কৃষ্ণসাগরে মুখোমুখি যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া


  • আহমেদ বায়েজীদ
  • ১৭ জুলাই ২০২১, ১৪:২৪

কৃষ্ণসাগর অঞ্চলে বেশ কিছুদিন থেকে মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ক্রিমিয়া উপদ্বীপের কাছে ন্যাটোর নৌমহড়ায় আপত্তি তুলেছে রাশিয়া। এমনকি দুটি জাহাজের উদ্দেশ্যে সতর্কতামূলক গুলিও চালিয়েছেন রাশিয়ার সৈন্যরা। এরপর পাল্টা বিমানহামলার মহড়াও করেছেন নিজেরা। যে কারণে দুই পরাশক্তির মাঝে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে ওই অঞ্চলে। মূলত, ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব ও কৃষ্ণসাগরে আধিপত্য বিস্তার নিয়েই এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। যেখানে কোনো পক্ষই ছাড় দিতে নারাজ।

কৃষ্ণসাগরে পাল্টাপাল্টি মহড়া নিয়ে উত্তেজনা চলছে ন্যাটো ও রাশিয়ার মাঝে। কোনো পক্ষই নিজেদের অবস্থান থেকে সরে আসতে নারাজ। যার ফলে ওই অঞ্চলে বড় ধরনের সামরিক উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে। এর সাথে জড়িয়ে আছে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ইউক্রেন। গত কয়েক সপ্তাহ থেকে রাশিয়ার সেনারা ব্রিটিশ ও ডাচ সেনাদের সাথে মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছেন।

২০১৪ সালে রাশিয়ার দখল করে নেওয়া ইউক্রেনের ক্রিমিয়া উপদ্বীপ সংলগ্ন সমুদ্রসীমায় দুই পক্ষের অবস্থান নিয়ে এবারের উত্তেজনা। রাশিয়া ওই সমুদ্রসীমাকে নিজেদের বলে দাবি করলেও ন্যাটো জোটভুক্ত দেশগুলো ক্রিমিয়া দখলের বিরোধিতা করছে এখনও এবং তারা ওই সমুদ্রসীমাকে ইউক্রেনের বলেই মনে করেন। যে কারণে ন্যাটোভুক্ত কয়েকটি দেশ ওই অঞ্চলে নৌমহড়া চালাতে গেলে রাশিয়া আপত্তি তোলে।

রাশিয়া বলছে, সমুদ্রসীমা লঙ্ঘন করার কারণে তারা ব্রিটিশ ডেস্ট্রয়ারের উদ্দেশে সতর্কতামূলক গুলি চালিয়েছে, যদিও ব্রিটেনের সেনারা তা স্বীকার করেননি। এছাড়া, নেদারল্যান্ডসের একটি ফ্রিগেটের কিছুটা দূরে হুশিয়ারিমূলক হামলা চালিয়েছে রুশ যুদ্ধবিমান। এরপরও ন্যাটো ওই এলাকায় মহড়ার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেনি। সী ব্রিজ নামে তাদের মহড়ায় অংশ নিয়েছেন ৩২টি দেশের ৫ হাজার সেনা, ৩২টি জাহাজ ও ৪০টি যুদ্ধবিমান।

এর কয়েকদিন পরই কৃষ্ণসাগর এলাকায় শত্রুর জাহাজে হামলার মহড়া চালিয়েছে রুশ যুদ্ধবিমান। রুশ কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে আরআইএ বার্ত সংস্থার খবরে বলা হয়, শত্রু নৌযানে মিসাইল ও বোমা হামলার মহড়া দিয়েছে রাশিয়ার সু-থার্টি ফোর, সু-থার্টিসহ বেশ কয়েক ধরনের ফাইটার জেট।

অনেক দিন ধরেই পশ্চিমাদের সাথে রাশিয়ার উত্তেজনার একটি হটস্পট হয়ে আছে কৃষ্ণসাগর। ইউক্রেনের সাথে রাশিয়ার সঙ্ঘাতের পর সেটি আরো বেড়েছে। ২০১৪ সালে কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ক্রিমিয়া উপদ্বীপ রাশিয়া দখল করে নিয়েছে, যেখানে ছিলো ইউক্রেনের একটি নৌঘাঁটি এবং উপকূলীয় গুরুত্বপূর্ণ শহর সেবাস্তোপোল। সামরিকভাবে দুর্বল ইউক্রেনের শক্তি ছিলো না রাশিয়াকে বাধা দেয়ার। তাইওই সময় রাশিয়া প্রায় বিনাবাধায় ক্রিমিয়া দখল করে। রাশিয়ার হাত থেকে ওই অঞ্চলের দেশগুলোকে বাঁচাতে সেখানে তৎপরতা বাড়ায় সামরিক জোট ন্যাটো। তার পর থেকেই কৃষ্ণসাগরে দুই পক্ষের মাঝে আধিপত্য বিস্তারের লড়াই চলছে।

নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করেন কৃষ্ণসাগর এমন একটি পয়েন্ট যা যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া উত্তেজনার চূড়ান্ত বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে। তবে এই উত্তেজনা নিয়ে যে উভয় পক্ষই ভীত ও উদ্বিগ্ন তাতে কোনো সন্দেহ নেই বলে মনে করেন অনেক বিশ্লেষক। আবার নিজ নিজ অবস্থানেও তারা অনড়।

ন্যাটোর একজন কর্মকর্তা নিউজউইক ম্যাগাজিনকে বলেন, কৃষ্ণসাগরে ন্যাটোর যুদ্ধজাহাজ নিয়মিত আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলাচল করে। বছরের দুই তৃতীয়াংশ সময় তারা নিয়মিত ওই এলাকায় অবস্থান করে। ন্যাটো ইউক্রেনের স্বার্বভৌমত্ব ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত স্থল ও নৌ সীমান্তকে সমর্থন করে। রাশিয়ার অবৈধভাবে ক্রিমিয়া দখল করে নেয়াকে আমরা সমর্থন করিনা এবং এই দখলদারিত্বেও নিন্দা জানাই।

রাশিয়া তার দখলকৃত এলাকা এবং এর আশপাশের সমুদ্রসীমার দাবি ছাড়তে নারাজ। ২০১৯ সালে তারা ওই সমুদ্রসীমা থেকে ইউক্রেনের তিনটি নৌ যান ও ২৪ নাবিককে আটক করেছে। মোট কথা ক্রিমিয়া দখলের পর থেকেই রাশিয়া ওই অঞ্চলে একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে।

ন্যাটো জোটের সৈন্যরাও ওই অঞ্চলে নিয়মিত মহড়া চালায়; কিন্তু এবার দুই পক্ষ অনেকটা মুখোমুখি অবস্থানে চলে এসেছে। সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ষষ্ঠ নৌ বহরের মুখপাত্র লেফট্যানেন্ট কর্নেল ম্যাথু কোমার বলেন, সী ব্রিজ মহড়া প্রমাণ করে যুক্তরাষ্ট্র কৃষ্ণসাগরে মুক্ত ও স্থিতিশীল একটি পরিবেশের বিষয়ে কতটা অঙ্গীকারাবন্ধ। ৩০ দেশের এই সম্মিলিত মহড়ার অর্থ হচ্ছে আন্তর্জাতিক মহল কৃষ্ণসাগরকে স্থিতিশীল দেখতে চায়। এই মহড়া কোনো কিছুর জবাব নয়, এটি মিত্রদের মাঝে সংহতি বৃদ্ধির জন্য আয়োজন করা হয়েছে।

অন্যদিকে কৃষ্ণসাগর অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র বা পশ্চিমাদের কোনো ধরনের তৎপরতাকে ক্রিমিয়ার ওপর তার নিয়ন্ত্রণের জন্য চ্যালেঞ্জমনে করে রাশিয়া। যুক্তরাষ্ট্র তাদেরকে ঘিরে ফেলতে চাইছে বলে রাশিয়ার বহু যুগ ধরে যে ভয় কাজ করে, সেটিও বেড়ে যায় কৃষ্ণসাগরে ন্যাটোর তৎপরতা বাড়তে দেখলে।

ইউক্রেন এখনো ক্রিমিয়া উপদ্বীপকে নিজেদের বলে দাবি করে এবং ফিরে পেতে চায়। রাশিয়া কখনোই তা স্বেচ্ছায় ফেরত দেবে না, আবার পশ্চিমারাও যে এর জন্য রাশিয়ার সাথে যুদ্ধ শুরু করে দেবে তার সম্ভাবনাও নেই। উল্টো পূর্ব ইউক্রেনের বিচ্ছিন্নতাবাদ নিয়ে টেনশনে আছে ইউক্রেন। যে কারণে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের জন্য রাশিয়াকে চাপে রাখার একটি উপায় হচ্ছে কৃষ্ণসাগরে সামরিক তৎপরতা অব্যাহত রাখা।

এতে পূর্ব ইউক্রেনেও অশান্তি সৃষ্টি হবে না আবার যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্যও পূরণ হবে। কারণ ওয়াশিংটন কিছুতেই রাশিয়াকে কৃষ্ণসাগরে একক আধিপত্য বিস্তার করতে দিতে রাজি নয়। একই সাথে রাশিয়ার আরো কিছু ভূরাজনৈতিক উচ্চাকাক্সক্ষার প্রতিও চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেবে কৃষ্ণসাগর পরিস্থিতি। রাশিয়ার তেল, গ্যাস বাণিজ্যের কেন্দ্র কৃষ্ণসাগর। একই সাথে ভূমধ্যসাগর সহ ইউরোপ, আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের আশপাশে শক্তি দেখানোর একমাত্র রুটও এটি।

