মিসরের সামরিক শক্তি


  • মেহেদী হাসান
  • ০২ জুন ২০২১, ১৫:৪১

সামরিক শক্তির দিক দিয়ে বর্তমানে বিশ্বে মিসরের অবস্থান ১৩তম। মিসর মাঝারি পাল্লার ব্যালিস্টিক মিসাইলসহ টেকটিক্যাল এবং স্বল্পপাল্লার ব্যালিস্টিক মিসাইলের অধিকারী। মধ্যপ্রাচ্যে মিসরের রয়েছে শক্তিশালী এবং ব্যাপকভিত্তিক এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম। মিসর বিশ্বের প্রথম সারির একটি দেশ, যারা ১৯৬২ সালে ব্যালিস্টিক মিসাইলের সফল পরীক্ষা চালায়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠনের পর থেকে বিভিন্ন কারণে মধ্যপ্রাচ্যের আলোচিত দেশে পরিণত হয় মিসর। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠনের পর থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত চারবারের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে মিসর ছিল নেতৃত্বের ভূমিকায়। ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠনের পর কয়েক দশক পর্যন্ত মিসরের সমর প্রস্তুতি চলে ইসরায়েলকে ঘিরে।

যুক্তরাষ্ট্র-সোভিয়েত ইউনিয়ন স্নায়ুযুদ্ধ, আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ, সুয়েজ খালের ওপর কর্তৃত্বের কারণে মিসর কখনও যুক্তরাষ্ট্র আবার কখনও সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে বাধ্য হয়। এ সময় যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ সমরাস্ত্র সংগ্রহ করেছে মিসর। একই সাথে এ দুটি দেশের সাথে বিভিন্ন সমরাস্ত্র যৌথভাবে তৈরিও করেছে।

মিসর বিভিন্ন দেশের সাথে দীর্ঘকাল ধরে যৌথভাবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সমরাস্ত্র তৈরি করলেও আজ অবধি এককভাবে উল্লেখযোগ্য কোনো সমরাস্ত্র তৈরি করে না। যদিও ৭০ বছরের বেশি সময় ধরে দেশটিতে টানা সামরিক শাসন চলছে। মিসরের সমরাস্ত্র শিল্প উল্লেখযোগ্য নয়। ৫০ ও ৬০-এর দশকে তারা নিজেরা প্রশিক্ষণ বিমান তৈরি করলেও বর্তমানে তাদের সমরাস্ত্র তালিকায় নিজস্ব তৈরি কোনো প্রশিক্ষণ বিমানও নেই। জামাল আব্দেল নাসের ক্ষমতায় আসার পর ১৯৫৬ সালে শুরু করেন ব্যালিস্টিক মিসাইল উদ্ভাবনের কার্যক্রম। ১৯৬২ সালে দেশটি স্বল্প পাল্লার ব্যালিস্টিক মিসাইলের সফল পরীক্ষা চালালেও পরে তা অন্ধকারে ঢাকা পড়ে যায়। বর্তমানে মিসর যেসব ব্যালিস্টিক মিসাইলের অধিকারী, তা উত্তর কোরিয়া এবং রাশিয়ার সাথে যৌথভাবে তৈরি। বর্তমানে মিসরের সমরাস্ত্র মূলত যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ফ্রান্স, জার্মানি এবং রাশিয়া-নির্ভর।

মিসরের মোট সৈন্য সংখ্যা ১৩ লাখ ৩০ হাজার। এর মধ্যে সক্রিয় সৈন্য সংখ্যা ৪ লাখ ৫০ হাজার। রিজার্ভ সৈন্য ৪ লাখ ৮০ হাজার। প্যারামিলিটারি ৪ লাখ। মিসরের বিমান বাহিনীর মোট বিমানের সংখ্যা ১ হাজর ৫৩টি। এর মধ্যে ফাইটার জেট ২৫০টি। ডেডিকেটেড এটাক ৮৮টি। সামরিক পরিবহন বিমান ৫৯টি। প্রশিক্ষণ বিমান ৩৪১টি। স্পেশাল মিশন ১১টি। মিসরের হেলিকপ্টার ৩০৪টি। এটাক হেলিকপ্টার ৯১টি।

মিসরের কাছে ফ্রান্সের ফোর প্লাস জেনারেশন বহুমুখী রেফালে ফাইটার জেট আছে ২৪টি। এটিই মিসরের সবচেয়ে শক্তিশালী আধুনিক ফাইটার জেট। মিসরের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের ফোর্থ জেনারেশন মাল্টিরোল ফাইটার জেট এফ-১৬ রয়েছে ২৩৬টি। ফ্রান্সের মিরেজ ২০০০ এবং মিরেজ ভি ফাইটার জেট রয়েছে ১০৬টি।

রাশিয়ার বহুমুখী ফাইটার জেট মিগ-২৯ রয়েছে ৪৬টি। সোভিয়েত আমলে তৈরি বোমারু বিমান টুপোলেভ টিইউ-১৬ রয়েছে ৩০টি, মাঝারি বোমারু বিমান ইলিউশিন-২৮ রয়েছে ৮০টি।

যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক পরিবহন বিমান সি-১৩০ রয়েছে ৩১টি, সোভিয়েত ইউনিয়নের তৈরি সামরিক পরিবহন বিমান ইলিউষিন-১৪ রয়েছে ৭০টি, মিসরের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের বোয়িং অ্যাপাচি হেলিকপ্টার রয়েছে ৪৬টি, বোয়িং সিএইচ-৪৭ রয়েছে ১৯টি এবং সিকরস্কি পরিবারের হেলিকপ্টার রয়েছে ৫৬টি।

রাশিয়ার কামভ কে-৫২ এটাক হেলিকপ্টার রয়েছে ৪৬টি, মিল মি-৮ এবং মিল মি১৭ অ্যাসল্ট হেলিকপ্টার রয়েছে মোট ৩৪টি।

৫০ এবং ৬০-এর দশকে মিসর একাধিক ধরনের প্রশিক্ষণ বিমান নির্মাণ করত। বর্তমানে তারা ফ্রান্সের সাথে যৌথভাবে লাইট এটাক এবং প্রশিক্ষণ বিমান ড্যাসল্ট-ডরনিয়ার আলফ জেট তৈরি করে। এটি ফ্রান্স এবং জার্মানি উদ্ভাবিত বিমান।
মিসরের বিমান বহরে ফ্রান্সের রেফালে ফাইটার জেট যুক্ত হওয়ার আগে তাদের বিমান শক্তি পুরোপুরি যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়া নির্ভর ছিল।

মিসরের ট্যাঙ্ক সংখ্যা ৩ হাজার ৭৩৫টি। সাজোয়া যান ১১ হাজার। সেলফ প্রপেল্ড আর্টিলারি ১ হাজার ১৬৫টি। টাউড আর্টিলারি ২ হাজার ২০০টি। রকেট প্রজেক্টর ১ হাাজর ২৩৫টি। আসুন জেনে আসি মিসরের সামরিক শক্তির আরো কিছু তথ্য

মিসরের কাছে মিসর-যুক্তরাষ্ট্র যৌথ নির্মিত এম১ আবরাম এবং মিসর-রাশিয়া যৌথ নির্মিত টিউ-৯০, টি-৫৫ মেইন ব্যাটল ট্যাঙ্ক রয়েছে। এ ছাড়া মিসরের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের এম৬০ প্যাটন, সোভিয়েত ইউনিয়নের তৈরি টি-৮০, টি-৬২ মেইন ব্যাটল ট্যাঙ্ক রয়েছে।

মিসরের কাছে মিসর-যুক্তরাষ্ট্র তৈরি প্রায় তিন হাজার আরমারড পারসোনেল ক্যারিয়ার রয়েছে। মিসরের কাছে সোভিয়েত ইউনিয়নের তৈরি এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে যৌথভাবে তৈরি আরমারড পারসোনেল ক্যারিয়ার রয়েছে কয়েক হাজার। এ ছাড়া মিসরের কাছে জার্মানি, ইতালি, ফ্রান্স, ইউক্রেন, দক্ষিন আফ্রিকাসহ আরো বিভিন্ন দেশের সাথে বিভিন্ন ধরনের আরমারড পারসোনেল ক্যারিয়ার রয়েছে।

১৯৫২ সালে মিসরের ক্ষমতায় আসেন জাতীয়তাবাদী নেতা জামাল আব্দেল নাসের। তার উদ্যোগে ১৯৫৬ সালে মিসর স্থাপন করে ব্যালিস্টিক মিসাইল টেস্ট এবং লঞ্চ ফ্যাসিলিটি। মিসর উদ্ভাবন করে আল জাফির এবং আল কাহির নামক স্বল্প পাল্লার ব্যালিস্টিক মিসাইল। কিন্তু পরবর্তীতে রহস্যজনক কারনে এই প্রকল্প আর এগুতে পারেনি। জামাল আব্দেল নাসের ব্যালিস্টিক মিসাইল কর্মসূচি গ্রহণ করেন ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে। অভিযোগ রয়েছে মিসরের এ কর্মসূচি পরবর্তীতে নানা ষড়যন্ত্রের শিকার হয়।

