝিতে কর্নেল আকবর করিমলু নামের এক কর্মকর্তার বরাতে জানা যায়, ইরান বিপ্লবী গার্ডের ড্রোন কমান্ড তাদের ড্রোনের কমিউনিকেশন এবিলিটি বাড়াতে চেষ্টা করছে। তিনি তাসনিম নিউজ নামের একটি সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, এসব ড্রোনে ভিডিও ইমেজিং, জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সিস্টেম এবং একশো কিলোমিটার পর্যন্ত রেঞ্জ বৃদ্ধি নিয়ে কাজ করছে ইরান।

ইরানের লক্ষ্য ছিল ড্রোনের শক্তিশালী একটি ইউনিট গঠন করে শত্রুদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানের জানান দেয়া। তেহরান যেখানেই তার প্রভাব বিস্তার করতে চায়, সেখানেই একাধিক রাষ্ট্রের বিরোধীতার মুখে পড়ে। সেসব জায়গায় ড্রোন পাঠিয়ে ইরান সুবিধা নিতে চেয়েছে। এটা শুরু হয়েছে তাদের নিকটতম প্রতিবেশী ইরাক থেকে। এরপর সেটি বিস্তৃত হয়েছে সিরিয়া, লেবানন, ইয়েমেন, সুদান, গাজা ও আফগানিস্তানে। এছাড়া পারস্য উপসাগর কিংবা ওমান উপসাগরের ওপরেও টহল দিয়ে বেড়ায় ইরানের ড্রোন।

কিন্তু তেহরানই কি সত্যিই যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ড্রোন শক্তিতে পাল্লা দেয়ার সামথ্য রাখে? এই প্রশ্নের উত্তর এক শব্দে দেয়া কঠিন। যুক্তরাষ্ট্র যখন ড্রোন শিল্পে বিশে^ সবার চেয়ে এগিয়ে, ইরান তখন এই জায়গায় নিজেকে শক্তিশালী করতে শুরু করে। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে টক্কর দেয়ার জন্যই ইরান হরমুজ প্রণালীর কাছে এবং এর দক্ষিণ পাশে ড্রোন ঘাঁটি তৈরি করেছে। ২০১৫ সালে বালুচিস্তান প্রদেশের জাকিগুড়ে নির্মাণ করেছে বিমান ঘাঁটি। এছাড়া এই সময়ে তারা তাদের ড্রোনকে দেশের বাইরেও পাঠিয়েছে। সিরিয়ার মরুভুমিতে তিয়াস নামের একটি ঘাঁটিতে পাঠানো হয়েছে ইরানি ড্রোনের বহর।

কথিত আছে তিয়াস ঘাঁটি থেকে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইরান একটি ড্রোন উড্ডয়ন করেছিল, ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে যাচাই করার জন্য। ড্রোনটি গোলান মালভূমির কাছ দিয়ে উড়ে গিয়ে জর্দান উপত্যকার বেইত শেন শহরে অনুপ্রবেশ করে। ইসরায়েল একটি অ্যাপাচি হেলিকপ্টার পাঠিয়ে ড্রোনটিকে ভূপাতিত করে। এই ঘটনার প্রতিশোধ হিসেবে কয়েকদিন পরই ইসরায়েলের একটি এফ-সিক্সটিন ফাইটার ভূপাতিত করে সিরিয়ান এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম।

ড্রোন দিয়ে শত্রুপক্ষকে যাচাই করা ইরানের জন্য নতুন নয়। ২০১৬ সালের ১২ জানুয়ারি ইরানের একটি ড্রোন পর পর উড়ে যায় যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহী রণতরী ইউএসএস হ্যারি ট্রুম্যান ও ফ্রান্সের চার্লস ডি গল এর ওপর দিয়ে। যুক্তরাষ্ট্রের পঞ্চম নৌ বহরের মুখপাত্র কেভিন স্টেফান্স ওই ঘটনার পর বলেন, ড্রোনটি নিরস্ত্র ছিল এবং রণতরীর জন্য কোন হুমকি হয়ে দেখা দেয়নি। যদিও তার এই বক্তব্য পুরোপুরি অপেশাদার। ইরান সেদিন তার নতুন উদ্ভাবিত শাহেদ ১২৯ ড্রোনটি পাঠিয়েছিল মার্কিন রণতরীর ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার জন্য। তাদের উদ্দেশ্য ছিল ড্রোনটির সক্ষমতা পরীক্ষা করা।

এরপর তারা ২০১৭ সালের আগস্টে পারস্য উপসাগওে মার্কিন রণতরী ইউএসএস নিমিৎজের ওপর পাঠায় একটি সাদেঘ ড্রোন। যেটি রণতরীতে অবতরণের প্রস্তুতি নিতে থাকা একটি যুদ্ধবিমানকে কিছুটা ডিস্টার্বও করে। ২০১৯ সালের এপ্রিলে একই ড্রোনকে পাঠানো হয় ইউএসএস আইসেনহাওয়ারের কাছে। একই বছর মার্চে ইরান ৫০টি ড্রোনের একটি মহড়া চালায়, যার নাম দেয়া হয় ‘ওয়ে টু জেরুসালেম’। ২০২১ সালের জানুয়ারিতেও ইরান ২ দিন ব্যাপী স্থানীয়ভাবে তৈরি ড্রোনের বড় একটি মহড়া চালায়। এসব ছিল ইরানের ড্রোন সক্ষমতা জানান দেয়ার চেষ্টা।

সেথ জে ফ্রাৎসম্যান তার বইয়ের এই অধ্যায়ের একেবারে শেষে লিখেছেন, বাস্তবতা হলো যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল কিংবা ইরানের অন্য প্রতিপক্ষের কাছে তেহরানের ড্রোনকে প্রতিরোধ করার মতো খুব বেশি ক্ষমতা নেই। ওয়াশিংটন সন্ত্রাসীদের দমনে ড্রোন প্রযুক্তি প্রভূত উন্নয়ন করলেও, যেসব দেশের ড্রোন আছে তাদের সাথে লড়াই করার বিষয়টিতে গুরুত্ব দেয়নি।