কেন ইউক্রেন দখল করতে চায় রাশিয়া


  • মেহেদী হাসান
  • ৩০ এপ্রিল ২০২১, ১৬:২১

অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহৎম দেশ ইউক্রেন। ২০১৪ সালে ইউক্রেনের খুবই গুরুত্বপূর্ণ এলাকা ক্রিমিয়া দখল করে রাশিয়া। এ সময় পূর্ব ইউক্রেনের দুটি অঞ্চলে রুশপন্থী বিদ্রোহীরা গঠন করে স্বঘোষিত রাষ্ট্র। এর ফলে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চল কার্যত রাশিয়ার দখলে রয়েছে। পশ্চিমাদের আশঙ্কা পূর্ব ইউক্রেনও রাশিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে দখলে নেবে এবং ইউক্রেন রাষ্ট্রের সমাপ্তি ঘটবে। রাশিয়াও হুমকি দিয়েছে, রাশিয়ার দখলে থাকা এলাকা উদ্ধারে ইউক্রেন যদি কোনো পদক্ষেপ নেয়, তাহলে রাশিয়া অভিযান চালাবে ইউক্রেনে। যা হতে পারে ইউক্রেন রাষ্ট্রের সমাপ্তির সূচনা। অনেকের আশঙ্কা ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্র যদি রাশিয়ার বিরুদ্ধে গিয়ে ইউক্রেন রক্ষায় কোনো সামরিক পদক্ষেপ নেয়, তাহলে এর সূত্র ধরে বিশ্ব জড়িয়ে পড়তে পারে বড় ধরনের যুদ্ধে। এমনকি তা গড়াতে পারে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে।

যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি কোম্পানির অংশীদারিত্বে ক্রিমিয়ায় ন্যাচারাল গ্যাস রিজার্ভার স্থাপনের পরিকল্পনা নিয়েছিল ইউক্রেন। এটি বাস্তবায়িত হলে রাশিয়া হারাত গ্যাসের বড় এক ক্রেতাকে। ২০১৪ সালে রাশিয়ার ক্রিমিয়া অভিযানের অন্যতম কারণ ছিল জ¦ালানি খাতে পশ্চিমা কোম্পানিগুলোকে ঠেকানো। এছাড়া ক্রিমিয়ায় রয়েছে রাশিয়ার শক্তিশালী নৌঘাঁটি। ২০১৪ সালে ইউক্রেনে রাশিয়াপন্থী সরকারের পতন হলে রাশিয়ার নৌঘাঁটি হুমকির মুখে পড়ে। ক্রিমিয়া দখলের এটি ছিল আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ।

ইউক্রেনের প্রতি রাশিয়ার তীব্র ক্ষোভের আরেক কারণ হলো ন্যাটোর সাথে ইউক্রেনের ঘণিষ্ঠতা। ১৯৯৪ সালে ইউক্রেন ন্যাটোর অংশীদারে পরিণত হয়। রাশিয়া মনে করে এটি নিরাপত্তার জন্য বড় ধরনের হুমকি। এ ছাড়া ২০১৬ সালের এপ্রিল মাসে ন্যাটো জোট এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, লিথুনিয়া এবং পোল্যান্ডে সেনা মোতায়েন করে। এই সেনা মোতায়েনকে রাশিয়া বড় ধরনের নিরপত্তা হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে আসছে।

ন্যাটো ছাড়াও ইউক্রেন ক্রমে ঘণিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে। এসব কারণে রাশিয়া-ইউক্রেনের সম্পর্ক তিক্ত আকার ধারণ করে।

ইউক্রেনের বর্তমান দূরবস্থার আরেকটি কারণ হলো দেশটিতে অভ্যন্তরীণ বিভাজন। ইউক্রেনের জনগনের একটি অংশ চায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে থাকতে। আরেকটি অংশ চায় রাশিয়ার সাথে থাকতে। ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চল মূলত রুশভাষী রাশিয়ান জাতিগত লোকজনের বসবাস। তারা ইউরোপের পরিবর্তে রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক রক্ষা করে চলতে চায়। এমনকি অনেকে এ অঞ্চলকে রাশিয়ার সাথে যুক্ত করতে আগ্রহী। এরা শুরু করেছে বিচ্ছিন্নতাবাতদী যুদ্ধ। তাদের সরাসরি সহায়তা করছে রাশিয়া। সেখানে চলছে রাশিয়ান পন্থী এবং ইউক্রেনপন্থীদের মধ্যে সশস্ত্র লড়াই।

