এফ-২২ পাঠিয়ে চীনকে কী বার্তা দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র?


  • আহমেদ বায়েজীদ
  • ২৯ জুলাই ২০২১, ১৫:২০

এশিয়া প্রশান্ত মহাসগারীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের শক্তি প্রদর্শন নতুন কিছু নয়। কিন্তু অঞ্চলটিতে এবার তারা পাঠাচ্ছে পঞ্চম প্রজন্মের এফ-২২ র‌্যাপটর ফাইটারের বিশাল এক বহর। প্রথমবারের মতো বিমানগুলো মহড়া চালাবে চীনা ভূখণ্ডের কাছে। যার পেছনে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের একটি সামরিক মাস্টারপ্ল্যান। তাইওয়ান নিয়ে উত্তেজনার প্রেক্ষিতে চীনের হুমকি মোকাবিলায় পেন্টাগন যে কত ধরনের যুদ্ধপ্রস্তুতি নিচ্ছে, তারও কিছু দিক প্রকাশ পেয়েছে এবার।

তাইওয়ানের সাথে চীনের উত্তেজনার মাঝেই প্রশান্ত মহাসগারীয় অঞ্চলে দুই ডজনেরও বেশি এফ-২২ র‌্যাপটর স্টিলথ ফাইটার পাঠাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। চলতি মাসে ওই অঞ্চলে বড় একটি সামরিক মহড়ায় অংশ নেবে বিশে^র সবচেয়ে শক্তিশালী ফাইটার হিসেবে পরিচিত র‌্যাপটর। কোনো কারণ ছাড়াই যুক্তরাষ্ট্রের এই বড় পদক্ষেপকে বিশ্লেষকরা বলছেন, বেইজিংয়ের প্রতি ওয়াশিংটনের বৈরীতার ক্ষেত্রে নতুন বার্তা।

হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ ভিত্তিক মার্কিন বিমান বাহিনীর কমান্ড প্যাসিফিক এয়ার ফোর্সের বরাত দিয়ে সিএনএনের খবরে জানানো হয়েছে, হাওয়াই এয়ার ন্যাশনাল গার্ড ও আলাস্কার এলমেন্ড্রফ-রিচার্ডসন ঘাঁটির প্রায় ২৫টি র‌্যাপটর ফাইটার জেটকে চলতি মাসে গুয়াম দ্বীপ ও তিনিয়ান দ্বীপে মোতায়েন করবে যুক্তরাষ্ট্র। ওই অঞ্চলে অপারেশন প্যাসিফিক আয়রন নামের একটি মহড়ায় অংশ নেবে বিমানগুলো। প্যাসিফিক এয়ারফোর্সের কমান্ডার জেনারেলক কেন উইলসবাচ সিএনএনকে বলেন, প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে আমরা এর আগে কখনো এক সাথে এতগুলো র‌্যাপটর পাঠাইনি।

তাইওয়ান ও দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চীনের চলমান উত্তেজনার মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র ওই অঞ্চলে পাঠাচ্ছে তার সর্বাধুনিক যুদ্ধবিমানের বহর। যা বেইজিংয়ের প্রতি ওয়াশিংটনের একটি কড়া বার্তা হিসেবে প্রতিফলিত হচ্ছে বলে মনে করেন সামরিক বিশ্লেষকরা। গত মাসে তাইওয়ানের আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে ২৮টি চীনা বিমান। এর মধ্যে ছিলো ১৪টি জে-সিক্সটিন ও ছয়টি জে-ইলেভেন ফাইটার। এছাড়া পারমাণবিক বোমা বহনে সক্ষম ছয়টি বোম্বারও ছিলো এই তালিকায়। জি-সেভেনের পক্ষ থেকে তাইওয়ান প্রণালীতে চীনা সামরিক পদক্ষেপের নিন্দা জানানোর কয়েকদিন পরই চীনা বিমান তাইওয়ানের আকাশসীমা লংঘন করে।

তাইওয়ান চীনে ওয়াশিংটনরে সাথে বেইজিংয়ের বিরোধ অনেক পুরনো। বেইজিং সব সময়ই তাইওয়ানকে চীনের অংশ বলে দাবি করে ; কিন্ত তাইওয়ান চায় স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে। চীনের বিরোধীতার কারণে বেশির ভাগ রাষ্ট্রই তাইওয়ানের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করে না। যুক্তরাষ্ট্রের অনুগত বিশ^ রাজনীতিতে উল্লেখযোগ্য নয় এমন কিছু দেশ তাইওয়ানকে স্বীকৃতি দিয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই তাইওয়ানকে স্বাধীন দেশ হিসেবে দেখতে চায়। তারা তাইওয়ানকে বিভিন্নভাবে সামরিক সহায়তাও দিয়ে থাকে, যা নিয়ে ক্ষুব্ধ চীন।

জুলাইয়ের দ্বিতীয় সপ্তাহে তাইওয়ানে ডি ফ্যাক্টো মার্কিন দূতাবাসে একটি কূটনৈতিক বার্তা পাঠিয়েছে ওয়াশিংটন। জাপানের মার্কিন ঘাঁটি থেকে এই বার্তাটি নিয়ে তাইওয়ানে অবতরণ করেছে একটি মার্কিন সামরিক বিমান। যেটি নিয়ে অনধিকার প্রবেশের অভিযোগ তুলে গুরুত্বর পরিণতির হুমকি দিয়েছে বেইজিং। চীনা প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলেছে, তাইওয়ান চীনা ভূখণ্ড। এখানে কোনো বিদেশি বিমান অবতরণের আগে অবশ্যই চীনের অনুমতি নিতে হবে। এছাড়া জুন মাসে তিন মার্কিন সিনেটরের তাইওয়ান সফরের সময়ও কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে চীন সরকার।

এমন পরিস্থিতির মাঝেই চীনা ভূখণ্ডের কাছে র‌্যাপটর ফাইটার জেটের বিশাল বহর পাঠাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রর। এটি স্পষ্টই ওয়াশিংটনের একটি বড় পদক্ষেপ। মার্কিন সেনাবাহিনীর প্যাসিফিক কমান্ডের সাবেক কর্মকর্তা ও হাওয়াইভিত্তিক সামরিক বিশ্লেষক কার্ল শুস্টার বলেন সাধারণত কোথাও র‌্যাপটর পাঠানো হলে তাতে থাকে ৬ থেকে ১২টি বিমান। কিন্তু এবার এক সাথে এতগুলো বিমান পাঠিয়ে যুক্তরাষ্ট্র হয়তো চীনকে দেখাতে চাইছে যে, অল্প সময়ের নোটিশে তারা অনেকগুলো পঞ্চম প্রজন্মের ফাইটার যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠাতে পারবে। কারণ চীনের পুরো বহরেও এতগুলো পঞ্চম প্রজন্মের ফাইটার নেই। চীনের বিমান বাহিনীর কাছে সব মিলে ২০ থেকে ২৪ টি পঞ্চম প্রজন্মের ফাইটার আছে বলে জানান এই বিশ্লেষক। তবে বেইজিং দ্রুত তার সক্ষমতা বাড়াচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনীর পরিসংখ্যান অনুযায়ী তাদের কাছে বর্তমানে র‌্যাপটর আছে ১৮০টি। তবে এর মধ্যে অর্ধেক সংখ্যক হয়তো দ্রুততার সাথে যুদ্ধে নামতে পারবে। বাকি অর্ধেক ফাইটারকে তাৎক্ষণিক ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত রাখা হয় না। তবে কয়েক দিনের নোটিশে সেগুলোও রেডি হয়ে যেতে পারবে। তার মানে, য্ক্তুরাষ্ট্র তার র‌্যাপটর বহরের ২৫ শতাংশ এবারের মহড়ায় পাঠাচ্ছে। মহড়ায় আরো থাকবে ১০টি এফ-১৫ ঈগল ও দুটি হারকিউলিস পরিবহন বিমান। সব মিলে ৩৫টি বিমান ও ৮০০ বিমান সেনা এই মহড়ায় অংশ নেবে। মহড়ায় ফাইটার েেজটের পাইলটরা যুদ্ধকালীন সব ধরনের পরিস্থিতির অনুশীলন করবে।

পঞ্চম প্রজন্মের ফাইটার এফ-২২-কে বলা হয় মোস্ট অ্যাডভান্সড ফাইটার এয়ারক্রাফট। যাতে স্টিলথ টেনকোলজি ছাড়াও আছে অনবোর্ড সেন্সর সিস্টেম ও অফ-বোর্ড ইনফরমেশন সিস্টেম, যা যুদ্ধক্ষেত্র সম্পর্কে বিস্তািরত তথ্য দেয় পাইলটকে। এফ-৩৫ যুদ্ধের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত হওয়ার আগ পর্যন্ত এফ-২২-ই যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বহরের সেরা যুদ্ধবিমান। অনেকে এটি এখন পর্যন্ত বিশে^র সেরা বিমান হিসেবেও আখ্যায়িত করেন।

দুই ইঞ্জিনের সুপারসনিক এই বিমানটি তৈরি করেছে লকহিড মার্টিন। এর রয়েছে তিনটি ওয়েপন বে। প্রধান ওয়েপন বে’তে ছয়টি মাঝারি পাল্লার এয়ার টু এয়ার মিসাইল অথবা ১০০০ কেজির জয়েন্ট ডিরেক্ট অ্যাটাক মিউনিশন বহন করতে পারে। এছাড়া কয়েক ধরনের এয়ার টু গ্রাউন্ড মিসাইল বহন করতে পারে এই বিমান।

র‌্যাপটরের রাডারকে ফাঁকি দেয়ার ক্ষমতা অনেক বেশি, যেকারণে বৃহৎ কোনো প্রতিপক্ষের সাথে যুদ্ধ বাধলে যুক্তরাষ্ট্র যে সবার আগে এই ফাইটার ব্যবহার করবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। গ্রিফিথ এশিয়া ইনস্টিটিউটের বিশ্লেষক ও অস্ট্রেলিয়ান এয়ার ফোর্সের সাবেক কর্মকর্তা পিটার লেটন বলেন, যে কোনো বড় যুদ্ধ বা সঙ্কটের জন্য যুক্তরাষ্ট্র তাদের এই মহড়া চালাচ্ছে। তারা চীনের হুমকিকে গুরুত্বের সাথে নিচ্ছে এবং যে কোনো সময় যাতে দ্রুত বাহিনী মুভ করাতে পারে সেই প্রস্তুতি নিয়ে রাখছে।

২০১৮ সালে গৃহীত যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ডিফেন্স স্ট্রাটেজির সমর্থনে এবারের মহড়াটির উদ্যোগ নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ওই স্ট্রাটেজিতে সামরিক বাহিনীকে আরো মারাত্মক, দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখাতে সক্ষম এবং আগ্রাসী বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এর আওতায় মার্কিন যুদ্ধবিমান ও অন্যান্য সামরিক সরঞ্জামাকে এই অঞ্চলের সবগুলো সামরিক ঘাঁটির সাথে পরিচিত করা হবে, যাতে প্রয়োজনের সময় তারা শত্রুর মিসাইল স্ট্রাইককে ফাঁকি দিতে সক্ষম হয়। যেমন, পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নিয়োজিত মার্কিন বিমান শক্তির প্রায় পুরোটাই এই অঞ্চলের ওকিনাওয়া ও গুয়াম দ্বীপের বিমান ঘাঁটিকে কেন্দ্র করে। যার ফলে এসব ঘাঁটিতে শত্রুর সফল হামলা যে কোনো সময় যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনীতে অনেকটা পঙ্গু করে দিতে পারবে। এর বিকল্প হিসেবে তাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিভিন্ন ঘাঁটিতে বিমান শক্তির উপস্থিতি রাখতে চাইছে পেন্টাগন।

এবারের প্যাসিফিক আয়রন মহড়ায় মার্কিন বিমান গুলো অপেক্ষাকৃত ছোট ও কম উন্নত বিমান ঘাঁটি থেকেও অপারেশন চালানোর অনুশীলন করবে। এর মধ্যে রয়েছে নর্দান মারিয়ানা আইল্যান্ডের তিনিয়ান এয়ারপোর্ট, গুয়াম দ্বীপের ওন প্যাট এয়ারপোর্ট প্রভৃতি। এর মাধ্যমে পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের যে কোনো ছোট দ্বীপ থেকে যুদ্ধবিমান উড্ডয়ন ও অবতরণের অনুশীলন সেরে রাখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র।

তাদের এই উদ্যোগটি সফল হলে যে কোনো শত্রুর পক্ষের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের বিমান শক্তিতে টার্গেট করা সহজ হবে না। এবং একটি, দুটি ঘাঁটি ধ্বংস হয়ে গেলেও তারা পাল্টা আক্রমণ করার সুযোগ পাবে। এই প্রক্রিয়াকে বলা হচ্ছে অ্যাজাইল কমব্যাট এমপ্লয়মেন্ট অপারেশন্স অর্থাৎ কার্যকর লড়ায়ের প্রস্তুতি এটি। এর আগে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে গুয়াম দ্বীপের ঘঁাঁটিতে জ¦ালানি সংগ্রহের জন্য নেমেছিল বেশ কয়েকটি এফ-৩৫ ও এফ-১৬ ফাইটার। যেটিকেও বলা হয়েছে সামরিক মহড়ার অংশ।

মার্কিন সামরিক বাহিনীর অর্থায়নে পরিচালিত থিংক ট্যাংক র‌্যান্ড কর্পোরেশন ২০১৯ সালে এক রিপোর্টে, দেখিয়েছে কিভাবে চীনা প্রভাব মোকাবেলায় মার্কিন সামরিক বাহিনীর এই পরিকল্পনা কাজ করছে। রিপোর্টে বলা হয়, চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি দূরপাল্লার ক্রুজ ও ব্যালেস্টিক মিসাইলের সংখ্যা এবং শক্তি দুটোই বাড়িয়ে চলছে- যা ওই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের বিমান ঘাঁটিগুলোকে টার্গেটে পরিণত করতে পারবে। এতে আরো বলা হয়, মার্কিন বিমান বাহিনীর যুদ্ধবিমানগুলো বিভিন্ন ঘাঁটিতে ছড়িয়ে দেয়া হলে শত্রু পক্ষকে লক্ষ্য অর্জনের জন্য এক সাথে অনেকগুলো মিসাইল হামলা চালাতে হবে।

র‌্যান্ড কর্পোরেশনের এই রিপোর্টের সাথে সুর মিলিয়ে প্যাসিফিক কমান্ডের সাবেক কর্মকর্তা কার্ল শুস্টার বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের এই কৌশল এবং শক্তি প্রদর্শন চীনের কাছে একটি কঠিন বার্তা পৌছে দেবে এবং ওই অঞ্চলে মার্কিন মিত্রদের আশ^স্ত করবে। তিনি বলেন, চীন নিশ্চয়ই খুব কঠোর ভাবে যুক্তরাষ্ট্রের এবারের পদক্ষেপটির ওপর নজর রাখবে।