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন কৃষ্ণসাগরের সাম্প্রতিক ঘটনাকে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের উস্কানি হিসেবে অভিহীত করেছেন। পুতিন মনে করেন, ইউক্রেন কিংবা আশপাশের এলাকায় ঘাঁটি স্থাপনের পরিকল্পনা নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তিনি বলেন, তারা জানে যে, এই বিরোধে জিততে পারবে না। আমরা নিজস্ব ভূখন্ড রক্ষায় লড়াই করবো। হাজার মাইল দূরে তাদের ভূখণ্ডের কাছে যুদ্ধ করতে যাবে না। যেভাবে তারা এসেছে আমাদের ভূখণ্ডের কাছে।

পুতিনের এই কথায় স্পষ্ট যে, রাশিয়া কৃষ্ণসাগর এলাকায় তার আধিপত্য ধরে রাখতে কতটা মরিয়া। ক্রেমলিন বিষয়টিকে দেখছে রাশিয়ার ভূখণ্ডের নিরাপত্তা হিসেবে।আর রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা বলেছেন, এবারের ঘটনার মাধ্যমে এক তরফাভাবে যুক্তরাষ্ট্রের নেৃতত্বে বিশ্বের আরও একটি অঞ্চলেক অস্থিতিশীল ও হুমকির মুখোমুখি করা হচ্ছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমান পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণের চাবি আছে উভয় পক্ষের হাতে। আটলান্টিক কাউন্সিলের সিনিয়র ফেলো মার্ক সিমাকভস্কির মতে এই পরিস্থিতি মূলত মস্কো ও ওয়াশিংটনের মাঝে একটি কূটনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক দৌড়ঝাপ। এখানে ভøাদিমির পুতিন চাইছেন, পশ্চিমাদের ফেরত পাঠিয়ে রাশিয়ার আধিপত্য ধরে রাখতে। আর পশ্চিমারা ইউক্রেনের স্বার্বভৌমত্বের প্রতি সমর্থনের পাশাপাশি চাইছে অবাধ ও মুক্ত একটি কৃষ্ণ সাগর।

জুন মাসে ব্রাসেলসে ন্যাটো জোটের সম্মেলনের পর মিত্র দেশগুলো কৃষ্ণসাগরে তাদের উপস্থিতির বিষয়ে ঐক্যমত্য প্রকাশ করেছে। এছাড়া ওই অঞ্চলের ন্যাটো সদস্য নয় এমন দেশ হয়েও ইউক্রেন, জর্জিয়া ও মলদোভা ন্যাটোর সাথে সংহতি প্রকাশ করেছে। কৃষ্ণসাগর অঞ্চলের ছোট ও কম শক্তির দেশগুলো রাশিয়ার আগ্রাসনের ভয়ে আছে। যে কারণে তারা ন্যাটোর দিকে ঝুকেছে। জর্জিয়া ও ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগ দেয়ার পথে অনেকটা অগ্রসরও হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও তার পূর্বসূরী ডোনাল্ড ট্রাম্পের চেয়ে রাশিয়া ইস্যুতে অনেক বেশি কঠোর হবেন বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে। নির্বাচনি প্রচারণার সময়ই ট্রাম্পের রাশিয়ার প্রতি দুর্বলতা নিয়ে সমালোচনা করেছিলেন বাইডেন। এমনকি পুতিনকে খুনি হিসেবেও আখ্যায়িত করেছেন। বাইডেন ইতোমধ্যেই রাশিয়ার গোপন কার্যক্রম নিয়ে সোচ্চার হয়েছেন। এবং সাইবার অ্যাটাক, হত্যা চেষ্টা ও নিজ দেশে ভিন্নমত দমনের বিষয়ে বাইডেন প্রশাসন মস্কোর ওপর অনেকগুলো নিষেধাজ্ঞাও দিয়েছে।

জেনেভায় বাইডেন ও পুতিনের বৈঠকের পর কৌশলগত স্থিতিশীলতার পক্ষে যৌথ বিবৃতি দেওয়া হলেও কৃষ্ণসাগর যে মস্কো ও ওয়াশিংটনের মধ্যে উত্তেজনার পারদ বাড়িয়ে তুলবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। রাশিয়া সব সময়ই মনে করে, যুক্তরাষ্ট্র তার বাড়ির কাছে এসে দাপট দেখাচ্ছে, যেটা অনৈতিক। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, ওই অঞ্চলের দেশগুলোকে রাশিয়ার দখলদারিত্ব থেকে বাঁচানোর দায়িত্ব রয়েছে তারও। উভয় দেশের এই অনড় অবস্থানই কৃষ্ণসাগর অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে। সরাসরি যুদ্ধ না বাঁধলেও এই উত্তেজনা দীর্ঘমেয়াদি হলে তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়তে পারে বিশ্ব রাজনীতির ওপর।