তুরস্ক কেন আফগানিস্তানে থাকতে চায়


  • আহমাদ আব্দুল্লাহ
  • ১৩ জুলাই ২০২১, ১৩:২৯

দুই দশকের যুদ্ধের পর অনেকটা পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। এরইমধ্যে দেশটির সবচেয়ে বড় বিমানঘাঁটি বাগরাম থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনারা চলে গেছেন। আফগান মাটিতে তালেবানদের প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ আরও বেড়েছে। বেশিরভাগ জেলা তাদের নিয়ন্ত্রণে এসেছে। অনেকে আশঙ্কা করছেন, দেশটিতে নতুন করে গৃহযুদ্ধ শুরু হতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে কাবুলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কিছু বিদেশি সৈন্য উপস্থিত থাকার কথা বলা হচ্ছে। এরমধ্যে দেশটির বিমানবন্দরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তুরস্ক-যুক্তরাষ্ট্র ও আশরাফ ঘানি সরকার একমত হয়েছে। কিন্তু তালেবানরা এমন প্রস্তাবে রাজি নন।

মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পর আঞ্চলিক শক্তি হিসাবে আফগানিস্তানে ভূমিকা রাখতে চায় তুরস্ক। তাদের লক্ষ্য কাবুল বিমানবন্দরের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে রাখে। এতে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন আছে। কারণ তাতে পরোক্ষভাবে ন্যাটোর নিয়ন্ত্রণ থেকে যাচ্ছে। দূতাবাস কর্মী ও থেকে যাওয়া অল্পসংখ্যক সৈন্যর আফগান ত্যাগ সহজ হবে।

তালেবানরা এমন প্রস্তাবে মোটেও রাজি নন। তালেবান মুখপাত্র সোহাইল শাহীন তুরস্কের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন টিআরটি ওয়ার্ল্ডকে দেওয়া সাক্ষাতকারে বলেছেন, তারা তুরস্কের সাথে বিভিন্ন সেক্টরে একসাথে কাজ করতে চায়। কিন্তু প্রথমে আফগানিস্তান থেকে ন্যাটো জোটের সব সৈন্য প্রত্যাহার করতে হবে। তুরস্কের সৈন্যরা ন্যাটো জোটের আওতায় অবস্থান করছে। তিনি বলেন, সৈন্য প্রত্যহারের পর আফগানিস্তানের স্বাধীন সরকারের সাথে যে কোনো দেশের সহযোগিতার দিক নিয়ে আলোচনা হবে। তাতে অবশ্যই তুরস্কও থাকবে।

সাম্প্রতিক মাসগুলোতে তুরস্ক আফগানিস্তানে বড় আকারের ভূমিকা রাখতে শুরু করেছে। আফগান সরকার ও তালেবানদের সাথে সমন্বয় করে দেশটিতে আফগানিস্তানে একটি শান্তি প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে আসছে। যদিও তাতে খুব একটা সফলতা আসেনি।

এখন তুরস্ক কাবুল বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ও পরিচালনার প্রস্তাব দিয়েছে। এ বিমানবন্দর দিয়েই পশ্চিমা কূটনীতিক ও ত্রাণকর্মীরা আফগানিস্তানে যাওয়া-আসা করেন। তুরস্ক যদি আফগান বিমানবন্দরের নিরাপত্তা দেওয়ার অজুহাতে শেষ পর্যন্ত আফগানিস্তানে থাকতে পারে তাহলে এর মাধ্যমে ন্যাটোর একটি পদচিহ্ন আফগানিস্তানে থেকে যাবে। সেক্ষেত্রে ন্যাটোর পৃষ্ঠপোষকতা নিয়ে তুরস্ক আফগানিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ কাঠামোর নিরাপত্তা প্রদানের সুযোগ পাবে। তালেবানদের আপত্তি এখানেই। তারা ন্যটোর যে কোনো অবস্থান মেনে নিতে রাজি নয়। যদিও তুরস্ক নিয়ে তাদের কোনো আপত্তি নেই।

গত জুনে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান বেশ আস্থা ও দৃঢ়তার সাথেই ঘোষণা করেছিলেন যে, তুরস্কই হলো একমাত্র নির্ভরযোগ্য রাষ্ট্র যা আফগানিস্তানকে শান্তিপূর্ণ ও স্থিতিশীল রাখতে পারবে। তুরস্ক এমন একটি সময়ে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা দেয়ার প্রস্তাব দেয় যখন রাশিয়ার কাছ থেকে এস-ফোর হান্ড্রেড মিসাইল সিস্টেম কেনাকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আঙ্কারার সম্পর্কে ব্যাপক টানাপড়েন চলছে।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, তুরস্ক খুব কৌশল করেই আফগানিস্তানে থাকার প্রস্তাব দিয়েছে। এতে একদিকে যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তুরস্কের সম্পর্ক উন্নত হবে অন্যদিকে, ন্যাটোর অভ্যন্তরেও তুরস্কের অবস্থান সংহত হবে।

বিগত এক যুগ ধরে আঙ্কারা বেশ সম্প্রসারণমূলক পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। ন্যাটোতেও তুরস্কের প্রভাব এ সময়ে অনেকটা বেড়েছে। অনেকে ধারনা করছেন আফগান সরকার ও তালেবানদের মধ্যে চিন্তা ও অবস্থানগত দুরত্ব রয়েছে। তুরস্ক তা নিরসনে ভূমিকা রাখতে পারে। তুরস্ক মুসলিম রাষ্ট্র হওয়ায় আফগান সরকার ও তালিবান উভয় পক্ষের কাছেই দেশটির গ্রহনযোগ্যতা রয়েছে। যা অন্য কোনো ন্যাটো দেশের নেই।

অপরদিকে আফগানিস্তানের প্রতিবেশি রাষ্ট্র পাকিস্তানের সাথেও তুরস্কের উষ্ণ সম্পর্ক রয়েছে। যা আঞ্চলিক উত্তেজনা প্রশমন ও দ্বিপাক্ষিক সংলাপ আয়োজনে সহায়ক হতে পারে।

তালেবানদের সাথে রয়েছে পাকিস্তানের ঘনিষ্ট সম্পর্ক। ইসলামাবাদ চাইলে যে কোনো পরিস্থিতিতেই আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে গ্যারান্টর হতে পারে।

কাবুল ভিত্তিক থিংকট্যাংক ইন্সটিটিউট অব ওয়ার এন্ড পিস স্টাডিজের পরিচালক এনায়েত নাজাফিজাদা মনে করেন তুরস্কই একমাত্র দেশ যারা আফগানিস্তানের সকল রাজনৈতিক মহলকে একসাথে কাজ করার ক্ষেত্রে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। শান্তি ও মীমাংসা রক্ষায় একটি চুড়ান্ত কাঠামো ও প্রেক্ষাপট প্রস্তুত করতে পারে।

আফগান সরকার ও তালিবান কর্তৃপক্ষের মাঝে মধ্যস্থতা করার মাধ্যমে তুরস্ক প্রমাণ করতে পারে যে সামরিক সমাধানের চেয়ে রাজনৈতিক সমাধান অনেক বেশি কার্যকর ও স্থায়ী। তবে কাজটি মোটেও সহজ নয়। কারন তালেবানরা বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে চলে এসেছে। সেপ্টেম্বরের পর তারা কাবুল নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার চেষ্টা করবে। ইতোমধ্যে অনেক স্থানে আফগান সরকারের সৈন্যরা পক্ষ থেকে তালেবানদের সাথে যোগ দিচ্ছে। স্বাভাবিক তারা চাইবে দেশটির ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পর নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনা করতে।

তুরস্কের প্রতিরক্ষামন্ত্রী হুলুসি আকার সম্প্রতি বলেছেন , আফগানিস্তানে নতুন করে আর কোনো সেনা মোতায়েনের পরিকল্পনা তুরস্কের নেই। আফগানিস্তানে এখন তুরস্কের ৫শ সেনা দায়িত্ব পালন করছে। তুরস্কের এখন লক্ষ্য কোনো ভাবে বিমানবন্দরটির নিরাপত্তার দায়িত্ব নেয়া। এ ক্ষেত্রে তুরস্কের কিছু ভূরাজনৈতিক লক্ষ্য আছে। তাতে পাকিস্তানের সমর্থন আছে কিনা তা এখনো স্পষ্ট নয়।

আঙ্কারা চেষ্টা করছে কাবুল বিমানবন্দরের নিরাপত্তা বিধানের সুযোগে ন্যাটোর ওপর আরো চাপ সৃষ্টির করে সর্বোচ্চ পরিমান লজিস্টিক ও অর্থনৈতিক সুবিধা নিশ্চিত করা। পাশাপাশি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রেও তুরস্ক এ ইস্যুকে কাজে লাগাতে চায়। একই সাথে, তুরস্ক তার কিছু আন্তর্জাতিক মিত্রকে কাজে লাগিয়ে তুরস্কের নেতৃত্বাধীন একটি বহুজাতিক সেনাবাহিনীও গড়ে তুলতে চায়। যারা কাবুল বিমানবন্দরের নিরাপত্তা বিধান করবে।

সম্প্রতি এরদোয়ান বলেছেন, পাকিস্তান ও হাঙ্গেরীর সেনাবাহিনী তুর্কি সেনাবাহিনীর আওতায় কাজ করবে। কাবুল বিমানবন্দরের নিরাপত্তা প্রদানে তারা সহায়তা করবে। এরদোয়ানের এ ঘোষণার আঞ্চলিক ও ভুরাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের দিকটি খুব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। পূর্ব ইউরোপে তুরস্কের সবচেয়ে মিত্র দেশ হিসেবে হাঙ্গেরি পরিচিত।

তুরস্কের ব্যাপারে সাধারন আফগানদের এক ধরনের দূর্বলতা রয়েছে। আফগানিস্তানের সাথে তুরস্কের রয়েছে ঐতিহাসিক সম্পর্ক। ন্যটোর আওতায় আফগানিস্তানে তুরস্কের সৈন্যরা কখনো তালেবানদের টার্গেটে পরিনত হয়নি। তুর্কি সৈন্যরা যাতে হতাহত না হয় সে ব্যাপারে তালেবানরা সর্তকতার সাথে এড়িয়ে যেতো।

তালেবানরা এখন যে অবস্থান নিয়েছে তাতে তুরস্কের বহুজাতিক কোনো বাহিনী গঠনের পরিকল্পনার বাস্তবায়নের তেমন সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। এছাড়া তুরস্কের মধ্যস্থতায় আশরাফ ঘানি সরকারের সাথে তালেবানদের কোনো ধরনের সমাঝেতায় যাওয়ার তেমন সম্ভাবনা নেই। এছাড়া আফগানিস্তানের মাটিতে পাকিস্তান সেনা মোতায়েনে রাজি হবে কিনা তাও নিশ্চিত নয়। কারন ভবিষ্যতে এতে পাকিস্তানের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়তে পারে।

অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, আফগানিস্তানকে সামনে রেখে এরদোয়ান একটি ইসলামিক কোয়ালিশন তৈরি করতে চাইছেন। যার অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে তুরস্কের আঞ্চলিক আধিপত্য ও প্রভাব সংহত করা। ন্যাটোর সদস্য হাঙ্গেরিকে তারা রাখতে চাইছেন যাতে এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন না ওঠে। তবে এরদোয়ানের এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন বেশ জটিল। তা করতে হলে তালেবানদের আস্থায় নিয়ে করতে হবে।

এবার তালেবানরা অনেক বেশি কূটনৈতিক দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। কাতারে যে আলোচনা শুরু হয়েছিলো শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্য প্রত্যহারের মাধ্যমে তা চূড়ান্ত রূপ পেয়েছে। তালেবানরা বেশ ভালোভাবে দরকষাকষি করেছে। পুরো আফগানিস্তানের ওপর ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে চলছে। তাদের সরকারের বিভিন্ন জাতি গোষ্টীর প্রতিনিধিত্ব বাড়ানো হয়েছে। এই প্রথম হাজরা শিয়া সম্প্রদায়ের ওপর কোনো ধরনের হামলার ঘটনা ঘটেনি। এমনকি ইরানের মধ্যস্থততায় আলোচনাতেও অংশ নিয়েছে।

এমন পরিস্থিতিতে কাবুল বিমাবন্দরের নিরাপত্তা নিশ্চিতে তুরস্ক কিংবা অন্য কোনো ন্যাটো সৈন্যদের উপস্থিতি তালেবানদের মেনে নেওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই কম। তবে তুরস্কের সাথে তালেবানরা যে ঘনিষ্ট সম্পর্ক বজায় রাখবে, তা নিশ্চিত করে বলা যায়। এক্ষেত্রে পাকিস্তানও চাইবে আফগানিস্তানের ওপর তুরস্কের প্রভাব থাকুক। তবে তা কোনোভাবেই ন্যটোর কাঠামোর মধ্যে থাকবে না।