বিশ্বের তৃতীয় সমরাস্ত্র নির্মাতা নরথ্রপ গ্রুম্যান


  • মেহেদী হাসান
  • ১০ মে ২০২১, ১৫:৫১

নরথ্রপ গ্রুম্যান বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম সমরাস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান। এটি একটি বহুজাতিক অ্যারোস্পেস অ্যান্ড ডিফেন্স টেকনোলজি কোম্পানি। সামরিক বিমানসহ বিভিন্ন সমরাস্ত্র নির্মাণ করলেও নরথ্রপ গ্রুম্যান মূলত বিখ্যাত মহাকাশ গবেষণা এবং মহাকাশ যান উদ্ভাবন ও নির্মাণের জন্য।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম আন্তঃমহাদেশীয় মিসাইল, প্রথম স্যাটেলাইট তৈরিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে পাইওনিয়ার ভূমিকা রয়েছে নরথ্রপ গ্রুম্যানের। যুক্তরাষ্ট্রের চন্দ্র অভিযান ভেহিক্যাল অ্যাপোলোর নির্মাণকারী গ্রুম্যান। বলা হয়ে থাকে, আমেরিকাকে চাঁদে নিয়ে গেছে গ্রুম্যান। যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার গুরুত্বপূর্ণ সব কর্মসূচির সাথে গভীরভাবে যুক্ত সমরাস্ত্র নির্মাতা ও টেকনোলজি উদ্ভাবক প্রতিষ্ঠান নরথ্রপ গ্রুম্যান।

বিশ্বের প্রথম এবং একমাত্র প্রকৃত স্টেলথ ফাইটার বিখ্যাত বি-২ স্পিরিট বোমারু বিমানের নির্মাতা গ্রুম্যান। গ্রুম্যানের রয়েছে একাধিক বিশ্ব রেকর্ড স্থাপনকারী ড্রোন বিমান। ৬৫ বছর ধরে গ্রুম্যান যুক্ত রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের মিসাইল উদ্ভাবন এবং নির্মাণের সাথে।

গ্রুম্যানের সদর দফতর যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ায়। ২০১৮ সালে গ্রুম্যান ৩০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের সমরাস্ত্র বিক্রি করে। ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠানটির নেট ইনকাম ছিল ৩ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার। নরথ্রপের জনবল সংখ্যা ৯৭ হাজার।

সমরাস্ত্র নির্মাণসহ নরথ্রপ গ্রুম্যান গুরুত্বপূর্ণ যেসব শাখায় নিয়োজিত সেগুলো হলো মিসাইল উদ্ভাবন ও নির্মাণ। স্যাটেলাইট অ্যান্ড স্পেস, স্যাটেলাইট নির্মাণ, মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম। সামরিক বিমান ও আনম্যান্ড এরিয়েল ভেহিক্যাল, রণতরী, অটো ক্যাননস, চেইন গানস অ্যান্ড মিউনিশনস নির্মাণ করে। এছাড়া ইনফরমেশন টেকনোলজি, ইলেকট্রনিক সেন্সরস অ্যান্ড সিস্টেমস, রকেট লঞ্চ সিস্টেমস তৈরি করে থাকে নরথ্রপ গ্রুম্যান।

সাইবার জগতসহ যুক্তরাষ্ট্র আর্মির সব শাখায় উচ্চ প্রযুক্তি এবং বিভিন্ন ধরনের সিস্টেম উদ্ভাবন ও সরবরাহ করে গ্রুম্যান। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বিমান, রণতরী, মহাকাশ যান এবং স্থলবাহিনীতে যেসব সমরাস্ত্র ব্যবহার করা হয় তার বিভিন্ন ধরনের প্রযুক্তি, সিস্টেম, নেটওয়ার্ক গ্রুম্যানের।

১৯৩৯ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত গ্রুম্যানের নাম ছিল নরথ্রপ করপোরেশন। ১৯৯৪ সালে এর নাম হয় নরথ্রম গ্রুম্যান। বর্তমানে গ্রুম্যানের চলমান গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রকল্প হলো জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ। নাসার হাবল টেলিস্কোপ এর পরিবর্ততে ব্যবহার করা হবে এটি। চলতি বছরই এটি উৎক্ষেপন করার কথা। এটি নাসার সাথে যৌথভাবে নির্মাণ করছে নরথ্রপ।

গ্রুম্যানের অপর চলমান আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প নাসার স্পেস লঞ্চ সিস্টেম প্রোগ্রামের জন্য সলিড রকেট বুস্টার নির্মাণ। নাসার এ প্রোগ্রামের লক্ষ্য নতুন আন্তমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক মিসাইল উদ্ভাবন।

