চীন-ভারত সঙ্ঘাতের হটস্পট আন্দামান ও মালাক্কা


  • মেহেদী হাসান
  • ২৯ এপ্রিল ২০২১, ০৯:৫৬

বর্তমানে বিশ্বরাজনীতির কেন্দ্রস্থল হয়ে উঠেছে ইন্দো-প্যাসেফিক অঞ্চল। ইন্দো-প্যাসেফিক অঞ্চলে আধিপত্যের লড়াইয়ে একদিকে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ভারত, জাপান ও অস্ট্রেলিয়া। অপরদিকে চীন। ইন্দো-প্যাসেফিক অঞ্চলের এ দুই পক্ষের ভবিষ্যত যে কোনো সঙ্ঘাতের দুটি হটস্পট হলো আন্দামান সাগর এবং মালাক্কা প্রণালী। এ দুটি হটস্পটের নিয়ন্ত্রণ ঘিরে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত আর চীন ব্যাপক সমর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত।

মালাক্কা প্রণালী বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর দ্বিতীয় ব্যস্ততম শিপিং চ্যানেল। এ শিপিং চ্যানেলের রুট যুক্ত হয়েছে আন্দামান সাগরের সাথে। চীনা অর্থনীতির প্রাণ বলা হয় মালাক্কা প্রণালীকে। আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ ভারতের এবং তা মালাক্কা প্রণালীর পশ্চিম প্রবেশমুখে অবস্থিত। ফলে আন্দামান সাগর আর মালাক্কা প্রণালীর ওপর রয়েছে ভারতের স্বাভাবিক আধিপত্য।

চীনের জন্য এটি একটি দুর্বল দিক। ফলে চীন এ রুটের দুটি বিকল্প রুট তৈরি করেছে পাকিস্তান ও মিয়ানমারের মধ্য দিয়ে। একই সাথে মালাক্কা প্রণালী আর আন্দামান সাগর রুটের ওপর সামরিক আধিপত্য বিস্তারের উদ্যোগও নিয়েছে চীন। আন্দামান সাগরে চীনের মোকাবেলায় ব্যাপক প্রস্তুতি নিচ্ছে ভারত। অপর দিকে মালাক্কা প্রণালীর সাথে সরাসরি যুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি । ফলে আন্দামান সাগর আর মালাক্কা প্রণালী ঘিরে এ তিন শক্তির মধ্যে চলছে তীব্র সমর প্রস্তুতির প্রতিযোগিতা।

ভারত মহাসাগর অঞ্চলে ক্রমে বাড়ছে চীনের স্বার্থ। এ অঞ্চলে প্রায়ই আগমন ঘটছে চীনা রণতরী, সাবমেরিন আর জলজ ড্রোনসহ বিভিন্ন জাহাজ। ভারতের কাছে চীনা এসব জাহাজের আনাগোনা প্রায়ই ধরা পড়ছে। গত সেপ্টেম্বরে শিয়ান -১ নামে একটি চীনা রিসার্চ ভেসেলকে বহিষ্কার করেছে ভারতীয় নেভি। ভারতের আন্দামান এবং নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের বিশেষ অর্থনৈতিক জোনে প্রবেশ করেছিল এ জাহাজ। ভারতীয় নৌ প্রধান করমবার সাংবাদিকদের জানান, অনুমতি ছাড়া চীনা এ জাহাজ তাদের জলসীমায় প্রবেশ করেছিলো।

গত এক দশক ধরে চীনা সামরিক এবং অর্থনৈতিক উত্থানের সাথে সাথে ভারত মহাসাগরে চীনা রণতরীর প্রবেশ নাটকীয়ভাবে বেড়েছে।বলা যায় ২০০০ সালে এ অঞ্চলে চীন পা রাখে। আর এখন সাবমেরিন, সারফেস ভেসেল এবং রিসার্চ ভেসেল মিলিয়ে বছরে আট থেকে ১০টি চীনা রনতরী এ অঞ্চলে অপারেশন পরিচালনা করছে। ভারত মহাসাগরে চীনা নেভির উপস্থিতি নিয়ে ভারত বারবার উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে। বিশেষ করে আন্দামান সাগরের চার দিকে চীনা নেভির আনা গোনা ভারতীয় নেভির জন্য হুমকির সৃষ্টি করছে।

আন্দামান এবং নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ ভারতকে সামরিক এবং ভূ-কৌশলগত দিয়ে সুবিধা দিয়েছে। আন্দামান সাগর পূর্ব ভারত মহাসাগরকে প্রশান্ত মহাসগারের সাথে যুক্ত করেছে মালক্কা প্রণালীর মাধ্যমে। গুরুত্বপূর্ণ মালাক্কা প্রণালীর পশ্চিমে প্রবেশ মুখে আন্দামান সাগরের অবস্থান। ফলে আন্দামান সাগরের ওপর নিয়ন্ত্রনের মাধ্যমে ভারত মালাক্কা প্রণালীর ওপরও প্রভাব বিস্তারে সক্ষম। আর ভারতকে এ সুযোগ এনে দিয়েছে তাদের আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ। এ দ্বীপপুঞ্জের কারনে বঙ্গোপাসাগর এবং দক্ষিন পূর্ব এশিয়ায়ও ভারতের জন্য প্রভাব বিস্তারের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জকে বলা হয় ভারতের এমন এক বিমানবাহী রণতরী যা ডুববে না।

