ড্রোনের বাজারে তুরস্কের নিয়ন্ত্রণ বাড়ছে


  • আহমাদ আব্দুল্লাহ
  • ০২ জুন ২০২১, ১৪:৫১

ন্যাটোর সদস্য দেশগুলোর মধ্যে পোল্যান্ড প্রথম দেশ, যারা তুরস্ক থেকে মনুষ্যবিহীন আকাশযান বা ইউএভি ক্রয় করেছে। তুরস্কের এই ইউএভিগুলো সাম্প্রতিক সময়ের যুদ্ধ ও সঙ্ঘাতে এরইমধ্যে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছে। ড্রোন ক্রয়ে তুরস্কের ইউএভির ওপর পোল্যান্ডের নির্ভরতাকে বিশ্লেষকরা বেশ গুরুত্বের সাথেই বিবেচনা করছেন। তারা মনে করছেন, ন্যাটোভুক্ত রাষ্ট্র হিসেবে পোল্যান্ডের তুর্কিমুখী এ সামরিক সিদ্ধান্ত ড্রোন কেনাবেচায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মনোপলিকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেবে।

সামরিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, তুরস্কের সাথে পোল্যান্ডের ড্রোন কেনার চুক্তি অন্যান্য ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোকেও তুরস্কের ড্রোন কিনতে উদ্বুদ্ধ করবে। আন্তর্জাাতিক সামরিক শিল্পে তুর্কি ড্রোনের চাহিদা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সিরিয়া, লিবিয়া এবং নাগরনো কারাবাখের যুদ্ধে প্রতিপক্ষকে নাস্তানাবুদ করার সাফল্যে বেরাকতারসহ অন্য তুর্কি ড্রোনের বিশ্ববাজারে চাহিদা বেড়েছে। এর আগে ড্রোনের ব্যবহার থাকলেও তা পরোক্ষ যুদ্ধে বা নজরদারির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু যুদ্ধের ময়দানে ড্রোনের সফল ব্যবহার করে তুরস্ক গোটা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে।

এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি ড্রোনগুলোও ইয়েমেনে ও আফগানিস্তানের যুদ্ধে সফলতা পাওয়ায় বিশ্ববাজারে এসব ড্রোনের চাহিদা আছে। কিন্তু চীন ও ইসরাইল এখনও যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের তৈরি ড্রোনগুলোর সফলতা ও পারদর্শিতা প্রমাণ করতে পারেনি। আর এ সুযোগটি নিয়েই তুরস্ক ইউএভির বাজারে নতুন শক্তি হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে।

তুর্কিরা যুদ্ধের ময়দানে ড্রোনের ব্যবহার করে ড্রোনের ভিন্নধর্মী উপযোগিতা সৃষ্টি করেছে। হেলিকপ্টার দিয়েও যুদ্ধের ময়দানে উপকারিতা পাওয়া যায়। তবে, হেলিকপ্টার খুব বেশি লম্বা সময় আকাশে ভাসতে পারে না। অন্যদিকে, ড্রোন পুরো ২৪ ঘণ্টা ধরেই ভাসতে সক্ষম হওয়ায় নিচে যুদ্ধরত সেনাবাহিনী অনেক বেশি সুবিধা পায়।

ড্রোন মনুষ্যবিহীন হওয়ায় যুদ্ধে সৈন্যদের মৃত্যুসংখ্যাও কমে আসে। ২০২০ সালে সিরিয়ার ইদলিবের ঘটনাই তুর্কি ড্রোনের ইতিহাসের ক্ষেত্রে মাইলফলক। কারণ, ইদলিবের পুরো যুদ্ধটিই তুরস্ক ড্রোন দিয়েই পরিচালনা করেছিল। ঐ যুদ্ধে তুর্কি সরকার সিরিয়ার ক্ষমতাসীন বাশার আল আসাদের বাহিনীর বিরুদ্ধে একটি সমন্বিত আক্রমণ চালিয়েছিল। সেই যুদ্ধে আকাশপথে তুর্কি সেনারা এবং ড্রোনসহ অন্যান্য আকাশযানগুলো যে কার্যকারিতা দেখিয়েছিল, তা বাশার বাহিনীর ভিত্তিকেই অনেকটা কাঁপিয়ে দিয়েছিল।

