ইরানে বিমান হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে ইসরায়েল


  • মেহেদী হাসান
  • ০৮ মে ২০২১, ১৩:৪৮

ইসরায়েল বারবার প্রকাশ্যে বলে আসছে, তারা ইরানকে কোনো অবস্থাতেই পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী হতে দেবে না। ইরান যাতে পারমাণবিক বোমা বানাতে না পারে সেজন্য আগেই ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালিয়ে তা ধ্বংস করে দেওয়ার পরিকল্পনা আছে দেশটির। এটি ইসরায়েলের প্রকাশ্য ঘোষণা।

ইরানে হামলার ক্ষেত্রে ইসরায়েলের প্রধান সমস্যা হলো ইরান একটি বড় দেশ। পারমাণবিক স্থাপনাগুলো বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়ানো। আর ইসরায়েলের বিমান বাহিনীর কাছে যেসব ফাইটার জেট রয়েছে, তাতে ইরানের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে বিমান হামলা চালানোর ক্ষমতা নেই। যদিও শীঘ্রই এ সক্ষমতা অর্জন করতে যাচ্ছে ইসরায়েল। ইরানের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে বিমান হামলা পরিচালনার প্রস্তুতি নিচ্ছে দেশটি। সেজন্য শক্তিশালী করা হচ্ছে বিমান বাহিনীকে।

ইসরায়েলের হাতে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের এফ-৩৫, এফ-১৬ এবং এফ-১৫ ফাইটার জেট রয়েছে। কিন্তু ইরানের কাছে শক্তিশালী মিসাইল সিস্টেম থাকায় এর কোনো বিমান বর্তমানে ইরানের অভ্যন্তরে হামলা চালিয়ে আবার ফেরত আসার উপযুক্ত নয়। এফ-১৬ এবং এফ-১৫ নন স্টেলথ ফাইটার হওয়ার কারণে এসব বিমান ধরা পড়বে ইরানের রাডার নেটওয়ার্কে। ভূপাতিত হতে পারে ইরানি মিসাইলের আঘাতে।

অপর দিকে এফ-৩৫ স্টেলথ ফাইটার রাডারকে ফাঁকি দিতে সক্ষম হলেও এ বিমানের অপারেশন আওতা ৬৫০ মাইল। বিশাল আয়তনের দেশ ইরানের অভ্যন্তরে সর্বত্র এ বিমান বোমা হামলা চালিয়ে আবার ফিরে আসতে পারবে না।

ইসরায়েল ইরানে এ বিমান হামলা পরিচালনার দুর্বলতা দ্রুত কাটিয়ে উঠতে জোরালো পদক্ষেপ নিয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে ইরানের অভ্যন্তর প্রবেশ করে বিমান হামলা পরিচালনার সক্ষমতা অর্জন করতে যাচ্ছে তেল আবিব। ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় গুলো লক্ষ করে হামলা চালানোর প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।

ইসরায়েল সম্প্রতি নতুন করে হুশিয়ারি দিয়েছে ইরানকে পারমাণবিক বোমা উদ্ভাবন থেকে প্রতিহত করতে পারমনিবক স্থাপনায় আগেই হামলা চালানো ছাড়া তাদের হয়তো আর বিকল্প থাকবে না। আর এ ধরনের হামলা পরিচালনার জন্য ইসরায়েলি বিমান বাহিনী আগের তুলনায় আরো অনেক শক্তি অর্জন করেছে।

ইসরায়েলের ইন্টেলিজেন্স মিনিস্টার এলি কোহেন গত এপ্রিলে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র-ইরান একটি খারাপ পারমাণবিক চুক্তি এ অঞ্চলকে যুদ্ধের দিকে নিয়ে যাবে। স্বল্প মেয়াদে সুবিধা সন্ধানকারী যে কাউকে দীর্ঘমেয়াদি বিষয় মনে রাখা উচিত। এলিন কোহেন বলেন, ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের সুযোগ দেবে না ইসরায়েল। তিনি জানিয়েছিলেন গোটা ইরান ইসরায়েলের হামলার আওতায় রয়েছে। ইসরায়েলের যুদ্ধবিমান ইরানসহ সমস্ত মধ্যপ্রাচ্যে অপারেশন পরিচালনায় সক্ষম।