৬৫ বছর ধরে গ্রুম্যান নেতৃত্ব দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের আন্তমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক মিসাইল সিস্টেম তৈরিতে। বিশ্বের প্রথম সলিড ফুয়েল মিসাইল টিএক্স-১৮ ফ্যালকন তৈরি করে গ্রুম্যান।

যুক্তরাষ্ট্রের পরমানু বোমা বহন সক্ষম আন্তমহাদেশীয় মিসাইল উদ্ভাবনের জন্য ১৯৫৪ সালে কাজ পায় নরথ্রম গ্রুপম্যান। বর্তমানে আন্তমহাদেশীয় মিসাইলের গ্রাউন্ড সাপোর্টসহসহ বিভিন্ন ধরনের সিস্টেম ও মিসাইল আধুনিকায়ন কর্মসূচির সাথে যুক্ত গ্রুম্যান।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম মিসাইল এবং স্যাটেলাইট কর্মসূচির সাথে যুক্ত ছিল গ্রুম্যান। যুক্তরাষ্ট্রের চন্দ্র অভিযান, স্পেস শাটল, ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন নির্মাণের সাথে যুক্ত নরথ্রপ গ্রুম্যান। যুক্তরাষ্ট্রের চন্দ্র অভিযানের জন্য ব্যবহৃত অ্যাপোলো লুনার মডিউল নির্মাণ করে গ্রুম্যান। অ্যাপোলো লুনার মডিউলে করে নভোচারীরা চাঁদে অবতরণ করেন।

মহাকাশ সংস্থার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচির সাথে গভীরভাবে যুক্ত নরথ্রপ গ্রুম্যান। অটোনোমাস সিস্টেম তৈরির ক্ষেত্রে নরথ্রপ গ্রুম্যান বিশ্বে লিডার হিসেবে পরিচিত। ড্রোন বিমান, সমুদ্রে মাইন হান্টিং থেকে শুরু করে আকাশ, সমুদ্র, ভূমি এবং মহাকাশ যানের ক্ষেত্রে ব্যাপক মাত্রায় প্রয়োগ করা হয় গ্রুম্যানের অটোনোমাস সিস্টেম।

যুদ্ধবিমান, রণতরী, মহাকাশ এবং স্থলবাহিনীর বিভিন্ন সমরাস্ত্রে ব্যবহার করা হয় গ্রুম্যানের ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার সিস্টেম। গ্রুম্যান সরবরাহ করে মিলিটারি এভিয়েশন সিস্টেম, নেভিগেশন সিস্টেম, রাডার সিস্টেম এবং ইন্টিগ্রেটেড স্ট্রাইক সিস্টেম।

নরথ্রম বর্তমানে নির্মাণ করছে বি-২১ রেইডার নামের এক ভয়ানক শক্তিশালী ভারী বোমারু বিমান। বি-২১ রেইডার পারমানবিক এবং প্রচলিত উভয় ধরনের বোমা বহনে সক্ষম। এটি হবে দীর্ঘ পাল্লার, ভারী স্ট্রাটেজিক বোমারু বিমান। এর থাকবে স্টেলথ টেকনোলজি।

যুক্তরাষ্ট্রের বি-২ স্পিরিট, বি-৫২ বমার এবং বি-১ ল্যান্সারের স্থানে ভবিষ্যতে ব্যবহার করা হবে বি-২১ রেইডার। ২০২৬ সালে এ বিমান সার্ভিসে যুক্ত হওয়ার কথা। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে অন্যতম ব্যয়বহুল প্রকল্প বি-২১ রেইডার নির্মাণ চলছে অতি গোপনে। এ সম্পর্কে বিস্তারিত কোনো তথ্য এখনো প্রকাশ করেনি যুক্তরাষ্ট্র। এখন পর্যন্ত এর যে ছবি প্রকাশ করা হয়েছে তাতে এর এর গঠন বি-২ স্পিরিটের মতো দেখা গেছে।

নরথ্রপের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চলমান প্রকল্প হলো এক্স-৪৭ বি আনম্যান্ড কমব্যাট এরিয়েল ভিহিক্যাল নির্মাণ। এটি হবে প্রথম আনম্যান্ড অটোনোমাস এয়ার সিস্টেম যা বিমানবাহী রণতরীর সাহায্যে পরিচালনা করা হবে। এর থাকবে এরিয়েল রিফুয়েলিং ক্ষমতা। এক্স-৪৭ বি প্রথম আকাশে ওড়ে ২০১১ সালে।

নরথ্রপ গ্রুম্যানের একটি বিখ্যাত ড্রোন বিমানের নাম আরকিউ ৪-গ্লোবাল হক । এটি একটি সার্ভিল্যান্স ড্রোন বিমান। যুক্তরাষ্ট্র এয়ার ফোর্স, নাসা এবং ন্যাটো ব্যবহার করে এ ড্রোন। এর রয়েছে ৬০ হাজার ফিট উচ্চতায় দীর্ঘ সময় ওড়ার ক্ষমতা। এটি প্রথম আকাশে ওড়ে ১৯৯৮ সালে। লকহিড মার্টিন নির্মিত রহস্যজনক গোয়েন্দা বিমান ইউ-২ ড্রাগন লেডির সমান দায়িত্ব পালন করতে পারে আর কিউ গ্লোবাল হক। দক্ষিন কোরিয়া অথবা আইসল্যান্ডের মত গোটা দেশ একদিনে পর্যবেক্ষনে সক্ষম এটি।

২০০১ সালে প্রথম মানুষবিহীন কোনো ড্রোন বিমান হিসেবে আর কিউ গ্লোবাল হক প্রশান্ত মহাসাগর অতিক্রম করে। ৮হাজার ২১৯ মাইল পথ অতিক্রমে মোট সময় লাগে ২২ ঘন্টা। ২০০৮ সালে টানা ৩৩ ঘন্টা ওড়ার বিশ্বরেকর্ড করে এ ড্রোন বিমান। এসময় ৬০ হাজার ফিট উচ্চতায় অবস্থান করে এ ড্রোন বিমান। ১ হাজার ২৬০ কেজি ওজনের সমরাস্ত্র বহন করতে পারে এ ড্রোন বিমান।

নরথ্রপ গ্রুম্যানের এক আশ্চর্য উদ্ভাবন বি-২ স্পিরিট । এটি বিশ্বের প্রথম স্টেলথ ফাইটার। পৃথিবীতে একমাত্র প্রকৃত স্টেলথ ফাইটার বিমান নামে পরিচিত এটি। বি-২ মূলত একটি ভারী বোমারু বিমান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি এ বিমান টানা দুই দিনেরও বেশি আকাশে উড়তে পারে। ফলে পৃথবীর যে কোনো প্রান্তে উড়ে গিয়ে হামলা করে কোনো বিরতি ছাড়া আবার নিজ দেশে ফিরে আসতে পারে এ বিমান।

বি-২ স্পিরিট বা স্পিরিট অব আমেরিকা নামে পরিচিত। বি-২ স্পিরিট বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল আর রহস্যে ঘেরা ভয়ানক এক যুদ্ধ বিমান । ১৯৯৭ সালে একটি বিমানের দাম ২ দশমিক ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ১৭ হাজার ৭শ ৩৮ কোটি টাকা।

রাশিয়ার সাথে স্নায়ু যুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র তৈরি করে এ বিমান। এ যুদ্ধ বিমান তৈরির উদ্দেশ্য সোভিয়েত ইউনিয়নের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে পারমানবিক বোমা হামলা পরিচালনা করা। সোভিয়েত ইউনিয়নের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ব্যর্থ করা।

বি-২ স্পিরিট যে কারনে সবচেয়ে ভয়াবহ তাহলো প্রচলিত এবং পারমানবিক উভয় ধরনের বোমা বহনে সক্ষম এ বমার। প্রতিটি বিমান ১৬টি বি৮৩ পারমানিবক বোমা বহন করতে পারে। বি৮৩ একটি পারমানবিক বোমার ওজন ১১০ কেজি। বি৮৩ পারমানবিক বোমা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে থাকা সবচেয়ে শক্তিশালী বোমা। পারমানবিক বোমার পরিবর্তে প্রচলিত গাইডেড বোমা বহন করতে পারে ৮০টি যার প্রতিটির ওজন ২৩০ কেজি। তবে এর ওজন বহন ক্ষমতা আরো অনেক বেশি। বিশ্বব্যাপী এখনো বড় ধরনের হুমকি আর আতঙ্ক গ্রুম্যান নির্মিত যুক্তরাষ্ট্রের বি-স্পিরিট।

বি-২ বম্বার এখন পর্যন্ত টানা ৪৪ ঘন্টা ৪৩ মিনিট আকাশে ওড়ার রেকর্ড করেছে। তবে পুন জ্বালানি সংগ্রহের মাধ্যমে এর টানা উডডয়ন ক্ষমতা আরো অনেক বেশি। কসভো, আফগানিস্তান এবং লিবিয়া অভিযানে এ বিমান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে উড়ে গিয়ে হামলা করে আবার নিজ দেশে ফিরে গেছে । কোনো যুদ্ধে আজ অবধি এ বিমান খোয়া যায়নি।

এ বিমান প্রথম আকাশে ওড়ে ১৯৮৯ সালের ১৭ জুলাই। বি-২ স্পিরিট যুক্তরাষ্ট্র কারো কাছে বিক্রি করে না। ডিজাইনের দিক দিয়ে আজ অবধি এটি বিশ্বে অদ্বিতীয়।