তুরস্কে পোল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট আন্দ্রেজ ডুডার সাম্প্রতিক তুরস্ক সফরের সময় দুই দেশ তুর্কি ড্রোন কেনার চুক্তি সাক্ষর করে। পোল্যান্ডের প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয় তাদের অফিসিয়াল টুইটার একাউন্ট থেকে দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর বরাত দিয়ে জানায় উদ্ধৃত করে জানায়, পোল্যান্ডের সেনাবাহিনী খুব শীঘ্রই আধুনিক ও উন্নত সমরাস্ত্র ও সামরিক সমঞ্জামাদিতে সমৃদ্ধ হতে যাচ্ছে। আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই হাতে আসবে তুরস্ক নির্মিত রেবারকতার টিবিটু নামক মনুষ্যবিহীন আকাশযান। এই ড্রোনগুলো আমাদের দেশের পূর্ব প্রান্তে সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া যুদ্ধে এর পারদর্শিতা ও কার্যকারিতা প্রমান করেছে। আফ্রিকাতেও বেরাকতারের সফল প্রয়োগ ও ব্যবহার হয়েছে।

প্রাথমিকভাবে, পোল্যান্ড তুরস্ক থেকে ২৪টি বেরাকতার টিবিটু ধরনের মনুষ্যবিহীন আকাশযান বা ড্রোন ক্রয় করবে। এই ড্রোনগুলোর প্রথম চালান আগামী ২০২২ সালেই পোল্যান্ডের হাতে পৌঁছে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। শুধু ড্রোনই নয়, পোল্যান্ড তুরস্ক থেকে আরো বেশ কিছু লজিস্টিক এবং ট্রেনিং প্যাকেজ কিনছে। নতুন এ ড্রোনে এন্টি ট্যাঙ্ক প্রোজেকটাইলও সংযোজন করা হবে। পাশাপাশি, এর টহলদারি এবং টার্গেট সনাক্তকরণ সক্ষমতাও অনেকটা বৃদ্ধি করা হবে।

বিশ্বে এ মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি ড্রোন উৎপাদন করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে ইসরাইল আর চীন আছে তৃতীয় অবস্থানে। তবে, তুর্কি ড্রোনের চাহিদা বিশ্ববাজারে হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়ায় বিশ্লেষকরা মনে করছেন, খুব অল্প দিনের মধ্যেই তুরস্ক ড্রোন নির্মাণে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষদেশে পরিণত হতে যাচ্ছে।

তুরস্কের প্রশাসন অনেকদিন ধরেই ড্রোনের কার্যকারিতা উপলব্ধি করতে পারছিলো। এর আগে ২০১০ এবং ২০১২ সালে দুই দফায় তুরস্ক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তাদের প্রয়োজনীয় ড্রোনের চাহিদার কথাও জানিয়েছিল। কিন্তু মার্কিন প্রশাসন তাতে সাড়া দেয়নি। পরে তুরস্ক নিজেরাই ড্রোন নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়। এ খাতে বিপুল বিনিয়োগ করে। এর ফল হিসাবে তুরস্ক ড্রোন শিল্পে নতুন পরাশক্তি হিসেবে বিশ্বে আবির্ভুত হয়েছে।

