চীন-ব্রিটেন মুখোমুখি

-

  • মেহেদী হাসান
  • ০২ জুন ২০২১, ১৫:১৮

ব্রিটিশ বিমানবাহী রণতরী এলিজাবেথ কুইন-এর নেতৃত্বে শক্তিশালী এক ক্যারিয়ার স্ট্রাইক দক্ষিণ চীন সাগরে অবস্থান নিতে যাচ্ছে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পতন ও ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানের পর এটি হবে ব্রিটেনের প্রথম সবচেয়ে শক্তিশালী নৌশক্তির প্রদর্শন। সাত মাসের অভিযানে এলিজাবেথ কুইন মহড়া চালাবে বিতর্কিত দক্ষিণ চীন সাগরে। দক্ষিণ চীন সাগরে ক্যারিয়ার স্ট্রাইক গ্রুপ পাঠানোর মাধ্যমে ব্রিটেন সরাসরি যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের সাথে চীনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিল। ব্রিটেনের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে বিবিসিসহ আর্ন্তজাতিক গণমাধ্যমে নানা প্রশ্ন তোলা হয়েছে।

ব্রিটেনের রণতরী পাঠানোর পাল্টা জবাবের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে চীন। ব্রিটেন এমন এক সময় দক্ষিণ চীন সাগরে ক্যারিয়ার স্ট্রাইক গ্রুপ পাঠাচ্ছে, যখন ১ জুলাই চীনা কমিউনিস্ট পার্টির শতবার্ষিকী। ব্রিটিশ বিমানবাহিনী রণতরী এলিজাবেথ কুইন ২০১৭ সালে সার্ভিসে যুক্ত হওয়ার পর এটিই প্রথম অপারেশনাল মিশন।

ক্যারিয়ার স্ট্রাইক গ্রুপে রয়েছে মোট ৯টি রণতরী, ৩২টি ফাইটার জেট এবং তিন হাজার ৭০০ সৈনিক। বিমানবাহী রণতরীর সাথে অন্যান্য যেসব রণতরী রয়েছে সেগুলো হলো রয়াল নেভির দুটি ফ্রিগেট, দুটি ডেস্ট্রয়ার, দুটি সাপ্লাই শিপ, একটি সাবমেরিন। এসকর্ট হিসেবে রয়েছে একটি আমেরিকান ডেস্ট্রয়ার এবং একটি ডাচ ফ্রিগেট। বিমানবাহী রণতরীতে ৩২টি বিমানের মধ্যে ১৮টি যুক্তরাষ্ট্রের ফিফথ জেনারেশন এফ-৩৫ ফাইটার জেট।

ক্যারিয়ার স্ট্রাইক গ্রুপের অভিযান নিয়ে বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের মতো ব্রিটেনও চীনের উত্থানবিরোধী তৎপরতা শুরু করেছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় চীনের ওপর ব্রিটেনের প্রভাব সামান্যই।

ব্রিটেনের সাবেক দুই প্রতিরক্ষামন্ত্রী প্রশ্ন তুলেছেন দক্ষিণ চীন সাগরে ক্যারিয়ার গ্রপ পাঠানো নিয়ে। লর্ড নিকোলাস হাউটন বিবিসিকে বলেছেন, এর কোনো প্রয়োজন ছিল না। অপরদিকে লর্ড ডেভিড রিচার্ড বলেছেন, ব্রিটেনের উচিত তাদের ঘরের পাশে ন্যাটো এবং ইউরো আটলান্টিক এরিয়ায় মনোনিবেশ করা।

ক্যারিয়ার স্ট্রাইক গ্রুপকে ব্রিটেন দেখছে ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ হিসেবে। বরিস জনসনের প্রতিশ্রুতি ছিল ব্রিটেনের নৌবাহিনীকে ইউরোপের সবচেয়ে শক্তিশালী নৌবাহিনীতে পরিণত করা। একে তিনি আখ্যায়িত করেছেন ‘পশ্চাদপসরনের যুগের অবসান’ হিসেবে। ব্রিটিশ রয়াল নেভির পক্ষ থেকে ক্যারিয়ার স্ট্রাইক গ্রুপ মোতায়েনকে বলা হয়েছে এক প্রজন্মের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী নৌ মহড়া হিসেবে।

কুইন এলিজাবেথ প্রথম যাত্রা করবে ভূমধ্যসাগরে। সেখান ফ্রান্সের সাথে যৌথ মহড়ার সময় এফ-৩৫ এর ফাইটার জেটের মাধ্যমে ইরাকে আইএস এর বিরুদ্ধে বিমান হামলা পরিচালনা করবে ব্রিটেন। আর এটাই হবে ক্যারিয়ার স্ট্রাইক গ্রুপের প্রথম কমব্যাট অপারেশন। এরপর কুইনে এলিজাবেথ ক্যারিয়ার গ্রুপ সুয়েজ খাল ও ভারত মহাসাগর হয়ে ফিলিপাইন সাগরে আসবে। এরপর বিভিন্ন দেশের সাথে মিলে মহড়া পরিচালনা করবে দক্ষিণ চীন সাগরে।

দক্ষিণ চীন সাগরের মালিকানা নিয়ে চীনের প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে বিরোধ রয়েছে। অপারেশন অব ফ্রিডমের নামে যুক্তরাষ্ট্র এখানে নিয়মিত নৌ মহড়া চালিয়ে আসছে। এখন এতে যোগ দিচ্ছে ব্রিটেন। ব্রিটেনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী বেন ওয়ালেস বলেছেন, ব্রিটেন কারো সাথে সংঘাতে যাচ্ছে না। ফ্রিডম অব নেভিগেশন অধিকার অনুযায়ী ক্যারিয়ার গ্রুপ সেখানে অবস্থান করবে।

ক্যারিয়ার স্ট্রাইক গ্রুপ মোতায়েনের মানে হলো গ্লোবাল ব্রিটেন ইন এ্যাকশন এর প্রতীক এবং চীনের বিরুদ্ধে ইন্দো-প্যাসেফিক অঞ্চলের মিত্র দেশগুলোর প্রতি সংহতি। এর মাধ্যমে ব্রিটেন পরিষ্কারভাবে চীনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরুনের সময় ব্রিটেন চীনের সাথে বিশেষ সম্পর্ক গড়ে তোলে। বরিস জনসন সরকার এ অধ্যায়ের অবসান ঘটাতে চায়। সম্প্রতি প্রকাশিত ‘গ্লোবাল ব্রিটেন ইন কমপিটিভি এজ’ নামের সিকিউরিটি এবং ফরেন পলিসি মূল্যায়নে বলা হয়েছে ব্রিটেনের অর্থনৈতিক নিরাপত্তার জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি চীন। এতে চীনকে একটি কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র হিসেবেও আখ্যা দেয়া হয়েছে। ব্রিটেন বলেছে, তাদের স্বার্থ যদি হুমকির মুখে পড়ে এবং চীন যদি চুক্তি ভঙ্গ করে তাহলে ব্রিটেন পদক্ষেপ গ্রহনের ক্ষেত্রে পিছপা হবে না।

এ ডকুমেন্টে স্পষ্ট যে, ইন্দো-প্যাসেফিক অঞ্চলে ব্রিটেন তার অবস্থান বদলিয়েছে এবং চীনকে তার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। চীন বিরোধী কোয়াদের নাম উল্লেখ না করলেও ব্রিটেন কার্যত ভারতের সহযোগী হিসেবে আবির্র্ভূত হতে যাচ্ছে ।

ব্রিটেন নেভির পক্ষ থেকে এ মিশনের পেছনে বানিজ্যিক উদ্দেশ্য রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। রয়্যাল নেভি প্রধান এডমিরাল টনি রাডাকিন বিবিসিকে বলেছেন, নেভি অনুসরণ করে বানিজ্য আর বানিজ্য আসে নেভি থেকে। তিনি বলেন, কুইন এলিজাবেথের এ মিশন বরিসন জনসনের ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ ভিশনের অংশ।

ক্যারিয়ার স্ট্রাইক গ্রপ মোতায়েনের মাধ্যমে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনবিরোধী লড়াইয়ে ব্রিটেন সরাসরি যুক্ত হলো। ফলে চীনের সাথে ব্রিটেনের অর্থনৈতিক, বানিজ্যিক এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক এখন জটিল রুপ নিতে যাচ্ছে। ফলে বরিসন জনসন সরকারের ফরেন পলিসিসহ বিভিন্ন ইস্যুতে ব্রিটেনে এখন তীব্র সমালোচনা চলছে।

বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ক্যারিয়ার স্ট্রাইক গ্রুপ না পাঠিয়েও চীনকে অন্যভাবেও শক্তিশালী বার্তা দেয়া যেত। ব্রিটেনে দুটি কিলার হান্টার সাবমেরিন পাঠাতে পারত। প্রথমে তারা এ সাবমেরিন আর্কটিক সাগরে পাঠিয়ে পরবর্তীতে সেখান থেকে প্রশান্ত মহাসাগরে পাঠাতে পারত। তাহলে রাশিয়া এবং চীনের প্রতি আরো শক্তিশালী বার্তা দেয়া হতো।

বিশ্লেষকদের মতে ব্রিটেন এ ক্যারিয়ার গ্রুপ মোতায়েনের মাধ্যমে সরাসরি চীনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে কিন্তু চীন বিরোধী এ অবস্থানে দাড়িয়ে থাকার মত অর্থনৈতিক এবং সামরিক ক্ষমতা ব্রিটেনের নেই। চীনের বিরুদ্ধে সার্বক্ষিনকভাবে পূর্ণ শক্তি মোতায়েন রাখা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসেফিক কমান্ডের বিপরীতে এ অঞ্চলে ব্রিটেনের উপস্থিতি অনেকের কাছে খুবই তুচ্ছ।

অনেকের মতে ব্রেক্সিট পরবর্তী ব্রিটেনকে প্রভাবশালী প্রমানের জন্য বরিস জনসন এ উদ্যোগ নিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের সময় যুক্তরাষ্ট্র সহযোগী হয়ে থাকার নীতি অবলম্বন করেছে ব্রিটেন। ইন্দো-প্যাসেফিক অঞ্চলে চীনের বিরুদ্ধে ক্যারিয়ার স্ট্রাইক গ্রুপ মোতায়েন তার সর্বশেষ নজির।

যুক্তরাষ্ট্র ডেমোক্রেটরা ছিল অ্যান্টি-ব্রেক্সিট। অর্থাৎ ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের বের হয়ে আসার বিপক্ষে। এখন ইন্দো-প্যাসেফিক অঞ্চলে স্ট্রাইক গ্রুপ মোতায়েন করে বাাইডেন প্রশাসনের মন পেতে চাইছেন বরিস জনসন।

ব্রিটেনসহ ইউরোপের দেশগুলো চীনের বিরুদ্ধে বিগড়ে যাবার পেছনে চীনেরও ভূমিকা কম নয়। হংকং ইস্যু ইউরোপের দেশগুলোকে ক্ষুদ্ধ করেছে। এ ছাড়া উইঘুরে মুসলমান সম্প্রদায়ের ওপর দমন অভিযানের বিরুদ্ধেও সোচ্চার অনেক দেশ। রোহিঙ্গাসহ ইস্যুতে মিায়ানমারের সামরিক জান্তার প্রতি চীনের অকুন্ঠ সমর্থনও গ্রহণযোগ্য নয়।

ব্রিটেনের অতীতের গৌরবময় নৌশক্তির স্মরনে ২২ মে বিমানবাহী রণতরী কুইন এলিজাথের নেতৃত্বে লন্ডন থেকে এশিয়া প্যাসিফিকের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে। যাত্রার আগে কুইন এলিজাবেথ রণতরী ভ্রমন করেন রানী এলিজাবেথ এবং প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন।

সাত মাসের দীর্ঘ যাত্রায় ৭০টির বেশি বিভিন্ন ধরনের অপারেশন, মহড়া পরিচালনা করবে। ভারত, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুরসহ ৪০টি দেশ ভ্রমন করবে। আগামী আগস্ট নাগাদ কুইন এলিজাবেথ ক্যারিয়ার গ্রুপের ভারত পৌছার কথা রয়েছে। দক্ষিণ চীন সাগরে অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, নিউজিল্যান্ড, সিঙ্গাপুরের সাথে এলিজাবেথ ক্যারিয়ার গ্রুপ যৌথ মহড়া পরিচালনা করবে। জাপানেরও এতে অংশ নেয়ার সম্ভাবনা রয়েছ।

২০১৮ সালে ব্রিটেন যখন দক্ষিণ চীন সাগরে এসল্ট শিপ আলবিয়ন মোতায়েন করে তখন চীন তাকে ভালভাবে নেয়নি। চীন তখন এর মোকাবেলায় রণতরী মোতায়েন করে আলবিয়নের শ্যাডো হিসেবে।

যুক্তরাজ্যের ক্যারিয়ার স্ট্রাইক গ্রুপ এমন এক সময় দক্ষিণ চীন সাগরে আসছে যখন ১ জুলাই চীনা কমিউনিস্ট পার্টির শতবার্ষিকী। ব্রিটিশ স্ট্রাটেজি কনসালট্যান্ট এলেক্স নেল বলেন, আমি নিশ্চিত ব্রিটিশ ক্যারিয়ার গ্রুপ যখন দক্ষিণ চীন সাগরে আসবে তখন চীনের রাষ্ট্রীয় টিভিতে ব্রিটিশ বিরোধী ইতিহাস প্রচার করবে। চীনের প্রতিরক্ষা মুখপাত্র ইতোমধ্যে জানিয়েছেন, সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা রক্ষা এবং দক্ষিণ চীন সাগরে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে চীন যে কোনো পদক্ষেপ নেবে।

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অবসানের পর আঞ্চলিক রাজনীতিতে অংশগ্রহণও অস্তমিত হয়। সর্বশেষ ১৯৯৭ সালে হংকং থেকে ঘাটি সরিয়ে নেয়ার পর ইন্দো-প্যাসেফিক অঞ্চলে দেশটির উপস্থিতির অবসান ঘটে। ব্রিটেন আবার আঞ্চলিক রাজনীতিতে অংশগ্রহণের নীতি গ্রহণ করতে যাচ্ছে।