ইরাকে সমরাস্ত্র বিক্রির প্রতিযোগিতা : এগিয়ে যাচ্ছে রাশিয়া


  • আহমদ আব্দুল্লাহ
  • ১১ জুন ২০২১, ১৩:৫৩

মধ্যপ্রাচ্যের সমরাস্ত্র বাজারে এখন প্রতিযোগিতা নতুন রূপ নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের একচেটিয়া বাজারে ঢুকতে চাইছে চীন ও রাশিয়া। রাশিয়ার গণমাধ্যমগুলো দাবি করছে, ইরাক রাশিয়ার তৈরি এস-ফোর হান্ড্রেড এবং এস-থ্রি হান্ড্রেড এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম এবং সুখোই এসইউ-ফিফটি সেভেন যুদ্ধবিমান কেনার কথা ভাবছে। এ খবর নিয়ে চলছে তোলপাড়। ইরাকে এখনও যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্য অবস্থান করছে। যুক্তরাষ্ট্রের দখল করা দেশটির রাজনৈতিক নেতৃত্ব আসলে কি এতটা সাহসের পরিচয় দিতে পারবেন?

সামরিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, মস্কো হঠাৎ করেই ইরাকে অস্ত্র বিক্রির বিষয়ে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। সাম্প্রতিক সময়ে ইরাকের সাথে আঞ্চলিক অন্য দুই পরাশক্তি সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সখ্যতা গড়ে উঠেছে। ইরাকের সংসদে এক বছর আগে রাশিয়া থেকে অস্ত্র কেনার আলোচনা হয়েছিল। কিন্তু এরপর ইরাকের দিক থেকে তেমন একটা আগ্রহের কথা আর জানা যায়নি। হঠাৎ করে এখন রাশিয়ার গণমাধ্যমে এ নিয়ে খবর প্রকাশ হয়েছে। যদিও ইরাকের শীর্ষ কর্মকর্তাদের কেউই রাশিয়া থেকে অস্ত্র কেনাবেচার বিষয়ে কোনো আলোচনার ইঙ্গিত দিতে পারেননি।

এস-থ্রি হান্ড্রেড বা সুখোই বিমান ক্রয়ের বিষয়ে কোনো সমঝোতার চূড়ান্ত খবরও পাওয়া যায়নি। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ইরাক কখনও রাশিয়া থেকে এস-ফোর হান্ড্রেড কেনার কথা চিন্তা করবে না। কারণ, আমেরিকা এতে ভীষণ নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে। আমেরিকার আপত্তিকে তোয়াক্কা না করে ন্যাটোভুক্ত রাষ্ট্র তুরস্ক রাশিয়া থেকে এস-ফোর হান্ড্রেড কেনায় যুক্তরাষ্ট্র এরই মধ্যে তুরস্কের সামরিক শিল্পের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এই বাস্তবতাও ইরাকের সামনে আছে। ইরাকের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র আরও অনেক বেশি স্পর্শকাতর। সেখানে প্রতিপক্ষ রাশিয়ার কাছ থেকে ইরাক অস্ত্র বা ডিফেন্স সিস্টেম ক্রয় করবে- এটি কখনও যুক্তরাষ্ট্র মেনে নেবে না।

গত এপ্রিলে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেনের সাথে ইরাকের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফুয়াদ হুসেইনের একটি ভার্চুয়াল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এ বৈঠকে দুই দেশের শীর্ষ নেতা ইরাক থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের সম্ভাব্য ডেডলাইন নির্ধারণ নিয়ে সংলাপ শুরুর বিষয়ে একমত হন।

২০০৩ সালের মার্চ আসে মার্কিন সেনারা ইরাকের ভূখণ্ডে প্রবেশ করে। সে সময় তারা অভিযোগ তুলেছিল, ইরাকের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের জিম্মায় গণবিধ্বংসী অস্ত্রের মজুদ রয়েছে। মার্কিন সেনারা পরবর্তীতে ইরাক দখল করে। সাদ্দাম হোসেনকে ক্ষমতাচ্যুত করে যদিও কথিত সে গণবিধ্বংসী অস্ত্রের আজও দেখা মেলেনি।

বর্তমানে মার্কিন সেনাসদস্যরা ও তাদের মিত্রবাহিনী ইরাকে প্রশিক্ষনমূলক কাজ করছে। মার্কিন সেনাদের ভূমিকা এখন অনেকটা পরামর্শকের মতো। দুই দেশের নীতি নির্ধারকরা চাইছেন ইরাকি সেনাদেরকে একটি সক্ষম ও কর্মক্ষম অবস্থায় পৌঁছে দিয়ে মার্কিন সেনারা ইরাক ত্যাগ করবে। পাশাপাশি, ইরাকে নতুন করে মার্কিন সেনাবাহিনীর আর কোনো ব্যাটেলিয়ন মোতায়েন না করার বিষয়েও তারা সম্মত হন।

মার্কিন সেন্ট্রাল কমান্ডের কমান্ডার মেরিন জেনারেল ফ্র্যাংক ম্যাকেনজি জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র ধীরে ধীরে মধ্যপ্রাচ্য থেকে সেনা প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের জন্য নতুন উদ্বেগ দেখা দিয়েছে রাশিয়া ও চীন মধ্যপ্রাচ্যে তাদের প্রভাব ও আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করছে। ম্যাকেনজি বার্তা সংস্থা এপির সাথে এক সাক্ষাতকারে স্বীকার করেছেন, মধ্যপ্রাচ্য পরাশক্তিগুলোর প্রতিযোগিতার কেন্দ্রে পরিণত হচ্ছে। ফলে আফগানিস্তান বা ইরাক থেকে সেনা প্রত্যাহারের বিষয়টি আবারো নতুন করে পর্যালোচনা করছে যুক্তরাষ্ট্র। ম্যাকেনজি জানান যুক্তরাষ্ট্র এমন কোনো স্থান ছেড়ে দিয়ে আসতে চায় না, যেখানে প্রতিপক্ষ দেশগুলো আধিপত্য বিস্তারের সুযোগ পায়।

এমন পরিস্থিতির মধ্যে ইরাক অনেকদিন থেকেই প্রতিরক্ষা সামগ্রীর জন্য নতুন দেশের সন্ধান করছে। রাশিয়ার সামরিক কিছু সিস্টেমও ইরাক ব্যবহার করে আসছে। ফ্রান্স থেকে মিরেজ বিমান কেনার জন্যেও ইরাকের প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয় এক সময়ে আলোচনা চালিয়েছে।

বর্তমানে ইরাকের হাতে রাশিয়ার তৈরি পান্টসির-এস ওয়ান মোবাইল অ্যান্টি এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমও রয়েছে। আগামীতে রাশিয়া থেকে বেশ কয়েকটি এমআই-টোয়েন্টি ফোর হেলিকপ্টার গানশিপ কেনার বিষয়েও ইরাকের চিন্তা রয়েছে। এ নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো সমঝোতা হয়নি।

কার্নেগী মিডিল ইস্ট সেন্টারের গবেষক আরাম নারগুইজিয়ানের মতে, ইরাকের বহু পুরনো ও মেয়াদোত্তীর্ণ সিস্টেমগুলো নতুন প্রযুক্তি দিয়ে প্রতিস্থান করার ক্ষেত্রে রাশিয়া বড়ো সম্ভাবনা রয়েছে। ইতোমধ্যেই ইরাক নিয়মিতভাবে রাশিয়ার এট্যাক হেলিকরপ্টার ব্যবহার করছে।

রাশিয়া ইরাকের কাছে বেশ কিছু টি-নাইনটি যুদ্ধট্যাঙ্কও বিক্রি করেছে। ইরাকি সেনাবাহিনী কীভাবে রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুই বিপরীতধর্মী সমরাস্ত্রকে একইসাথে ব্যবহার করবে- তা নিয়ে জটিলতা রয়েছে। রাশিয়া চাইছে ইরাকের কাছে বহুমাত্রিক চতুর্থ বা পঞ্চম জন্মের যুদ্ধবিমান বিক্রি করতে। এসইউ-থার্টি ফাইভের মতো আধুনিক বিমান এবং শক্তিশালী এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম বিক্রি করতেও রাশিয়া আগ্রহী।

ইরাক দীর্ঘদিন ধরেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এফ-সিক্সটিন বিমান ব্যবহার করে আসছে। এ বিমানগুলোর মেরামত ও রক্ষনাবেক্ষন নিয়ে বেশ সংকটে রয়েছে ইরাক। এফ সিক্সটিন বিমানের নির্মাতা প্রতিষ্ঠান লকহিড মার্টিন জানিয়েছে, তারা খুব শীঘ্রই ইরাক থেকে তাদের মেইনটেইনেন্স টিমকে প্রত্যাহার করে নেবে। কারণ হিসেবে তারা বলছে, রক্ষনাবেক্ষন কর্মীরা প্রায়ই ইরাকি মিলিশিয়া বাহিনীগুলোর রকেট হামলার শিকার হচ্ছে। এতে কর্মীরা নিরাপত্তা ঝুঁকিতে রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বিকল্প কোন পন্থায় এ ব্যয়বহুল বিমানগুলোর রক্ষনাবেক্ষন করা হবে এখনো ঠিক করা যায়নি। রাশিয়ার যুদ্ধ বিমান কিনতে ইরাকের আগ্রহের এটিও একটি কারন বলে মনে করা হচ্ছে।

নানামুখী টানাপোড়েনের মুখে পড়ে ইরাক তার আঞ্চলিক পরাশক্তি সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমীরাতের সাথে সম্পর্ক উন্নত করতে চাইছে। বেশ কিছুটা অগ্রগতিও হয়েছে। গত জানুয়ারী মাসে ইরাকের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জুমা ইনাদ সাদোওনের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল সংযুক্ত আরব আমীরাত সফরে যান। সামরিক সহযোগিতা বাড়ানো এই সফরের লক্ষ্য ছিলো। এরপর মার্চ মাসের শেষে সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্স মুহাম্মাদ বিন সালমান ও ইরাকের প্রধানমন্ত্রী মুস্তাফা আল কাদিমির মধ্যে বৈঠক হয়।

এ বৈঠকের পর থেকেই দু দেশ সামরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে নানা প্রক্রিয়াও শুরু করে। সামরিক সহযোগিতা ছাড়াও ইরাক ও সৌদি আরব অর্থনৈতিক সম্পর্ককে আরো এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যও একটি চুক্তি সাক্ষর করে। এ চুক্তির অংশ হিসেবে প্রাথমিকভাবে দুই দেশ যৌথভাবে ৩ বিলিয়ন ডলারের একটি বিশাল তহবিলও গঠন করেছে।

গত মে মাসের শেষে ইরাকের প্রতিরক্ষামন্ত্রী দ্বিতীয়বারের মতো সৌদি আরব সফরে যান। এ সময় উভয় দেশের প্রতিরক্ষা খাতের নীতি নির্ধারকেরা সামরিক সম্পর্ককে সম্প্রসারিত করার প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করেন। ইরাকের প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয় এরই মধ্যে সমরাস্ত্রের মুল্যায়নের মানদন্ড নিরুপন করেছেন। সে হিসেবে তারা নানা দেশ থেকে অস্ত্র ক্রয়ের বিষয়ে বিবেচনা করছেন। রাশিয়াও এরমধ্যে একটি হতে পারে। তবে, এখনো কোনো কিছুই চুড়ান্ত হয়নি।

মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক মার্কিন থিংক ট্যাঙ্ক গালফ স্টেট এ্যানালিটিকস গবেষক থিওডোর কারাসিক মনে করেন, আগামী দিনের যুদ্ধের চিত্র কেমন হবে, তা দূরদৃষ্টির আলোকে নিরুপন করে ইরাকের সমরাস্ত্র বাছাই করতে হবে। কারাসিক এখনো মনে করেন না যে, ইরাক রাশিয়া থেকে এস-থ্রি হান্ড্রেড এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম ক্রয় করার সাহস পাবে। তবে, রাশিয়া থেকে ড্রোন মোকাবেলায় কাউন্টার টেকনোলোজি কিনতে ইরাক আগ্রহী হতে পারে বলে মনে করেন কারাসিক।

ইরাকের জন্য প্রতিরক্ষা সরঞ্জামাদি কেনার ক্ষেত্রে আরেকটি সীমাবদ্ধতা হলো দেশটির আর্থিক সংকট। এ বছরের শুরু থেকেই ইরাকের মুদ্রার হারে ব্যাপক দরপতন ঘটেছে। এ মুহূর্তে ইরাক আদৌ কোনো এয়ার ডিফেন্স কিনতে পারবে কিনা- তা নিয়েও যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। এমনও হতে পারে, ইরাক সরাসরি অর্থ না দিয়ে বরং তার ভূগর্ভস্থ তেল বা গ্যাসের বিনিময়ে অস্ত্র পাওয়ার বিষয়ে কোনো দেশের সাথে চুক্তি করে ফেলতে পারে। যদিও এর আগে চীনের সাথেও ইরাক এরকম একটি চুক্তির চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে।

তেলের বিনিময়ে রাশিয়া সমরাস্ত্র কেনার চুক্তিতে কতটা আগ্রহী হবে তা এখনও স্পষ্ট নয়। এ মুহূর্তে ইরাকের তেল বা গ্যাসের কোনো চাহিদা রাশিয়ার নেই। এছাড়া শুধু অস্ত্র কিনলেই হবে না। নিজস্ব তেল স্থাপনাগুলোর নিরাপত্তা এবং সমুদ্র তলদেশে তেলের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ইরাকি নৌ বাহিনীকেও অনেক বেশি সক্রিয় করতে হবে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অনেক দিন থেকে বলে আসছে , ইরাকের সেনা বাহিনীর নিজস্ব সক্ষমতা তৈরি না হওয়া পর্যন্ত ইরাকের সকল তেল টার্মিনালকে মার্কিন সেনারাই নিরাপত্তা দিয়ে যাবে। ইরাকের তেল স্থাপনার বেশিরভাগই দেশটির দক্ষিনাঞ্চলে এবং সেখানে মার্কিন সেনারা দীর্ঘদিন ধরে অবস্থান করছে।

বাজেট সংকটের কারণে ২০১৪ সাল থেকে ইরাকের তেলের দামেও ব্যাপক পতন দেখা দেয়। করোনা মহামারি শুরু হওয়ার পর সে অবস্থার আরও অবনতি হয়েছে। ইরাকের অর্থনৈতিক অবস্থা এতটাই খারাপ অবস্থায় চলে গিয়েছিল যে, আন্তর্জাতিক বাজার থেকে নাগরিকদের জন্য প্রয়োজনীয় পণ্য কেনার মতো সক্ষমতাও দেশটির ছিল না। তবে দেশটিতে যেভাবে মিলিশিয়া এবং সন্ত্রাসী গোষ্ঠী তৎপরতা বাড়িয়েছে, তাতে কিছু হেলিকপ্টার কেনা জরুরি হয়ে পড়েছে। এ ক্ষেত্রে রাশিয়া তাদের একটি ভালো বাজার হতে পারে।