১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার পর স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ইউক্রেন। এরপর অনেক বছর ধরে রাশিয়া-ইউক্রেন সুসস্পর্ক ছিল। ইউক্রেন স্বাধীনতা লাভ করলেও দেশটির ওপর ছিল রাশিয়ার ব্যাপক প্রভাব। আসলে ইউক্রেনের স্বাধীনতা ছিল মূলত সীমাবদ্ধ। ইউক্রেন নেভির সাথে ১৯৯৪ সাল থেকে রাশিয়ান নৌবহর অবস্থান করে আসছিল কৃষ্ণ সাগরে। কিন্তু গ্যাস সম্পদকে কেন্দ্র করে দুদেশের সর্ম্পকের অবনতি হয়।

১৯৯৩ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত রাশিয়া এবং ই্উক্রেনের মধ্যে গ্যাস ক্ষেত্র নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। ২০০১ সালে জর্জিয়া, আজারবাইজান এবং মলদোভা নিয়ে ইউক্রেন গঠন করে গুয়াম অর্গানাইজেশন ফর ডেমোক্রেসি এন্ড ইকনোমিক ডেভেলপমেন্ট।

রাশিয়া একে সরাসরি কমনওয়েলথ অব ইন্ডিপেন্ডেন্ট স্টেটস বা সিআইএস এর প্রতি চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহন করে। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার পর ৯টি দেশ নিয়ে গঠন করা হয় সিআইএস।

২০০৪ সালে ইউক্রেনে অরেঞ্জ বিপ্লবে রাশিয়াপন্থী ভিক্টর ইয়ানুকভিচ পরাজিত হয় বিজয়ী হয় পশ্চিমা ঘনিষ্ট ভিক্টর ইউশেনকো। এসময় থেকে রাশিয়ার সাথে ইউক্রেনের দূরত্ব বাড়তে থাকে। ইউক্রেন ক্রমে ঝুকে পড়ে ন্যাটো এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের দিকে।

রাশিয়া বিরোধী ইউক্রেনের এ সরকার ক্রিমিয়ায় রাশিয়ান নৌঘাঁটি রাখার চুক্তি নবায়ন করেনি। ফলে রাশিয়ান সৈন্যদের ২০১৭ সালের মধ্যে ক্রিমিয়া ছাড়ার বিষয় সামনে আসে। ১৯৯৭ সালের চুক্তি অনুযায়ী ২০১৭ সাল পর্যন্ত ক্রিমিয়ায় রাশিয়ান সৈন্য অবস্থানের অনুমতি ছিল। ইউক্রেনের ওপর ক্ষোভ বাড়তে থাকে ক্রেমলিনের।

রাশিয়ানপন্থী ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ ২০১০ সালে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। রাশিয়া তখন ইউক্রেনের সাথে পুরনো বিভিন্ন চুক্তি নবায়নের সুযোগ পায় দুই দেশের মধ্যে আবার সম্পর্ক উন্নতি হতে থাকে।

রাশিয়ানপন্থী ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ প্রেসিডেন্ট হবার পর ক্রিমিয়ায় রাশিয়ান নৌঘাঁটি বজায় রাখার চুক্তি নবায়ন করে। ক্রিমিয়ায় আরো রাশিয়ান সৈন্য আনার অনুমিত দেয়া হয়। এসময় ভিক্টর ইয়ানুুকোভিচ সরকারের সাথে সম্পর্কের অবনিত ঘটতে থাকে ইউরোপের। কিন্তু ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ রাশিয়ার সাথে যুক্ত থাকাকেই বেছে নেন।

অপরদিকে রাশিয়ানপন্থী প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচের প্রতি ক্রমে ক্ষোভ বাড়তে থাকে ইউক্রেনের অভ্যন্তরে। চাপ বাড়তে থাকে রাশিয়ার সাথে ঘনিষ্ঠতা কমিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতি সম্পর্ক স্থাপনের। রাশিয়া এসময় ইউক্রেনকে হুমকি দেয় তারা যদি ইউরোপীয় উনিয়নের সাথে মুক্ত বানিজ্য চুক্তি করে তবে তাদের ভয়াবহ পরিণতি বহন করতে হবে। এমনকি ইউক্রেন রাষ্ট্রের অবসান ঘটতে পারে। রাশিয়ান পন্থীরা আহবান জানালে রাশিয়া ইউক্রেনে সরাসরি অভিযান চালাবে।

রাশিয়ার সাথে টানাপড়েনের কারণে ইউক্রেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে ২০১৩ সালে গুরুত্বপূর্ণ একটি চুক্তি সাক্ষর স্থগিত করে। এর জের ধরে ওই বছরই নভেম্বর মাসে ইউক্রেনে সরকার বিরোধী ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়। ২০১৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি পতন হয় রাশিয়াপন্থী ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ সরকারের।

এর কয়েক দিন পর ক্রিমিয়ায় রাশিয়ানপন্থী সশস্ত্র গ্রুপ নিয়ন্ত্রনে নেয় ক্রিমিয়া। তাদের সরাসরি সহায়তা করে সেখানে অবস্থানরত রাশিয়ান সৈন্য এবং রাশিয়ান স্পেশাল ফোর্স। রাশিয়ানপন্থীরা ক্রিমিয়ার পার্লামেন্ট দখলে নেয়। মধ্য মার্চে পার্লামেন্টের এক বিতর্কিক রেফারেন্ডামের মাধ্যমে ক্রিমিয়াকে ইউক্রেন থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাশিয়ান ফেডারেশনের সাথে যুক্ত করে আনুষ্ঠানিকভাবে।

১৫ এপ্রিল ইউক্রেন পার্লামেন্ট ঘোষণা করে ক্রিমিয়া সাময়িকভাবে রাশিয়ার দখলে রয়েছে। এরপর থেকে ক্রিমিয়ায় রাশিয়ান সৈন্য বাড়তে থাকে এবং পুতিন ঘোষণা দেন সেখানে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হবে। শুরু হয় ইউক্রেনের সাথে রাশিয়া চরম তিক্ত সম্পর্কের যুগ।

ডনবাস, ডনেটস্ক, লুহানস্কসহ দক্ষিন এবং পূর্ব ইউরোপে রয়েছে রুশভাষী রাশিয়ান জাতিগত মানুষ। এসব অঞ্চলে রাশিয়ানপন্থীরা ইউক্রেন সরকারের বিরুদ্ধে এবং রাশিয়ার পক্ষে বিক্ষোভ করছে। রাশিয়ানপন্থীরা এসব অঞ্চলকে ইউক্রেন থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাশিয়ার সাথে যুক্ত করতে চায়। রাশিয়া এসব অঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সহায়তা দিচ্ছে। ডনেটস্ক এবং লুহানস্ক মূলত রাশিয়ানপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দখলে রয়েছে। বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ডনেটস্ক এবং লুহানস্ককে আলাদা রাষ্ট্র ঘোষণা করেছে। তারা এর নাম দিয়েছে ডনেটস্ক পিপলস রিপাবলিক এবং লূহানস্ক পিপলস রিপাবলিক। ২০১৪ সালের মে মাসের এক বিতর্কিত রেফারেন্ডামের মাধ্যমে এ দুটি রিপাবলিক গঠন করা হয়।

পূর্ব ইউক্রেনের স্বঘোষিত ডনেটস্ক এবং লুহানস্ক রিপাবলিকে ৫ লাখের বেশি নাগরিকদের রাশিয়ান নাগরিক হিসেবে পাসপোর্ট দিয়েছে রাশিয়া। মস্কো হুশিয়ার করে বলেছে ইউক্রেন যদি পূর্ব ইউক্রেনে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে তাহলে রাশিয়া সেখানকার রুশ ভাষী রাশিয়ান নাগরিকদের সহায়তায় এগিয়ে আসবে। রাশিয়ান নাগরিকদের রক্ষায় রাশিয়া সেখানে হস্তক্ষেপ করতে পারে।