বর্তমানে মিসর উত্তর কোরিয়া এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে যৌথভাবে টেকটিক্যাল ব্যালিস্টিক মিসাইল, মাঝারি পাল্লার ব্যালিস্টিক মিসাইলসহ বিভিন্ন ধরনের মিসাইল তৈরি করেছে।

মিসরের কাছে স্বল্প পরিমান মজুদ রয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়নের স্কাড টেকটিক্যাল ব্যালিস্টিক মিসাইল। মিসর এটি তৈরি করেছে উত্তর কোরিয়ার সহায়তায়।

মিসর-উত্তর কোরিয়া যৌথভাবে তৈরি করছে উত্তর কোরিয়া উদ্ভাবিত হসং ৭ নামক মাঝারি পাল্লার এবং হসং-৬ নামক স্বল্প পাল্লার ব্যালিস্টিক মিসাইল। মিসরের কাছে রয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়ন- মিসর যৌথ নির্মিত ব্যাটল ফিল্ড রেঞ্জ ব্যালিস্টিক মিসাইল।

উন্নত এবং বড় এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যে মিসরের খ্যাতি রয়েছে। মিসরের কাছে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী প্যাট্রিয়ট এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম। এ ছাড়া সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং মিসরের নিজেদের তৈরিও বিভিন্ন ধরনের স্বল্প পাল্লার শক্তিশালী এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম রয়েছে। ওবামা প্রশাসনের সময় মিসর উদ্যোগ নেয় যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে এন্টি শিপ ক্রুজ মিসাইল সংগ্রহের। সে সময় সারফেস টু সারফেস মিসাইল সংগ্রহ করে। মিসরের কাছে শক্তিশালী ক্রুজ মিসাইল আছে বলে মনে করা হয়।

মিসর যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ্ইউনিয়নের সাথে যৌথভাবে তৈরি করেছে বিভিন্ন ধরনের ট্রাক মাউন্টেড ও মোবাইল মিসাইল ও রকেট লঞ্চার সিস্টেম। মিসরের কাছে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের তৈরি বিভিন্ন ধরনের শক্তিশালী সেলফ প্রপেল্ড আর্টিলারি ও সেলফ প্রপেল্ড মর্টার, টাউড আর্টিলারি, ইঞ্জিনিয়ারিং ভিহিক্যাল রয়েছে। মিসর চীনের সাথেও যৌথভাবে টাউড আর্টিলারি তৈরি করেছে। আসুন জেনে নেই মিসরের নৌবাহিনী সর্ম্পকে কিছু তথ্য।

মিসরের মোট রণতরীর সংখ্যা ৩১৬টি। মিসরের হেলিকপ্টার ক্যারিয়ার ২টি। ফ্রিগেটস ৯টি। করভেট ৭টি। সাবমেরিন ৮টি। টহল জাহাজ ৫০টি। মাইন ওয়ার ফেয়ার ২৩টি।

মিসরের নৌ শক্তিও পুরোপুরি বিদেশী সমরাস্ত্র নির্ভর। মিসরের সাবমেরিন জার্মানি এবং চীনের তৈরি। হেলিকপ্টার ল্যান্ডিং ডক ফ্রান্সের তৈরি। ফ্রিগেটগুলো ইতালি, জার্মানি, ফ্রান্স এবং যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি।

মিসর ফ্রান্সের সাথে যৌথভাবে চারটি করভেট নির্মান করেছে। বাকী করভেট দক্ষিন কোরিয়া এবং স্পেনের তৈরি।

কেবল মাত্র মিসাইল বোট আর ফুয়েল ট্যাঙ্কার রয়েছে যা মিসরের নিজেদের তৈরি। আর যুক্তরাষ্ট এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে যৌথভাবে মিসর নির্মান করেছে কিছু টাগ বোট।

তাদের ফাস্ট এটাক রণতরী যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন, রাশিয়া, চীন, ব্রিটেন এবং জার্মানির তৈরি। তাদের রয়েছে চীনের তৈরি ৮টি এন্টি সাবমেরিন রণতরী রয়েছে। মাইন ওয়ারফেয়ার যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের তৈরি।