রাফালে কেলেঙ্কারি নিয়ে বিপাকে মোদি


  • আহমাদ আব্দুল্লাহ
  • ২৫ জুলাই ২০২১, ১৩:৪৯

২০১৬ সালে ভারত ও ফ্রান্সের মধ্যে ৯ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের প্রতিরক্ষা চুক্তি নিয়ে ফ্রান্সে বিচার বিভাগীয় তদন্ত শুরু হয়েছে। রাফালে বিমান কেনার পুরো প্রক্রিয়াতেই মারাত্মক ধরনের দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি এবং দুই দেশের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ততার অভিযোগ উঠেছে। দুই দেশের সরকারের মধ্যে ৩৬টি রাফালে বিমান কেনার চুক্তি হয়েছিল। এ-নিয়ে অভিযোগ ওঠার পর ফ্রান্সের পাবলিক ফাইনান্সিয়াল প্রসিকিউটর তদন্তের আদেশ দেন। এ-নিয়ে ভারতের মোদি সরকার বেশ বিপাকে পড়েছে।

ফ্রান্সের পাবলিক ফাইনান্সিয়াল প্রসিকিউশন অফিসের সুপারিশে তদন্তের জন্য একজন বিচারপতি নিয়োগ পেয়েছেন। তার প্রাথমিক দায়িত্ব হলো, যারা এ চুক্তি অনুমোদনের সাথে জড়িত ছিলেন, সেই কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা। এ চুক্তি সাক্ষরের সময় ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ছিলেন ফ্রাঙ্কোইস ওল্যান্ডে। তাকেও জিজ্ঞাসাবাদের কথা রয়েছে। বর্তমান প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁকেও তদন্তের স্বার্থে জিজ্ঞাসাবাদের পরিকল্পনা রয়েছে। তিনি ২০১৬ সালের সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। পাশাপাশি তৎকালীন সরকারের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জিন ইভস লে ড্রিয়ানকেও জিজ্ঞাসাবাদ করার কথা রয়েছে। লা ড্রিয়ান এখন ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

ফরাসি ম্যাগাজিন মিডিয়াপার্ট গত এপ্রিলে রাফালে স্ক্যান্ডাল নিয়ে সিরিজ খবর প্রকাশ করে। এরপর ফরাসি নীতি নির্ধারকদের টনক নড়ে। তারা জরুরি ভিত্তিতে তদন্ত কার্যক্রম শুরু করে। আর্থিক দুর্নীতি ছাড়াও মিডিয়াপার্টের খবরে সুশেন গুপ্তা নামক একজন মধ্যস্বত্বভোগীর নামও চলে আসে। যিনি বর্তমানে অন্য আরেকটি প্রতিরক্ষা চুক্তির দুর্নীতির অভিযোগে ভারতে তদন্তের মুখোমুখি হয়েছেন।

গুপ্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি ফ্রান্সের বিমাননির্মাতা প্রতিষ্ঠান ড্যাসল্ট অ্যাভিয়েশন এবং ডিফেন্স ইলেকট্রনিকস ফার্ম থালেসের মাধ্যমে গোপন কমিশন বাণিজ্যের সাথে জড়িত। এই বিপুল পরিমাণ অর্থ ঘুষ দেওয়ার উদ্দেশ্য ছিল রাফালে চুক্তিকে প্রভাবিত করা।

ড্যাসল্ট রাফালে জেটগুলোর ৫০টি রেপ্লিকা তৈরির জন্য ভারতের একটি কোম্পানিকে ১ দশমিক ২ মিলিয়ন ডলার প্রদান করে। ফ্রান্সের দুর্নীতিবিরোধী এজেন্সি এএফএ যখন ড্যাসল্টের কাছে এ রেপ্লিকাগুলো দেখতে চায়, তারা ৫০টি রেপ্লিকার একটিও দেখাতে পারেনি।

ভারতের যে প্রতিষ্ঠানকে ড্যাসল্ট অর্থ দিয়েছিল তার নাম ডেফিস সলিউশনস। এ প্রতিষ্ঠানটির সাথেও সুশেন গুপ্তার সম্পৃক্ততা রয়েছে। ২০১৬ সালে মূল চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হওয়ার ৬ মাসের মধ্যেই ডেফিস সলিউশনের প্যাড ব্যবহার করে গুপ্তা ড্যাসল্টের কাছে ইনভয়েস পাঠান। ড্যাসল্ট সে টাকা সময়মতো দিয়ে দিলেও চুক্তি অনুযায়ী কিছুই পায়নি। ধারণা করা হচ্ছে, পুরো অর্থ গুপ্তার নিজের পকেটেই চলে গেছে।