১৯৯০ দশকের মাঝামাঝি থেকে ইসরায়েলের লিকুদ এবং লেবার উভয় দল ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন কর্মসূচি বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে। একই সাথে ইরানের ব্যালেস্টিক মিসাইল কর্মসূচি নিয়েও শঙ্কিত ইসরায়েল। এরপর থেকেই ইরানে অফেনসিভ হামলার পরিকল্পনা গ্রহণ করে ইসরায়েল।

১৯৮১ সালে ইসরায়েল ইরাকের ওসিরাক রিএ্যাক্টরে হামলা চালায়। ২০০৭ সালে ধ্বংস করে একটি সিরিয়ান রিএ্যক্টর। আর ইরানের বিভিন্ন পারমাণবিক স্থাপনায় নিয়মিতভাবে ঘটছে দুর্ঘটনা। কখনো কখনো ভেতর থেকে বিস্ফোরিত বোমায় উড়ে যাচ্ছে ভবন। গুপ্ত হামলায় নিহত হচ্ছেন পরমানু বিজ্ঞানী। এসব ইসরায়েলের কাজ বলে বিশ্ব গণমাধ্যমে অনেক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। আর ইরানতো সরাসরি ইসরায়েলকে এ জন্য দায়ী করে থাকে। তবে ইরাক এবং সিরিয়ার তুলনায় ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি এবং স্থাপনা অনেক সুরক্ষিত আর এগুলো বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়ানো।

২০০৫ সালে ইসরায়েলের সেনা প্রধান ড্যান হালুজকে প্রশ্ন করা হয় ইরানের পরমানু অস্ত্র অর্জন কর্মসূচি ঠেকাতে ইসরায়েলের প্রস্তুতি কতদূর। তিনি সে সময় বলেছিলেন, ‘দুই হাজার কিলোমিটার’। এর মানে হলো ইসরায়েলি ফাইটার জেটকে দুই হাজার কিলোমিটার বা ১২শ মাইল উড়তে হবে ইরানের পরমানু স্থাপনায় হামলা পরিচালনার জন্য। অর্থাৎ ২০০৫ সালে তারা ইরাইনের পরমানু স্থাপনায় সরাসরি বিমান হামলা পরিচালনার সক্ষমতা অর্জন করেছে । ২০০৮ সালে ইসরায়েলের ১০০টি এফ-১৫ এবং এফ-১৬ জঙ্গি বিমান ভূ-মধ্য সাগরে মহড়া চালায় এবং এসময় বিমানগুলো ৯০০ মাইল ওড়ে। এটি ছিল তাদের ইরানে পৌছার সক্ষমতা প্রদর্শনের একটি মহড়া।

বর্তমানে ইসরায়েলের বিমান বাহিনী সজ্জিত করা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বাধুনিক প্রযুক্তির ফিফথ জেনারেশন স্টেলথ ফাইটার এফ-৩৫ দিয়ে। অনেকগুলো এফ-৩৫ বিমান নির্মান করা হয়েছে শুধুমাত্র ইসরায়েলের চাহিদা অনুসারে । ইসরায়েলের জন্য রয়েছে এফ-৩৫ এর একটি ভেরিয়্যান্ট তথা এফ-৩৫ ওয়ান আদির।

ইরানের বিমান বাহিনী অনেক পুরোন বিমানে সজ্জিত এবং দুর্বল। তবে ইরানের এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম অনেক শক্তিশালী। এক সময় ইরানের রাডার নেটওয়ার্ক সিস্টেম যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েলের কোনো যুদ্ধবিমান সনাক্ত এবং অনুসরনে সক্ষম ছিলো না।

যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েলসহ বিভিন্ন দেশের ড্রোন বিমান ইরানের অভ্যন্তরে অহরহ প্রবশে করত এবং দীর্ঘ সময় অবস্থান করতে পারত। ইরান এগুলো সনাক্ত করতে পারত না। আফগানিস্তান এবং ইরাক অভিযানের সময় যুক্তরাষ্ট্রের অনেক যুদ্ধবিমান ইরানের আকাশে দীর্ঘ সময় অবস্থান করত বিনা বাধায় ।

ইরানের সেদিন এখন আর নেই। ইরানের কাছে বর্তমানে রয়েছে রাশিয়ার শক্তিশালী এস-৩০০ মিসাইল। আর ইরান নিজেও এ ধরনের এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম উদ্ভাবন করেছে। ইরানের বর্তমান এয়ার ডিফেন্স মিসাইল সিস্টেম ইসরায়েলের এফ-১৬ অথবা এফ-১৫ বিমানের জন্য বড় ধরনের হুমকি। এসব বিমান ইরানে প্রবেশ করলে তা ইরানের রাডারে ধরা পড়বে এবং ইরানের শক্তিশালী মিসাইল আঘাতের শিকার হবে। তাই ইরানে হামলা করতে হলে এখন ইসরায়েলের সেটি করতে হবে শুধুমাত্র এফ-৩৫ এর সাহায্যে।

২০১৯ সালে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু জানিয়েছিলেন , তাদের এফ-৩৫ ফইটার জেট, ইরান সিরিয়াসহ সমস্ত মধ্যপ্রাচ্যে অপারেশন পরিচালনায় সক্ষম। তবে এফ-৩৫ যখন অস্ত্রে সজ্জিত থাকে তখন এর রেঞ্জ ৬৫০ মাইল এর কাছাকাছি । এ রেঞ্জের সাহায্যে ইসরায়েল থেকে উড়ে গিয়ে ইরানের অভ্যন্তরে পারমাণবিক স্থাপনায় অপারেশন পরিচালনা করে ফিরে আসতে সক্ষম হবে না।

ইসরায়েলি বিমানকে ইরানে প্রবেশ করতে হলে তাকে পাড়ি দিতে হবে সৌদি আরব অথবা সিরিয়া এবং ইরাকের আকাশ। তবে ইরানের প্রতিবেশী কোনো দেশ থেকে ইসরায়েল এটি করতে পারলে তার জন্য অপারেশন পরিচালনা সহজ হবে । কিন্তু এর সম্ভাবনা কম। কারন সে ক্ষেত্রে প্রতিবেশী দেশ ইরানের আক্রমনের শিকার হবে। ফলে সহজে অন্য কোনো দেশ ইসরায়েলকে এ সুযোগ নাও দিতে পারে।

ইসরায়েল থেকে ইরানের অভ্যন্তরে অপারেশন পরিচালনায় মধ্য আকাশে এফ-৩৫ এর জন্য প্রয়োজন হবে পুন: জ্বালানি গ্রহন। সেজন্য আকাশে অবস্থান করতে হবে এরিয়েল রিফুয়েলিং ট্যাঙ্কার। আর এফ-৩৫ স্টেলথ টেকোনলজির হলেও এরিয়েল রিফুয়েলিং ট্যাঙ্কার ধরা পড়বে ইরানের রাড়ারে। ফলে এরিয়েল রিফুয়েলিং ট্যাঙ্কার ভূপাতিত হতে পারে ইরানী মিসাইলের আঘাতে। সে ক্ষেত্রে ইসরায়েল থেকে উড়ে গিয়ে ইরানের ভেতরে গিয়ে বিমান হামলা চালানো অনেক ঝুকিপূর্ন।

এ সমস্যার কারণে ইসরায়েল পরিকল্পনা নিয়েছে এফ-৩৫ এর সাথে এক্সটারনাল ফুয়েল ট্যঙ্ক যুক্ত করার। এর ফলে এর অপারেশন রেঞ্জ দ্বিগুন হবে। দীর্ঘ অপারেশন পরিচালনায় সক্ষম হবে এফ-৩৫। অতিরিক্ত ফুয়েল ট্যাঙ্ক যোগ করার পরও এফ-৩৫ এর স্টেলথ বৈশিষ্ট্য অর্থাৎ রাডার ফাকি দেয়ার ক্ষমতা থাকবে।

এ জন্য ইসরায়েল ইতোমধ্যে এফ-৩৫ ফাইটার জেটে বিভিন্ন ধরনের মোডিফাই কার্যক্রম চালিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের আগেই ইসরায়েল এফ-১৫কে মোডিফাই করে একে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বোমা বহনকে উপযুক্ত করেছে। ইসরায়েলের মোডিফাইড এফ-১৫ বিমানের নাম স্ট্রাইক ঈগল।

বিশ্লেষকদের মতে, অদূর ভবিষ্যতে ইরানের ভেতরে প্রবেশ করে ইসরায়েল বিমান হামলা পরিচালনায় সক্ষম হবে। ইসরায়েলের কাছে বর্তমানে মোট ২৭টি এফ-৩৫ ফাইটার জেট রয়েছে। আরো ৫০টি সংগ্রহের অর্ডার দিয়েছে। ইসরায়েলের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি এফ-১৬ ফোর্থ জেনারেশন বহুমুখী ফাইটার জেট রয়েছে ২২৪টি। এফ-১৫ রয়েছে ৮৩টি। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী আর্লি ওয়ার্নিং ও সার্ভিলেন্স বিমান রয়েছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক।