তুরস্ক থেকে অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র কিনছে বাংলাদেশ

রকেটসান-এর লেজার গাইডেন্স মিসাইল কিট - সংগৃহীত

  • মেহেদী হাসান
  • ০৯ জুলাই ২০২১, ১৬:০২

নতুন উচ্চতায় পৌঁছাতে যাচ্ছে বাংলাদেশ-তুরস্ক সম্পর্ক। প্রতিরক্ষা খাতে দুই দেশ সহযোগিতা বাড়ানোর পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। তুরস্ক বর্তমানে বিশ্বে অন্যতম প্রধান সমরাস্ত্র রপ্তানিকারক দেশ। সমরাস্ত্র বিনিময়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ-তুরস্ক সম্পর্ক নতুন মাত্রা পেতে যাচ্ছে।

সম্প্রতি তুরস্কের কাছ থেকে স্বল্পপাল্লার মিসাইল ডেলিভারি পাওয়ার পর দেশটির সাথে নতুন আরেকটি অস্ত্র ক্রয় চুক্তি করেছে বাংলাদেশ। ২৯ জুন আঙ্কারায় এই চুক্তি স্বাক্ষরের পর তুরস্কের ডিফেন্স ইন্ডাস্ট্রিজের প্রেসিডেন্ট ইসমাইল দেমির এক টুইটবার্তায় বলেন, রকেটসান থেকে বিভিন্ন সরঞ্জাম রপ্তানির জন্য দুই দেশের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে।

তবে বাংলাদেশ কী কী অস্ত্র কেনার চুক্তি করেছে এবং এসব অস্ত্র কখন ডেলিভারি পাবে, সে বিষয়ে বিস্তারিত এখনও প্রকাশ করেনি দুই দেশ। বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ তুরস্ক থেকে যেসব সমরাস্ত্র কেনার চুক্তি করেছে, তার মধ্যে রয়েছে লেজার গাইডেন্স মিসাইল কিট। এটি বাংলাদেশ কিনবে তুরস্কের সমরাস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান রকেটসানের কাছ থেকে। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর এফ-৭ যুদ্ধবিমানে ব্যবহার করার জন্য প্রায় ৫০টি লেজার গাইডেন্স কিট এবং বোমা কিনবে।

তুরস্ক থেকে বাংলাদেশের অস্ত্র কেনার আগ্রহী হওয়ার পেছনে প্রধান কারণ হচ্ছে, এসব অস্ত্রের দাম তুলনামূলক কম এবং আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন। তুরস্ক ন্যাটো সদস্য এবং তারা ন্যাটো মানের আধুনিক অস্ত্র তৈরি করে থাকে। ইউরোপসহ এশিয়া ও আফ্রিকার অনেক দেশের কাছে তুরস্ক সমরাস্ত্র অস্ত্র বিক্রি করে থাকে।

তুরস্কের সাথে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের যৌথ অস্ত্র উৎপাদন নিয়েও আলোচনা চলছে। তুরস্ক বাংলাদেশকে অনেক আগেই অস্ত্র বিক্রি, যৌথভাবে অস্ত্র উৎপাদন এবং প্রয়োজনে প্রযুক্তি হস্তান্তরেরও আকর্ষণীয় প্রস্তাব দিয়েছে। তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসগ্লু ২০২০ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ সফরের সময় এই প্রস্তাব দেন। এমনকি তুরস্কের পক্ষ থেকে যৌথভাবে মিসাইল এবং যুদ্ধবিমান নির্মাণেরও প্রস্তাব রয়েছে বাংলাদেশের কাছে।

বিশ্লেষকদের মতে, ভবিষ্যতে তুরস্কের সাথে বাংলাদেশের নিরাপত্তা সম্পর্ক বৃদ্ধির ভালো সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশের প্রয়োজন এমন অনেক সমরাস্ত্র তুরস্ক তৈরি করছে । এসব অস্ত্র কেনার ক্ষেত্রে তুরস্ক কোনো শর্ত আরোপ করে না। গুলি, গোলাবারুদ, বোমাসহ বিভিন্ন ক্ষুদ্রাস্ত্র ও যন্ত্রাংশ যৌথভাবে দুই দেশ তৈরি করার পরিকল্পনা করছে। বাংলাদেশের ফোর্সেস গোল টুয়েন্টি থার্টির অংশ হিসেবে এসব পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।

সম্প্রতি বাংলাদেশ তুরস্কের কাছ থেকে ডেলিভারি পেয়েছে তুরস্কের রকেটসান নির্মিত টিআরজি-৩০০ মাল্টিপল রকেট লঞ্চার সিস্টেম এবং রকেট। ২০ জুন তুরস্কের টাইগার টি-৩০০ রকেট সিস্টেম হস্তান্তর করা হয়েছে সাভার ক্যান্টনমেন্টে।

তুরস্কের বার্তা সংস্থা আনাদলুর খবরে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনী প্রধান তুরস্কের সাথে বাংলাদেশের নিরাপত্তা সম্পর্ক বৃদ্ধি করতে সম্মত হয়েছেন। এতে বলা হয়েছে, তুরস্ক-বাংলাদেশ সম্পর্ক বর্তমানে নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। বিশেষ করে, সমরাস্ত্র বিনিময়ের ক্ষেত্রে দুই দেশই সামনে এগোনোর বিষয়ে একমত হয়েছে।

তুরস্ক ২০২১ সালের প্রথম চার মাসে ১ বিলিয়ন ডলার মূল্যের অস্ত্র বিক্রি করেছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ এ বছর প্রথম চার মাসে তুরস্কের কাছ থেকে ৬০ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র কিনেছে। ফলে প্রথম চার মাসে তুরস্কের অস্ত্র বিক্রির তালিকায় চতুর্থ স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ।

বাংলাদেশ ডিফেন্স এনালিস্ট ওয়েবসাইটের বরাতে আনাদুলুর খবরে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরিজ ২০১৬ সালে চীনের সহায়তায় প্রথমবারের মতো উদ্যোগ নেয় এয়ার ডিফেন্স এবং অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক মিসাইল তৈরির। কিন্তু ২০২১ সালের আগ পর্যন্ত এ বিষয়ে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। বর্তমানে এ প্রকল্প সামনে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে অন্যদের সহযোগিতার সুযোগ রয়েছে।

বাংলাদেশের নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন আনাদলুকে জানান, তুরস্ক বাংলাদেশকে যৌথভাবে মিসাইল এবং ফাইটার জেট নির্মাণ পরিকল্পনার প্রস্তাব দিয়েছে।

বাংলাদেশ ও তুরস্কের মধ্যে সামরিক সহযোগিতা বাড়াতে দুই দেশের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সফর বিনিময় হচ্ছে। চলতি বছরের মে মাসে বাংলাদেশ নৌবাহিনী প্রধান তুরস্ক সফর করেন। তুরস্কের বিমানবাহিনী প্রধানের আমন্ত্রণে জুন মাসে বাংলাদেশ বিমানবাহনী প্রধান আঙ্কারা সফর করেন।

গত ১৬ জুন বাংলাদেশ নেভি খুলনা শিপইয়ার্ডের সাথে চুক্তি করেছে তিনটি ডাইভিং সাপোর্ট বোট নির্মাণের। ডিফ্সকে-র খবরে বলা হয়েছে, এগুলো নির্মাণ করা হবে তুরস্কের আধুনিক নকশা অনুসারে। বাংলাদেশ আইএসপিআরের তথ্য অনুসারে, তুরস্কের ডিফেন্স ইন্ডাস্ট্রিজ প্রেসিডেন্ট ইসমাইল দেমিরসহ তুরস্কের নৌ এবং বিমানবাহিনীর কর্মকর্তাদের সাথে বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের বৈঠকে জাহাজ নির্মাণ, সাইবার সিকিউরিটি সহযোগিতা বৃদ্ধির বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।

২০২০ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ সফর করেন তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রী মেভলুত কাভোসগ্লু। একই বছর সেপ্টেম্বরে তুরস্ক সফর করেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আবদুল মোমেন। আঙ্কারায় নবনির্মিত বাংলাদেশ দূতাবাসের স্থায়ী ভবন উদ্বোধন অনুষ্ঠান উপলক্ষে তিনি এ সফর করেন।

এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে ভার্চুয়ালি যোগ দেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় তিনি তুরস্কের সাথে বাংলাদেশের গভীর ঐতিহাসিক সম্পর্কের প্রসঙ্গে উল্লেখ করেন। তিনি তার বক্তব্যে ১২০৪ সালে তুর্কি জেনারেল ইখতিয়ার উদ্দীন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির বঙ্গ বিজয়ের কথা উল্লেখ করেন।

শেখ হাসিনা বলেন, তুরস্ক-বাংলাদেশের রয়েছে যৌথ ইতিহাস, মূল্যবোধ এবং বিশ্বাস। রোহিঙ্গা ইস্যুসহ বিভিন্ন বিষয়ে বাংলাদেশের প্রতি তুরস্কের সহযোগিতার হাত বাড়ানোর জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এবং ব্যক্তিগতভাবে তুরস্ককে ধন্যবাদ জানান। বৈরুত বিস্ফোরণে বাংলাদেশি নেভি শিপ তুরস্ক কর্তৃক মেরামত করে দেওয়ার জন্যও তিনি তুরস্ককে ধন্যবাদ জানান । কোভিডসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এরদোয়ানের নেতৃত্বেরও প্রশংসা করেন শেখ হাসিনা।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী দূতাবাস ভবন উদ্বোধনের সময় বলেন, আঙ্কারা এবং ঢাকায় উভয় দেশের স্থায়ী দূতাবাস নির্মাণ দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে সহযোগিতা করবে। দুই দেশের মধ্যে বহুমাত্রিক সম্পর্ক উন্নয়নের আগ্রহ প্রকাশ করে শেখ হাসিনা তখন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান এবং ফার্স্ট লেডি এমিনিকে ঢাকা সফরের আমন্ত্রণ জানান। এর ধারাবাহিকতায় দুই দেশের সম্পর্ক এগিয়ে চলছে।

তুরস্ক বিশ্বের ১৩তম সমরাস্ত্র রপ্তানিকারক দেশ। বিশ্বের শীর্ষ ১০০টি সমরাস্ত্র শিল্পের তালিকায় রয়েছে তুরস্কের সাতটি প্রতিষ্ঠানের নাম। ২০২০ সালে তুরস্ক ২ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলার সমরাস্ত্র রপ্তানি করেছে। তুরস্ককে সমরাস্ত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার লক্ষ্যে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান গ্রহণ করেছেন বিশেষ পরিকল্পনা। বিনিয়োগ করেছেন ৬০ বিলিয়ন ডলার।

তুরস্কের সবচেয়ে বড় সমরাস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান হলো আসেলসান। এটি একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান। বিশ্বের শীর্ষ ১০০টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এর অবস্থান ৪৮তম।

তুরস্কের যে সাতটি প্রতিষ্ঠান ‘ডিফেন্স নিউজ টপ ১০০’ তালিকায় স্থান পেয়েছে সেগুলো হলো- আসেলসান, তার্কিশ অ্যারো স্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ বা টিএআই, বিএমসি, রকেটসান, এসটিএম, এফএনএসএস এবং হাভেলসান।

তুরস্ক যেসব সমরাস্ত্র রপ্তানি করে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- প্রশিক্ষণ বিমান, ড্রোন বিমান, হেলিকপ্টার, মেইন ব্যাটল ট্যাঙ্ক, মিডিয়াম ব্যাটল ট্যাঙ্ক, অ্যান্টি ট্যাঙ্ক ভেহিক্যালসহ বিভিন্ন ধরনের আরমারড ভেহিক্যাল, কমব্যাট ভেহিক্যাল, পিস্তলসহ বিভিন্ন ধরনের ক্ষুদ্রাস্ত্র। জাহাজ নির্মাণশিল্পে উন্নত তুরস্ক বর্তমানে নিজেরা নির্মাণ করছে ফ্রিগেট ও ডেস্ট্রয়ারসহ গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন রণতরী।

নিরাপত্তা ক্ষেত্রে তুরস্ক এবং বাংলাদেশের মধ্যে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এসবও দুই দেশের মধ্যে ভবিষ্যতে সম্পর্ক বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশের কর্মকর্তারা। বাংলাদেশ আশা করছে, করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান ঢাকা সফর করতে পারেন।

বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধ বিচার নিয়ে ২০১২ সাল থেকে তুরস্ক-বাংলাদেশ দীর্ঘ সম্পর্ক তলানিতে পৌঁছায়। তবে সময়ের প্রেক্ষিতে সে অচলাবস্থা কাটিয়ে আবার দুই দেশ ফিরে যাচ্ছে পুরনো ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্কের জায়গায়।