২০১৯ সালের মার্চ মাসে ভারতের মুদ্রাপাচার-বিরোধী প্রতিষ্ঠান এনফোর্সমেনট ডিরেক্টরেট গুপ্তাকে চপারগেইট নামক অন্য একটি প্রতিরক্ষা চুক্তিতে দুর্নীতির অভিযোগে আটক করে। এ চুত্তিটিও ৬৫০ মিলিয়ন ডলারের। চুক্তি অনুযায়ী ইতালিয়ান-ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠান আগাস্টা ওয়েস্টল্যান্ডের কাছ থেকে ভারতের হেলিকপ্টার কেনার কথা রয়েছে।

ভারতের এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের কাছে রাফালে বিমান ক্রয়ে দুর্নীতির অভিযোগ প্রথম আসে ২০১৯ সালে। ভারতের দ্য হিন্দু পত্রিকায় এ-নিয়ে একের পর এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে। দ্য হিন্দু তাদের অনুসন্ধানে জানতে পারে, ভারতের সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত প্রক্রিয়ার দুর্নীতিবিরোধী ধারাগুলো ভারত সরকারের তরফ থেকে বাদ দেওয়া হয়।

গত এপ্রিলে ফরাসি পত্রিকা মিডিয়াপার্ট দুর্নীতির প্রতিবেদনগুলো প্রকাশ করে। এরপর ফ্রান্সের দুর্নীতিবিরোধী এনজিও শেরপা এ নিয়ে ট্রাইবুনালে অভিযোগ দায়ের করে। বিষয়টা ফ্রান্সের সরকারের জন্যও খুব বিব্রতকর। ধারণা করা হচ্ছে, কোনো নির্দিষ্ট দুর্নীতিবাজ নয়, বরং গোটা ফ্রান্স সরকারই এ দুর্নীতির সাথে জড়িত ছিল।

ড্যাসল্ট অবশ্য দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তারা দাবি করছে যে, চুক্তির ক্ষেত্রে ফ্রান্সের ঘুষবিরোধী কনভেনশন এবং প্রচলিত আইনি বিধি-বিধানগুলো অনুসরণ করা হয়েছে। ভারতের প্রখ্যাত আইনজীবী প্রশান্ত ভুষণ বহুদিন থেকেই রাফালে চুক্তি নিয়ে তদন্তের দাবি জানিয়ে আসছিলেন। তিনি বলেছেন, মিডিয়াপার্ট দুর্নীতির পুরো চিত্র প্রমাণসহ আমাদের সামনে নিয়ে এসেছে। এগুলো সুপ্রিম কোর্টে দাখিল করা হয়েছে। এ চুক্তির বিষয়ে একটি স্বাধীন তদন্তের দাবি জানানো হয়েছে।

রাফালে চুক্তিটি ভারতের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় প্রতিরক্ষা চুক্তি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও তার হিন্দু জাতীয়তাবাদী সরকার ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ফ্রান্সের সাথে ৩৬টি রাফালে বিমান কেনার জন্য এ চুক্তি করে। এরইমধ্যে চুক্তি অনুযায়ী ভারতের হাতে বেশ কিছু রাফালে বিমান চলে এসেছে।

২০২২ সালের মধ্যে ভারত সবগুলো বিমান পেয়ে যাবে। ভারত যখন রাশিয়ার মিগ না কিনে ফ্রান্সের রাফালের দিকে আগ্রহ প্রকাশ করেছিল, তখন থেকেই নানা মহলে ভারতের এ সিদ্ধান্তকে রহস্যজনক হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়। চুক্তি অনুযায়ী নির্ধারিত বিমানগুলোর মধ্যে ৫০ শতাংশ বাস্তবায়ন করবে ড্যাসল্ট এবং এর সহযোগী প্রতিষ্ঠান। ভারতে প্রতিরক্ষাখাতের ক্রয় সংক্রান্ত বিধান অনুযায়ী যে কোনো বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে একটি চুক্তির অন্তত ৩০ শতাংশ অর্থ আবার ভারতে বিনিয়োগ করতে হয়। ভারতের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন খাতকে শক্তিশালী করার জন্যই এ নীতি করা হয়েছে।

রাফালে নিয়ে প্রথম ঝড় উঠে, যখন দেশটির প্রধান বিরোধীদল কংগ্রেস বিজেপির বিরুদ্ধে কয়েকজন ব্যবাসায়ীকে অনৈতিক সুবিধা দেওয়ার অভিযোগ আনে। এরমধ্যে অনীল আম্বানির রিলায়েন্স গ্রুপকে নানা ধরনের সুবিধা দেওয়ার সমালোচনা করেন। ব্যক্তিগতভাবে অনিল আম্বানির সাথে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিশেষ সখ্য রয়েছে।

বিজেপি অবশ্য কংগ্রেসের এসব অভিযোগ সরাসরি নাকচ করে দেয়। বিজেপি দাবি করে, ভারতের জনগণকে ভুল পথে নেওয়ার জন্য কংগ্রেস উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এসব অভিযোগ তুলছে। সব অভিযোগ মিথ্যা বলে উড়িয়ে দেওয়া হয়। ফ্রান্সের দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে এখন বিজেপি বলছে, ড্যাসল্টের প্রতিদ্বন্দ্বী কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো এ অভিযোগ তুলছে। তারা ফ্রান্সের সরকারকেও বিব্রত করতে চায়।

ভারত দীর্ঘসময় থেকে রাশিয়ার তৈরি বিমান ব্যবহার করেছে। ২০০১ সালে ভারত সরকার যুদ্ধবিমান উন্নত করার সিদ্ধান্ত নেয়। ২০০৭ সালে দেশটি ১২৬টি যুদ্ধবিমান কেনার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে টেন্ডার ইস্যু করে। ২০০৮ সালে ড্যাসল্ট, বোয়িং এবং সাবের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো ভারতের টেন্ডারে বিড করে। ২০১২ সালে ড্যাসল্ট সবচেয়ে কম দামে বিড দিয়ে শর্টলিস্টে চলে আসে।

ভারতের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান হিন্দুস্তান অ্যারোনটিকস লিমিটেড ভারতের মাটিতেই ১০৮টি জেটবিমান তৈরির জন্য ড্যাসল্টের অফসেট পার্টনার হিসেবে নির্ধারিত হয়। কিন্তু ড্যাসল্ট ও হিন্দুস্তান অ্যারোনটিকস শেষ পর্যন্ত কোনো সমঝোতায় আসতে না পারায় চুক্তিটি বাতিল হয়ে যায়। ২০১৪ সালে বিজেপি নির্বাচনে জয়ী হয়ে আসার আগ পর্যন্ত এ-নিয়ে আর কোনো অগ্রগতি হয়নি।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২০১৫ সালে ফ্রান্স সফরে যান। সে সময় মোদি আগের চুক্তি থেকে সরে এসে নতুন করে ফ্রান্সের ড্যাসল্ট থেকে ৩৬টি রাফালে বিমান কেনার সিদ্ধান্ত নেন।

মিডিয়াপার্টের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, মোদির সরকার ফ্রান্সের সরকারের সাথে আনুষ্ঠানিক চুক্তি করার ১৫দিন আগে ২০১৫ সালের ২৬ মার্চ ড্যাসল্ট ও রিলায়েন্স কোম্পানি গোপনে প্রথম এ-নিয়ে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করে। এর দুইমাস পর দুই দেশের তরফে চুক্তিকে অনুমোদন দেওয়া হয়। ড্যাসল্ট ও রিলায়েন্স তখন প্রকাশ্যে স্টেকহোল্ডার চুক্তি করে। এ দুটি কোম্পানি যৌথভাবে একটি নতুন কোম্পানি চালু করতেও সম্মত হয়। এরপর ২০১৭ সালে দুই কোম্পানি মিলে ড্যাসল্ট-রিলায়েন্স অ্যারোস্পেস লিমিটেড গঠন করে। মিডিয়াপার্ট জানায়, এই যৌথ কোম্পানি প্রতিষ্ঠার পেছনে ড্যাসল্টের কোনো শিল্প স্বার্থ ছিল না। ভারত সরকারের রাজনৈতিক স্বার্থ বাস্তবায়নের অংশ হিসেবেই তারা এ যৌথ উদ্যোগটি কার্যকরে রাজি হয়।