সম্ভাব্য চীন-ভারত সমুদ্র সঙ্ঘাতে এ দ্বীপপুঞ্জ ভারতের প্রথম ডিফেন্স লাইনের ভূমিকা পালন করবে। আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ অববাহিকা অঞ্চলে ভারত নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা করতে পারলে পুরো ভারত মহাসাগরে চীনের হুমকির মাত্রা কমে আসবে বলে মনে করেন অনেক বিশেষজ্ঞ।

চীন এ বিষয়টি ভালোভাবে জানে। ২০১২ সাল থেকে চীনা নেভি এ অঞ্চলে নিয়মিত সাবমেরিন টহল পরিচালনা করে আসছে । ভারতীয় নেভি জানিয়েছে প্রত্যেক তিন মাস পরপর তিন থেকে চারটি চীনা সাবমেরিন এখানে অপারেশন চালায়। চীন তাদের বিশাল সাবমেরিন বহর এ অঞ্চলে রিকনিস্যান্স এবং সার্ভিল্যান্স মিশন পরিচালনা করছে।

চীনা অর্থনীতি ব্যাপকভাবে নিভরশীল মালাক্কা প্রণালী আর আন্দামান সাগর রুটের ওপর। বিরুপ পরিস্থিতিতে ভারত ইচ্ছা করলে আন্দামান সাগরের রুট নিয়ন্ত্রনের মাধ্যমে মালাক্কা প্রণালী চীনের জন্য বন্ধ করে দিতে পারে। এতে বন্ধ হয়ে যেতে পারে চীনা অর্থনীতির গতি ।

সেজন্য চীন মালাক্কা প্রণালী আর আন্দামান সাগরের বিকল্প দুটি রুট তৈরি করেছে। এর একটি হলো পাকিস্তানের মধ্য দিয়ে গোয়াদর বন্দর হয়ে আরব সাগরে প্রবেশের রেল এবং সড়ক রুট । অপরটি হলো চীন-মায়ানমার ইকনোমিক করিডোর। রাখাইনের কিয়াউকপিউ দ্বীপে বেইজিং নির্মান করছে গভীর সমুদ্র বন্দর। এ ছাড়া রয়েছে ইউনান প্রদেশ থেকে মিয়ানমারের প্রাচীন রাজধানী মান্দালয় পর্যন্ত রেল নেটওয়ার্ক প্রকল্প। রয়েছে রাখাইন-চীন তেল এবং গ্যাস পাইপ লাইন।

এছাড়া আন্দমান সাগর উপকূলীয় দেশগুলোতেও বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করেছে চীন। এর মধ্যে প্রস্তাবিত ক্রা ক্যানাল আন্দামান সাগর এবং থাই উপসাগরকে যুক্ত করেছে। এতে মৌলিকভাবে বদলে যাবে বঙ্গোপসাগরের ভূগোল। আর চীন পৌছে যাবে পূর্ব ভারত মহাসাগরের দরজায়।

আন্দামান সাগরে চীন সি ডিনায়াল কৌশল গ্রহণ করেছে। সি ডিনায়াল কৌশল হলো নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা ছাড়াও সাগর ব্যবহার করা। যেহেতু দক্ষিন চীন সাগরের মত সে এখানে সারফেস ভেসেল অপারেশন পরিচালনা করতে পারবে না এ জন্য চীন ব্যাপক বিনিয়োগের উদ্যোগ নিয়েছে সাবমেরিন প্রকল্পে।

আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে সামরিক এবং অর্থনৈতিক স্থাপনা তৈরিতে ভারত ৫০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে এ বছরের শুরুতে। ২০২২ সাল নাগাদ ভারত এখানে কমপক্ষে ৩২টি রনতরী মোতায়েন করতে চায়। ভারত এখানে জোর দিয়েছে মেরিটাইম সার্ভিলেন্স দক্ষতা বৃদ্ধির। আন্দমান দ্বীপপুঞ্জের দক্ষিন মাথায় ক্যাম্পবেল উপসাগর বিমান ঘাটিতে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক অবকাঠামো নির্মান চলছে। এটি সম্পন্ন হলে এখান থেকে ফ্লাইট পরিচালনা করতে পারবে ভারতের পি-৮১ মেরিটাইম সার্ভিলেন্স বিমান।

আন্দামান সাগরকেন্দ্রিক ভবিষ্যত আধিপত্য আর লড়াইয়ে সরাসরি যুক্ত মালাক্কা প্রণালী। মালয়েশিয়া উপদ্বীপ এবং ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপের মাঝ দিয়ে প্রবাহিত সরু জলপথের নাম মালাক্কা প্রণালী। বিশ্বে সমুদ্র পথে যত পন্য পরিবহন করা হয় তার ৬০ ভাগেরও বেশি আনা নেয়া করা হয় এ প্রণালী দিয়ে। ইউরোপ, আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যের সাথে এশিয়া প্যাসেফিক অঞ্চলের সংক্ষিপ্ততম সমুদ্র রুট হলো মালাক্কা প্রণালী ।

অপর দিকে সমুদ্র পথে বিশ্বে যত তেল বহন করা হয় তার চার ভাগের এক ভাগ বহন করা হয় মালাক্কা প্রণালী দিয়ে। ২০১৬ সালে মালাক্কা প্রণালী দিয়ে দৈনিক ১ কোটি ৬০ লাখ ব্যারেল তেল পরিবহন করা হয়। বিশ্বে শীর্ষ জ্বালানি তেল আমদানিকারক দেশ হলো চীন আর চতুর্থ জাপান। মধ্যপ্রাচ্য থেকে আমদানী করা জ্বালানি তেলের ৮০ ভাগ চীন পরিবহন করে এ প্রণালী দিয়ে।

মালাক্কা প্রণালী বর্তমানে যে কারনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হলো কৌশলগত কারন। সামরিক অভিযান পরিচালনায় জড়িত বর্তমানে মালাক্কা প্রণালী। ফলে মালাক্কা প্রণালী শুধুমাত্র গুরুত্বপূর্ণ কোনো শিপিং চ্যানেল নয় বরং ভূ-রাজনৈতিক কারনে এটি হয়ে উঠেছে বিশ্বের আলোচিত একটি চ্যানেল।

এশিয়া- প্যাসেফিক অঞ্চলে আধিপত্য কেন্দ্রিক রাজনীতির অন্যতম হট স্পটে পরিণত হয়েছে মালাক্কা প্রণালী। যুক্তরাষ্ট্র, ভারত বনাম চীনের মধ্যে ভবিষ্যত যে কোনো বড় ধরনের দ্বন্দ্ব আর সঙ্ঘাতের প্রেক্ষিতে এ প্রণালীর নিয়ন্ত্রন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

চীন ও ভারতের ভবিষ্যত শক্তির ভারসাম্য পরিমাপের থার্মোমিটার বলা হয় মালাক্কা প্রণালীকে। আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের কারনে মালাক্কা প্রণালীর প্রবেশ মুখে রয়েছে ভারতের ন্যাচারাল আধিপত্য। আর চীনা সমুদ্র বানিজ্যের মূল রুট এ মালাক্কা প্রণালী। মালাক্কা প্রণালী ঘিরে যেমন রয়েছে ভারতের স্বাভাবিক আধিপত্য তেমনি চীন এগিয়ে রয়েছে তার নৌ শক্তিসহ সাার্বিক সামরিক শক্তিতে। ফলে মালাক্কা প্রণালী ঘিরে চলছে এশিয়া-প্যাসেফিক অঞ্চলে বড় ধরনের লড়াই প্রস্তুতি। চীন-ভারত এ লড়াইয়ের সাথে সরাসরি জড়িত বর্তমান বিশ্বের সুপার পাওয়ার যুক্তরাষ্ট্র।

যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে বেশি পন্য আমদানি করে চীন থেকে। যুক্তরাষ্ট্র সারা বিশ্ব থেকে যত পন্য আমদানি করে তার ২১ ভাগেরও বেশি আমদানি করে থাকে চীন থেকে। চীনা এসব পন্য যুক্তরাষ্ট্রে যায় মালাক্কা প্রণালী দিয়ে। একইভাবে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন পন্যও চীনসহ এ অঞ্চলে আনা হয় এ প্রণালী দিয়ে।

চীন চেষ্টা করছে ভারত মহাসাগরে তার আধিপত্য প্রতিষ্ঠায়। চীনা এ আধিপত্য ঠেকাতে ভারত সামরিক উপস্থিতি ও শক্তি বৃদ্ধির পদক্ষেপ নিয়েছে। বাড়িয়েছে টহল কার্যক্রম। ভবিষ্যত যে কোনো বড় সঙ্ঘাতে ভারত মালাক্কা প্রণালীর পশ্চিম প্রান্ত ব্লক দেয়ার অবস্থানে রয়েছে। ভারতের এ পদক্ষেপ মোকাবেলায় সামরিক প্রস্তুতি নিচ্ছে চীন। অপরদিকে পাকিস্তান ও মিয়ানমারে তৈরি করে রেখেছে বিকল্প রুট।