ইউক্রেনের যেসব অংশ বর্তমানে রাশিয়ার নিয়ন্ত্রনে রয়েছে সেসব এলাকা পুনর্দখলে ইউক্রেন কোনো পদক্ষেপ নিলে তার বিরুদ্ধে চরম পরিণতির হুমিক দিয়ে আসছে ক্রেমলিনের কর্মকর্তারা। ইউক্রেনের এ ধরনের পদক্ষেপের বিরুদ্ধে রাশিয়া পাল্টা পদক্ষেপ নেবে এবং হতে পারে এটা ইউক্রেন রাষ্ট্রের সমাপ্তি।

ন্যাটোর সাথে ইউক্রেনের অংশীদারিত্ব রাশিয়া তার নিরাপত্তার জন্য বড় ধরনের হুমকি হিসেবে দেখে আসছে। ইউক্রেন ন্যাটোর সাথে ক্রমে সহযোগিতা বাড়াচ্ছে। ইউক্রেন ২০০৪ সালে ইরাকে তৃতীয় বৃহত্তর সেনা কন্টিনজেন্ট পাঠায় । এ ছাড়া ন্যাটোর পিস কিপিং মিশনে অংশ নিয়েছে আফগানিস্তান এবং কসোভোয়।

ক্রিমিয়া দখল এবং ইউক্রেন নীতির কারণে রাশিয়ায় পুতিনের জনপ্রিয়তা অনেক বেড়েছে। ফলে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে আগ্রাসন নীতি অব্যাহত রাখতে সহায়তা করছে পুতিনকে। ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখলের পর থেকে রাশিয়ার সাথে পশ্চিমাদের সম্পর্কের অবণতি ঘটে। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়ার বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপ করে।

ক্রিমিয়া দখল, ইউক্রেনের অভ্যন্তরে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মদদ দেয়া এবং সর্বশেষ ইউক্রেন সীমান্তে ব্যাপক সেনা মোতায়েনের পর রাশিয়ার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্রের ওপর অভ্যন্তরীন চাপ বেড়েছে।

ইউক্রেন নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন আর যুক্তরাষ্ট্র যতই উদ্বেগ প্রকাশ করুক রাশিয়া জানে তারা কেউ ইউক্রেন রক্ষায় এগিয়ে আসবে না। বিশ্লেষকদের মতে বর্তমানে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপীয় ইউনিয়ন কেউ ইউক্রেনের কারণে নিজেদের ঝুঁকিতে ফেলতে রাজি হবে না। ফলে সংশয় দেখা দিয়েছে ইউক্রেন রাষ্ট্রের অস্তিত্ব নিয়ে।

সোভিয়েত ইউনিয়নের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ ছিল ইউক্রেন। ১৯২০ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত সোভিয়েত অর্থনীতিতে ইউক্রেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বর্তমানে ইউক্রেন যে সমরাস্ত্র শিল্পে উন্নত তার মূলে রয়েছে সোভিয়েত আমলের পদক্ষেপ। সোভিয়েত ইউনিয়ন ইউক্রেনে সামরিক বিমান শিল্পসহ অনেক সমরাস্ত্র কারখানা গড়ে তোলে। ইউক্রেনে ছিল রাশিয়ার পারমানবিক অস্ত্রাগার।

ইউক্রেন একটি বিশাল দেশ। আর আয়তন ২ লাখ ৩৩ হাজার ৬২ বর্গমাইল। জনসংখ্যার ৮৭ ভাগ খ্রিস্টান। ৭৭ ভাগ জাতিগ্রত ইউক্রেনিয়ান এবং ১৭ ভাগ রাশিয়ান। বর্তমানে রাশিয়ার দখলে চলে যাওয়া ক্রিমিয়াসহ দেশটির জনসংখ্যা ৪ কোটির বেশি।