শুধু ড্রোন নিয়েই যুক্তরাষ্ট্র তুরস্ককে অবহেলা করেছে তা নয়। তুরস্ক মার্কিনীদের কাছে প্যাট্রিয়ট এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমও চেয়েছিল। কিন্তু সময়মতো যুক্তরাষ্ট্র সেই সিস্টেম সরবরাহ না করায় রাশিয়া থেকে এস-ফোর হান্ড্রেড মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম কেনার সিদ্ধান্ত নেয়। এ ঘটনার জেরে তুরস্কের সামরিক শিল্পের ওপর অবরোধ আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু এরপরও পিছু না হটে তুরস্ক নিজেদের দেশেই স্থানীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে উন্নত বিমান ও বিমানের ইঞ্জিন নির্মাণসহ নানা ধরনের সামরিক উপকরণ তৈরি করতে শুরু করেছে।

তুরস্কের সামরিক শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো ২০১৪ সালে বেরাকতার টিবিটু ড্রোন উৎপাদন শুরু করে। বর্তমানে ইউক্রেইন, কাতার, আজারবাইজানসহ বেশ কিছু দেশ সফলভাবে এই ড্রোনের ব্যবহার করছে। গত মার্চে তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান বেরাকতার ড্রোন কিনতে সৌদি প্রশাসনের আগ্রহের কথাও জানিয়েছিলেন। যদিও পরে এ নিয়ে আর কোনো তথ্য আর পাওয়া যায়নি।

তুরস্কের সামরিক প্রযুক্তি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বেকার সর্ব প্রথম সামরিক ঘরানার এ ড্রোনটি উৎপাদন করে। এ ড্রোন নির্মাণের ফলে তুর্কি সামরিক বাহিনী এখন অনেকটা সুবিধা পাচ্ছে। বিশেষ করে ক্রসবর্ডার তৎপরতা এবং সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানগুলো পরিচালনায় তুরস্ক আগের তুলনায় বেশ সফলতা অর্জন করছে। বিগত ৫ বছরে আংকারা অনেকগুলো ক্রসবর্ডার অপারেশনে ড্রোন মোতায়েন করেছিল। অপারেশন ইউফ্রেটিস, অপারেশন অলিভ ব্র্যাঞ্চ এবং অপারেশন স্প্রিং ফিল্ডের মতো গুরুত্বপূর্ন সামরিক অভিযানে তুর্কি বাহিনী ড্রোন ব্যবহারের মাধ্যমে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করে। ড্রোন ব্যবহারে তুরস্কের মুল উদ্দেশ্য হলো, সিরিয়া সীমান্তকে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর প্রভাব মুক্ত করা। আর তুরস্ক এ কাজে সামরিক বা পদাতিক সেনাদের কাজে না লাগিয়ে বরং ড্রোনের মাধ্যমেই উদ্দেশ্য পূরণ করতে চায়।

তুরস্কের ড্রোনই মুলত লিবিয়ার চলমান গৃহযুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। তুর্কি প্রশাসন ড্রোন দিয়ে জাতিসংঘ স্বীকৃত জাতীয় ঐকমত্যের সরকারকে সহায়তা করে। এর ফলে এ সরকারের পক্ষে বিদ্রোহী খলিফা হাফতারের নেতৃত্বাধীন বাহিনীকে দেশের বিভিন্ন স্থানে পরাজিত করা সম্ভব হয়।

লিবিয়ার পশ্চিমাঞ্চল এবং মধ্যবর্তী এলাকাগুলোতে বিভিন্ন গোষ্ঠীর সহায়তা নিয়ে খলিফা হাফতারের সেনারা যেভাবে ঘাটি নির্মাণ করেছিল, তুর্কি ড্রোন সেগুলো ধ্বংস করে দিতে সক্ষম হয়।

সামরিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, বিশ্বজুড়ে তুর্কি ড্রোনের জনপ্রিয়তার পেছনে বড়ো কারণ হলো বিশ্ববাজারে এর কম দাম এবং বিক্রয় প্রক্রিয়াও সহজ। তুর্কি ড্রোনগুলো মার্কিন ড্রোনের তুলনায় বেশ সস্তা। অন্যদিকে, ওয়াশিংটনের নীতি নির্ধারকরা বিদেশে অস্ত্র বা সামরিক উপকরণ বিক্রির ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত যেভাবে বিধি নিষেধ আরোপ করছেন এবং জটিল সব নিয়ম কানুন প্রয়োগ করছেন, তুরস্কের ড্রোনের বিক্রি প্রক্রিয়া সে তুলনায় অনেকটাই সহজ। তুর্কি ড্রোনগুলো পাওয়ার ক্ষেত্রে ক্রেতা দেশ গুলোকে এ ধরনের কোনো জটিলতায় পড়তে হয় না।

সিরিয়ায় প্রথমদিকে যেভাবে প্রথাগত পদ্ধতিতে যুদ্ধ চলেছিল, এখন আর সেভাবে বিষয়টি অগ্রসর হচ্ছে না। সাম্প্রতিক সময়ের নাগারনো কারাবাখও প্রমান করেছে যে, প্রথাগত উপায়ে যুদ্ধের দিন অনেকটাই শেষ হয়ে আসছে। আধুনিক যুদ্ধক্ষেত্রে হাইব্রিড ওয়ারফেয়ার কৌশল বেশি গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে।

তুর্কি ড্রোন ব্যবহার করে আজার বাইজানের সেনারা প্রতিপক্ষ আর্মেনিয়ানদের ২০০ ট্যাঙ্ক, ৯০টি আরমড সমরযান এবং ১৮২টি আর্টিলারিকে ধ্বংস করতে সফল হয়েছিল। আর্মেনিয়া সে যুদ্ধে ধারনার চেয়ে কম সময়ে পরাজিত হওয়ায় বিশ্বজুড়ে তুর্কি ড্রোনের চাহিদা বেড়েছে।

ইতালির সামরিক বিশেষজ্ঞ ফেডরিকো বোরসারি মনে করেন, তুরস্ক সাম্প্রতিক সময়ে ড্রোন শিল্পে নতুনত্ব নিয়ে এসেছে। দেশটি একের পর এক ড্রোন নির্মাণ করছে। এর মধ্যে অনেকগুলোর পেলোড সক্ষমতা রীতিমতো ঈর্ষণীয়। বিশেষ করে বেরাকতারের কথা বলতেই হয়। কারণ আকাশ থেকে আকাশে কিংবা আকাশ থেকে ভূমিতে এ ড্রোনগুলো বেশ কার্যকর। যে কোনো মিশন সফলভাবে সমাপ্ত করার ক্ষেত্রেও এ ড্রোনগুলো পারদর্শিতা দেখিয়েছে। সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে পরিচালিত এ ড্রোনগুলো যুদ্ধবিমানের বিপরীতেও কার্যকর।

ড্রোনগুলো মানুষের সরাসরি হস্তক্ষেপ ছাড়াই রিমোটের মাধ্যমে উড্ডয়ন করতে পারে আবার মিশণ শেষে অবতরণও করতে পারে। এসব বৈশিষ্ট্যর থাকার কারণে তুর্কিরা ক্রমশ ড্রোন নির্মাণে অপ্রতিদ্বন্দী হয়ে উঠেছে। তুরস্কের হাতে ড্রোনের এমন কিছু প্রযুক্তিও চলে এসেছে যা এই মুহুর্তে ইসরাইল ছাড়া আর কারো কাছেই নেই।

স্টকহোম ভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইন্সটিটিউটের হিসেবে তুরস্ক বিগত ৪ বছরে তাদের অস্ত্র রফতানির পরিমাণ ১৭০ শতাংশ বৃদ্ধি করেছে। তুরস্ক বর্তমানে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের ঘোষিত ২০২৩ রূপকল্পের আওতায় সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধিতে নজিরবিহীন বিনিয়োগ করেছে। আশা করা হচ্ছে , আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই দেশটি নিজেদের তৈরি ট্যাঙ্ক, যুদ্ধবিমান, ডিফেন্স সিস্টেম এবং ড্রোন প্রযুক্তি দিয়ে বিশ্বের নতুন সামরিক পরাশক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে।