এস-৪০০ নাকি থাড, কোনটি সেরা?


  • আহমেদ বায়েজীদ
  • ২২ জুলাই ২০২১, ০৯:১১

শত্রুর হামলা থেকে কোনো দেশের নিরাপত্তার সর্বাধুনিক আবিষ্কার মিসাইল ডিফেন্স বা এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম। রাশিয়ার আছে সর্বাধুনিক এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম এস-ফোর হান্ড্রেড। এই সময়ের বহুল আলোচিত প্রতিরক্ষাব্যবস্থা। আবিষ্কারের পরই বিশ্বে এস-ফোর হান্ড্রেড বহু আলোচনার জন্ম দিয়েছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের আছে টার্মিনাল হাই অলটিচ্যুড এরিয়া ডিফেন্স বা থাড। যেটি মাঝারি ও স্বল্পপাল্লার ব্যালেস্টিক মিসাইল প্রতিরোধ করতে পারে।

টার্মিনাল হাই অলটিচ্যুড এরিয়া ডিফেন্স বা থাড যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি একটি অ্যান্টি-ব্যালেস্টিক মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম। উড়ে আসা যে কোনো স্বল্প ও মাঝারিপাল্লার ব্যালেস্টিক মিসাইল শনাক্ত করে টার্মিনাল ফেজে থাকা অবস্থায়ই সেটিকে ধ্বংস করতে পারে থাড। ১৯৯১ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় ইরাকের স্কাড মিসাইলের হামলা মার্কিন বাহিনীকে যে বিপদের মুখোমুখি করেছিল, তা থেকে উত্তরণের জন্যই পরে এটি উদ্ভাবন করা হয়েছে।

প্যাট্রিয়টের ব্যর্থতার পরই থাড উদ্ভাবনের কর্মসূচিটি শুরু করেছিল যুক্তরাষ্ট্র সেনাবাহিনী। পরবর্তীতে সেটি দেশটির মিসাইল ডিফেন্স এজেন্সিতে স্থানান্তর করা হয়। আর প্রধান ঠিকাদার হিসেবে এটি নির্মাণ করেছে বিখ্যাত অস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান লকহিড মার্টিন। এছাড়া রেথন, বোয়িংয়ের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোও সাবকন্ডাক্টর হিসেবে যুক্ত এই প্রকল্পের সাথে। শুরুতে ২০১২ সাল নাগাদ থাড অপারেশনে যাওয়ার কথা থাকলেও দ্রুত উন্নয়ন ও নির্মাণ শেষ হওয়ায় ২০০৮ সালেই এটি প্রথমবারের মতো মোতায়েন করা হয়। ওই বছর মে মাসে টেক্সাসের ফোর্ট ব্লিস ঘাঁটিতে প্রথম ইউনিটটি বসানো হয়।

অন্যদিকে ১৯৯০ এর দশকে নির্মিতি এস-৩০০ মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেমকে আরো উন্নত ও কার্যকর রূপ দিয়ে রাশিয়া তৈরি করেছে এস-৪০০। এটি মূলত একিিট সারফেস টু এয়ার মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম। ১৯৯৩ সালে প্রথম এটি নির্মাণের ঘোষণা দেয়া হয়। ১৯৯৯ সালে সফল পরীক্ষার পর ২০০১ সালে মোতায়েনের সময়সীমা ঠিক করা হলেও সেটি পিেিছ যায়।

রুশ সরকারের মালিকানাধীন ফাকেল মেশিন-বিল্ডিং ডিজাইন ব্যুরো এটির নির্মাতা। ২০০৭ সালের ১ জুলাই রাশিয়ার রাজধানী মস্কো ও এর আশাপাশের এলাকার নিরপত্তার জন্য প্রথম এই মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম মোতায়েন করা হয়। ট্রাকের ওপর স্থাপিত এর প্রতিটি ইউনিটে থাকে ৯টি মিসাইল লঞ্চার, ১২০টি মিসাইল এবং কমান্ড ও সাপোর্ট ভেহিকেল। এস-৪০০ দুই স্তরের ডিফেন্স সিস্টেম তৈরি করতে সক্ষম।

যুক্তরাষ্ট্রের থাড মূলত ব্যালেস্টিক মিসাইল প্রতিরোধের জন্য তৈরি। থাড ২০০ কিলোমিটার উচ্চতায় থাকা অবস্থায় স্বল্প ও মাঝারি পাল্লার ব্যালেস্টিক মিসাইল ধ্বংস করতে পারে। থাডের প্রতিটি ইউনিটে থাকে চারটি বিভাগ। লঞ্চার, ইন্টারসেপ্টর, রাডার ও ফায়ার কন্ট্রোল ইউনিট। প্রতিটি ইউনিটে থাকে ছয়টি লঞ্চার ভেহিকেল। প্রতিটি ভেহিকেল ৮টি করে মিসাইল ছুড়তে পারে।

থাডও ট্রাকের ওপর স্থাপন করা একটি মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম। যে কারণে সুবিধামতো যে কোনো জায়গায় নেয়া এবং দ্রুত সক্রিয় করার সুবিধা রয়েছে এতে। এটিতে ব্যবহার করা হয় হিট-টু কিল সিস্টেম। যা বিস্ফোরকের পরিবর্তে গতিশক্তিতে মিসাইল প্রতিরোধ করে। এক্স-ব্যান্ড রাডার এক হাজার কিলোমিটার দূরে থাকতেই ছুটে আসা মিসাইল শনাক্ত করে মিসাইল ইন্টারসেপ্টরকে তথ্য দেয়। এরপর এটি টার্মিনাল ফেজে থাকা অবস্থায়ই ব্যালেস্টিক মিসাইলকে ধ্বংস করতে পারে। শব্দের চেয়ে আটগুন গতিতে ছুটে যায় থাডের ছোড়া মিসাইল।

এস-৪০০ ডিফেন্স সিস্টেম ৪০০ কিলোমিটার পর্যন্ত টার্গেট ধ্বংস করতে পারে। এটি এই মূহুর্তে সবচেয়ে উন্নত সারফেস টু এয়ার মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম। ব্যালেস্টিক মিসাইল, ক্রুজ মিসাইল ছাড়াও শক্রুর যুদ্ধ বিমান কিংবা ড্রোনও সনাক্ত করে ধ্বংস করতে পারে এস-৪০০। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের এফ-থার্টি ফাইভ ফাইটার জেটকেও আটকাতে পারবে এটি। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের থাড শুধুই ব্যালেস্টিক মিসাইল ধ্বংস করতে পারে। থাডের আরেকটি বৈশিষ্ট হচ্ছে এটি অনেক বেশি উচুতে টার্গেটে আঘাত হানে, সেটি নূন্যতম ৪০ থেকে ৫০ কিলোমিটার।

যে কারণে এই মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম ফাইটার জেট কিংবা লং রেঞ্জ ট্যাকটিক্যাল এয়ারক্রাফটের বিপক্ষে কাজ করবে না। তাই ব্যালেস্টিক মিসাইল ছাড়া অন্য আক্রমণের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রকে নির্ভর করতে হয় তার প্যাট্রিয়ট মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেমের ওপর। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের থাড ও প্যাট্রিয়টের যে কাজ তা রাশিয়ার এস-৪০০ একাই করতে পারে।

এস-৪০০ এর একটি ইউনিটে থাকে ৮টি লঞ্চার ও ১১২টি পর্যন্ত মিসাইল। এটি এক সাথে ৮০টি টার্গেট শনাক্ত করতে পারে, আক্রমণ করতে পারে ৩৬টি টার্গেটে- যা বিশ্বের আর কোনো ডিফেন্স সিস্টেমের পক্ষে সম্ভব নয়। এটির রেসপন্স টাইম ৯ সেকেন্ড, অর্থাৎ মিসাইল সনাক্ত করা এবং পাল্টা মিসাইল ছোড়ার জন্য ৯ সেকেন্ড সময়ই যথেষ্ট। এরপর শব্দের চেয়ে ১৫ গুণ বা প্রায় প্রতি সেকেন্ডে ৫ কিলোমিটার গতিতে এর অ্যান্টি ব্যালেস্টিক বা অ্যান্টি এয়ারক্রাফট মিসাইল উড়ে যায় টার্গেটের রদিকে। এস-৪০০ তিন ধরনের মিসাইল ছুড়তে সক্ষম, যার কারণে এটি তৈরি করতে পারে তিন স্তরের নিরাপত্তা বলয়। এছাড়া রাশিয়ার তৈরি অন্যান্য এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের সাথেও তথ্য আদান প্রদান করতে পারে এটি।

শক্তিশালী রাডার ব্যবহারের কারণে ডিটেকশন রেঞ্জ বা টার্গেট সনাক্ত করার ক্ষমতার দিক দিয়ে এগিয়ে আছে যুক্তরাষ্ট্রের থাড। একটি এক হাজার কিলোমিটার দূরে থাকতেই টার্গেট সনাক্ত করতে পারে, এস-৪০০ যা ৬০০ কিলোমিটারের বেশি দূরত্বে পারে না। সনাক্ত করা টার্গেট ৭০০ কিলোমিটারের ভেতর এলে থাড সিদ্ধান্ত নিতে পারে, এস -৪০০-কে অপেক্ষা করতে হয় ৪০০ কিলোমিটারের মধ্যে আসা পর্যন্ত।

এস ফোর হান্ড্রেডের মিসাইল ছোড়া হয় সোজা উপরের দিকে, যে কারণে একটি ৩৬০ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে যেকোনো দিকের টার্গেটে পৌছতে পারে। অন্যদিকে থাডের কাঠামো কোনাকুনি হওয়ার কারণে এর ফায়ার রেঞ্জ সীমিত।

থাড অনেক ব্যয়বহুল একটি প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম। একটি থাড সিস্টেমের দাম ৮০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। অন্য দিকে এস-৪০০ ব্যাটারির প্রতিটি ইউনিটের দাম ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। থাড সিস্টেমে টার্গেট সনাক্ত করার জান্য যে টিপিওয়াই অ্যারে রাডার ব্যবহার করা হয়েছে, সেটি খুবই ব্যয়বহুল। যে কারণে এই প্রতিরক্ষা সরঞ্জামটির নির্মাণ খরচ বেড়ে গেছে।

থাড বানানোই হয়েছে ব্যালেস্টিক মিসাইল প্রতিরোধের জন্য। অন্য দিকে এস-৪০০ এর মূল কাজ বিমান, ড্রোন ও ক্রুজ মিসাইল প্রতিরোধ করা। তবে এটি তার রেঞ্জের মধ্যে এলে ব্যালেস্টিক মিসাইলও প্রতিরোধ করতে পারে। দুটির কাজের এই ভিন্নতার কারণে অনেক সামরিক বিশ্লেষক থাড ও এস-৪০০-এর মাঝে তুলনা করতে রাজি নন।

বর্তমানে রাশিয়া, চীন, বেলারুশ ও তুরস্ক এস-৪০০ ব্যবহার করছে। আলজেরিয়াকে এই ডিফেন্স সিস্টেম দেয়া হয়েছে বলেও শোনা যায়। ভারত ও সৌদি আরব একটি কেনার জন্য চুক্তি করেছে। সৌদি আরব অবশ্য থাড কিনতেও আগ্রহী। সিরিয়ার যুদ্ধে এস-৪০০ ব্যবহার করেছে রাশিয়া। এস-৪০০-কে আরো উন্নত করে এর নতুন একটি সংস্করণ আনবে শীঘ্রই রাশিয়া। যার নাম দেয়া হয়েছে এস-৫০০। এই সংস্করণটির সফল পরীক্ষা ইতোমধ্যেই শেষ হয়েছে। ২০২১ সালে এটি মোতায়েনের কথা থাকলেও সেটি অবশ্য পিছিয়ে যেতে পারে।

অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের থাড এখনো পর্যন্ত কোনো যুদ্ধে নামেনি নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দিতে। দক্ষিণ কোরিয়া, ইসরাইল, রোমানিয়া ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে এটি মোতায়েন করা হয়েছে এখন পর্যন্ত। পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় মার্কিন দ্বীপ গুয়ামে উত্তর কোরিয়ার হামলার হুমকির পর থাড মোতায়েন করা হয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ায় থাড মোতায়েনের সময় চীন প্রবল বিরোধীতা করেছিল। দক্ষিণ কোরিয়ার সাধারণ নাগরিকরাও এর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছি।

অপেক্ষাকৃত কম শক্তিধর দেশগুলোর জন্য এস-৪০০ হান্ড্রেড একটি গেমচেঞ্চার ডিফেন্স মেশিন হয়ে উঠতে পারে। ধরা যাক, ভারত যদি এই ডিফেন্স ব্যাটারি মোতায়েন করে তাহলে পাকিস্তানের মিসাইল কিংবা ফাইটার জেটের বিপরীতে তারা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠতে পারে। কারণ এস-৪০০-কে চ্যালেঞ্জ জানানো বা এটিকে ফাঁকি দেয়ার মতো কোনো প্রযুক্তি পাকিস্তানের হাতে নেই। সেক্ষেত্রে পাকিস্তানের নীতি নির্ধারকদের বিকল্প চিন্তা করতে হবে এটিকে মোকাবেলার জন্য।